ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৪
অবন্তিকা তৃপ্তি
—-‘কুহু সিয়ামকে ভালোবাসে।’
তানিম প্রথমে বুঝেনি কাব্য কি বলেছে। ও কাব্যের দিকে চেয়ে পরপর অবুঝ; নাদান গলায় মাথা ঝাকালো——-‘কে কাকে ভালোবাসে?’
কাব্য এবার গলা খাকারি দিল। একটা ঢোক গিলে; ম্লান গলায় জবাবে উত্তর দিল——-‘কুহু সিয়ামকে ভালোবাসে।’
কাব্যের এমন একটা উত্তরে তানিম সঙ্গেসঙ্গে ভ্রু কুচকে ফেলল। চোখ ছোটছোট করে তাকালো ও কাব্যের ম্লান-শুকনো পাতার খসখসে মুখটার দিকে। কাব্যের চোখ তখন অন্যমনস্ক! ও খেয়াল করেনি তখনো যে—- এইমাত্র থেকে মিস্টার তানিম ওকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। কাব্য পায়ের জুতোর দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে চেয়ে রয়েছে।
তানিম সেভাবেই ভ্রু কুচকে; সন্দেহকণ্ঠে কাব্যকে যাচাই করার জন্যে চোখ ছোট করে হঠাৎ বললো————‘তো? তোর কি তাতে?’
পরপর মাথা তুলে কাব্য বিরক্ত হয়ে তাকাল তানিমের দিকে। তানিমের প্রশ্ন ওর পছন্দ হয়নি সম্ভবত( কাব্য ক্ষেপে উঠে জবাব দিল————‘আমার কি মানে? সিয়াম ওকে ট্র্যাপে ফেলছে; আর আমার কিছু না বলছিস?’
তানিম কাব্যের এমন উত্তরটাই আশা করেছিল। ও ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব ধরে; যেন কিছুই হয়নি সেভাবে বললো—-‘কুহু ফল করেছে কারোর জন্যে; দ্যাটস গ্রেট। একচুয়ালি দ্যাটস রিয়েলি গ্রেট। তুই তো বেচে যাবি; তোর তো পিছু ছেড়ে গেছে; রাইট?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘বাজে বকা বন্ধ কর। আমি কবে বলেছি—- আমি কুহুর থেকে পিছু ছাড়তে চাইছি! ———- কাব্য এইবার মহা বিরক্ত কণ্ঠে বললো। তানিমের হেঁয়ালি ওর ভালো লাগছে না বোধহয়। কাব্যের চোখ-মুখ কুচকে রয়েছে; যেন একটা ছোট বাচ্চার থেকে তার কোনো প্রিয় খেলনা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ছোট বাচ্চাটা এখন সেটার বিচার চাইতে এসেছে।
কাব্যের মহা বিরক্ত; চোখ-মুখ কুচকে তাকানো দেখে তানিমের হঠাৎ বড্ড হাসি পাচ্ছে। ওর ভেতরটা ফেটে হাসি উপচে আসছে। কাব্যু দেখতে যা মারাত্মক দেখাচ্ছে না এখন; কুহু সামনাসামনি দেখলে নির্ঘাত কাব্যের প্রতি আরো একবার ফল করতো। আহারে বেচারাটা!
কুহু-কাব্য, এই দুটোর মধ্যে আসলে চলছেটা কি? কুহু পানি থেকে আগুন হয়ে গেছে; আর কাব্য— সে তো জ্বলন্ত অগ্নিকুঞ্জ বনে গেছে। জ্বলছে অথচ স্বীকার করবেই না। চাই সে জ্বলে-পুড়ে ছাই হোক।
গল্পটা হচ্ছে—-একজন প্রেমে পড়েছে, অন্যজন সেই বুক ভরা প্রেম ফিরিয়ে দিয়েছে। আর এখন যখন সেই একজন যখন ওকে ছেড়ে অন্যের জন্যে ঝুঁকেছে; তখন সেই ফিরিয়ে দেওয়া ছেলের জ্বলছে। বিধাতার কি লীলাখেলা!
তানিম এবার হাসি আটকে না রাখতে পেরে হেসেই ফেললো শেষ অব্দি। ওর হাসির আওয়াজ কাব্যের কানে যেতেই কাব্য ভ্রু কুচকে তাকালো———-‘বোকার মতো হাসছিস কেন? সিরিয়াস কথা বলছি না আমি?’
সঙ্গেসঙ্গে তানিম হাসি গিলে ফেলে মুখটা থমথমে রাখার চেষ্টা করে বলল——-‘সরি! আর হাসব না।’
কাব্য টেবিলের মধ্যে আঙুল দিয়ে টোকা দিতে দিতে অন্যদিকে চেয়ে; মারাত্মক গম্ভীর গলায়; কিছু একটা গভীর মন দিয়ে ভাবতে ভাবতে বলল——-‘কুহু কি করছে নিজেও জানে না। সিয়াম ভালো ছেলে না; আর ওই ছাগলটা এটা বুঝতেই পারছে না। শি ইজ অন ট্র্যাপ, ম্যান। কুহুকে যে আমি বোঝাবো— সেই উপায়ও নেই। হোয়াট শুড আই ডু নাও?’
তানিম এবার নিজেকে গুরুগম্ভীর বানালো। কাব্যের দিকে একটু ঝুঁকে এসে; কাব্যের মতোই জুতোর দিকে চেয়ে থেকে নিচু গলায় বলল——-‘এইবার? তো তুই এখন কি করতে চাইছিস? ওই সিনেমার মতো কুহুকে বিয়ে করে সিয়ামকে ওর লাইফ থেকে সরিয়ে দিবি?’
হঠাৎ কাব্য মাথা তুলে কিছুক্ষণ তাকালো তানিমের দিকে।কিছুক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে থেকে তানিম ভ্রু নাচাতেই কাব্য চোখ সরিয়ে পরপর অন্যদিকে চেয়ে বিড়বিড় করল——-‘পসিবল হলে তো তাই করতাম।’
তানিম ভ্রু নাচিয়ে কাব্যকে দেখছিল; ওর একেকটা এক্সপ্রেশন সূক্ষ্ম চোখে নিরীক্ষা করছিল সম্ভবত। কাব্য পরপর তানিমের দিকে চেয়ে রাগ নিয়ে বলল——-‘আই উইল কিডন্যাপ দিস বাস্টার্ড তানিম। ও কুহুকে কোন নজরে দেখে ওইটা ওই মাথামোটা কুহু না বুঝলেও আমি বুঝি।’
হাল ছেড়ে দিল তানিম। আর শক্তি নেই ধৈর্য ধরে রাখার। সিয়ামের নামে বদনাম করলে নিশ্চয়ই সিয়াম খারাপ হয়ে যাবে না। সিয়াম বদলেছে কিনা তানিম জানে না। কিন্তু এই ‘সিয়াম’ নামক আপদটাই পারে— কুহু-কাব্যকে এক করে দিতে। তানিম ওর প্ল্যান কাজে লাগবে এইবার।
আজ অব্দি মাস্টারমাইন্ড তানিমের প্ল্যান কখনো ফ্লপ খায়নি; এবারেই তাই হবে।
তানিম এবার মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো। কাব্যের দিকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে সরাসরি আগেপিছে কিছু না বলেই বলে বসলো—-—-‘কাব্য; তুই জেলাস। প্লিজ এটা মেনে নে।’
‘আবারও উল্টোপালটা বকছে এই ছাগল! গড সেইভ মি ফ্রম হিম প্লিজ!’—- কাব্য অতিষ্ট গলায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে চেয়ে দোয়া করে তানিমের দিকে বিরক্ত হয়ে তাকালো। এই তানিমের মাথাটা গেছে একদম।
তানিম কাব্যের গায়ে হাত রাখল; ওর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলতে লাগল——-‘ইউ আর ইন লাভ, কাব্য। যতই অস্বীকার করিস; কিন্তু এটাই সত্য!’
কাব্য এবার বিরক্ত হয়ে তানিমের হাত ওর বাহু থেকে সরিয়ে দিল। এইবার নিজে তানিমের হাত ধরে যেমন হুশে ফিরিয়ে আনছে, এমন করে বললো——-‘হুশে আয় ; এখানে আমি কোনো রোমান্টিক সিনের কথা বলছি না যে আমার লাভের কথা এখানে আসবে। আমি সিয়ামকে খু’ন করার কথা বলছি তোকে, ড্যাম।‘
তানিম কাব্যের হাত ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দিল——-‘কিন্তু আমি সেটাই দেখতে পারছি। তুই আসলেই একটা গাধা, রামছাগল তুই। তোর জায়গায় আমি থাকলে আমি বুঝেই নিতাম— কোনটা রাগ আর কোনটা জেলাসি!’
গালি দেওয়াতে কাব্য রেগে গেল সম্ভবত। তানিম ওই চাওনি দেখে গলা খাকারি দিয়ে মেজাজ সামলে বলে গেল—-——-‘কুহু কাউকে ভালোবাসতেই পারে, কাব্য। তুই তো বলেছিস— ও কাউকে ভালোবাসে বললে তুই নিজে ওদের বিয়ে দিয়ে দিবি; বলিস নি?’
‘হু বলেছি; বাট সেটা সিয়াম না অবশ্যই!’ —————কাব্য সাফাই গাইল; অথচ অতিষ্ট ভঙ্গিতে— যেন নিজের কথাতে নিজেই ফেসে যাচ্ছে।
তানিম এবার সিরিয়াস হয়ে; সিয়ামের নামে ইচ্ছে করেই ভালো কথা বাড়িয়ে বাড়িয়ে কাব্যকে শুনিয়ে বলল———‘সিয়াম কুহুকে নিয়ে এইবার সিরিয়াস কাব্য। ওর বন্ধু নাদিম আছে না;ওর থেকে শুনলাম—- সিয়াম মেইবি খুব দ্রুত কুহুকে প্রপোজ করবে। কুহু না রাজি হলে সোজা আঙ্কেলের কাছে, আই মিন কুহুর বাবার কাছে ওর বাবা প্রস্তাব নিয়ে যাবেন বলেছে। মানে— এই মুহূর্তে সিয়ামের কুহুর প্রতি স্ট্রং ফিলিংস আছে। একটা ছেলে নিশ্চয়ই না জেনেশুনেই: শিউর না হয়ে বিয়ে অব্দি ভাবতে পারে না। সেটা তো তুই আরও ভালো জানবি। তুইও তো কুহুকে এইজন্যেই ফিরিয়ে দিয়েছিলি।’
পুরো কথা কাব্য কেমন চোখে; যেন শুনেই গেল শুধু। কাব্য চুপ করে তাকিয়ে রইলো স্রেফ তানিমের দিকে। শেষের কথাতে পরপর অস্ফুটে নিচু গলায় বলে——-‘চা—চাচ্চু সিয়ামকে মানবেন না।’
‘কেন? সিয়াম তোদের মতোই বিত্তশালী; ওর বংশ ভালো; ওরা খানদানি বংশের। সব তো ঠিকই আছে।এক্সপ্লেইন কর, মানবে না কেন?’ ———- তানিম আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে ভ্রু উচালো। কাব্যকে ও আজ ছাগল থেকে প্রেমে পাগল করবেই— এটাই বদ্ধমূল ধারণা তানিমের।
কাব্যের সম্ভবত এবার লাগছে বুকে। হয়তবা কোথাও না কোথাও ভয়ই হচ্ছে—- যদি মেনে নেন চাচ্চু? কুহু চলে যাবে সিদ্দিক বাড়ি থেকে? সিদ্দিক বাড়িতে কাব্য কিভাবে দেখবে কুহুর চলে——
পরপর কাব্য মাথা ঝাঁকালো। আবার তানিমের দিকে তাকালো; স্বাভাবিক গলায় বলল———‘কারণ ওখানে কুহু অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না। কুহুকে সামলানোর ক্ষমতা সবার নেই; তাই।’
‘বিয়ের পর সব মেয়ে অ্যাডজাস্ট করা শিখে যায় কাব্য। তুই কুহুকে রিজেক্ট করার পর তো ও ঠিকই অ্যাডজাস্ট করে ফেলেছে। তোকে মনে রেখেছে আর?’ ——- তানিম খোঁচাচ্ছে যেন।
কাব্য তানিমের দিকে তাকিয়ে উঠল। ওর বিশ্বাস করতে কষ্ট হলে এটাই সত্যি। যে কুহু আগে কাব্যকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না; সেই কুহু এখন কাব্যের ছায়াও মারাতে চায়না।
কাব্যকে চুপচাপ দেখে তানিম ভালো করে চোখ ছোট করে কাব্যকে দেখতে লাগলো। টনিকটা কি কাজে দিয়েছে? সম্ভবত দিয়েছে।
তানিম এবার একটু থেমে বলতে লাগলো——‘কুহু বদলে গেছে কাব্য। তোর আগের গুলুমলু, হাসিখুশি কুহু আর আগের মতো নেই। ও পুরোটাই বদলে গেছে।আংকেল বললে, ও তোকে ভুলে সিয়ামকে বিয়ে করতে দুবার ভাববে না কাব্য। এখনই ওর পাশে তোর সিয়ামকে সহ্য হচ্ছে না; তখন কিভাবে সহ্য করবি? কুহু সিয়ামের বাচ্চার মা হবে; যে পাগলামি ও তোর জন্যে করতো সেটা তখন সিয়ামের জন্যে.. ..!’
তানিমকে বাকি কথা বলতে বা দিয়ে কাব্য চেঁচিয়ে সাথেসাথে বলে উঠলো—-—‘স্টপ ওকে; স্টপ রাইট দেয়ার!’
কাব্য জোরেজোর শ্বাস ফেলতে লাগল। ও অস্থির— সেটা বুঝে তানিম।
হয়তবা তানিমের এখন দুঃখ লাগে। ভালোবাসা জিনিসটা আর কেউ না বুঝুক তানিম বুঝে ভালোই। শখের মানুষকে অন্য কারোর সাথে দেখা যায়না কখনোই। তানিম তাই চায়না—- কাব্য পস্তাক। কাব্যের সামনে ওর শখের মানুষ অন্য কাউকে নিয়ে মেতে থাকুক। কাব্য সহ্য করতে পারবে না সেটা; কাব্যের সেই জোর নেই।
তানিম এবার ছোট শ্বাস ফেলে বলল——-‘শেষ একটা কথা বলি কাব্য। তুই যদি কুহুকে ভালো না বেসে থাকিস তাহলে প্লিজ ওকে মুভ অন করতে দে। সিয়াম যদি ওকে ভালোবেসে থাকে: বাসতে দে। খামোকা মেয়েটার জীবনে নিজে থেকে আর প্রবলেম ক্রিয়েট করিস না। ও মুভ অন করে ফেলেছে: ওকে হেল্প কর। কারণ ওর এসবের পেছনে দায়টা কিন্তু তোর কাব্য।’
কাব্য চুপচাপ মাথায় নিচু করে রেখেছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে টেবিলের উপর চেপে ধরা। কিচ্ছু মুখে বলছে না; শুধু শ্বাস ফেলছে অস্থির ভঙ্গিতে।
তানিম একবার কাব্যের মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর উঠে গেল চেয়ার থেকে। চলে যাবার আগে মাথাটা নিচু করে থাকা কাব্যের দিকে চেয়ে শেষবারের ন্যায় আবার বলে গেল——-‘আমার কথাটা ভেবে দেখিস কাব্য। অলরেডি অনেক ব্লান্ডার করে ফেলেছিস; এবার থেকে আর না, দোস্ত!’
কাব্য উত্তর দিল না; চুপ করে রইলো স্রেফ। তানিম ফার্মেসির বিল মেটাতে চলে গেল কাব্যকে ওভাবে রেখেই।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি—দুপুর ১২:৩০!
লেকচার আজকের মতো সব শেষ হওয়াতে ঊর্মি ওর দু জন বান্ধবীদের পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। বলা বাহুল্য— ঊর্মির আজ এই অবস্থার জন্যে ওর দুই বান্ধুবি কিছুটা হলেও দায়ী।
ঊর্মি হাসতে হাসতে বলছিল— কাব্যকে ও কিভাবে জালাচ্ছে। বেচারা পিছু ছাড়াতেই পারছে ঊর্মি।
ব্রেকআপ বললেই কি ব্রেকআপ হয়ে যায় নাকি। বয়ফ্রেন্ড হিসেবে কাব্যের ঊর্মির মতো মেয়েকে সিভারে দেওয়ার সাহস হয় কি করে? কি কমতি আছে ওর মাঝে? পুরো ক্লাসের মধ্যে সবথেকে সুন্দরী মেয়ে কিনা একটা ছেলের থেকে রিজেক্টেড হবে? হাউ ফানি!
ঊর্মিকে এসব কথা বলার সময় আস্ত এক মানুষিক ভারসাম্যহীনের মতো দেখাচ্ছিলো। ঊর্মিকে লাই দিতে; ওকে আরো উষ্কে দিতে পাশ থেকে উর্বশী বলে উঠল———‘কাব্যকে দেখলাম আজ মারতে গেছিল সিয়ামকে: তাও কি না ওই কু.. .হু মেয়েটার জন্যেই। জানিস তুই এই খবর?’
কুহু শব্দটা উর্বশী একটু টেনেটেনেই বললো ঊর্মিকে উষ্কে দেবার জন্যে। ঊর্মি সঙ্গেসঙ্গে ভ্রু বাকিয়ে তাকাল উর্বশীর দিকে। উর্বশী ওই চাওনি দেখে বাকা হেসে বলল——-‘কি ওভাবে কি দেখাস? ভিডিও আছে আমার কাছে। দেখবি?’
ঊর্মি ভ্রু নাচিয়ে তাকাতেই, উর্বশী ফোনে ভিডিও বের করে দেখালো ঊর্মিকে। ভিডিও যত এগুচ্ছে, ঊর্মির রাগ ততই বেড়ে যাচ্ছে তরতর করে। ভিডিওতে কাব্য কুহুর নাম ধরে ধরে ক্রমাগত মেরেই যাচ্ছে স্টিক দিয়ে সিয়ামকে। যতটুকু বুঝতে পারল—- সিয়াম কুহুকে ভালোবাসে বলেই কাব্যের যত প্রবলেম।
ঊর্মির রাগ বেড়েই যাচ্ছে।ও ঠাস করে উর্বশীর ফোনটা হাতে নিয়ে ছুড়ে ফেলবে ফ্লোরে; তার আগেই উর্বশী লুফে নিলো ওর ফোন———-‘নতুন আইফোন বেবস। তোমার কাব্য বেবির রাগ এটাতে ঝারিস না অন্তত।’
ঊর্মি চোখ রক্তিম করে তাকালো উর্বশীর দিকে। ওই চাওনি দেখে উর্বশী ঊর্মির দিকে তাকিয়ে আশপাশ দেখে তারপর নিচু গলায় বলল———‘ঊর্মিইইই…এটাই কিন্তু সুযোগ! কাব্যকে কুহুর থেকে দূরে সরিয়ে সিয়ামের ঘাড়ে ফেলে দেওয়া।’
ব্যাস! ঊর্মির মাথায় যা বুদ্ধি খেলার খেলে গেল। বরাবরের মতোই— ঊর্মি ব্রেভ স্টুডেন্ট। ওর রেজাল্টস টপনোচ!
তবে এই ট্যালেন্টগুলো বরাবরের মতো ভুল জায়গায় কাজে লাগাচ্ছে। বলা হয়—- সাইকো; পাগল মানুষদের রাগ উঠলে নাকি মস্তিস্ক অনেক দুর্দান্ত কাজ করে। তখন নতুন নতুন আইডিয়া; ধারণা ওদের মাথাতে আসতেই থাকে, যা একজন স্বাভাবিক মানুষের মাথায় সহজে কিন্তু আসেনা।
ঊর্মির বেলাতেও তাই। এবারেও একটা প্ল্যান ঠিক সাজিয়ে নিলো ও।
একটা প্ল্যান; একটা ছক! ঊর্মি ভেবেছিল— এই প্ল্যান কুহুকে কাব্যের থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। কিন্তু না…প্ল্যান অনুযায়ী বিষয়টা ঠিক সেটা হয়নি; হয়েছে ওর উল্টোটা। কাব্য-কুহুর জীবনের সবচেয়ে বড় মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে তাদেরই জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু—- ঊর্মি শিকদার।
ঊর্মি ভাবনা মাথায় আসামাত্রই হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে গেল। ব্যাগটা টেবিলের উপর থেকে কাঁধে নিতেই; উর্বশী ওর হাত চেপে ধরলো সাথেসাথে———‘কোথায় যাচ্ছিস?’
ঊর্মি একটু হাসল স্রেফ। হাসলে ওকে মারাত্মক সুন্দর দেখায়। হয়তবা এইজন্যেই কাব্য আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ; যখন ওর ২০ বছর ছিলো—- তখন জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে ফেলেছিলো; যার মাসুল ওকে এখনও গুনতে হচ্ছে ওকে কি নিষ্ঠুরভাবেই।
ঊর্মি হালকা হেসে উর্বশীর চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো———‘গোলমাল ঘটনাকে আরও একটু মসলা মিশিয়ে দিয়ে আসি। বস তুই, আম কামিং!’
কুহু সবেই লেকচার ক্লাস করে বেরিয়েছে। আজ শার্লিন আসেনি; ও লাস্ট ক্লাসে এটেন্ড করবে শুধু; একটু অসুস্থ বোধ করছে নাকি ও। তাই কুহু আজ একাই ক্লাস করেছে সবটা। সকাল ৯ টা থেকে ক্লাস করে শরীরটা বড্ড ম্যাজম্যাজ করছিল। ভেবেছিল—- এবার একটু রেস্ট রুমে জিরিয়ে নিবে।
অথচ মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে, ক্লাস থেকে বেরুতেই কুহুর সামনে এসে ভূতগ্রস্থের ন্যায় সটানে এসে হঠাৎ দাড়িয়ে গেল ঊর্মি। কুহু আচমকা পা থামিয়ে কিছুটা শুরুতে ভরকালো, পরপর মুখ শক্ত করে সরাসরি জিজ্ঞেস করে উঠলো———‘কি চাই?’
ঊর্মি একটু টেনেটেনে হেসে হেসেই বলল———‘আপাতত তো তোমাকে একটু দেখতে এলাম। কাব্য বললো— তুমি নাকি ওর ভার্সিটিতে এডমিট হয়েছো। কাব্যের পিছু নিতে নিতে এতদূর অব্দি চলে এলে; বেচারা ভার্সিটিতে এসেও দু-দন্ড রক্ষে পেল না।’
কুহু ভ্রু কুচকে পুরো কথাটা মন দিয়ে শুনলো। পরপর সামান্য হেসে; চোখ-মুখ শক্ত করে বললো ———‘বলা হয়ে গেছে? ডান? এবার সাইড দিন; আমি যাব। দেরি হচ্ছে আমার।’
বলে কুহু পাশ কাটিয়ে চলে আসবে; তার আগে ঊর্মি ওর পথ রোধ করলো সাথেসাথেই। কুহু আটকে গেল; ঊর্মি এবার সামান্য হেসে বলল——-‘আরে, কিসের এত তাড়া তোমার? কাব্য এখন ফুটবল ক্লাবে আছে: দেখা করা এলাও না প্র্যাকটিজ টাইমে। আজ তো ম্যাচ আছে ওদের; জানোনা? কাব্য হয়তো তোমাকে বলেনি।’
কুহু ব্যাগটা ঠিক করলো; তারপর মহা বিরক্ত হয়ে হাসিহাসি মুখ করে জবাবে বললো——‘আপনার কাব্যের কাছে আপনি যান। আমার কাজ আছে; তার কাছে যাওয়া ছাড়াও লাইফে অনেক কাজ থাকে আমার।’
ঊর্মি এবার টোন চেঞ্জ করে ফেলল; শাসিয়ে উঠে বলল———-‘তাই নাকি? কাব্য তো আমাকে বললো তুমি ওর সাথে অন্যের বাসর রাতের প্ল্যান এক্সচেঞ্জ করো; কাব্যের জন্যে তার ফেব্রেট করলা ভাজি করে ওর ঘরে দিয়ে আসো। আসলে ইউ আর স্টিল সো ওবসেসড উইথ হিম; রাইট বাচ্চা?’
ঊর্মি হালকা হাসল এ পর্যায়ে। কুহু রীতিমত তাজ্জব হয়ে গেল; ও হতবম্ব হয়ে ঊর্মির হাসিহাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
কাব্য ভাই এগুলাও বলেন ঊর্মি আপুকে? আর কতটা নিচে নামবেন উনি? কুহু প্ল্যান করার জন্যে স্রেফ সেদিনই কাব্যের সাথে কথা বলেছিল। নাহলে সাধারণত কুহু কথা বলা তো দূর কাব্যের মুখোমুখি অব্দি হয়না। কাব্য ভাই এই কথাটা কতো ম্যান ইগোর সাথে গর্ব করে শেয়ার করলেব ঊর্মি আপুর সাথে? ছি! লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে কুহুর এখন।
উনার সাথে কথা বলার থেকে: আজ থেকে কুহু একটা পশুর সাথে কথা বলা প্রেফার করবে বেশি। কাব্যের প্রতি রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে কুহুর।
বুকের ভেতর কেমন যেন একটা করছিল কুহুর। কুহুর চোখ বোধহয় টলমল করছিল।
কাব্যের থেকে আঘাত পেয়ে; রিজেকশন পেয়ে সরেই এসেছিল কুহু। তারপরও এই লোক ওর সাথে ছোট ঘটনা নিয়ে দেখা করা; কথা বলাটাকেও ঊর্মির আপুর সাথে হাইলাইট করে উল্লেখ করেন।
কুহু সেদিন স্রেফ কয়েকটা কথা কাব্যের সাথে। সেটাও কাব্য ভাইয়ের ব্যাঙ্গ করে ঊর্মি আপুকে বলা লাগলো?
কুহুর জোরে একটা শ্বাস ফেলল। ও কাঁদবে না; নিজেকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙবে না কুহু। তাই পরমুহূর্তে ও নিজেকে সামলে; শ্বাস চেপে রেখে, মুখ শক্ত করে বললো——‘কি চাই আপনার? শান্তি দিচ্ছেন না কেন আমাকে? এভাবে আপনি আমাকে হ্যারেজ করতে পারেন না।’
ঊর্মি এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল: কুহুর কাধ সমান চুল একবার হাত দিয়ে দেখতেই কুহু সরে গেল। পরপর ঊর্মি চোখ-মুখ শক্ত করে বলল———‘আমি চাই তুমি কাব্যের সাথে সবকিছু শেষ করে ফেলো; ওর সাথে আর দেখা না করো। লাইফে এত ওর্থলেস তুমি? রিয়েলি? একটাও ছেলে তোমাকে পছন্দ করে না নিজের জন্যে। এইজন্যে কি ঘরে যা পেয়েছো, সেটার জন্যেই কাব্যের পেছনে ছুটছো! দেখো এই ভার্সিটি। প্রায় সবার বয়ফ্রেন্ড আছে। কারোর কারোর ক্রাশ আছে; কারোরও আবার সিক্রেট চয়েজ আছে। তোমার কি আছে? কে আছে তোমাকে এখানে যে ঠিক তোমাকে পছন্দ করবে?লুক; কেউ নেই বাচ্চা।
তুমি আসলে সুন্দরী না; দেখতে প্রচণ্ড বিচ্ছিরি; স্টাইলও জানো না; স্ট্যাণ্ডার্ড নেই। এইজন্যে বোধহয় কাব্যও তোমাকে পছন্দ করেনি। ও তো জানে— তুমি কতটা ভ্যালুলেস। জানো, কাব্য না সেদিন এটাই বলছিল আমাকে। ও তো ভাই খুব হাসছিল এটা বলে— যে তুমি কতটা ডেলুলুতে ভুগো।
হাউ ফানি। জানো— তুমি আমাদের কথা বলার একটা টি স্যাম্পল। আমরা এই টি স্প্লিট করতে ভীষণ এনজয় করি। আমি কতবার ওকে বললাম— তোমাকে বলে দিতে সরাসরি এসব। অথচ কাব্য বেচারা মুখেও বলতে পারছে না এটা তোমাকে; চাচাতো বোন হও কিনা। কষ্ট পেলে যদি বিচার দিয়ে বসো।’
কুহু নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো ঊর্মির দিকে।
ও একটা টি; কাব্য ভাইয়ের কাছে স্রেফ গসিপ করার একটা টপিক মাত্র। কাব্য ভাই আসলেই মনে করেন— কুহু ভ্যালুলেস? কাব্য ভাই ছাড়া ওর কাউকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা নেই? সত্যি তিনি এটা মনে করেন? এই পুরো ভার্সিটিতে ও একমাত্র বিচ্ছিরি বলেই কেউ ওকে পছন্দ করে না? কাব্য ভাই কি আদৌ জানেন— কুহুর মেসেজ রিকোয়েস্ট এ রোজ কত ছেলে ইনিয়ে-বিনিয়ে আসে একটু পাত্তা পাবার জন্যে? কুহু ওদের দেখেও না চোখ তুলে একবার। সেটাকে কাব্য ভাই— ওর চেহারার মধ্যে কমতি আছে ভেবেছেন?
কুহু চুপচাপ তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ ঊর্মির দিকে; পরপর শ্বাস আটকে, ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না আসার আগেই আলগোছে পাশ কেটে চলে এলো ঊর্মির থেকে। ওর ঊর্মিকে বলার মতো কিছু নেই আজ।
ঊর্মি পেছন থেকে হাসতে লাগলো। ঊর্মি এবার সিয়ামের কাছে গেল। এবার আসল টোপের পালা। আজ তো কাব্যকে একটা সারপ্রাইজ দিবে ঊর্মি; কাব্যের জীবনের সেরা সারপ্রাইজ!
কুহু ধীরে ধীরে করিডোর দিয়ে হাটছিলো। আশেপাশের মানুষ ওকে ডিঙিয়ে আগে চলে যাচ্ছে, অথচ কুহু যেন হাঁটতেই পারছে না- ওর শক্তি সব যেন খুইয়েছে।
হঠাৎ হাঁটার মধ্যে কুহু একজনের সাথে ধাক্কা খেলো। ছেলেটা সরি বলে সরে গেল পরপর। কুহু ওই ছেলের দিকে তাকালো; ছেলেটা মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতেই কুহু ছোট একটা শ্বাস ফেললো।
কুহু আনমনে পুরো ভার্সিটিতে থাকা প্রত্যেকটা স্টুডেন্টকে দেখলো; ভীষণ নিখুঁতভাবেই।
কুহুর চোখ এদিকে; ওদিক ক্লান্ত-ভঙ্গিতে ঘুরছে—- কুহু দেখে যাচ্ছে; সবাই খুশি এখানে। সবার জীবনে ভালো থাকার মতো মানুষ আছে। কুহুর কিসের কমতি। ওরও তো আছে ভালো রাখার মতো একঝাঁক মানুষ।
তবুও কোথাও না কোথাও ওর আজ বড্ড একা লাগছে। ভীষণ ইনসিকিউর্ড লাগছে। মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন—- কুহুর কেউ নেই এক পৃথিবীতে।
ও একা, সম্পূর্ণ একা একটা ফিনিক্স পাখির ন্যায় ঘুরছে শুধু লাটিমের ন্যায়।
জীবনে এক কাব্য ভাইকে কুহু মন থেকে চেয়েছিলো। আর আজ..! সেই কাব্য ভাই ওকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।
কুহু নিজেকে একবার দেখলো আগাগোড়া! কাব্য ভাই ওকে এতটা অপছন্দ করেন; ওকে নিয়ে; ওর অনুভূতি নিয়ে এতটা ব্যঙ্গ-তামাশা করেন—- জানা ছিলো না কুহুর। অথচ কুহুর সামনে কেমন ভদ্র; মাসুম মানুষ হয়ে থাকেন। দুই মুখোশওয়ালা কাব্য ভাইকে কুহুই একমাত্র চিনতে পারেনি; প্রেমে পরে গেছে। এখন সেটার মাসুল এতটা নির্মমভাবে কুহুর ভুগতে হচ্ছে।
কুহু আর থাকতে পারলো না করিডোরে। দৌড়াতে দৌড়াতে পাগলের মতো এসে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল।
ও ওয়াশরুমের দরজার সামনে কিচ্ছুক্ষণ ওভাবেই স্থির দাড়িয়ে রইল; একটা পাথরের মূর্তির মতো। যেকোনো মুহূর্তেই কুহু কেঁদে ফেলবে।কিন্তু ও…ও তো কাঁদতে চায়না: একটুও না। ও তো সামলে নিয়েছে নিজেকে। কার জন্যে কাঁদবে কুহু? কেউ নেই; কারোর যোগ্যতা নেই কুহুর কান্নার কারণ হবার। কুহু…কুহু নিজের কাছে অনেক দামি। কেউ ওকে ওর্থলেস বলে দিলেই কুহু নিজের কাছে মূল্যহীন হয়ে যাবে না একদম। আর কারোর কাছে ওর নিজের কোনও দাম না থাকলেও; ওর নিজের কাছে নিজের একটা সম্মান আছে।
কুহু কেন কাঁদবে? কাঁদবে না ও।
কুহুর ছোট একটা জীবনে সবচেয়ে বড় পাপ ছিলো—- কাব্য ভাইকে ভালোবাসা, এবং তাকে সেটা জানানো। এই পাপ এখন কিকরে মুছবে কুহু? কিকরে? শরীর গোসল দিয়ে মুছে ফেললেও মনের দাগ মুছে কি করে? কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে মনের দাগ মোছা যাবে? কার কাছে আছে এই পদ্ধতি? কে সাহায্য করবে কুহুকে?
কুহুর বড্ড গলাটা জ্বলছে। একটু কাঁদতে পারলে হয়তো শান্তি মিলতো। কিন্তু ও তো কাঁদবে না। নিজেকে দেওয়া প্রমিজ ও ভাঙতে পারবে না কখনো।
কুহু আয়নার দিকে তাকিয়ে করে একটা শ্বাস ছাড়লো। আয়নার নিজেকে একবার খুব, খুব ভালো করে দেখলো। হাত দিয়ে পুরো মুখটা ছুয়ে দিতে দিতে ভীষণ বিস্ময় নিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো———-‘আমি বিচ্ছিরি দেখতে? আমার মধ্যে কোনো সৌন্দর্য নেই? সত্যিই নেই? তাহলে আজ অব্দি সেটা কেউ বললো না কেন আমাকে।’
কুহুর এই উত্তরের জবাব আয়নার কাছে যে নেই। কুহু একটা ঢোক গিললো। বড্ড আশ্চর্য নিয়ে নিজেকে দেখতে থাকলো আয়নায়।
কুহু নিজেকে সামলে নিলো। দরকার নেই ওর বাহ্যিক সৌন্দর্যের। অন্তত কাব্য ভাইয়ের মতো ওর মনটা কুলষিত নয়। কুহু নিজেকে সামলে নিলো। পরপর ট্যাপ ছেড়ে নাকে-মুখে পানি ছিটিয়ে দিতে লাগল একের পর এক। পুরো জামা ভিজে যাচ্ছে ওর; পাগল কুহু সেই খেয়াল নেই। ও অস্থির; ওর হাত কাঁপছে স্পষ্ট।
অনেকবার পানির ঝাপটা দিয়ে কুহু আবার আয়নায় তাকাল। ওকে দেখতে মনে হচ্ছে — গোসল সেরে ফেলেছে। কুহুর ভেজা মুখটা বোর্ড স্নিগ্ধ লাগছিল। কুহু অনেকক্ষণ নিজের ওই ভেজা মুখের দিকে চেয়ে রইলো। পরপর হালকা হাসার চেষ্টা করে দেখল—- ওকে কি আসলেই বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে?
আজ থেকে সৌন্দর্য নিয়ে দিধান্বিত কুহু জানে না ওকে হাসলে কেমন দেখাচ্ছে। কারণ আজ অব্দি— কুহু জানে এসেছে ওর চেহারা মায়াবী। কেউ বলেনি— কুহু দেখতে এত বিচ্ছিরি। হয়তো কেউ মুখের উপর বলে দিতে পারেনি— যেমন পারেননি কাব্য ভাই স্বয়ং।
কাব্যের কথা মাথায় আসতেই; কুহু মলিন হাসলো। আয়নার দিকে তাকিয়ে কুহু চুড়ান্ত বিধ্বস্তের ন্যায় বলে উঠলো——-‘আপনি আমার কাছে ওর কত নিচে নামতে পারেন কাব্য ভাই, আমিও দেখতে চাই সেটা।’
বলে কুহু ওড়না ঠিক করে; ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেড়িয়ে আসলো ওয়াশরুম থেকে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই দেখে সিয়াম ওর দিকেই এগুচ্ছে। গায়ে জার্সি; আর হাফপ্যান্ট। একহাতে একটা বাস্কেটবল চেপে রেখেছে গায়ের সঙ্গে। কুহুকে দেখতে পেয়েসিয়াম কিছুটা দ্রুত এগিয়ে এলো। কুহু ওকে দেখে থামলো। সিয়াম ভীষণ উচ্ছাস নিয়েই বলল———-‘আরে তুমি এখানে। আমি আসলে তোমাকেই খুঁজছিলাম।’
কুহু শুকনো হেসে প্রশ্ন করলো—‘কেন? কোনো দরকার?’
সিয়াম মাথার পেছনটা চুলকে হাতের বাস্কেটবল দেখিয়ে বলল——‘আজ বাস্কেটবল ফাইনাল রাউন্ডের ম্যাচ আছে। তুমি এলে ট্রফিটা আমরাই পাব— এটা আমার ধারণা। তো আসবে তুমি?’
কুহু জবাবে হঠাৎ মলিন হেসে বললো——-‘আমি ভাগ্যবতী নই: সিয়াম ভাইয়া। আমার ধারণা— আমি এলেই বোধহয় আপনি ট্রফিটা হেরে যাবেন। আমি না গেলেই হয়তো জিতবেন।’
সিয়াম সাথেসাথে বলে উঠল——‘উহু, সিয়াম ভাইয়া না, অনলি সিয়াম।’
কুহু জবাবে কিছু বললো না; শুধু হালকা হাসলো।
সিয়াম হেসেই হেসে বলল——-‘দেন প্রুভ হয়ে যাবে সেটা আজ। স্টেজে প্রথম সারিতে বসে আমার খেলা দেখবে তুমি, পুরোটা দেখতে পেলে ট্রফি না পেলেও তোমাকে লাস্টে একটা সারপ্রাইজ দিব। এটা গিফট আমার এত বোরিং খেলা দেখার জন্যে।’
কুহুর ইচ্ছে ছিলো না যেতে। তবুও সিয়ামের জোড়াজোড়িতে যাওয়া লাগলো।
বাস্কেটবল খেলা চলছে। সিয়াম বাস্কেটবল ‘Daffodil Hoopmaster’ দলের ক্যাপ্টেন।ইতিমধ্যে সিয়ামের বিপক্ষ দল, অর্থাৎ ‘Daffodil squad’ দল ৩ পয়েন্টসে এগিয়ে আছে।
সিয়ামদের দল হারছে—- কুহু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে চলে যাবে দর্শক সারির থেকে প্রস্তুত হলো। হঠাৎ পুরো দর্শক সারি জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। কুহু থেমে গেলো আচমকা।
উৎসুক দর্শক সারি দেখে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে সিয়ামদের একটা পয়েন্টস বেড়েছে। সিয়াম বাস্কেটবল হাতে নিয়ে বাউন্স করতে করতে কুহুর দিকে চেয়ে বাকা হাসলো—- অর্থাৎ কুহুকে ভুল প্রমাণিত করবে সিয়াম আজ।
পরপর সিয়াম চোখের ইশারায় ওকে দাঁড়াতে বললো দর্শক সারিতে। তাই কুহু না চাইতেই দাড়িয়ে খেলা দেখতে থাকলো। এবার যেন খেলার মোড় সম্পূর্ণ ঘুরে গেল। সিয়ামদের দল একের পর এক পয়েন্টস বাড়াচ্ছে। যে দল এতটা পিছিয়ে ছিলো— সেই দলই এখন জেতার দিকে। কুহু এবার ভীষন আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলো খেলা।
খেলায় টানটান উত্তেজনা চলছে। সিয়ামের হাতের বাস্কেটবল। ও সেটাকে বাউন্স করতে করতে সামনে এগুচ্ছে। ওকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে কজন খেলোয়ার। সিয়াম সেসব তোয়াক্কা না করে এগুচ্ছে। খুবই সিরিয়াস মুখ-ভঙ্গি সিয়ামের। সম্পূর্ণ মনোযোগ ওর এখন খেলাতেই। আশপাশের দর্শক সারি ভীষণ থ্রিল নিয়ে খেলা দেখছে; সবার মুখেই চিন্তা। আর মাত্র একটা পয়েন্টস। তাহলেই ‘Daffodil hoopmaster’ দল অর্থাৎ সিয়ামদের দল জিতে যাবে।
কুহুও এইবার আগ্রহ দেখাচ্ছিলো। দুহাত মুখের সামনে এনে চোখ-মুখ খিছে খেলা দেখছে।
কাব্যের ম্যাচ সবেই শেষ হয়েছে। জার্সি এখনো খোলেনি কাব্য। ও এদিক দিয়েই যাচ্ছিল কোথাও। বাস্কেট গ্রাউন্ডে এত লোকের ভিড় দেখে কাব্য থামলো। ও দূর থেকেই দেখছে— সিয়ামের দল খেলছে। বোর্ডে নাম সিয়ামের দলের।
কাব্য দীর্ঘসাস ফেললো। ও চলে যাবে— হঠাৎ শুনে জোরে এক চিৎকার। সিয়ামের দল জিতে গেছে দেখে দর্শক সারিতে উল্লাস বয়ে যাচ্ছে। কাব্যের কান ধরে যাচ্ছে ওদের চিৎকারে। অথচ যখন কাব্যদের দল জিতে; তখনো এমন করেই দর্শক সারি থেকে চিয়ার্স আপ শোনা যায়। এখন সিয়ামের সাথে এটা হওয়া দেখে কাব্যের মেজাজ গরম হচ্ছে। ও আঙুল দিয়ে কান পরিষ্কার করলো; বিড়বিড় করলো মেজাজ হারিয়ে———‘একটা ম্যাচ জিতে মনে হচ্ছে অলিম্পিক জিতে গেছে। বাস্টার্ড একটা!’
কাব্য আপনমনে গালি দিয়ে চলে যাবে; হঠাৎ একদম আচমকা ওর চোখ গেল দর্শক সারিতে। ওটা….ওটা কুহু না? ও সিয়ামের খেলা দেখছিল এতক্ষণ? ও চিৎকার করে সিয়ামের জয়ে?
কাব্যের ভ্রু কুচকে গেল সাথেসাথেই! কাব্য জার্সি গায়ে ফুটবলটা একহাতে চেপে এগুলো ওইদিকে।
সিয়ামদের দলকে ট্রফি নিতে ডাকা হয়েছে। সিয়াম ট্রফি গ্রহণ করে ওর দলের কাছে গিয়ে ছবি তুললো। দলের সবাই ট্রফি নিয়ে উলাস করবে বলে হুরোহুড়ি লেগে গেছে একপ্রকার। সিয়াম কাউকেই ট্রফি দিল না।
বরং ও ট্রফি হাতে বিচারকদের কিছু বললো। বিচারক মৃদু হেসে সিয়ামকে মাইক ধরিয়ে দিলেন: সিয়াম একহাতে ভারি ট্রফি; ওপরহাতে মাইক নিয়ে সবার সামনে গিয়ে দাড়ালো।
মাইক হাতের নিয়ে: সেটার সুইচ অন করে একবার টেস্টিং করলো——-‘হ্যালো, 1 2 3 !’
কুহু কেন যেন হেসে ফেললো সিয়ামের ওমন ভঙ্গিতে টেস্টিং করা দেখে। সিয়াম ওই হাসি দেখলো কিছুক্ষণ; পরপর নিজেও কথাটা নিচু করে হালকা হাসলো। কাব্য তখন মাত্রই এসে দাঁড়িয়েছিল—- ওদের সামনে। কুহুর হাসি; সিয়ামের পালটা হাসি দুটোই ওর নজরে এসেছে।
কাব্য ভ্রু কুঁচকে কুহুর সামনে যাবে; তার আগেই হঠাৎ সিয়াম দারুণ স্মার্ট ভঙ্গিতে বলে উঠল——-‘আজকের এই ট্রফি শুধুমাত্র একজনের জন্যে ডেডিকেটেড।’
কাব্য থেমে গেল; পুরো কথাটা শোনার জন্যে ঘুরে তাকাতেই দেখে সিয়াম কুহুর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। কাব্য ওই তাকানো দেখে যা বোঝার হয়তবা তখনই বুঝে ফেলল।
সিয়াম এবার মাথায় নিচু করে; হালকা হেসে আবার মাথায় তুললো।পরপর কুহুর দিকে চেয়ে; ওর দিকে ট্রফিটা বাড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললো———-‘মাই লাভ অফ মাই লাইফ; কুহু, আমার লাকি কয়েন।’
কুহু সঙ্গেসঙ্গে অবাক হয়ে তাকালো সিয়ামের দিকে। কাব্যও হতবম্ব; ও অবাক হয়ে; চুড়ান্ত বিস্ময় নিয়ে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে পরপর কুহুর দিকে তাকালো।
কুহুর হাত থেকে ব্যাগ পরে গেছে, দর্শক সারির সবাই কুহুর দিকে চেয়ে চিয়ার্স আপ করছে, সিয়ামের পাগলামি দেখে বিচারক দল হাসছেন স্রেফ।
সিয়াম আবার ট্রফিটা উঁচু করে ধরল মাথার উপর, তারপর মাইক ফেলে রেখে গলার জোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বললো———‘আই লাভ ইউ কুহু। আই লাভ ইউ; আই লাভ ইউ; আই লাভ ইউ সো মাচ ম্যাই লাকি কয়েন। ইউ আর ম্যাই লাক; ইউ আর ম্যাই ইন্সপিরেশন ফর দিস ট্রফি, গার্ল। আই লাভ ইউ মোর দ্যান এনি…এনিথিং!’
পুরো গ্রাউন্ডে সিয়ামের চিৎকার করে বলা প্রপোজ ভেসে বেড়াচ্ছে। পুরো ভার্সিটির যারাই এই প্রপোজ শুনেছে সবাই এসে ভিড় জমিয়েছে দর্শক সারিতে। সবাই মিলে কুহুকে একজোটে বলে যাচ্ছে— প্রপোজ একসেপ্ট করার জন্যে।
কাব্য এতসব দেখে ওর মাথাই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ও স্রেফ শ্বাস আটকে কুহুর দিকে চেয়ে রয়েছে একবুক আশা নিয়ে।কুহু মানবে না সিয়ামকে; কুহু এখনো কাব্যকে ভালোবাসে। সিয়ামকে নিশ্চয়ই না। সিয়াম এত ক্রিঞ্জভাবে প্রপোজ করেছে; কুহু ওকে কি করে একসেপ্ট করবে? এটা কোনো ধরন হলো প্রপোজ করার?
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৩
কাব্য শ্বাস আটকে রেখে দিয়েছে। বুক ধুকপুক করছে শুধু। হাত কাপছিলো। ঠিক তখন বিস্ময়ে ফেটে পরা কুহুর নজর গেল কাব্যের দিকে। কাব্য কেমন একটা চোখে যেন কুহুর দিকেই তখন তাকিয়ে ছিলো।
কুহু কাব্যকে দেখলো। কাব্যের নজরে নিজেকে দেখলো। দুজনের চোখে চোখে মিললো স্রেফ!