তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৩

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৩
ফারহানা নিঝুম

“বাংলায় ষাট, ইংরেজিতে সত্তর, ভূগোলে পঞ্চম, আইসিটিতে সাতাত্তর, ইতিহাসে শূন্য?”
রেজাল্ট কার্ড জোরে জোরে পড়ছে তাশফিন।বট গাছের নিচে বসেছে বেঞ্চের উপর।তাশফিনের ঠিক সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ, লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে রীতিমতো।এত লজ্জা রাখবে কোথায়?
যেখানে তাশফিন নাকি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলো তার উপর এখন একজন নেভি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। সেখানে ফারাহ ফেল্টুস কুমারী ছে রে!

“রেজাল্টের এই অবস্থা কেন? এগুলো মার্কস? সিরিয়াসলি?”
নত মস্তকে থাকা মেয়েটার মস্তক নেমে এলো থুতনিতে।এত লজ্জা রাখি কোথায়?
“আর পৌরনীতি? এটার কথা তো বললাম না।”
তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠলো ফারাহ,টান দিয়ে রেজাল্ট কার্ড টেনে নিয়ে কড়া কন্ঠে বলল।
“তাতে আপনার কি? নিজের চরকায় তেল দিন ‌।আর হ্যাঁ আমার টা না দেখে নিজের বউয়ের টা দেখেন।”
সহসা হেসে ফেলল তাশফিন,বোকা বউটা তার।সেই তো তার বউ তাহলে এটা আবার কেমন কথা বলল?
অপেক্ষা না করে নিজ পথে হাঁটতে লাগলো ফারাহ। মেঠো পথ ধরেছে সে, পিছন পিছন আসছে তাশফিন।বউটা এমনিতেই এত পিচ্চি তার উপর বস্তার মতো একটা ব্যাগ নিয়েছে কাঁধে।ব্যাগ টা টেনে নিল তাশফিন। অকস্মাৎ এমন ঘটনায় আশ্চর্য হয় ফারাহ। প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে, আপাতত তার লাভ হচ্ছে।এত ভারী ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতে হবে না।
রাস্তার ধারে আসা মাত্র একজন বয়স্ক মহিলার সাথে দেখা হলো ফারাহর।হাত টেনে ধরলেন সেই মহিলা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কী রে ফারাহ কে রে পিছনের টা?”
ভেংচি কাটলো ফারাহ,মুখ বাঁ’কিয়ে বলল।
“তোমার জামাই।”
সহসা হেসে ফেললেন সেই ভদ্র মহিলা।
“বুঝে গেছি।”
ঠোঁট টিপে হাসলো ফারাহ। চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে তাশফিন,বউ তার যার তার জামাই বানিয়ে দিচ্ছে তাকে! আশ্চর্যের বিষয়!
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে,সবে সাড়ে তিন টা বাজে।আরো কিছুটা গেলেই আহমেদ মঞ্জিলে পৌঁছে যাবে ফারাহ এবং তাশফিন দু’জনে।
“ওই মহিলা কে ছিলেন?”
কন্ঠস্বর গম্ভীর, সামনের দিকে হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছে ফারাহ।তাশফিনের প্রশ্ন শুনে বলল।
“আপনার বউ।”

ব্যথাতুর কন্ঠে চিৎকার করে উঠল ফারাহ,পিঠে ছড়িয়ে থাকা চুল গুলো টেনে ধরেছে তাশফিন।
“আর একটা বাজে কথা বললে খুব খারাপ হবে।”
ফারাহ মুখ কুঁচকে নেয়।
“তাহলে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।”
“এত ত্যাড়া কথা বলো কেন তুমি?”
“আমি এমনি,ষ ত্যাড়া, আমার সাথে কথা বলবেন না।”
“নো প্রবলেম, আমি সোজা করে দেব।”
কথাটি বলেই চোখ টিপে তাশফিন, চোখ পা’কিয়ে তাকালো ফারাহ। চমৎকার হাসলো তাশফিন। ছোট আঙ্গুল টেনে ধরে ফারাহর, শীর্ণ বদন খানি ক্ষীণ কেঁপে উঠলো।
“আশেপাশে মানুষ থাকলে এত সাহস বাড়ে? ইস্ আর একা থাকলে..
পরের বাক্য টুকু বলল না তাশফিন। লজ্জায় আড়ষ্ট হলো ফারাহ,মনে মনে গা’লি দিল তাকে।

“আপনি এত বেহায়া কেন?”
“বউ লজ্জাবতী লতা তাই।”
চকিতে ফিরে তাকালো ফারাহ, তাকিয়ে রইল ক্ষণকাল, অতঃপর দৃষ্টি ফিরিয়ে ফের হাঁটতে লাগলো। দালানের কাছাকাছি আসা মাত্র কুয়া থেকে পানি নিয়ে পা ধুয়ে ছুট লাগালো ভেতরে।তাশফিন হাসলো,নিজেও পা ধুয়ে নিল। এদিকে ফারাহ ফের ছুটে এলো।
“ওহে লেফটেন্যান্ট সাহেব আমার ব্যাগ দিন।”
“লেফটেন্যান্ট সাহেব”শুনতে ভারী মিষ্টি লাগে তাশফিনের নিকটে।বউ তার বুকে আগুন জ্বা’লছে, কিন্তু নেভাতে যে তার কাছেই আসবে সে কী তা জানে?

বৃষ্টি থামার পর চারদিকে একটা ভেজা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। কাঁচা রাস্তাগুলো কর্দমাক্ত হয়ে উঠেছে, প্রতিটি পদক্ষেপে পায়ের নিচে চপচপে শব্দ হয়। কোথাও কোথাও ছোট ছোট জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে,যেখানে বৃষ্টির ফোঁটার প্রতিচ্ছবি এখনো খেলে বেড়াচ্ছে। কিছু জায়গায় জমে থাকা কাঁদার ওপরে এলাকার শিশুরা খালি পায়ে দাপাদাপি করে, আর কোনো কোনো জায়গায় সাইকেল কিংবা গাড়ির চাকার।
কফি কাপ হাতে বাইরে বেরিয়ে এসেছে ঝুমুর। না ততটাও খারাপ লাগছে না আজ। আশেপাশের পরিবেশটা নিদারুণ,আর অনূভুতিও দিচ্ছে নিদারুণ।
গাছের পাতাগুলো তখনো ভেজা, কিছু পাতা থেকে টুপটাপ করে পানি ঝরে পড়ছে। রাস্তার পাশে ফুটপাতে কিংবা মাটির ওপর বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাওয়া শুকনো পাতা জড়ো হয়ে আছে।
কিছুটা দূরেই গরুর গোশত গুলো আলাদা করতে ব্যস্ত নবীন আহমেদ।হাতে রক্ত,হাতে চা’পাতি নিয়ে গো’শত আলাদা করতে ব্যস্ত। নাক মুখ কুঁচকে নিল ঝুমুর। ওষ্ঠো পুট হতে বেরিয়ে এলো “ইয়াক” শব্দটি।
অদ্ভুত শব্দটি শুনে চোখ তুলে তাকালো নবীন। পাশে বসে থাকা ছোট মাহির সবটা দেখছিল, খালামনি কে দেখে আঁকড়ে ধরে মূহুর্তের মধ্যে।

“খালামনি গোশত।”
আধো আধো কন্ঠস্বর। ঝুমুর চোখ বাঁ’কিয়ে তাকালো,কেমন গন্ধ বের হচ্ছে। নবীন হাসলো ঝুমুরের নাক মুখ কুঁচকে নেওয়া দেখে।
“কী ম্যাডাম সব ঠিকঠাক?”
প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না ঝুমুর। মাহির কে তাড়া দিয়ে বলল।
“মাহির তোমার আম্মু ডাকছে তাড়াতাড়ি যাও।”
মাহির পা বাড়ায় দালানের দিকে।
“কী ব্যাপার এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
গোশত রেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নবীন, অস্বস্তিতে পড়ে গেল ঝুমুর।
“না দেখছি বড়লোক বাপের বড়লোক মেয়ে কীভাবে নাক মুখ কুঁচকে নিচ্ছে।”
দাঁত কিড়মিড় করলো ঝুমুর।
“অভ’দ্র কোথাকার।”
পিছন ফিরে যেতেই স্লিপ খেয়ে কর্দমাক্ত জায়গায় ঠাস করে পড়ে গেল ঝুমুর।
“মা গোঁ..

ব্যথাতুর কন্ঠে চিৎকার করে উঠল ঝুমুর। আকস্মিক সবটা ঘটে যাওয়াতে হো হো করে হেসে উঠলো নবীন।নবীনের হাসিতে চমকে উঠে ঝুমুর।পুরো শরীরে কাঁদা লেগে আছে ,কফি কাপ টা পড়ে আছে অবহেলায়। রাগান্বিত স্বরে বলল।
“এই এভাবে হাসছো কেন তুমি? একটা মেয়ে পড়ে গেছে তাকে না তুলে অভ’দ্রের মতো হাসছো?”
ভাবলেশহীন ভাবে উঠে দাঁড়ালো নবীন।
“বেশী অ্যাটিটিউড দেখালে এমনি হয়।”
নাকের ডগা ফুলে উঠে ঝুমুরের। এগিয়ে এলো নবীন,হাত বাড়িয়ে উঠাতে চাইলো ঝুমুর কে।ঝুমুর কম যায় না,হাত টেনে ধরে , নিজে উঠে দাঁড়িয়ে ফেলে দিল নবীন কে। হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে।
“এটা কী করলে?”
ভ্রু কুঁচকে শুধোয় নবীন। কোমড়ে হাত উঁচিয়ে দাঁড়ালো ঝুমুর।
“একটু আগে হাসছিলেন যে ওইটার বদ’লা নিলাম।”
এদিক সেদিক দুলতে দুলতে দালানের ভেতরে চলে গেল ঝুমুর। আহাম্মক বনে গেল নবীন, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল রমনীর যাওয়ার পানে।

বৃষ্টি পর পরিবেশটা সবকিছুই যেন একটু বেশিই সতেজ হয়ে ওঠেছে। চারপাশের গাছপালা আরও সবুজ দেখায়, যেন প্রকৃতি নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বাতাসে একটা শীতলতা, মাটির ভেজা গন্ধ আর গাছের পাতায় জমে থাকা পানির ফোঁটাগুলো রোদে ঝিলমিল করে ওঠে।
নদীর পানি বৃষ্টির কারণে একটু বেড়ে গেছে, আর তীরে জমে থাকা কাঁদায় ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে। গাছের পাতায় বসে থাকা পাখিগুলো ধীরে ধীরে গলা ছেড়ে ডাকতে শুরু করেছে, যেন প্রকৃতির এই বদলে যাওয়া সৌন্দর্যকে স্বাগত জানাচ্ছে। দূরে কোথাও রামধনু দেখা যায়, যার সাতটি রঙ আকাশের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়।আর রাতের আকাশ হলে তো কথাই নেই!
রান্না ঘরে থালাবাটি গুলো গুছিয়ে রাখছেন আরিফা আহমেদ। এগিয়ে গেল তাশফিন।
“উঁহু।”
গলা খাঁকারি নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছিল।আড় চোখে তাকায় আরিফা আহমেদ।কাট কাট কন্ঠে শুধোয়।
“এখানে কী চাই?”
“আপনার মেয়ে চাই।”
স্পষ্ট জবাব।অবাক হলেন তিনি। পিছন ফিরে তাকালেন।
সোজাসাপ্টা তাকানোর পূর্বে হাতে আরো একটি হাতের স্পর্শ পেলো।
“আম্মু।”

নমনীয় কন্ঠস্বর, চমকালেন আরিফা আহমেদ।
“অ্যাম স্যরি আম্মু, আমি আপনার মেয়ে কে না দেখেই ফেলে চলে গেছিলাম। প্লিজ আম্মু আমাকে ক্ষমা করে দিন, আপনার মেয়ে চাই আমার।যদি ভালোয় ভালোয় দিয়ে দেন তাহলে ভালো,আর দিলে আমি খারাপ হবো।”
অবাক নেত্রে তাকাচ্ছেন আরিফা আহমেদ, ছেলে হুম’কি দিচ্ছে?
“ভালো হবে না তুমি?”
বাঁকা হাসলো তাশফিন।
“আপনার চঞ্চল মেয়ে ভালো হতে দিলো কই?”
“কেন কী করছে আমার মেয়ে?”
ঠোঁট উল্টে নেয় তাশফিন।
“শ্বাশুড়ির কাছে বলতে চাই না আপাতত।”
“ছাড়ো ফাজিল ছেলে,মেয়ে নিতে শ্বাশুড়ি কে হাত করতে এসেছ?”
গা দুলিয়ে হেসে বলল তাশফিন।
“এটাই আমার শ্বাশুড়ি, একদম জামাইয়ের মতো বুদ্ধিমতী।”
সব কাজ শেষে লাইট অফ করে দিলেন আরিফা আহমেদ।
“এবার বলো কি চাও।”
“আমার নিষ্পাপ বাচ্চা বউটা দিয়ে দিন।তাকে আমার লাগবে,খুব করে লাগবে।”
মুগ্ধ নয়নে তাকালেন আরিফা আহমেদ। এমন একটা ছেলে চেয়েছিলেন ফারাহর জন্য,তবে কী তার ইচ্ছে টা পূর্ণ হলো?

এই রাতবিরেতে পড়তে হয়েছে সবাই কে বিপা’কে।পুরো এলাকায় কারেন্ট নেই,এখন রাত সাড়ে বারোটা ছুঁই ছুঁই।বড় আম কাছের কিছুটা বেঁকে গিয়ে কারেন্টের পিলারের উপর পড়েছে, ফলস্বরূপ কারেন্ট চলে গেছে পুরো এলাকায়। এলাকার স্থানীয় ব্যক্তিরা মিলে গিয়েছিল কারেন্টের অফিসে।লোক এসেছিল, কিন্তু এই আঁধারে এত কিছু করা সম্ভব নয়। দিনে আকাশ ভালো থাকলেও রাতের আকাশ টা খুব একটা ভালো নয়।তাদের বক্তব্য কাল সকালে আসবে,গাছ টা আগে সরাতে হবে।
আঁধার রাত, চাঁদ টা লুকিয়ে আছে মেঘের আড়ালে। নারকেল বাগানের গাছ গুলো নড়ছে বার বার। অন্ধকার দালানে কিছুই ঠিকঠাক করে দেখা যাচ্ছে না।রুমে হারিকেনের আলোতে আলোকিত হচ্ছে। বিছানা গুছিয়ে রাখছে ফারাহ।কারো পদধ্বনি কর্ণ কুহু হওয়া মাত্র থমকায় সে।পিছন ফিরে তাকানোর ফুরসৎ নেই,তার পূর্বেই কেউ আঁ’কড়ে ধরেছে তাকে।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১২

ভয় পেলো ফারাহ, কম্পিত সুরে শুধোয়।
“ক..কে?”
“মিসেস শেখ ভয় পাচ্ছেন আপনি?”
হৃদয় জুড়ে ছড়িয়ে গেল এক চাপা অনূভুতি। পায়েল নিচ থেকে শিরশির অনূভুতি টা একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে অস্তিত্বের মাঝে।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৪