তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৫

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৫
ফারহানা নিঝুম

ঝলমলে সকালের সৌন্দর্য যেন এক স্বপ্নের মতো রীতিমতো।আকাশে মেঘের লুকোচুরি নেই, সোনালি রোদের আভায় চারপাশ ঝলমল করছে। শিশিরবিন্দুতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে মুক্তোর মতো ঝিকিমিকি করছে। বাতাসে মিষ্টি ঠান্ডা, হালকা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। পাখিরা গুনগুন করে গান গাইছে, যেন তারা নতুন দিনের আনন্দে মে’তে উঠেছে। দূরে স্কুলে যাওয়া শিশুর খিলখিল হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে সকালবেলার স্নিগ্ধ পরিবেশের সাথে। ফুলের বাগানে মৌমাছিরা ব্যস্ত, আর কোকিলের কুহুকুহু ডাক যেন হৃদয়ে এক প্রশান্তির সুর তোলে। ঠিক সেই সময় গুলোতে পুরো একটি পরিবার একত্রে যখন থাকে,তখন আনন্দে আড্ডায় ভরে উঠে পরিবেশ টা।
খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়েছেন শায়লা আহমেদ। জয়নাল আহমেদ এবং সাজ্জাদুল আহমেদ দু’জনেই এসেছেন, সঙ্গে এসেছেন বাকিরা।

রুবেনা শেখ এবং রিজুয়ান শেখ দু’জনেই তাড়া দিলেন।
“জয়নাল ভাই অনেক দিন তো হলো এবারে আমাদের ছেলের বউ টা হাতে তুলে দিন।*
রিজুয়ান শেখের কথায় শব্দ করে হেসে উঠলেন জয়নাল আহমেদ এবং সাজ্জাদুল আহমেদ দু’জনেই। সাজ্জাদুল আহমেদ আওড়ালো।
“আরে কী যে বলিস রিজুয়ান? ফারাহ তো তোদের-ই।”
জয়নাল আহমেদ একই সঙ্গে বললেন।
“হ্যা রিজুয়ান ফারাহ তো তোমাদের বাড়ির বউ।”
রুবেনা শেখ চাপা অভিমান দেখিয়ে বললেন।
“তার পরেও তো আরিফা আপা মেয়ে দিচ্ছেন না। এটা কি ঠিক?”
“না একদম ঠিক নয়।”
রুটি গুলো নিয়ে আসতে আসতে আওড়ালো আরিফা আহমেদ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এটা ঠিক নয় কিন্তু আরিফা আহমেদ, শায়লা আপা আপনি কিছু বলেন।”
শায়লা আহমেদ ঠোঁট টিপে হাসলেন।
জয়নাল আহমেদ এবারে বললেন।
“না আরিফা এবারে আর অপেক্ষা করানোর প্রয়োজন নেই। সামনের শুক্রবার তাহলে শুভ কাজ টা সেরে ফেলা উচিত।”
চোখ দুটো চকচক করে উঠলো রুবেনা শেখের। তাহলে কী শেষমেষ তার ছেলের বউ নিয়ে যেতে পারবে?
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো তাশফিন। জয়নাল আহমেদ নিজের কাছের চেয়ারে বসালো।
“এসো এসো বসো তাশফিন।”
গুটি গুটি পায়ে নিচে এলো ফারাহ। চোখাচোখি হয় দু’জনের। দৃষ্টি আড়াল করে ফারাহ, বাঁকা হাসি ফুটে উঠেছে ওষ্ঠোপুটে।
খাবার টেবিলে আসলো সবাই, ঝুমুর এসেছে সবে। তার পাশের খালি চেয়ারে বসেছে। নবীন কে দেখা মাত্র তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠলো ঝুমুর। ঠোঁট টিপে হাসলো নবীন। খাবারের পর্ব শুরু হয়,খেতে বসেছেন একে একে সবাই।স্নেহা বরাবরের মতো ফারাহর পাশে বসেছে।

“ললিতা খাচ্ছিস?”
চোখ পাকিয়ে তাকালো ফারাহ, ফিসফিস করে বলল।
“বান্ধবী ললিতা চুপচাপ খা, না হলে তোর পাদের কাহিনী আমি কিন্তু ভাইরাস করে দেব।”
“ভাইরাস কী রে?”
“ভাইরা’স মানে ভাই’রাল।”
মুখখানি চুপসে আমের আঁটি হয়ে গেল স্নেহার। সামনেই তো তার ক্রাশ সৌহার্দ্য বসে আছে, তাহলে এভাবে ফারাহ তার ইজ্জতের ফালুদা করে দিচ্ছে?
দাঁত কটমট করে তাকালো স্নেহা, রাগান্বিত স্বরে ফিসফিস করে বলল।
“দেখ আমি কিন্তু মা কে সব বলে দেব।”
বাঁকা হাসলো ফারাহ।
“বেশি বাড়াবাড়ি করলে মাইকিং করে আমি বিশ্ববাসীরে তোর পাদের কাহিনী বলমু হা হা হা।”
বেফাঁসে পড়ে গেল স্নেহা,না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে।
ফারাহ এবং স্নেহার গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর দেখছে কখন থেকে তাশফিন। বিরক্তের ন্যায় কপাল কুঁচকে নেয়। বউ কি এত কথা বলছে?তাকে দেখার বদলে?
চোখাচোখি হয় দু’জনের,ডান ভ্রু উঁচিয়ে শুধোয় তাশফিন।চোখের ভাষা বুঝলো না ফারাহ,হাত নাড়িয়ে চুপচাপ খেতে লাগল সে।

রোদের সোনালি আভা, নীরব অলসতা, আর একটা মিষ্টি প্রশান্তি।রোদ্দুর তখন ঠিক মাঝ আকাশে, চারপাশে সোনালি আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। বাতাস হয়তো একটু গরম, কিন্তু তার মাঝেও শান্তি।দুপুরের আকাশ কখনো নীলচে ঝকঝকে, কখনো আবার হালকা সাদা মেঘের চাদরে ঢাকা পড়েছে ।কখনো গ্রীষ্মের দুপুরে ঝড়ের আগমন বার্তা দেয় গুমোট হাওয়া বইছে।
সাইফুল ফিরছে দুদিনের মধ্যে। ডিরেক্ট কৃষ্ণপুর আসবে সে। বিছানায় শুয়ে আছে নূপুর, সঙ্গে আছে মাহির। ছেলেটা ঘুমাতে চায় না। যাও একটু এখন শুয়েছে।
“হ্যালো।”
“হ্যা মাই ডিয়ার ওয়াইফ বলো।”
সাইফুলের দুষ্টু কথা শুনে হাসলো নূপুর।
“এখন মনে পড়ল আপনার একটা ওয়াইফ আছে?”
পরণের কালো স্যুট খুলে পাশে রাখলো সাইফুল। বাড়িটা পুরো খালি,আপাতত সে একাই রয়েছে।তবে কিছুদিনের মধ্যেই কৃষ্ণপুরে যাবে তাশফিন এবং ফারাহর বিয়ে উপলক্ষে।
“জ্বি ম্যাডাম অবশ্যই মনে আছে। আমার একটা বউ আছে, একটা বাচ্চা আছে তো।”
সহসা হেসে ফেলল নূপুর।উঠে বসলো বিছানায়, হাত রাখলো মাহিরের মাথায়।

“কবে আসবে তুমি?”
সময়টা দেখে নিল সাইফুল, এগারোটা বাজে সবে। আজকে সে ফিরেছে রাজশাহী থেকে।দু রাত ঘুম হয়নি। এখন দিন এগারোটা,তাকে একটু হলেও ঘুমাতে হবে।
“পরশু আসছি কৃষ্ণপুরে।”
হতাশ হলো নূপুর, কিন্তু কি করার?তাকে তো অবশ্যই সবটা মেনে নিতে হবে।
“আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে পরশু সময় মতো চলে এসো কিন্তু।”
সাইফুল ছোট্ট করে বলল।
“হ্যা।”
ক্ষণকালের জন্য চললো নিরবতা। নূপুর জিজ্ঞেস করলো।
“খেয়েছো তুমি?”
“বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।আপাতত এখন ঘুমাবো।”
“ওহ্। তাহলে উঠে খেয়ে নিও।”
সাইফুল আর কথা বাড়ালো না। নূপুর ফোন রাখতেই উঠে গেল মাহির,চোখ কচ’লে কচ’লে তাকালো।
“এই না তুই ঘুমা লি?”

দাঁত বের করে হাসলো মাহির।চট করে উঠে বাইরে দৌড়ে গেল। নূপুর উঠে বাইরে গেল।জিপ গাড়িতে বসে ছিল তাশফিন, হঠাৎ গিয়ে “মামা মামা” বলে কোলে উঠে গেল মাহির।
“ইয়েস মাই বয় ঘুম শেষ?”
“আর ঘুম? মাত্র পনেরো মিনিট..
কথার পিঠে বলে উঠলো নূপুর।হাসলো তাশফিন,নাক টেনে দিল মাহফিলের।
“থাকুক নূপুর।তুই ভেতরে যা।”
নূপুর এবং তাশফিন পিঠাপিঠি বলতে বলতে।তাশফিন নূপুরের থেকে মাত্র দু বছরের বড়।
নূপুর ভেতরে গেল,তাশফিন মাহির কে জিপ গাড়িটার উপর ডেস্কে বসিয়ে দিলো।
“মামা ওই যে মামী।”
আঙ্গুল তুলে সেদিক পানে ইশারা করে দেখালো মাহির। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকলো তাশফিন,হলুদ রঙা কন্য। প্রথম দেখায় তো হলুদে সুখ কে দেখেছে তাশফিন। পায়ের নূপুর টা ছনছন শব্দ তুলছে, অধর বাঁকালো তাশফিন। নিজের দিকে তাকিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো।মাহির গাড়ির উপর থেকে নামার জন্য ছটপট করছে।তাশফিন তাকে নামিয়ে দিল,মাহির দৌড়ে গেল ফারাহর দিকে।ভারী ব্যাগ টা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ, হাতের ইশারায় নিজের দিকে ব্যাগ টা ছুঁড়ে দিতে বলল তাশফিন। ফারাহ তাই করলো, ব্যাগটা ছুড়ে দিল তার দিকে ক্যাচ করে ফেলল তাশফিন। মৃদু হাসলো সে,মাহির চট করে গিয়ে কোলে উঠে বসলো ফারাহর। গালে ঠোঁট ছোঁয়ায় ছোট্ট করে।হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে।

“বড় মামা তোমাকে দেয়নি,মামী কে দিছি পাপ্পি।”
গা দুলিয়ে হেসে উঠলো তাশফিন, ফারাহ পরপর চুমু খেলো মাহিরের।ফের হাসলো মাহির,তাশফিনের উদ্দেশ্যে আওড়ালো।
“মামা তোমাকে দেয়নি।”
এদিক সেদিক তাকালো তাশফিন, এগিয়ে এলো দু কদম।
“আমি দিলে কড়া একটা চুমু দেব আর নিলেও কড়া একটা চুমু নেব।”
তাশফিনের কথার অর্থ ধরতে পারেনি ছোট্ট মাহির,অথচ তা ঠিক বুঝতে পেরেছে ফারাহ।গা শিরশির করে উঠলো তার, নেত্র পল্লব কেঁপে উঠল ক্ষণে।নিচে নামিয়ে দিল ফারাহ মাহির কে, বিনা বাক্যব্যয়ে চুপচাপ গুটি গুটি পায়ে দালানের ভেতরে চলে গেল মাহির। ফারাহ যেতে চাইলো , অথচ তাশফিন তা হতে দেয়নি।হাতে হাত স্পর্শ করায় একটু খানি,টেনে সামনে দাঁড় করালো জিপ গাড়ির।নিজেও দাঁড়িয়েছে ফারাহর সামনে,অধর কোণে ঝুল’ছে ক্ষী’ণ হাসিটুকু।

“দেবে নাকি একটা কড়া চুমু সুখ।”
নাক কুঁচকে নেয় ফারাহ, মুখশ্রী জুড়ে কঠিন্য ভাব।
“উফ্ এত রাগো কেন সুখ। তোমার রাগ মানায় না তো।”
বুকে হাত গুজে দাঁড়ালো ফারাহ,হেলান দেয় গাড়ির সহিতে।
“আপনি এত খারাপ এটা আপনার ডিপার্টমেন্টের লোকজন জানে?”
হাসলো তাশফিন, এগিয়ে এলো কাছাকাছি। অনামিকা আঙ্গুলে আঙ্গুল ছোঁয়ায়, দৃষ্টি তার গোল গোল চোখের দিকে।চিকন নাকের ডগা ফুলে উঠছে, অতিরিক্ত শিহরণে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস টেনে নিচ্ছে ফারাহ। গভীর নয়ন বুলিয়ে নিচ্ছে তার আদল পানে। অনূভুতিয অতলে তলিয়ে যাচ্ছে ফারাহর সর্বাঙ্গ।
“অস’ভ্যতামো করার মতো কাউকে পাইনি তো সুখ।তবে এখন পেয়েছি তো তুমি ছাড়া কেউই জানে না আমি অস’ভ্য।”

কান দিয়ে রীতিমত গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে ফারাহর।
“নির্লজ্জ!”
“সে এগেইন।”
“আপনি দয়া করে সরুন তো।”
শিশিরভেজা ঘাসের ওপর চিকচিক করে ওঠে। উঠানের এক পাশে একটা পুরোনো আমগাছ দাঁড়িয়ে আছে ।যার ছায়ায় দাঁড়ানো জিপ গাড়ি টা। দালানের পিছন দিকে তুলসী গাছ রাখা হয়েছে ,আবার পিছনের তুলসী গাছের পরেই খড়ের গাদা এবং গরুর গোয়ালঘর।
হাতের স্লিভ গোটায় তাশফিন,এদিক সেদিক তাকালো সে।আকাশ আপাতত এখন পরিষ্কার, তাহলে ম্যাডামের সঙ্গে একটু দুষ্টুমি করা যাক!

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৪

“গাড়িতে উঠো।”
শুনতে পেলো না বোধহয় ফারাহ!
“কী?”
“বললাম গাড়িতে উঠো।”

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৬