তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৬

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৬
ফারহানা নিঝুম

দুপুরের কড়া রোদে চারপাশ ঝলমল করছে। বাতাস ভারী, যেন এক অদৃশ্য অলসতা সবকিছু ঢেকে রেখেছে। রাস্তায় খুব বেশি লোকজন নেই, গাছের পাতাগুলো নীরব, রোদে চকচক করছে।
এমন সময় ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলেছে একটা জিপ গাড়ি। গাড়িতে বসে আছে তাশফিন শেখ এবং ফারাহ।গরম বাতাসের মধ্যে তার ইঞ্জিনের গর্জন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কালো রঙের টায়ারগুলো পিচের রাস্তায় ঘ’র্ষণ সৃষ্টি করছে, মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাথর ছিটকে যাচ্ছে তার গতির চাপে। সুন্দর ফর্সা আদলে,চোখে চশমা পরে, পাশে বসে থাকা বাচ্চা বউ টা এক হাত দিয়ে জানালা ধরে রেখেছে। রোদ তার মুখে পড়ায় সে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বারংবার।
জিপের পিছনে ধুলোর কুয়াশা, পেছনে পড়ে থাকা পথ যেন সেই গাড়ির ছুটে যাওয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। দুপুরের নীরবতার মধ্যে একমাত্র সেই জিপের শব্দই যেন প্রাণ এনে দিচ্ছে চারপাশে। গাড়ি কোন গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে, নাকি শুধু পথ চলাই তার উদ্দেশ্য—কে জানে! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ফারাহ,তাশফিনের অভিব্যক্তি বোঝা দায়।

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
উত্তর এলো না,দক্ষ হাতে ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করছে তাশফিন।অন্য হাতে চোখের সানগ্লাস খুলে বুক পকেটে গুঁজে রাখলো।
“হানিমুনে যাচ্ছি।”
বেফাঁস কথা বার্তা শুনে আহাম্মক বনে গেল ফারাহ, তাকিয়ে রইল একই ভাবে। শব্দ করে হেসে উঠলো তাশফিন।
“মিসেস তাশফিন শেখ আপনি কি আমার সঙ্গে হানিমুনে যেতে চান না?”
চুপটি করে বসে রইল ফারাহ।হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চাইলো তার, ইস্ এটা যদি অন্য কেউ হতো তাহলে সে নাকানিচোবানি খাওয়াতো।
“কী হলো মিসেস তাশফিন শেখ বলুন,যাবেন না হানিমুনে?”
রাগলো ফারাহ,কাট কাট কন্ঠে বলল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এই লজ্জা করে না আপনার এসব বলতে? আমি একটা বাচ্চা মেয়ে। আমার সামনে এসব বলছেন আল্লাহর ঠাডা পড়বে আপনার উপর। আমি কিন্তু খুব ধার্মিক বলে দিচ্ছি, ইমানদার বলতে পারেন।বাই এনি চান্স অভি’শা’প দিয়ে দিলে সত্যি সত্যি ঠাডা পড়বে!”
সজোরে ব্র্যাক ক’ষে তাশফিন, দৃষ্টি হলো তার তী’ক্ষ্ণ। চঞ্চল অধর দুটি স্থির হলো, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে সে।ভুল জায়গায় ভুল কথা গুলো বলে ফেলল বোধহয়।
“কী বললে?”
মুখাবয়ব জুড়ে গাম্ভীর্য ভাব, ফাঁকা ঢোক গিললো ফারাহ।আমতা আমতা করে বলল।
“কিছু বলিনি আল্লাহর কসম মুখ ফস’কে বেরিয়ে গেছে।”
কাঙ্ক্ষিত রমণী কে এভাবে নির্জনে একাকি পেয়ে কী করা উচিত? লেফটেন্যান্টের মাথায় ঘুরছে এক দুষ্টু ইচ্ছেরা।যা ক্ষণে ক্ষণে জেঁ’কে বসেছে মস্তিষ্কে। শুকিয়ে আসা ওষ্ঠো পুট আলতো করে ভিজিয়ে নিল সে। দৃষ্টি তার সামনের মেয়েটির থুতনিতে থাকা তিল টার দিকে।তাশফিন আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো।
“একটা চুমু খাই?”

কঠিন আবদার,রাখা বড়োই দায়। নিজেকে সংযত করা প্রয়োজন।বাজে পুরুষ কে তো মজা দেখাতে হবে!সে যে এই কন্যা কে ফেলে গেছিল?
কিছুটা রুঢ় কন্ঠে বলল।
“কখনো না। খারাপ মানুষ,বাজে পুরুষ। আমি বাসায় গিয়ে সব বলে দেব… আহ্..
ব্যথাতুর কন্ঠে মৃদু স্বরে আ’র্ত’নাদ করে উঠে ফারাহ। লম্বা চুল গুলো টেনে ধরেছে তাশফিন, ক্ষুধিত মুখে আওড়ালো, কিছুটা দাঁত পিষে।
“এই তোর উচিত ছিলো না আমাকে ফোন করা? যেহেতু আমার বউ সেই হিসেবে আমার বাড়িতে থাকা উচিত ছিলো। আমাকে মানানো উচিত ছিলো, আমি কী আগে তোর এই পবিত্র, নিষ্পাপ মুখ দেখেছি?কী করে জানতাম তুই আমার বউ?”

হো হো করে কেঁদে উঠলো ফারাহ, ব্যথা পেলো মেয়েটা?নাকি ভয়!তাশফিন রাগে গজগজ করে ফের বলল।
“আমি নির্দ’য়,পা’ষাণ তাই ফেলে চলে গেছি। কিন্তু তোর দায়িত্ব ছিলো বউয়ের সব দায়িত্ব পালন করা। উচিত ছিলো ফিরিয়ে আনা।এই আমার দিকে তাকা, আমি এক বছর তোকে মিস করে ফেললাম। তোকে দেখাটা মিস করে ফেললাম। ফিরিয়ে দে এক বছর, দীর্ঘ বারোটা মাস। মানে বুঝিস?তিনশো পঁয়ষট্টি দিন !ও গড কত গুলো দিন।”
কান্নারা দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসছে ফারাহর।দোষটা কি তার?লোকটা এতটা ভয়ং’কর?ভয়ে শিউরে উঠে ফারাহ।রাগে দুঃখে ব্যথিত কন্ঠে বলল।

“সব দোষ কি আমার? আপনি চলে গিয়েছিলেন। আমি কি আপনাকে চিনি.. আপনি… আপনি তো আমাকে দেখেন নি পর্যন্ত। তাহলে কী করে আপনার সম্পর্কে জানবো?কী করে অপরিচিত একজন কে ফোন করব? আপনি আসলে আপনি না খুব খুব খারাপ, আমি আপনাকে বিয়ে… আহ্..
কপোলদয় লালচে আভায় ছড়িয়ে পড়েছে! বলিষ্ঠ হাতের আঙ্গুল গুলো চেপে ধরেছে তাকে, হেঁচকি উঠে গেল মেয়েটার।
“নেক্সট টাইম যদি আর একবার বলা হয় বিয়ে করব না তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না,আই রিপিট আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
ধুলো উড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে জিপ গাড়ি। কোনো গন্তব্য ছিলো না,তবে এখন গন্তব্য হচ্ছে বাড়ির পথ। চুপচাপ সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে ফারাহ,মাঝে মাঝে হেঁচকির শব্দ শুনতে পাচ্ছে পাশের যুবকটি।অধর বাঁকিয়ে হাসলো সে,গাড়ি ডান দিকে ঘুরিয়ে বলল।

“আই উইল ট্রাই টু মেইক ইউ ক্রাই এগেইন অ্যান্ড এগেইন।কারণ তোমাকে কাঁদলে দারুণ লাগে সুখ।”
থমকালো ফারাহ, চকিতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালো তাশফিনের মুখ পানে।সে হাসছে, চমৎকার সেই হাসি।
“এভাবে তাকিয়ে থেকো না সুখ, আমি নিষিদ্ধ কিছু করে বসব কিন্তু।”
“আপনার মতো বাজে মানুষ আমি জীবনেও দেখি নাই।”
“তাহলে দেখে নাও, আমি একটাই। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ কিন্তু একটাই।”
নাক কুঁচকে নিল ফারাহ, মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো আকাশ পানে, আকাশ টা বুঝি তার দুঃখে কাঁদবে?

নিকষ কালো রাত। চারিদিক ভয়ানক নীরবতায় আচ্ছন্ন। গভীর অন্ধকারে ডুবে গেছে পৃথিবী। বাতাসও যেন থমকে গেছে, গাছে পাতাগুলো নড়ছে না। দূরে গাছে বসে থাকা রাতের পেঁচার ডাক ভেসে আসছে, যেন এই অন্ধকারের সাক্ষী।ধীরে ধীরে রাতের আঁধার ভাঙতে শুরু করেছে ।আকাশের পূর্ব প্রান্তে প্রথম আলো ফুটে ওঠলো বোধহয় ।কালো মেঘগুলো হালকা গোলাপি আর কমলা রঙে রাঙিয়ে তুলেছে।। পাখিরা একে একে ডানা ঝাপটাতে শুরু করেছে, তাদের কিচিরমিচির শব্দে প্রাণ ফিরে আসে চারপাশে।
সূর্যের প্রথম রশ্মি আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে ইতিমধ্যেই।অন্ধকারের চাদর সরে গিয়ে পৃথিবী আলোর স্পর্শ পেলো ।গাছের পাতাগুলো যেন প্রাণ ফিরে পায় যেন,শিশিরবিন্দু ঝকমক করে ওঠে। রাতের সেই ভয়ংকর পরিবেশ যেন কখনো ছিলই না। নতুন সকাল শুরু হয়, আশার আলো নিয়ে।বাড়ি শোধ্য লোক ব্যস্ত আছে কাজে, বিয়ে বাড়ি মানেই কাজের হাট বসে।

আজকে ফারাহর আংটি বদল,তাশফিন আর ফারাহর এই অনুষ্ঠান করতে উঠেপড়ে লেগেছেন রুবেনা শেখ,ছেলের বিয়ে বলে কথা।একটা কিছু কমতি দিবেন না তিনি।বাড়ি সাজানো হয়েছে সেই কখন, অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেলের দিকে।
বিছানায় এত গুলো ড্রেস,শাড়ি জুয়েলারি রাখা।স্নেহা একের পর এক জুয়েলারি ড্রেস দেখছে। আয়নার সামনে বসে আছে ফারাহ, ভীষণ মন খারাপ তার। প্রথম তার ফ্যামিলি ছেড়ে চলে যাবে সে, দ্বিতীয়ত তাশফিন বড্ড রাগী। সেটা তো সকালেই দেখেছে সে।মনের মধ্যে এক আকাশ সম অভিমান নিয়ে বসে রয়েছে ফারাহ,ঢোক গিললো ফারাহ সুপ্ত ভালোবাসাটুকু পরিপূর্ণতা পাবার পূর্বেই তা নিমিষেই কর্পূরের ন্যায় উবে গেল!

“ফারাহ রেএএ এই দেখ এই ড্রেসটা আমাকে কত মানাবে তাই না?”
পাকিস্তানি একটা ড্রেস সামনে ধরে স্নেহা,হলুদ রঙের তা। ভীষণ ভালো লাগছে তাকে, অথচ একবারের জন্যও মুখ ফেরায়নি ফারাহ।অবাক হলো স্নেহা, এগিয়ে গেল ফারাহর দিকে।
“কী রে কি হয়েছে তোর?”
“কিছু না।”
ছোট্ট করে জবাব দিল ফারাহ,ভ্রু উঁচিয়ে শুধোয় স্নেহা।
“তাই নাকি? তাহলে এরকম মুখ বাঁকিয়ে রেখেছিস কেন?এই তোর বিয়ে তোর জন্য এত অনুষ্ঠান আর তুই নাকি এরকম চুপচাপ?”
“আসলে..

কারো পদধ্বনি কর্ণ স্পর্শ করলো দু’জনের, আয়নায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তাশফিনের মুখাবয়ব।
“আরে ভাইয়া আপনি..
ভেতরে প্রবেশ করলো তাশফিন, দৃষ্টি তার সামনের কন্যার দিকে। মৃদু স্বরে বলল।
“আমার কিছু কথা আছে।”
ঠোঁট টিপে শব্দ বিহিন হাসলো স্নেহা।
“আচ্ছা আপনারা কথা বলুন আমি এখুনি আসছি।”
বাইরের দিকে পা বাড়ায় স্নেহা, যাওয়ার পূর্বে দরজাটা টেনে দিয়ে গেল খানিকটা।

দৃষ্টি মিলে দুজনার,তবে তা ক্ষণিকের জন্য। নত মস্তকে বসে রইল ফারাহ,বাক্য নেই অধর দু’টো স্থির তার। কিঞ্চিৎ ভয় ঝে কে ধরেছে তাকে। চুপচাপ রইলো সে।পা জোড়া এগিয়ে এলো, মেয়েটা আন্দাজ করতে পেরেছে যুবক তার অতিব নিকটে রয়েছে।বসলো পাশে, ছোটখাটো শরীরের মেয়েটার দিকে তাকালো।
“লিসেন ফারাহ এতটা প্যানিক করার কিছু নেই।আই নো আমি রাগী বাট তা শুধু ক্ষণিকের জন্য। তুমি চাইলেই আমার রাগ পানি করতে পারো তাও তা এক মূহুর্তের মধ্যে ততটা ক্ষমতা তোমার আছে।”
কপালে পড়ল ভাঁজ, অদ্ভুত নয়নে তাকালো তাশফিন। দৃষ্টি ফেরায় ফারাহ,এই লোকটার রাগ সে পানি করবে?
“আপনি রুম থেকে চলে যান, না গেলে লাথি দিয়া নেটওয়ার্কের বাইরে ফেলে দিমু।”
সশব্দে হেসে উঠলো তাশফিন,উঠে দাঁড়ালো তৎক্ষণাৎ।পিছন থেকে হাত সামনে এনে সা’পের মতো গলা পেঁ’চিয়ে ধরে মেয়েটার।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৫

“কোনো একদিন, আঁধারে ডুবে থাকা রজনীতে। একাকী আমার বাহু তলে পিষ্ট হবে।সে খেয়াল রেখো মেয়ে,তার জন্যে শক্তি প্রয়োজন তোমার।এখন এই লাথিতে শক্তি অপচয় না করৈ স’ঞ্চয় করে রাখো।”
লজ্জায় রাঙা হলো মুখশ্রী, ধুকপুক শব্দটি প্রগাঢ় হলো। ফের দৃষ্টি হলো নত ফারাহর,তবে কমলো না তার রাগ।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৭