তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৮

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৮
ফারহানা নিঝুম

সন্ধ্যা নেমে এলে আকাশে লাল-কমলা আভা ছড়িয়ে পড়েছে।বাতাসে রয়েছে এক ধরনের মিষ্টি শীতলতা, চারপাশের কোলাহল ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এসেছে। দূর থেকে ভেসে আসে আজানের সুর, পাশের গাছ থেকে টুপটাপ করে পাতা ঝরে পড়েছে।
রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো একে একে জ্বলে উঠছে, আর নরম আলোয় চারপাশের পরিবেশ হয়ে উঠছে মোহনীয়। সামনের বারান্দায় টিমটিম করে জ্বলছে হলুদ আলো।
❝হলুদ সন্ধ্যা।❞

গায়ে হলুদের দিন ফারাহ নামক মেয়েটাকে দেখে যেন মনে হয়, ও নিজেই একটা হলুদ রঙের ফুল! চারপাশ আলো করে রেখেছে ওর উজ্জ্বল হাসি। গাঢ় হলুদের শাড়িতে, খোঁপায় গুঁজে রাখা গাঁদা আর রজনীগন্ধার মালায়, কপালে ছোট্ট টিপ আর হাতে মেহেদির নকশায় সে একেবারে যেন বসন্তের রানি।
পরিবারের সবার হাসি-আনন্দে বাড়িটা মুখরিত। গানের তালে তালে সবার নাচ, খিলখিল হাসির শব্দ, আর মেয়েটার ওপর একে একে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে তার আপনজনেরা। কেউ গালে আলতো করে হলুদ ছুঁইয়ে দিচ্ছে, কেউ হাতে, কেউ বা পায়ে। হলুদের গন্ধে, ফুলের সৌরভে আর কাঁচা চন্দনের শীতলতায় সে মুহূর্ত যেন জাদুর মতো।
চারপাশে ঝুলছে রঙিন পর্দা, ফানুস, আর fairy lights-এর ঝলক। মাটিতে বিছানো গোলাপ, গাঁদা আর বেলির পাপড়ি—সবকিছু মিলিয়ে এক স্বপ্নময় পরিবেশ। বন্ধু-বান্ধবীরা ওকে ঘিরে বসে মজার গল্পে মেতে উঠেছে, কেউ কেউ মেহেদি আঁকছে হাতে, কেউবা কনের জন্য গানের লিরিক ঠিক করছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফারাহ খানিকটা লজ্জায় নত হয় মস্তক।
হলুদ রঙা ফতুয়া পড়েছে তাশফিন, বন্ধু মহল এসেছে তার, আড্ডায় ম’ত্ত হয়েছে সে।
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রাইয়ান কাঁধে হাত রাখল তার।
“ব্রো ফাইনালি বিয়ে টা করেই ফেলছিস?”
নিম্নাষ্ট কাম’ড়ে হাসলো তাশফিন। আকস্মিক সুয়েজ ব্যস্ত কন্ঠে বলল।
“ভাই ভাই একটা কথা মনে রাখিস ভাবী কিন্তু আমাদের ছোট হ্যা! সেটা ভুলে গিয়ে নিজের পু… শক্তি দেখাতে যাস না!”
কপাল কুঁচকে এলো তাশফিনের, দাঁত পিষে বলে।
“আবে শা’লা চুপ কর,আগে নিজের অতীত মনে কর।ভাবী কে হসপিটালে পাঠিয়েছিলি ভুলে গেছিস?”
মুখখানি চুপসে গেল সুয়েজের, হো হো করে হেসে উঠলো রাইয়ান, মনসুর আর তাশফিন।
ব্যথিত কন্ঠে বলে উঠে মনসুর।

“কপাল টা কি আমার ফুটো? একটা বিয়া হইলো না।তাশফিন তোর একটা শা’লীকা আমাকে দিয়ে দে ভাই।”
সহসা হেসে ফেলল রাইয়ান।
“হ্যা তাশফিন আমাদের মনসুরের একটা ব্যবস্থা করে দে।”
“শা’লীকা বলতে স্নেহা ব্যতিত কেউ নেই,আর ও তো ছোট মানুষ তুই সামলাতে পারবি না।”
ভাবলেশহীন জবাব তাশফিনের,মন ভেঙ্গে গেল মনসুরের।
“শ’য়তা’ন ছেলে,তুই জানিস আমি সামলাতে পারব কিনা?”
তাশফিন বাঁকা হাসলো, এগিয়ে গিয়ে মনসুরের কানে কি যেন একটা বললো। থতমত খেয়ে গেল মনসুর।ভ্রু কুঁচকে নেয় বাকিরা। রাইয়ান প্রতিবাদ করলো।
“এই কি বললি তুই ওকে তাশফিন? আমাদের বল।”
সুয়েজ একই টুনে বলে।
“হ্যা হ্যা আমাদের বল।”
তাশফিন এমন কিছু বলল যা শুনে উপস্থিত সবাই থমকে গেল, লজ্জায় হা হয়ে গেল মনসুর।সুয়েজ বিস্ময় নিয়ে বলল।

“ভাই তুই যে এত নির্লজ্জ এটা কি ভাবি জানে?”
ফিচলে হাসে তাশফিন,সুয়েজ ফের বললো।
“ভাই বিবাহিত হয়েও কখনো এটা করার কথা ভাবিনি আর না বউ কে বলেছি।আর তুই কিনা…
রাইয়ান ফট করে বলল।
“তাশফিন হচ্ছে আসল খেলোয়াড় ব্রো।”
মনসুর হতাশ,কি বলার নেই তার। কষ্টে বুকটা ফা টে তার।
বেশ ভাব নিয়ে চুল গুলো কে ব্যাকব্রাশ করলো তাশফিন।পাশ কাটিয়ে চলে গেল স্ট্যাজের দিকে।যেতে যেতে আওড়ালো।
“তাশফিন শেখ একটাই,এক পিস কিন্তু!”

হলুদ দেওয়া সম্পূর্ণ হলো সবে, ঝুমুর নিজ দায়িত্বে ফারাহ কে নিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হয়। চুপচাপ হাঁটছে ফারাহ, ঝুমুর অনেকক্ষণ ধরে কিছু একটা বলতে গিয়েও পারছে না। আইঢাই করে শেষমেষ বলেই ফেলল।
“আচ্ছা তুমি তো এত ছোট মাত্র সতেরো বছর বয়স,সবে কলেজে উঠেছো তাহলে কেন বিয়ে করছো?আই মিন আমার ভাই কে কেন?সে তো তোমার থেকে বড়,একটু না অনেকটাই বড়!”
ঝুমুরের কথার উত্তরে কিছু বলতে পারছে না ফারাহ, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে।বলবেই বা কী? আচ্ছা সত্যি তো সে কেন বিয়ে করছে?
“মানলাম যখন ফ্যামিলি বলেছিল এক বছর আগে বিয়ে করতে তখন না হয় তুমি একটু বেশি ছোট ছিলে, কিন্তু এখন? তুমি তো মডার্ন যুগের মেয়ে তাহলে কেন বিয়ে করছো?”
এদিক সেদিক তাকাচ্ছে ফারাহ, ঝুমুর এত কঠোর কেন?তার ব্যবহার গুলো কঠিন মনে হচ্ছে। প্রশ্ন গুলো তার চেয়েও কঠিন।

“কী হলো উত্তর দাও,কেন করছো বিয়ে? উত্তর দিবে কিনা?”
ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে দিল ফারাহ। আহা’ম্মক বনে গেল ঝুমুর।
“এই তুমি কাঁদছো কেন?আরেহ থামো।”
থামাতে ব্যর্থ ঝুমুর।সে তো একটু মজা করতে চেয়েছিল বাচ্চা ভাবির সঙ্গে, অথচ মেয়েটা এতটাই বাচ্চা যে এই সামান্য ব্যাপারে কেঁদে দিয়েছে! আগমন ঘটে তাশফিনের, সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে এলো সে।
“কী হয়েছে?”
দৃষ্টি গেল ফারাহর দিকে, মেয়েটা নাক টানছে।টুপ টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আঁখিদয় ছোট হয়ে এলো তাশফিনের, চোয়াল হয় শক্ত। ঝুমুর কে উদ্দেশ্য করে শুধোয়।
“কী হয়েছে ওর? এভাবে কাঁদছে কেন?”
দাঁত বের করে হেসে ফেললো ঝুমুর।
“তোমার বাচ্চা বউ কে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম, বেচারি আমার ভয়ে কেঁদে দিয়েছে।”
সহসা হেসে ফেলল তাশফিন।বোন তার দুষ্টু, বরাবরই এমন ভাবে কথা বলবে মাঝে মাঝে বড়রাও কনফিউজড হবে।এবারে হলো তার নাবালিকা বউটা।

“তুই কি ভালো হবি না ঝুমুর?”
মুখ বাঁকালো ঝুমুর।
“ওকে ভাইয়া আমি আর কিছু বলছি না।বাই দ্যা ওয়ে ছোট ভাবি শুনো আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম। আচ্ছা ভাইয়া তুমি তোমার বউ কে রুমে দিয়ে এসো।”
পা বাড়ায় ঝুমুর, তৎক্ষণাৎ থামে ফের।পিছন ঘুরে তাশফিনের উদ্দেশ্যে আওড়ালো।
“আর হ্যাঁ রুমেই দিয়ে এসো উল্টো পাল্টা কিছু করো না আবার।”
কপাল মৃদু কুঁচকে নেয় তাশফিন।
“ওই তুই দাঁড়া।”
ঝুমুর কে আর পায় কে, সে গুটি গুটি পায়ে স্থান ত্যাগ করলো।বড় ভাই মানেই আবদারের জায়গা।বাবা কোনো কিছুতে না করলে ভাই বা বোন তো আছেই তার। আনন্দে নাচতে নাচতে চলে গেল ঝুমুর।
ঝুমুর যাওয়া মাত্র সম্পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো ফারাহর আদলে। মেয়েটার নাজুক অবস্থা, কেঁদে কে’টে একাকার অবস্থা।
বিরক্ত হলো তাশফিন,টেনে ধরে তার চুলের একাংশ। ব্যথিত কন্ঠে চেঁচায় ফারাহ।

“আমি ব্যথা পাচ্ছি লেফটেন্যান্ট সাহেব।”
“পাওয়াই উচিত,এমন ছিঁচকাদুনে কেন তুমি? কথায় কথায় কাঁদে।”
চিকন নাকের ডগা ফুলে উঠে ফারাহর,রাগলো বোধহয় সে। গডগড শব্দ করে রুমের দিকে অগ্রসর হয়,পিছু নেয় তাশফিন। প্রেয়সীর অভিমান তো কমাতে হবে,মন আঙিনায় অভিমানের পাহাড় তৈরি হয়েছে। তীব্র বুক ধড়ফড়ানি নিয়ে এগিয়ে গেল সেদিক পানে।
“শ’য়তা’ন কমান্ডার,এক নাম্বার দুষ্টু।তাকে যখন তখন বকছে! এই লোকটাকে তো লাথি দিয়া নেটওয়ার্কের বাইরে ফেলে দেওয়া উচিত। না না মঙ্গল গ্রহে পাঠানো উচিত,যাতে এলিয়েনের কাজ থেকে শিখে আসতে পারে কিভাবে বউ আদর করতে হয়।”

কথা গুলো রয়ে গেল কন্ঠনালিতে। বক্ত করেনি একটি শব্দও।
“ওই দাঁড়াও।”
“আসবেন না আমার পিছু পিছু, ফাজিল লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। আপনার সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক দি এন্ড।”
হেসে ফেলল তাশফিন। এটা কোনো কথা?বউ কে বড় করতে হবে তার।
“ওই দাঁড়াতে বলছি।”
নাক টানে ফারাহ, কান্নারত স্বরে বলল।
“আমি আম্মা কে ডাকব,যান আপনি ‌।”
টুপ করে রুমে ঢুকে গেল, দরজা আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে। প্রবেশ করলো তাশফিন,অধর পিঠে দেখা দিলো দুষ্টু হাসি।
“আব তুমারি ক্যে হো গি বেইবি।”
“ভুলভাল হিন্দি বলা বন্ধ করেন আর আমার ঘর থেকে যান পঁচা মানুষ।”
“এভাবে বলে না তো সুখ।”

দুষ্টুমি সহিত বলল তাশফিন,রাগ লাগছে ফারাহর। লোকটা মজা নিচ্ছে তার।থাকবে না সে রুমে ধ্যাত!
বেরিয়ে যেতে নিল বাইরে,তবে তা সম্ভব হলো কই? কনুইয়ে টান পড়লো, আটকা পড়ে বাঁধনে।
কক্ষটি ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত, শুধু জানালার ফাঁক গলে আসা চাঁদের আবছা আলো মেঝেতে সোনালি রেখা এঁকে দিয়েছে। বাতাসে একধরনের নরম উষ্ণতা, যেন নিঃশ্বাস আর হৃদস্পন্দনের সুর মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব সঙ্গীত রচনা করছে।একজোড়া মানব-মানবী,একে অপরের খুব কাছাকাছি, আলিঙ্গনে আবদ্ধ।আরো এগিয়ে এলো পরস্পরের খুব কাছে। ছায়ার আড়ালে তাদের মুখ স্পষ্ট নয়, কিন্তু অনুভূতির ভাষা এতটাই গভীর যে আলো দৃশ্যের প্রয়োজন পড়ে না। ফারাহ নামক মেয়েটি মৃদু কাঁপছে, হয়তো শীত, উঁহু তা বোধহয় আবেগের দোলা। তাশফিন ধীর লয়ে তার আঙুলে আঙুল জড়িয়ে ধরে, নিঃশব্দ মুহূর্তের মাঝেও একধরনের গুঞ্জন হৃদয়ের কথা হৃদয় বোঝে। ফারাহ মাথা তাশফিনের কাঁধে হেলে পড়ে, চোখ বুজে সে অনুভব করে তার হৃদস্পন্দন। তাশফিন তার চুলে আলতো ছোঁয়া দেয়, যেন অন্ধকারের মধ্যেও মায়ার আলো ছড়িয়ে দিতে চায়।তাশফিন নড়ে উঠে, স্পর্শ করে গালে গাল।হলুদ রঙা কপোল আরো হলদেটে আবরণে রাঙিয়ে তুলে।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৭

❝হলুদ রঙে রাঙিয়ে দিলাম,
তোমার স্পর্শে সোনালি সন্ধ্যা সাজিয়ে নিলাম।
ভালোবেসে বন্দি বানালাম,
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পেলাম ❞

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৯