তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩
ফারহানা নিঝুম
বারান্দায় বরই গুলো বড় ডালায় টিপে টিপে ফা’টিয়ে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন রুবেনা শেখ।গরম চলে আসতে খুব একটা বাকি নেই তাই তো আগে থেকেই আচার বানিয়ে রাখতে চাচ্ছেন।আচার গুলো গরমে খেতে ভালোই লাগে।বড় আরেকটা ডালা নিয়ে ছাদে উঠে এলো নূপুর শেখ।
“এই নাও মা বড় থালার বরই গুলো।”
আদরের ছোট মেয়ে নূপুর শেখ। ভাগ্যক্রমে স্বামীর নামেও শেখ রয়েছে। স্বামী সাইফুল শেখ। নূপুর এবং সাইফুল দু’জনেই শেখ বাড়িতে থাকে। সাইফুলের আপন বলতে কেউ নেই।একটি ফ্ল্যাটে আলাদা ভাবে থাকতো সে, রুবেনা শেখ নিজে পছন্দ করেছে সাইফুল কে। অতঃপর আয়োজন করে বিয়ে। বিয়ের পর একটা ছোট্ট ছেলে হয় তাদের। ছেলেকে নিয়ে ফ্ল্যাটে সারাদিন একা থাকতে হয় নূপুর কে। মাঝে মধ্যে সাইফুল কাজের সূত্রে বাইরে যাওয়া আসা লেগেই থাকে ।ছেলে মাহিন কে নিয়ে একা থাকতে পারে না নূপুর।রুবেনা নাতনি কে ভীষণ ভাবে মিস করেন অতঃপর আর থাকতে না পেরে সাইফুল শেখ কে জোরপূর্বক শেখ বাড়িতে নিয়ে আসে।
মাহিন ফুটবল নিয়ে খেলা করতে ব্যস্ত। নূপুর মায়ের পাশে বসলো।রুবেনা শেখের দেবর আলাফ শেখ আপাতত বাড়িতে নেই। ওনার স্ত্রী রাইমা শেখ রান্না ঘরে আছেন।
“আম্মু ভাইয়া সকালে ফোন করছিল কথা বললা না যে!”
মুখ কুঁচকে নিলেন রুবেনা শেখ।তাশফিনের সঙ্গে কথা বলে না তিনি আজ একটি বছর হলো।সেই যে ছেলেটা গিয়েছে এরপর ফিরেনি।আজকে যদি বিয়েটা মেনে নিতো তাহলে তো মাহিনের মতোই একটা বাচ্চা থাকতো। ছেলে যেমন জেদি তার মা-ও তেমন।
“ওর কথা একদম বলবি না নূপুর। সেদিন কি করছিল ভুলে গেছিস নাকি?”
হেসে ফেলল নূপুর।
“আম্মু এই জন্য তুমি ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলবে না?দিব্যি তো সৌহার্দ্য ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলো!”
চুপ রইলেন রুবেনা শেখ।
“ঝুমুর কোথায়?”
“ঝুমুর কলেজে গেছে।”
ঝুমুর, নূপুর এবং তাশফিন ভাই বোন। সৌহার্দ্য দেবরের বড় ছেলে। তাদের একটাই ছেলে।
ফোনের টুং শব্দ হওয়া মাত্র গামছায় হাত মুছে নিল নূপুর।চোখ দুটো তার চকচক করে উঠে।
“নেও এসে গেছে আবার ফোন।এই নাও কথা বলো!”
মুখ বাঁকিয়ে নেন রুবেনা শেখ। মায়ের বাচ্চামো দেখে আবারো হেসে ফেলল নূপুর।
“হ্যালো ভাইয়া। ভাইয়া কেমন আছো?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তাশফিন গাড়িতে,গাড়ি চলেছে আপন গতিতে। জঙ্গলের পথে রওনা হয়েছে তারা। সঙ্গে রয়েছে আরো কিছু কমান্ড রা। বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির পথে বেরিয়ে তাশফিন। মৃদু হেসে বলল।
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি,তুই কেমন আছিস?আর মাহিন কোথায়?”
“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাইয়া। মাহিন খেলছে।এই মাহিন মামার সাথে কথা বলবি না?”
মাহিন ছুটে এলো বলটা ফেলে।ছোট হাতে কানে ধরে ফোনটা।
“হ্যালো বড় মামা কেমন আছো তুমি?”আধো আধো কন্ঠস্বর শুনে প্রশান্তি পেলো তাশফিন।
“আমি ভালো মামা তুমি কেমন আছো?”
“আমি অনেক ভালো।মামা মামা তোমার বোন আমাকে সবসময় বকে!”
নিজের নামে ভাইয়ের কাছে নালিশ করছে তাও আবার নিজের পেটের সন্তান? থতমত খেয়ে গেল নূপুর।।তাশফিন চমৎকার হাসলো।
“আচ্ছা মামু আমি বাড়িতে আসলে তোমার আম্মু কে বকে দেব।”
কান মলে দিল নূপুর।গাল ফুলিয়ে ফেলে মাহিন, আবারো একই সঙ্গে বলল।
“মামা আমাকে মা’রছে তো!”
“তুমি আম্মু কে ফোন দাও তো আমি বকা দিচ্ছি।”
চোখে মুখে আনন্দের ছড়াছড়ি মাহিনের। পাঁচ বছরের ছোট ছেলেটা মাহিন।
“হ্যা ভাইয়া বলো।”
তাশফিন ধমকের সুরে বলে।
“এই একদম তুই মাহিন কে কিছু বলবি না নূপুর!”
“আমি কী বললাম ভাইয়া?ও তো সারাদিন..
“চুপ কর আমি ওর সম্পর্কে একটা কথাও শুনতে চাই না।”
বিষন্নতা ছেয়ে গেল নূপুরের মুখাবয়ব জুড়ে।
“নূপুর?”
“জ্বি।”
“আম্মু কোথায়?”
“পাশে বসে কথা শুনছে।”
“ওনাকে ফোন দে।”
নূপুর ফোন এগিয়ে দিল রুবেনা শেখের দিকে। তিনি কথা বলতে চান না, তারপরেও জোরপূর্বক ফোন দিলো নূপুর।
“কী হুঁ?”
হেসে ফেলল তাশফিন। মায়ের অভিমানী কন্ঠস্বরে।ছেলে ফোড়ন কে টে বলল।
“কী ব্যাপার ম্যাডাম আপনার কন্ঠস্বর এমন কেনো?”
“একদম ন্যাকামি করে কথা বলবি না তাশফিন!”
মায়ের রাগে মিশ্রিত কথা গুলো শুনে হেসে ফেলল তাশফিন।
“আপনার হাসব্যান্ড কী আপনাকে কিছু বলছে নাকি? এতটা রাগ করছেন কেন?”
তেতে উঠলেন রুবেনা শেখ।
“তোর মতো না তোর বাপ।তুই যে কেন এমন আল্লাহ মালুম।একে তো নিজের বউ কে ফেলে চলে গেলি এখন আবার মস্করা করছিস আমার সঙ্গে?”
বিয়ে করা নববধূ কে ফেলে আসা স্মৃতি গুলো মস্তিষ্ক নাড়া দেয়। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাশফিনের।রাগলো সে, তবে তা সংযত করতে হবে এই মূহুর্তে।
“এটা কি আমার দোষ আম্মু? তুমি বললে বিয়ে করতে করলাম বিয়ে। এখন যে সংসার করতে হবে এটা তো বলোনি!”
রুবেনা শেখ দাঁতে দাঁত পি’ষলেন।
“একবছর ধরে বাড়ি ফিরলি না।যদি ফিরতি সংসার টা যদি করতি তাহলে আজকে মাহিনের মতো তোর একটা বাচ্চা থাকতো।”
মায়ের কথায় চুপ থাকতে পারলো না তাশফিন, সশব্দে হেসে ফেলল।
“তুমি আর বদলাবে না আম্মু।”
রুবেনা শেখ কিছু বলতে নিবেন তার পূর্বেই তাশফিন ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠে।
“আম্মু ফোন রাখছি কেমন!পরে কথা হবে।”
চট করে ফোন রেখে দিল তাশফিন।রুবেনা শেখ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন। বিড়বিড় করে বললেন।
“ওর আবার কী হলো?”
হলুদ রঙা শাড়ি। হাতে পায়ে হলুদ রঙের বাহারী চুড়ি এবং কানের পিঠে গুঁজে নিয়েছে অলকানন্দা ফুল।
নিজেকে আয়নায় দেখে মুচকি হাসলো ফারাহ।বাধাই করে লজ্জা মাখা মুখশ্রী নিয়ে বলল।
“ওরে ফারাহ এ রূপে তুই বাইরে গেলে তো সবাই জ্ঞান হারাবে। হতে পারে রূপের আ’গুনে ঝ’লসে যাবে! ইস্!”
আয়নায় নিজেকে দেখে হাসলো ফারাহ।আজকে তার আর স্নেহার ছোট বেলার বান্ধবীর গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। সকাল সকাল যাবে ওরা।বেশী দেরী করা যাবে না।
পায়ে উঁচু হিল জুতো পরে বেরিয়ে পড়ল ফারাহ। দালানের কাছে আসা মাত্র পিছন ফিরে তাকালো, নবীন দাঁড়িয়ে আছে।
“ফারাহ কোথায় যাচ্ছিস?”
নবীন ফারাহর বড় ভাই। বয়সের গ্যাপ দু বছরের। শায়লা আহমেদের ছেলে তিনি।
“ও মা তুমি জানো না? ওহ্ তুমি জানবে কি করে? তুমি তো ছিলেই না। আচ্ছা শুনো, আজকে বেলীর গায়ে হলুদ ভাইয়া,ওই অনুষ্ঠানে যাচ্ছি।”
পা ফেলে এগিয়ে এলো নবীন।
“স্নেহা কোথায়?ও কি তোর সঙ্গে যাবে না?”
“আরে ও তো বাইরেই…
“এসে গেছি।”
দালানের কাছে এসে দাঁড়ালো স্নেহা,সেও হলুদ রঙা শাড়ি জড়িয়েছে। নবীন মৃদু হেসে বলল।
“আরে বাহ্ দুই রাজকন্যা কে মাশাআল্লাহ সুন্দর দেখতে লাগছে।”
স্নেহা এবং ফারাহ দু’জনেই হাসলো। নবীন ফোন বের করে দু’জনের ছবি তুললো। পকেটে ফোন গুঁজে বলল।
“চল আজকে আমি তোদের পৌঁছে দিয়ে আসি।”
ফারাহ ব্যস্ত কন্ঠে আওড়ালো।
“আরে ভাইয়া লাগবে না। তোমাকে শুধু শুধু কষ্ট করে যেতে হবে না। তাছাড়া রাস্তায় তো আমাদের আরো ফ্রেন্ড থাকবে ওদের সাথে নিতে হবে, তাহলে তোমার দেরী হবে আর তুমি এতক্ষণ অপেক্ষা করবে না কি? কষ্ট হবে না বুঝি?”
সশব্দে হেসে ফেলল নবীন। ফারাহর গাল টেনে বললো।
“ওরে পাকা বুড়ি একটা। আচ্ছা ঠিক আছে যা তোরা আর হ্যাঁ সাবধানে যাবি কিন্তু।”
ফারাহ হেসে উপর নিচে মাথা দোলায়। অতঃপর স্নেহা আর ফারাহ দু’জনেই বেরিয়ে পড়ল।
রাস্তায় যেতে যেতে লোকমুখে শুনছে এলাকার শেষ প্রান্তে যে রফিক আজাদ ওনার বড় রিসোর্টে নাকি নেভির কমান্ডার রা উঠেছে।নেভির কমান্ডার? শব্দটি তীব্র ভাবে কর্ণ স্পর্শ করলো ফারাহর।থমকালো তার হৃদয় স্পন্দন।
পা জোড়া থামলো তার,স্নেহা আশ্চর্যের ন্যায় তাকিয়ে রইল।
“কী রে থেমে গেলি কেন ফারাহ?দেরী হচ্ছে তো!”
ফারাহ চুল নড়লো না। দাঁড়িয়ে রইল ঠায়।যে লোক গুলো আলোচনা করছিল হেঁটে চলেছে নিজেদের মতো।
স্নেহা পিছন ফিরে ফারাহর দিকে এগিয়ে এলো।
“ফারাহ?কী রে কী হয়েছে?”
ওষ্ঠাদয় তিরতির করে কাঁপছে ফারাহর।নেভির কমান্ডার!এক বছর পূর্বে যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল সে অচেনা পুরুষ নাকি নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার!
“তুই শুনলি স্নেহা ওরা কি বলল?”
স্নেহা ভ্রু কুঁচকে নিল।
“হ্যা শুনলাম তো রফিক আজাদ ওনার রিসোর্টে কমান্ডরা উঠেছে।তাতে তোর কী হলো?”
ফারাহ কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল!কী বলবে? না আপাতত বলার প্রয়োজন নেই। আগে সঠিক টা জানার প্রয়োজন নেই।
“না বলছিলাম যে এর আগে তো কখনো আমরা স্বচক্ষে নেভি দের সামনে থেকে দেখিনি! তাই ভাবছি ফেরার সময় যাবো কী বলিস?”
স্নেহা চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো।
“কী বললি?তুই নেভিদের দেখতে শেষ প্রান্তে যাবি?”
ফারাহ বিরক্ত হলো।
“তো কী হবে গেলে?”
হাঁটতে লাগলো ফারাহ,স্নেহা দ্রুত গতিতে পা বাড়ায়।
“এই চাচী জানলে কী হবে ভাবতে পারছিস?”
“কিচ্ছু হবে না রে। তুই যাবি কিনা বল?”
অজ্ঞতা যেতে হবে স্নেহা কে। কিচ্ছু করার নেই আপাতত যেতেই হবে।
আকাশের নীলিমায় সূর্যের মেঘমাখা সোনালি আভা, পাখিদের ঘরে ফেরার ব্যস্ততা, আর বাতাসে এক ধরনের মিষ্টি প্রশান্তি।
নরমাল ট্রাউজার তার সঙ্গে ব্ল্যাক টি শার্ট। ট্রাউজারের পায়ের দিকটায় ম্যাচিং করা লেইচ লাগানো।পকেটে হাত গুজে রিসোর্টের চারিদিকে ঘুরে দেখছে তাশফিন শেখ। রিসোর্টের পিছন দিকে নারকেল গাছের বাগান।
ধীরে ধীরে রোদেলা আকাশ মুহূর্তেই মেঘে ঢেকে গেছে।আকাশ পানে এক পল দৃষ্টি ফেরায় তাশফিন।
বাগানের দিকে কারো পায়ের খচখচানি শব্দ শুনে কান খা’ড়া হয়ে এলো তার। সতর্ক ভঙিতে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল তাশফিন।হলুদ রঙের আঁচল নজরে এলো তার। ঈগল চক্ষুদয় খুঁ’টিয়ে খুঁ’টিয়ে দেখতে লাগল সে।
“কে ওখানে?”
পুরুষালী কন্ঠস্বর শুনে ঘাবড়ে গেল ফারাহ।তারা এসেছিল লুকিয়ে লুকিয়ে নেভি দের দেখবে বলে।অথচ বাগানের দিকে আসতে গিয়ে হিল জুতো জোড়া সমস্যা করলো। একটা জুতোর হিল ভেঙে গেছে।সেটা তুলতে ব্যস্ত সে। সামনের দিকে দাঁড়িয়ে আছে স্নেহা।
আকস্মিক তাশফিন কে দেখে চিৎকার করে দৌড় লাগায় স্নেহা।
“ফারাহ পালা পালা।”
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ২
ফারাহ জুতো জোড়া ফেলে দৌড় লাগালো, কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হলো সে। বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে আটকা পড়ে তার নরম তুলতুলে হাত খানা।ঠিক তৎক্ষণাৎ টুপটাপ করে বৃষ্টি শুরু হলো।ধীরে ধীরে তা ঝনঝন শব্দ তুলে মাটি স্পর্শ করতে লাগল।গাছের পাতাগুলো ভিজে চকচক করে ওঠছে। বৃষ্টি যেনো ধরণী কে সতেজ করে তুলতে ব্যস্ত।ধুলোবালি ধুয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছে চারিদিকটায়।
“কে তুমি?”
আবারো একই কন্ঠস্বর।এবারে ফিরে তাকালো ফারাহ।
ভেজা স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখে হৃদয় স্পন্দন ধুক করে উঠলো তাশফিন। ওষ্ঠাদয় আলাদা হয়ে এলো,হাতের বাঁধন হলো ঢিলে।