তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ২১

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ২১
ফারহানা নিঝুম

দুপুর বেলা,আকাশ থাকে একদম নীল, যেন বিশাল এক স্বচ্ছ ক্যানভাস। সূর্যের সোনালি আলো চারপাশকে উজ্জ্বল করে তোলে, গাছের পাতাগুলোও চকচক করে ওঠে রোদের ছোঁয়ায়।হালকা বাতাস মাঝে মাঝে বয়ে যাচ্ছে ,গাছের ডালে পাতাগুলো মৃদু দুলছে সমান তালে । ঘাসের উপর সূর্যের আলো পড়ে চকচক করে, আর ফুলগুলো যেন আরও বেশি রঙিন হয়ে ওঠে। পাখিরা দুপুরের নীরবতা ভেঙে কখনো সখনো ডাক দেয়, মাঝে মাঝে কোনো চিল উঁচু আকাশে ডানা মেলে উড়তে থাকে।
নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে ফারাহর।তাশফিনের ব্যবহার গুলো কষ্ট দিচ্ছে তাকে।বক্ষদেশের পীড়ায় নাজুক অবস্থায় মেয়েটার। আঁখি পুট ভরে উঠে ক্ষণে ক্ষণে।
আজ তাদের রিসেপশনের অনুষ্ঠান ছিল অথচ তা হচ্ছে না। বিয়ে বাড়ি আকস্মিক শান্ত হয়ে গেছে।সদ্য বিয়ে করা নববধূ কে রেখে ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে ফারাহর। কিশোরী মনটা ভেঙে গেল স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসের ন্যায়।টুকরো টুকরো হলো হৃদয়।এ কেমন প্রেম? না না প্রেম হওয়ার পূর্বেই তো সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল।

শুভ্র রঙা পুরুষ টি কে দেখে চমকায় ফারাহ।
তাশফিন শেখ এগিয়ে আসছে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী। সূর্যের আলোয় তার সাদা নেভি ইউনিফর্ম ঝলমল করছে।
সাদা, নিখুঁত ইস্ত্রি করা শার্ট, কাঁধে তিনটি সোনালি স্ট্রাইপ লেফটেন্যান্ট কমান্ডারের পরিচায়ক। বাঁ পাশে নেভির ইমব্লেম, বুকের ওপরে চকচকে নামফলক “Tashfin Sheikh”। গাঢ় নীল ট্রাউজার তার সুঠাম কাঠামোর সঙ্গে মিশে গেছে। কোমরে সোনালি বাকলসহ কালো বেল্ট, শক্তপোক্তভাবে বাঁধা।
তার মাথায় সাদা পিক ক্যাপ, সামনে উজ্জ্বল গোল্ডেন অ্যাঙ্কর ইমব্লেম, সূর্যের আলোয় যেন আরও দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে। হাতে কালো গ্লাভস নেই, তবে আঙুলগুলো আলগোছে মুষ্টিবদ্ধ। কালো, পালিশ করা চামড়ার জুতা তার প্রতিটি পা ফেলায় একটা নিয়ন্ত্রিত গাম্ভীর্য এনে দিয়েছে। সে সামনে আসছে ঠোঁটে এক চিলতে আত্মবিশ্বাসী হাসি, চোখে সমুদ্রের গভীরতার মতো প্রশান্তি। যেন এই মানুষটা ঝড়ের মাঝেও নৌযানের মতো স্থির। স্থির নেত্রে পল্লব ঝাপটায় ফারাহ।এক বার দুবার, অতঃপর বার কয়েক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়।এই পুরুষ কে এই পোশাকে সে আগে দেখেনি,তবে এখানে আসার পর তার অনেক গুলো ছবি দেখেছে সে। সুন্দর, সুশীল পুরুষ তার। সুদর্শন বললেও ভুল হবে,তার থেকেও হয়তো সুন্দর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কী সুন্দর আপনি!”
মুখ ফস্কে বলে দিল ফারাহ, মুচকি হাসলো তাশিন। এগিয়ে এসে হাতের আঁজলায় তুলে নিল ফারাহর আদল খানি। উষ্ণ ছোঁয়া এঁকে দেয় ললাটে।আবেশে আঁখি বুঁজে ফারাহ। ক্ষণিক আগেও যে রমণী রেগে ছিল,গলে গেছে বরফের ন্যায়।
“সুখ খুব শীঘ্রই ফিরবো ঠিক আছে,রাগতে নেই। বিশেষ করে তোমাকে একদম রাগা চলবে না। আমার বউ তুমি,রাগ করা বারণ আছে। আমি রাগ করব, তুমি রাগ ভা’ঙ্গাবে।আর আমি ভালোবাসবো, এটুকুই এনাফ।”
সহস ভাষায় নিজ কঠিন আবদার গুলো চাপিয়ে দিল তাশফিন। ফারাহ প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারলো না, থামতে হলো তাকে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল পুরোটা সময়।
“আপনি আমাকে ছেড়ে আবার চলে যাচ্ছেন লেফটেন্যান্ট সাহেব?”
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো তাশফিনের, যষ্ট ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিল এমন কিছুই জিজ্ঞেস করবে ফারাহ। অতঃপর তাই হলো!

“সুখ…
“ডাকবেন না ওই নামে। আপনি একদম ভালো মানুষ নন। আমি মোটেও আপনার সুখ নই,যদি সুখ হতাম তাহলে বার বার আমাকে ফেলে চলে যেতেন না আপনি।”
অভিমানী কন্ঠস্বর,চোখ দুটো অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশি লালচে দেখাচ্ছে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো তাশফিন।
“এটা আমার ডিউটি ফারাহ। তুমি ভুলে গেলে তো চলবে না তোমার হাসব্যান্ড একজন নেভি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার।তার কাজ এটাই, মাসের পর মাস বাইরে থাকা। তবে তোমার জন্য….
“থামুন আপনি। বলবেন না কিছু।”
অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায় ফারাহ।মনটা বি’ক্ষি’প্ত হয়েছে তার।
“আপনি বার বার কেন এমন করেন লেফটেন্যান্ট সাহেব? আপনি উচিত ছিলো আমার সাথে কিছু দিন থাকা তাই না?”
তাশফিন চমৎকার হাসলো, এগিয়ে এলো ঘুচিয়ে দিলো মধ্যবর্তী দূরত্ব। আলগোছে জড়িয়ে ধরে তাকে। হাঁসফাঁস করছে ফারাহ।
“আমি খুব শীঘ্রই ফিরবো তো সুখ। তোমার মাঝে আমার সমস্ত সুখ রেখে গেলাম,ফিরে এসে শোধসমেদ বুঝে নেব।”

তপ্ত দুপুর মানেই এক রোদ ঝলমলে, উত্তপ্ত পরিবেশ যেখানে চারপাশ যেন আগুনের হল্কায় জ্বলছে। সূর্যের প্রখর তাপে বাতাসও গনগনে হয়ে ওঠে, যেন উষ্ণ লোহার পাতার মতো ছুঁতে গেলেই পুড়িয়ে দেবে। রাস্তাগুলো ফাঁকা হয়ে যায়, গাছের পাতাগুলো ক্লান্ত হয়ে নুয়ে পড়ে, আর দূর থেকে ভেসে আসে কাঠফাটা রোদের মাঝে পথচারীদের ক্লান্ত হাঁটার শব্দ।পিচঢালা রাস্তা উত্তাপে দুলতে থাকে, যেন সৃষ্ট হচ্ছে মরীচিকা। গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকা মানুষজন ছায়ার খোঁজে ছোটে কেউ গাছের নিচে আশ্রয় নেয়, কেউবা ঠান্ডা পানির দোকানে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘরের মধ্যে বসে থাকা মানুষরাও ফ্যানের আরাম খোঁজে, তবুও গরমের কা’মড় যেন পিছু ছাড়ে না।শুকনো বাতাসের মাঝে মাঝেমধ্যে ধুলো উড়ে আসে, গরমে ক্লান্ত পশু-পাখিরা নীরব হয়ে যায়, আর পুকুরের পানি পর্যন্ত হয়ে ওঠে উষ্ণ। চারদিকে একরকম স্থবিরতা নেমে আসে, যেন প্রকৃতি নিজেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে এই তপ্ত দুপুরে।
কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছে স্নেহা।মনটা আনচান আনচান করছে তার। ফারাহ নেই, কবে আসবে তা-ও জানা নেই। ফারাহ কে ছাড়া অস্থির লাগছে তার। প্রাইভেট পথে গিয়েও আবার উল্টো পথে হাঁটতে লাগলো স্নেহা। না সে যাবে না আজকে প্রাইভেটে। মন ভালো নেই, কিছু ভালো লাগছে না।

“ওই স্নেহা কোথায় যাও?”
চিরচেনা কন্ঠস্বর,সায়র ডাকছে তাকে।না
ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালো স্নেহা।এই বেডা আবার তাকে ডাকছে কেন?এক সময় তার ক্রাশ ছিলো, কিন্তু এখন ভাল্লাগে না।
“কী?”
“চলে যাচ্ছ যে?”
“তো কি করব?”
খ্যাঁক করে উঠলো স্নেহা।সায়র চমৎকার হাসি উপহার দিয়ে বলল।
“বলছিলাম যে চলো কফি খেয়ে আসি, শুনলাম কলেজের পিছন দিকে বড় রাস্তার মোড়ে একটা নতুন কফি শপ খুলেছে।”
তেতে উঠল স্নেহা,খ্যাঁক করে উঠলো ফের।
“তোমার যাওয়ার হলে তুমি যাও। আমাকে একদম ঢঙ দেখাতে আসবে না।”
রাগে তেতে উঠল সায়র।

“এই স্নেহা এভাবে কথা বলছো কেন হুঁ?বেশি ভাব নিচ্ছো নাকি?”
মুখ বাঁকালো স্নেহা।
“হ্যা নিচ্ছি। কারণ তোমার প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।শুনো সায়র আমার পিছু ছ্যাঁ’চড়ামো করা বন্ধ করো।”
আহাম্মক বনে গেল সায়র, দু’দিন আগেও মেয়েটাকে তাকে ভাইয়া বলতো। এখন ডিরেক্ট নাম ধরে বলছে?আর এখন বলছে নাকি ইন্টারেস্ট নেই?
“এই সরো তো সামনের থেকে।”
পাশ কা’টিয়ে যেতে লাগল স্নেহা।সায়র চেঁচিয়ে উঠলো।
“যা যা তোমার মতো ফালতু মেয়ের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট নেই।বারো ব্যাটারি কোথায় কার!”
পা থামে স্নেহা, তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠে।
“এই সায়রের বাচ্চা তুই এক নাম্বার বারো খাটের পানি খাওয়া ছেলে। এসেছে আমাকে বলতে,তোকে তো ফারাহ পাত্তা দিতো না। ফালতু একটা!”

রাগে ফুঁসছে সায়র,মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না। সত্যি এই ফালতু ফারাহর পিছনে কতটা সময় ওয়েস্ট করেছে সে, ইশ্ এর চেয়ে ক্লাসের রাইয়ার পিছনে সময় দিলে আজকে ডেটিংয়ে যেতে পারতো!
সায়র অপেক্ষা করলো না, চুপচাপ বেরিয়ে গেল।স্নেহা তো সৌহার্দ্য কে দেখেই ফিট হয়ে গেছে।এবারে পাক্কা প্রেম টা করেই ছাড়বে। না না আর ছাড়াছাড়ি নেই,একে বারে বিয়ে করেই ছাড়বে।
মেয়ে কে বাড়ি দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে নিল শায়লা আহমেদ।
“কি রে স্নেহা তুই প্রাইভেটে যাস নি?”
কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে স্নেহা।
“আসলে মা আমার না মোটেও ভালো লাগছে না ফারাহ কে ছাড়া।”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন শায়লা আহমেদ।
“এটা কোনো কথা? ফারাহ তো গিয়েছে শ্বশুর বাড়ি,এখন কি ওর জন্য তুই পড়াশোনা ছেড়ে দিবি?তোকেও কি শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেব?”
চোখ দুটো চকচক করে উঠলো স্নেহার।
“সত্যি মা?দেখো শ্বশুর বাড়ি যেতে আমার আপত্তি নেই। তুমি চাইলে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করতে পারো।”
মেয়ের পাকনামো দেখে কান টেনে ধরলো শায়লা আহমেদ।
“চুপচাপ গিয়ে পড়তে বসবি, আমি নবীন কে পাঠাচ্ছি।”
আশাহত হলো স্নেহা, শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার স্বপ্ন কি চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে?

নীল সমুদ্রের বিশাল বুকে রাজসিক ভঙ্গিতে ভেসে চলছে এক বিশাল জাহাজ। চারপাশে শুধুই জলরাশি, দিগন্তে মিশে গেছে আকাশ আর সমুদ্রের রেখা। শক্তিশালী ইঞ্জিনের মৃদু গর্জন আর পানির সঙ্গে জাহাজের সংঘর্ষে সৃষ্টি হওয়া ছলাৎ ছলাৎ শব্দ যেন এক মনোমুগ্ধকর সঙ্গীত বাজিয়ে চলেছে।
তরঙ্গ একের পর এক ছুটে আসছে, কখনো ধীর, কখনো উত্তাল। সাগরের বুক চিরে এগিয়ে চলা জাহাজের সঙ্গে ঢেউগুলো যেন খেলা করছে। কখনো সামনের অংশে এসে আছড়ে পড়ে সাদা ফেনার ঝাপটা, আবার কখনো পেছনের জলে দোলা দিয়ে মিলিয়ে যায়। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে থাকলে অনুভব করা যায় সেই ঝিরঝিরে বাতাস, লোনা জলকণা মিশে আসে হাওয়ার পরশে।
নৌঘাঁটিতে পোঁছে গেছে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ।হাতে ফাইল গুলো নিয়ে তার পিছু পিছু আসছে লেফটেন্যান্ট নাইম ইসলাম।
“কমান্ডার এই ফাইল গুলো দেখুন, আপনি একবার রিচেইক করে নিন।”
তাশফিন হাত বাড়িয়ে ফাইল গুলো নিতে নিতে এগিয়ে চলেছে। প্রত্যুত্তরে শুধোয়।
“অস্ত্র গুলো কোথায়?”
“কমান্ডার সেগুলো নৌঘাঁটিতেই রয়েছে। আপনি যদি একবার সবটা দেখে নিতেন তাহলে আর্মস ডিল অ্যাক্ট বা ন্যাশনাল সিকিউরিটি আইনের অধীনে মামলা হতে পারে। এগুলো চো’রাচালানের মা’ল বলতে পারেন!”
“হুঁ!”

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ২০

নৌঘাঁটির ভেতরে,নিরাপদ গুদামে (Secure Storage Facility) রাখা হয়। এসব স্থাপনা কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে রাখা হয়েছে। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো তাশফিন। অস্ত্র গুলো সুরক্ষিত ভাবে রাখা হয়েছে,আপাতত এগুলো হস্তান্তর করতে হবে। দু’জন মানব কে ধরা হয়েছে,তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আপাতত এখনো মুখ খুলছে না তারা।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ২২