তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩০
ফারহানা নিঝুম
সন্ধ্যেটা শুরু হয়েছে এক ধরণের শান্ত আলোয়। সূর্যটা তখনো পুরোপুরি অস্ত যায়নি, আকাশের পশ্চিম কোণে লাল-কমলা রঙের খেলা। চারপাশটা একটু একটু করে ঘন অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে, কিন্তু বাতাসে যেন এক ধরণের ঠাণ্ডা প্রশান্তি। পাখিরা দল বেঁধে বাসায় ফিরছে, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে মৃদু সুরে আজানের ধ্বনি।
রাস্তার ধারে গাছের পাতা দুলছে হালকা বাতাসে, পাশের চায়ের দোকান থেকে উঠে আসছে কড়া লাল চায়ের গন্ধ। কিছু মানুষ অফিস থেকে ফিরছে ক্লান্ত মুখে, কেউ আবার হেঁটে বেড়াচ্ছে প্রিয় কারো হাত ধরে শান্ত, নির্ভার এক মুহূর্ত।
একত্রে সবাই নিজ নিজ কক্ষে নামাজ শেষ করে ফারাহ, নূপুর, ঝুমুর আর স্নেহা।রুবেনা শেখ নেই বাড়িতে সাথে নেই রিজুয়ান শেখ। আজকে রাইমা শেখের বাবার বাড়িতে গেছেন তারা। ওখানে কিছু একটা নিয়ে খুব ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে।
সন্ধ্যা বেলা বসার ঘরে আড্ডা জমেছে। আড্ডাতে সামিল হয়েছে আরিয়ান এবং নিহাল দুজনেই। ওদের ফারাহ আসতে বলেছে।সেদিন যাওয়ার পূর্বে দুজনেই এসে ফারাহ কে সরি বলেছে। মেয়েটা ভয় পেয়েছিল, তবে আরিয়ান আর নিহালের সঙ্গে তার বেশ ভাব হয়ে গেছে।
নূপুর চায়ের ট্রে নিয়ে আসছে তার সাথে রয়েছে ঝুমুর। ফারাহ চুপচাপ সোফায় বসে আছে,কি করবে?তার কোমড়ে কতটা ব্যথা।তাশফিন বিকেলে আসার পর থেকে ঘুমোচ্ছে। লোকটা কি হ্যাঁ?কেমন কাজ করে কিছুই বুঝতে পারে না ফারাহ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তা তোমার লেফটেন্যান্ট সাহেব কোথায় ফারাহ?”
নিহালের প্রশ্নে নাক কুঁচকে নেয় ফারাহ। আরিয়ান টিপুনে কে টে বলল,
“বেডা ঘুমাচ্ছে! আহারে কি কষ্ট!”
ফারাহ হতাশ কন্ঠে আওড়ালো।
“ওই পঁচা মানুষের নাম নিও না। আমাকে বলে আমি নাকি প্রতিবন্ধী।”
চোয়াল ঝু লে গেল আরিয়ানের।
“এহ বলো কি?”
“হ্যা হ্যা আপনারে খচ্চ’র বন্ধু আমাকে এটাই বলছে। নিতান্তই আমি ভালো মানুষ বলেই কিছু বললাম না। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে দেখিয়ে দিতো মজা হুউ!”
“তাই নাকি ম্যাডাম।”
কন্ঠস্বর খুব চেনা ফারাহর, বিদ্যুৎ বেগে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো ফারাহ। সুদর্শন যুবক তার সামনে। মূহুর্তের মধ্যে মনে পড়ে গেল বিকেলে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত সেই ঘটনা।তাশফিনের পুরুষ্ট ঠোঁট দুটো… ভাবতেই শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে ফারাহর।
ভাবলেশহীন ভাবে এগিয়ে এসে ধপাস করে সোফায় বসে পড়ে তাশফিন। নূপুর এগিয়ে এলো।
“এই যে সবার জন্য চা। ভাইয়ের জন্য কফি।”
নূপুর সব গুলো চায়ের কাপ এগিয়ে দিল।নিহালের কাছাকাছি যাওয়া মাত্র কিছুটা অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে তাকে। চোখাচোখি হয় দু’জনের।নিহাল অস্বস্তিটা আন্দাজ করতে পেরে নিজেই চায়ের কাপ টা তুলে নিল চুপচাপ। ঝুমুর নাস্তা গুলো দিয়ে দিচ্ছে। এদিকে হেলেদুলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে স্নেহা। স্নেহা কে দেখে আশ্চর্য হয় আরিয়ান,ভ্রুকুটি করে তাকালো সে।
“আরে বাস ওইটা কে?”
থেমে গেল স্নেহা।
“ও আমার গাধী নাম্বার ওয়ান বোন।”
ফারাহর কথায় তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠে স্নেহা।
“ওরে ফেল্টুস কুমারী আমি গাধী?তুই গাধী।”
“তুই খ২০।”
“তুই খ২০।”
“তুই আস্ত বলদা।”
“তুই বলদ।”
দুই বোনের ঝগড়া দেখে হো হো করে হেসে উঠলো সবাই।তাশফিন বরাবরের মধ্যে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তাদের কান্ড কারখানা দেখছে। নূপুর এসে গাল টেনে দেয় ফারাহর।
“পাগলী।”
তৎক্ষণাৎ আগমন ঘটে মাহিরের। নূপুরের বদলে গিয়ে বসলো ফারাহর কোলে।তার চায়ের কাপ টা নিয়ে নিল আলগোছে। ফারাহ কাপে ফু দিয়ে দিয়ে ঠান্ডা করে দিচ্ছে। নূপুর কাপ গুলো নিয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল ফের। আরিয়ান ফিসফিস করে বলল।
“নিহাল তোর মনে হয় না এবারে আমার বিয়া করা উচিত?”
নিহাল একই ভাবে ফিসফিসিয়ে বললো।
“তোর আদেও মুসলমানি হইছে তো?”
চোখের কালো মনি দু’টো এই বুঝি কোটা থেকে বেরিয়ে আসবে আরিয়ানের।
“নাউজুবিল্লাহ কি কস বন্ধু?ছিহ্ তুই এইটা কইতে পারলি?”
“না না আগে চেইক করতে হইবো তুই বড় হয়েছিস কি না? না হলে কেউ তার মেয়ে তোর কাছে বিয়ে দিবে কেন?”
দাঁত কটমট করে তাকালো আরিয়ান। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসলো নিহাল,হাসতে গিয়ে ঘটলো বিপত্তি। চায়ের কিছু অংশ পড়ে গেল শার্টের উপর।
“ওহ্ শিট!”
“হে হে হে আরো হাস শা’লা।”
নাক ফুলালো নিহাল। ফারাহ ওদের অবস্থা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।
নিহাল উঠে গেল তৎক্ষণাৎ বাথরুমে যেতে হবে তাকে। কিছুটা যেতেই বেরিয়ে এলো নূপুর। উপরে রুমের দিকে এগুচ্ছে সে।নিহাল বাথরুম থেকে বের হওয়া মাত্র মুখোমুখি হলো দু’জনে। তবে কেউ কারো সাথে কথা বললো না। নূপুর জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো,পাশ কা’টিয়ে চলে গেল রুমের দিকে। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিহাল।
রাত গভীর হয়েছে। আকাশ যেন কষ্টের চাদরে নিজেকে মুড়ে রেখেছে। নিস্তব্ধতার মাঝে ফারাহর নিঃশ্বাসের শব্দটুকুও ভারী শোনায়। কোমরে টান ধরে আছে, যন্ত্রণাটা হালকা নয় কিছুটা নিঃশব্দ, কিছুটা চিৎকারের মতো। প্রতিটা নড়াচড়ায় ব্যথা যেন তী’ক্ষ্ণ ছু’রির মতো গেঁথে যায় তার শরীরে।
ঘরের প্রতিটি জিনিস আজ বিষাক্ত মনে হয় আলোটা বেশি তী’ক্ষ্ণ, বাতাসটা বেশি ভারী, এমনকি নিজের ছায়াটাও অচেনা লাগছে। ফারাহ চোখ বন্ধ করেও শান্তি খুঁজে পায় না। সে যেন বিষ’ণ্নতার এক গাঢ় অরণ্যে আটকে গেছে, যেখানে শরীর আর মন দুটোই ক্লান্ত, দুটোই ভারী।
খট করে দরজা খুলে ভেতরে এলো তাশফিন। ফারাহ এক পলক ফিরে দেখলো তাকে। চোখাচোখি হয় দু’জনের। ক্ষণিকের জন্য থমকে যায় তাশফিন, চঞ্চল কিশোরীকে আজকে ম্লান দেখাচ্ছে কেন? দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ফারাহ,ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো তাশফিন। ফারাহ একই ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। কষ্ট টা নিজের মধ্যেই চেপে রাখা।তাশফিনের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছে ফারাহ।এদিক সেদিক হাঁটছে সে, ড্রয়ার খুলে কি যেনো নিচ্ছে! ফারাহ উঠে দেখার চেষ্টা করলো না।হুট করেই কারেন্ট চলে গেল। ইদানিং কারেন্ট অনেক সমস্যা করছে!তবে জেনারেটর থাকায় খুব একটা সমস্যা হলো না। তীব্র লাইটের আলোয় বিরক্ত হলো ফারাহ।
নিরেট কন্ঠে বলল,
“লাইট টা অফ করে দিন না!”
তাশফিন ফট করে লাইট টা অফ করে দিল।পুরো কক্ষটি অন্ধকারে তলিয়ে গেল মূহুর্তের মাঝে। টিমটিম রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলো আসছে এবারে। ফারাহ বা দিকে শোয়ার কারণে চোখে লাগছে না তার।
কোমড়ে কারো স্পর্শ পেয়ে আঁতকে উঠে সে।হাতে হাত চেপে ধরলো ত্বরিতে।
“কি হলো দেখতে দাও।”
থতমত খেয়ে গেল ফারাহ,কি দেখবে এই লেফটেন্যান্ট?
“মানে?”
“বুদ্ধু!”
বেনুনি টেনে দিল তাশফিন।এটা বুঝি তার অভ্যাস হয়ে উঠেছে!”উফ্” শব্দে নাক কুঁচকে নেয় ফারাহ।
কোমড়ের উপর থেকে জামা সরিয়ে নিল তাশফিন।
“খুব ব্যথা কি?”
“কষ্ট হচ্ছে খুব!”
কাতর কন্ঠে জবাব দেয় ফারাহ। আন্দাজ করতে পারছে তাশফিন, ঠিক কতটা ব্যথা পেয়েছে মেয়েটা।অবশ্য পাওয়ার কথাই, চঞ্চল সে,একটা জায়গায় স্থির হয়ে বসতেই চায় না।
“একটু জামাটা তুলতে সাহায্য করো আমাকে।”
হাত দুটো কাঁপছে ফারাহর, লজ্জা ভয় এক মিশ্রণ অনুভূতি।
“থ..থাক লাগবে না।”
চোখ পাকিয়ে তাকালো তাশফিন, অন্ধকারেও তা বেশ বুঝতে পারছে ফারাহ। নৈঃশব্দ্যে হাতটা সরিয়ে দিল সে।
পরম আদরে সযত্নে কোমড়ে মালিশ করে দিচ্ছে তাশফিন। পুরুষের যন্ত্রণা যেমন পীড়া দেয় তার ভালোবাসা মা’রা’ত্মক ভাবে সুখ দেয়। সুখের একাংশ বুঝি ফারাহ পেয়ে গেছে? হয়তো বা!
“সুখ?”
“জ্বি?”
“আমি যদি একটু গভীর ভাবে তোমাকে ছুঁই আমাকে নিতে পারবে?”
স্তম্ভিত ফারাহ।স্তব্ধতা যেন আচ্ছন্ন করল চারপাশ। ফারাহর নিঃশ্বাস গুলিয়ে যাচ্ছে নিজেরই বুকের ভেতর। তাশফিনের প্রশ্নটা তার হৃদপিণ্ডে ঝড় তোলে স্নিগ্ধ, অথচ প্রগাঢ় সেই ঝড়ের অভিঘাতে বাকরুদ্ধ সে।
তাশফিনের আঙুলগুলো কোমল অথচ দৃঢ়, ভালোবাসার স্পর্শে চুইয়ে পড়ছে এক অদৃশ্য আ’গুন যা পোড়ায় না, বরং উষ্ণ করে। সেই উষ্ণতায় ফারাহর সমস্ত গলিয়ে যেতে চায়, তবু কোথায় যেন এক দ্বিধা, এক আলো অন্ধকারের লুকোচুরি খেলা।
সে তাকায় তাশফিনের চোখে তীব্র, কিন্তু ভালোবাসায় ভরা সেই দৃষ্টিতে। সময় যেন থেমে থাকে এক মুহূর্তের জন্য। ফারাহ বুঝে যায়, এই ছেলেটি শুধুই তার শরীর চায় না সে চায় তার আত্মা, তার সমর্পণ, তার নিঃশর্ত বিশ্বাস।
তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, গলার স্বর নিস্তব্ধতার ভেতর নিভু নিভু প্রদীপের মতো,
“আপনার ছোঁয়া কি কেবল শরীরের জন্য?”
তাশফিন মৃদু হাসে। সেই হাসিতে ছিল প্রতিশ্রুতি, ছিল আশ্বাস।
❝”তোমাকে ছুঁতে চাই, কারণ তোমাকে উপলব্ধি করতে চাই। তোমার মন, তোমার কাঁপুনির ভাষা পড়তে চাই।”❞
ফারাহর চোখ ভিজে ওঠে অজান্তেই। ভালোবাসা যদি এতটা গভীর হয়, তবে ভয় কোথায়?
সে ধীরে হাত রাখে তাশফিনের হাতে, চোখ নামিয়ে বলে,
“❝আপনার ছোঁয়ায় যদি আমি ধ্বংস হই, তাও সে ধ্বংস হবে আমার পূর্ণতার❞”
তাশফিন তার দিকে এগিয়ে আসে, নিঃশব্দে, নরম স্রোতের মতো। ফারাহ চোখ বন্ধ করে, প্রস্তুত হয় এক অনন্ত অনুভবের জন্য।কানে ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করল ফারাহ।
“ইশ্ এত দুষ্টু কেন তুমি?”
চোখ মেলে তাকাল ফারাহ,লোকটা তাকে বোকা বানালো?
“কি হলো ব্যাপারটা?”
ঝটপট বিছানায় লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে পড়ল তাশফিন।
“মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো সব কিছু,সামনে পরীক্ষা না? মনটা পড়ায় দেও!”
কোমড়ের ব্যথা সাইটে রেখে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ল ফারাহ। ফাজিল লোক, কত্ত নাটক করে! সবসময় তাকে বোকা বানায়। বিছানায় ঘাপটি মে রে শুয়ে আছে ফারাহ। অকস্মাৎ অনুভব করলো তার কোমড়ে শক্ত হাতের চাপ। বিদ্যুৎ বেগে চমকে উঠে সে। ফিসফিসিয়ে বললো।
“তুমি কি চাও আমি উল্টো পাল্টা কিছু করি,তাও আবার এই অবস্থায়?”
লজ্জায় নাক ফুলে উঠে ফারাহর। নত হয় মস্তক।ফের শুনতে পেলো।
“আর চার রাত কিন্তু আপনার, এরপরের সব গুলো রাত আমার।”
দু’হাতে কান চেপে বসে রইল ফারাহ। ইশ্ কি লজ্জা!
কিচেনের লাইট জ্ব’লছে,নবীন হাতে বোতল নিয়ে এসেছে পানির জন্য।ঢুকেই দেখতে পেলো ঝুমুর কে।
“কি ম্যাডাম রাতে চুপিচুপি রান্না ঘরে খাবার চু রি করছো নাকি?”
অকস্মাৎ এমন প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেল ঝুমুর।
“একদম উল্টো পাল্টা কথা বলবে না। তুমি জানো আমি চু রি করতে এসেছি?”
হেসে ফেলল নবীন।
“দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।”
“তাহলে তুমি আস্ত বোকা।”
“আচ্ছা তাহলে তুমিই বলো কেনো এসেছো?”
“তুমি যে জন্য এসেছো আমিও সেটার জন্য এসেছি।”
ঝুমুর চুপচাপ পানির বোতল ভরে বাইরে আসতে নিল। নবনী খুব ফিসফিসিয়ে বললো।
“তেলাপোকা তেলাপোকা!”
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ২৯
মুখ বাঁকালো ঝুমুর, তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলল।
“ওসব ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। আমি ভয় পাই না।”
নবীন অস্থির কন্ঠে বলল,
“আরে সত্যি বলছি।”
খুব একটা পাত্তা দিলো না ঝুমুর।
দীর্ঘ শ্বাস ফেললো নবীন। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল।
“মাইয়া মানুষ একটু বেশি বুঝে!”
আকস্মিক গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল ঝুমুর। জামার ভেতরে কি ওটা?