তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪
ফারহানা নিঝুম
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে এখনো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। টাওয়েল দিয়ে মাথাটা মুছে বারান্দায় মেলে দিল ফারাহ। দৃষ্টি তার বৃষ্টির দিকে।এই তো মধ্যখানে উপরে কোনো কিছু না থাকায় আকাশ ফেটে বৃষ্টির পানি বাড়ির মাঝখানে পড়ছে।বাড়ি ধুয়ে নোংরা পানি গুলো বেরিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট পাইপ দিয়ে। পিলারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ। মনে পড়ে যাচ্ছে ঘন্টাখানেক আগের দৃশ্য।
সেই অনাঙ্ক্ষিত পুরুষের হাতে বন্দি ছিল তার কোমল হাত। তাকিয়ে ছিল নির্নিমেষ। চোখের গভীরতায় কী যেন ছিল! লম্বা সুঠামদেহী সুশ্রী চেহারার অধিকারী।গাল জুড়ে ছাপা দাড়ি। বৃষ্টির পানিতে ভিজে গায়ের কালো টি শার্ট লেপ্টে ছিল।হাতের বাঁধন ঢিলে হতেই ছুট্টে পালিয়ে এসেছিল ফারাহ।আসার সময় এক নজর পিছন ফিরে দেখেছিল সে।লোকটা সে-ই একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল।
“ফারাহ খেতে আয়।”
মায়ের কন্ঠস্বর শুনে কল্পনা থেকে বেরিয়ে এলো ফারাহ। দ্রুত পায়ে নিচে গেল। রান্না ঘরের পাশে ডাইনিং টেবিল।খেতে বসেছেন জয়নাল আহমেদ, সাজ্জাদুল আহমেদ, নবীন আহমেদ আর স্নেহা। পদে পদে হাঁচি দিচ্ছে স্নেহা। ফারাহ টুপ করে পাশের খালি চেয়ারে বসে পড়ল।
স্নেহার দিকে চোখাচোখি হতেই স্নেহা ক’টম’ট করে তাকালো তার দিকে।চোখে চোখেই যেনো বলছে “তোর জন্য আমার এই অবস্থা!তুই যদি না যেতি তাহলে বৃষ্টিতে ভিজতে হতো না আর না আমার হাঁচিতে হাঁচিতে জান বের হতো!”
কথা গুলো মুখ ফুটে বলতে পারলো না স্নেহা।চোখে চোখে বুঝে নিল ফারাহ। হঠাৎ ফুস করে একটা শব্দ হলো।একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো উপস্থিত সবাই। ফারাহ কি একটা ভেবে জোরে জোরে হেসে উঠলো।
আরিফা আহমেদ মেয়ের হাসির কারণ খুঁজে পেলেন না।
শায়লা আহমেদ বেকুবের ন্যায় শুধোয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তুই হাসছিস কেন ফারাহ?”
ফারাহ কিছু বলতে নিয়েও থামতে হলো তাকে। পায়ে ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করলো সে। স্নেহা পা দিয়ে চেপে ধরেছে তাকে। অজ্ঞতা চুপ থাকতে হয়েছে।
খাওয়া শেষে দু’জনেই রুমের দিকে এগুচ্ছে। আকস্মিক ফারাহ স্নেহার কানে ফিসফিস করে বলল।
“আমি কিন্তু শুনেছি।তুই হাঁচি আটকাতে গিয়ে পা’দ দিয়েছিস।”
দাঁত ক’টম’ট করে তেড়ে আসে স্নেহা, ফলস্বরূপ এক ছুট লাগালো ফারাহ।
“তোর ভবিষ্যৎ জামাই কে এই কথা বলে দেব একদিন।”
“ফারাহর বাচ্চা তোকে আমি..
ফারাহ কে আর পায় কে? দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল।
নিজ রুমে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে তাশফিন। কপালের ওপর এক হাত রাখা, দৃষ্টি তার সিলিং ফ্যানের দিকে।অথচ মস্তিষ্ক,মন দুটোই আটকে আছে হলদেটে রমণীর আদল খানে।
বৃষ্টির পানিতে ভিজে চকচক করছিল তার কবুতরি পেলব। ছোটখাটো দেহ খানা, ওষ্ঠাদয় কাঁপছিল তিরতির করে।তাশফিন এক মূহুর্তের জন্য ব’শীভূত হলো। হারিয়ে ফেলল নিজ সত্তা, দমবন্ধকর এক পরিস্থিতিতে থমকে ছিল তার হৃদয় স্পন্দন। চকিতে বিছানায় উঠে বসলো সে, শান্ত শিথিল দৃষ্টি অশান্ত হয়ে এলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল চারপাশে।এক মূহুর্তের জন্য মনে পড়ে গেল তার সদ্য বিয়ে করা বধূর কথা। স্মরণে এলো ফেলে যাওয়ার মূহুর্তটা। আচ্ছা তার ছোট্ট নাদুসনুদুস বউ টা এখনো তাকে স্বামী বলে মানে? বিয়ে বাড়িতে লোকমুখে শুনেছে বউ তার বড়-ই ছোট, এবং নাদুসনুদুস। স্বচক্ষে তো আর দেখেনি তাশফিন! তাই সঠিক টা বলতে পারছে না আর না পারছে মনের ক্যানভাসে তার আঁকিবুঁকি করতে।
পরক্ষণেই নিজেকে দু’টো বিশ্রী গা’লি দিলো সে। পুরো একটি বছর পেরিয়ে গেছে এখনো কি মেয়েটা তার জন্য থাকবে?দেখো গিয়ে বিয়ে করে সংসার করছে বোধহয়।ভালো হয়েছে তার প্রফেশনাল কাজের জায়গায় কেউই বিষয়টা তেমন জানে না।ভাই সৌহার্দ্য ছাড়া।
বিছানা ছেড়ে বাইরে এলো তাশফিন, বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমে আসছে। কৃষ্ণপুর এলাকায় আসার এক বিশেষ কারণ রয়েছে। তাদের টিমের একজন লেফটেন্যান্ট তার বন্ধু ইকবালের চাচাতো বোনের বিয়ে। যেহেতু তারা এ পথ ধরেই ফিরছে তাই তার চাচা ভীষণ ভাবে চাইলেন বিয়ে যাতে তারা উপস্থিত থাকে।না করতে ইচ্ছে করলো না তাশফিনের, বিয়েটা মিটে গেলেই বাড়িতে ফিরবে সে। বহুদিন পর মায়ের আদল খানি মন ভরে দেখবে।বাবা কে আলিঙ্গন করবে।
চমৎকার মূহুর্ত গুলো কল্পনা করতে করতে প্রশান্তির নিঃশ্বাস টেনে নিল তাশফিন। তবে অস্থির হচ্ছে হৃদয় পাড়া।কে ওই মেয়েটা? পবিত্র এক মুখের দেখা মিললো! জানতে তো হবেই কে সেই রমণী?
সকাল সকাল ঝুমুর কলেজের জন্য তৈরি হয়েছে। আজকে তার অনার্সের এক্সাম আছে। তাড়াহুড়ো করছে সব কিছুতে! ব্যাগ পত্র নিয়ে দুতলা থেকে নেমে এলো।
নূপুর সকাল সকাল তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে শুধোয়।
“কী রে ঝুমুর এখুনি চলে যাচ্ছিস?”
টেবিলের উপর থাকা এক গ্লাস জুস তুলে চট করে খেয়ে নিল।
“আরে আপু আজকে আমার কলেজে এক্সাম আছে তো!”
নূপুর তাড়াহুড়ো করে খাবার প্লেটে দিলো।
“তাহলে খেয়ে যা।এভাবে খালি পেটে যাবি না কি?”
ঝুমুর শুনলো না, অসম্মতি জানায়।
“না না আমি কলেজে কিছু একটা খেয়ে নেব।”
পা বাড়ায় সদর দরজার দিকে, কনুই টেনে ধরে রুবেনা শেখ।
“থা’প্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব সব! চুপচাপ খেতে বস।”
মায়ের ধমক খেয়ে মুখ চুপসে গেল ঝুমুরের। সাইফুল সবে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিচে এলো। শা’লীকার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে শুধোয়।
“কী ব্যাপার শা’লীকা সাহেব মন খারাপ কেন?”
পাশের চেয়ারে বসলেন সাইফুল শেখ।
“আর বলো না দুলাভাই আম্মু শুধু শুধু জোর করছে!”
খাবার বেড়ে দিচ্ছে নূপুর।রুবেনা শেখ রিজুয়ান শেখ কে ডেকে আনলেন খেতে।
“ঝুমুর আজকে তো তোমার পরীক্ষা আছে তাই না।”
বাবার কথায় মাথা দোলায় ঝুমুর। অল্প হাসলেন রিজুয়ান শেখ। খেতে খেতে গল্প জুড়ে দিলেন সাইফুল শেখের সঙ্গে।
“তোমার ব্যবসা কেমন চলছে সাইফুল?”
রুটির টুকরো মুখে পুরে ভদ্র ভাবে বলল।
“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই চলছে আব্বু!এই তো গত মাসে আবার রাজশাহী যাবো।”
সাইফুলের যাওয়ার কথা শুনে হাত থেমে গেল নূপুরের। তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টি নি’ক্ষেপ করে তার পানে। সবার অগোচরে হাসলো সাইফুল।
সাইফুল বিভিন্ন যন্ত্রপাতি র’প্তানি করে। রিজুয়ান শেখের শহরের মধ্যে একটা সুপারশপ এবং ধানমন্ডির দিকে আরেকটি সুপারশপ রয়েছে। বাড়ি থেকে বিশ মিনিটের রাস্তা।
রিজুয়ান আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে রুবেনা শেখের উদ্দেশ্যে শুধোয়।
“মাহিন কোথায়?ওকে আনো নি?”
নূপুর চট করে বলে উঠে।
“ও এখনো ঘুমাচ্ছে আব্বু।”
রুবেনা শেখও বলেন।
“হ্যা তোমরা খেয়ে নাও মাহিন উঠলে আমার সঙ্গে খাবে নে।”
রিজুয়ান শেখ আর কথা বাড়ালেন না।যে যার মতো খাবার শেষ করে কাজে বেরিয়ে পড়ল। রিজুয়ান শেখ গাড়ি নিয়ে সুপারশপের দিকে গেল। সাইফুল নিজ গাড়িতে ঝুমুর কে নিয়ে বের হয়। তাকে কলেজে ড্রপ করে নিজের অফিসে বেরিয়ে যায়।
প্লেট গুলো নিয়ে কিচেনে রেখে এলো নূপুর। একটু পরে তাদের কাজের মাসী দিপ্তী আসবে। তিনি এলেই ধুয়ে দেবেন।
বিয়ে বাড়ীতে যাবে আহমেদ পরিবার থেকে ফারাহ,স্নেহা, নবীন আরিফা আহমেদ এবং শায়লা আহমেদ।কত করে বলেছে যাতে বেলীর বিয়েতে তারা থাকে।
গৌধূলি নেমে এসেছে। রাত আটটায় বিয়ে।
এখুনি বের হতে হবে না হলে দেরী হয়ে যাবে!
কমলার মধ্যে স্বর্ণের চড়ির কাজ করা একটি শাড়ি পড়েছেন আরিফা আহমেদ। শায়লা একই রকম তবে তা নীলের মধ্যে পড়েছে।
ফারাহ রয়্যাল ব্লু জারদৌসি লেহেঙ্গ গাঢ় নীল রঙের এই লেহেঙ্গায় ভারী জারদৌসি কাজ করা, যা রাজকীয় লুক দেয়। গোল্ডেন শেডের এমব্রয়ডারি সিকুয়েন্স ওয়ার্ক করা আছে। স্নেহা নিওন গ্রীন মিরর ওয়ার্ক লেহেঙ্গা পড়েছে। লেহেঙ্গার বডি ও দোপাট্টায় ছোট ছোট আয়নার কাজ করা।
গাড়িতে বসে আছে সবাই। যত এগুচ্ছে বুকের ধুকপুকানি তীব্র হচ্ছে ফারাহর। তার কারণ বোধগম্য নয়! আকস্মিক মনে হচ্ছে কাজের মানুষ খুব কাছে রয়েছে।
গোলাপী ওষ্ঠ যোগল বারংবার ভিজিয়ে নিচ্ছে সে।
বিয়ে বাড়িতে যেতে হাঁসফাঁস লাগছে তার।কেন জানি মন পাড়ায় অনাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটার সম্ভাবনা দোলা দিচ্ছে!
মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে ফারাহ।
“ইয়া আল্লাহ কিছু হবে না তো? কেন জানি ভয় হচ্ছে? আপনি সাহায্য করুন আল্লাহ।”
ফারাহ কে চিন্তিত দেখে স্নেহা ফিসফিসিয়ে শুধোয়।
“কী হয়েছে তোর?”
“কই কিছু না তো!”
“দেখ একদম মিথ্যে বলবি না।কাল থেকে দেখছি কেমন একটা করছিস! চাচী কে বলব না কি?”
ফারাহ ঘাবড়ে গেল,স্নেহার সন্দেহ দূর করতে মেকি মন খারাপ করে বলল।
“আরে যেমন কিছু না,ওই যে বেলীর বিয়ে যাবে তাই ভয় করছে!”
হেসে ফেলল স্নেহা।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩
“ও এই ব্যাপার?আরে একদিন আমিও মন খারাপ করব যেদিন তোর বিয়ে হ….
ফারাহ চকিতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। দৃষ্টি ফেলল আকাশ পানে।স্নেহা অপরাধী মুখ করে বসে রইল, ভুলবশত অতীতের তী’ক্ষ্ণ স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে সে।