তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৭
ফারহানা নিঝুম
আকাশের বুক চিরে নেমে আসে এক নির্মম বজ্রপাত, আর তার পরপরই শুরু হয় বৃষ্টির করুণ আবাহন। এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা তারপর এক মুহূর্তেই মেঘ যেন ছিঁড়ে পড়ে ঝরে পড়ল শত শত জলের তীর। বৃষ্টির শব্দে নিস্তব্ধ রাতটা কেঁপে উঠতে থাকে প্রতিটি বজ্রগর্জনে যেন প্রকৃতির রাগ আর হাহাকার মিলেমিশে একাকার।চারদিক অন্ধকারে মোড়া, কেবল মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের ঝলকে উদ্ভাসিত হয় পৃথিবীর ভীত চেহারা। জানালার কাঁচে টুপটাপ শব্দ তুলে ঝরে পড়ছে জল।
রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা একটা নিঃশ্বাসও যেন শব্দ করে উঠলে চারদিক কেঁপে উঠবে। ঘরের বাতাস থমকে আছে, তেমনই থমকে আছে ফারাহ। কোমরের উপর চাপটা ক্রমেই গা জ্বা’লিয়ে দিচ্ছে।ঘামে ভেজা কপালে লজ্জা আর আত’ঙ্কের মিশেল। গলার কাছে যেন কিছু আটকে গেছে, কথা বেরোচ্ছে না ঠিকঠাক। তবু সমস্ত সাহস এক করে ফারাহ অনুনয় করে বলল।
“ছেড়ে দিন আল্লাহর ওয়াস্তে।”
কিন্তু তাশফিন শুনছে না। চোখে তার এক অদ্ভুত জেদ, ঠোঁটে এক নি’র্মম ব্যগ্রতা। বুকের ভেতর থেকে উথলে ওঠা নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ফারাহর ঘাড় জ্বা’লিয়ে দিচ্ছে রোমকূপ, গুলিয়ে দিচ্ছে হৃদস্পন্দন। ফিসফিসিয়ে কানে কানে বলে উঠল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আসার আগে ভাবা উচিত ছিলো।”
“আর আসবো না। এবারের মতো ছেড়ে দিন।”
“নট পসিবল।”
ফারাহ কাঁপছে ভয়ে, লজ্জায়, অপরাধবোধে নয়, এক অচেনা অস্থিরতায়। তার দু’চোখে কুয়াশা জমছে, শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। অথচ মন বলছে পালাতে, বাঁচতে, ছিঁড়ে ফেলতে এই মুহূর্তটাকে।বাইরের ঝড় আর ফারাহর মনের ঝড় যেন একসাথে তাণ্ডব চালাচ্ছে। প্রকৃতির উন্মাদনা আর হৃদয়ের আর্ত’নাদ দুইয়ে মিলে যেন সময়টাই উল্টে যাচ্ছে। বাতাসের গর্জন, জানালায় বৃষ্টির অবিরাম টোকা, আর ফারাহর ভেতরের ছটফটানি মিশে গেছে। ফারাহ হঠাৎই টের পায় তাশফিনের ডান হাত ধীরে ধীরে তার পিঠ বেয়ে ওপরে উঠছে, শিহরণ জাগিয়ে। মুহূর্ত পরেই জামার ফিতে টেনে খুলে দেয় সে। যেন সময় থেমে যায় এক পলকে।
চমকে ওঠে ফারাহ। চোখ বড় বড় হয়ে যায়, ঠোঁট কেঁপে ওঠে অজান্তে। হৃদয় যেন বুকে আটকে পড়েছে ধুকধুক ধুকপুক করে উঠছে অবিরাম, যেন নিজেই বুঝে গেছে অনিশ্চয়তার এক দুর্বোধ্য রেখা পার করছে সে। লজ্জা, অস্বস্তি আর আতঙ্ক ।ফারাহর মন বিদ্রোহ করছে পালাতে চায়, দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়তে চায় কোনো অচেনা নিরাপদ কোণে। কিন্তু বাস্তবতা নিষ্ঠুর শরীর জড়িয়ে পড়েছে এক অনিবার্যতায়। মুহূর্তের মধ্যে তাশফিন তাকে নিজের দিকে টেনে নেয়, দু’পা উঁচু করে কোলে তুলে নেয় শক্ত করে। তার বাহুতে স্পর্শ করে ।কোমরের চারপাশে সাপের মতো জড়িয়ে থাকা হিম শীতল স্নায়ু। ফারাহ যেন আরেকবার বিদ্যুতাহত হয় চোখে বিস্ময়, কণ্ঠে চাপা আর্তি, হৃদয়ে কাঁপুনি। তাশফিন বিছানার দিকে এগিয়ে যায় ধীরে ধীরে। , আর এক মুহূর্তে তার থুতনিতে পড়ে এক ব্যথামিশ্রিত কামড় । এক অদ্ভুত উন্মাদনা। নেশাময় কণ্ঠে ফিসফিস করে ওঠে তাশফিন।
“এতদিন ভালো রূপ দেখেছো এখন খারাপটা দেখবে মিসেস শেখ।”
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে ঘরের বাতাসে। তাশফিনের চোখে তখন এক অচেনা উত্তাপ, আর সেই উত্তাপে যেন ছেঁকে যাচ্ছে ফারাহর শরীর। মেদহীন কোমল উদরে একের পর এক টুকরো টুকরো কা’মড় বসায় সে অবদমিত ক্ষুধার মতো হিংস্র, প্রায় নিষ্ঠুর। ব্যথায় কেঁপে ওঠে ফারাহ, ঠোঁট চেপে ধরে রাখলেও গোঙানির শব্দ থামাতে পারে না। ব্যথায় ফারাহর হাত অজান্তেই উঠে যায় তাশফিনের চুলে মুঠো করে চেপে ধরে সে, যেন নিজেকে কোনোভাবে রক্ষা করতে চায়। চোখ বেয়ে নেমে আসে চুপচাপ কান্না, মুখ না গুমড়েই বিস্ময়ে ভেজে যায় বালিশের কোণা।অল্প কিছু সময় পরে নিঃশব্দেই ছেড়ে দেয় তাশফিন। নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে সে বিছানার উল্টো পাশে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ে।ফারাহ ধীরে ধীরে পেটের কাপড় তুলে দেখে চামড়ার ওপরে লালচে ছোপ, কামড়ের দাগ যেন তার শরীর নয়, আত্মাকে আঁচড়ে গেছে। আঙুল ছুঁইয়ে দেখে সে দাগগুলো।
“ঘুমাও সুখ, বেসামাল হতে চাচ্ছি না শ্বশুর বাড়ি বলে কথা। আমাকে ম্যানুপুলেট করো না প্লিজ!”
অসহায় চোখে তাকায় সে, পাষণ্ড স্বামী তার।এত কিছু করে বলছে কিছু করতে চাচ্ছে না। এই অবাধ্য লেফটেন্যান্ট সাহেব কে নিয়ে সে কি করবে?
আকাশের বুক ছিঁড়ে বৃষ্টির ফোঁটা মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে এদিক সেদিক করছে স্নেহা।কিছুতেই ঘুম আসছে না তার।
কৃষ্ণপুর থেকে বিকেলেই রওনা দিয়েছে সে। আরিয়ান তাকে নিয়ে এসেছে।আসার সময় শায়লা আহমেদ খুব কান্নাকাটি করেছেন। এটা মোটেও ভালো লাগেনি উনার।
উদোম গায়ে বিছানার এক পাশে শুয়ে আছে আরিয়ান।পিঠে অনেক গুলো দাগ দেখতে পাচ্ছে স্নেহা।চমকে উঠে সে! হকচকিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ,বুকের ভেতর টা মোচড় দিচ্ছে তার। এগুলো কি? কাঁপা হাতটি পিঠে রাখতেই ফিরে তাকালো আরিয়ান।ঘাবড়ে গেল স্নেহা।আমতা আমতা করে বলল।
“আ.. আপনার পিঠে ওসব কি?”
চাদর টেনে নিজেকে ঢেকে নিল আরিয়ান। মলিন হেসে বলল।
“এলা’র্জি!”
কিঞ্চিৎ অবাক হলো আরিয়ান। এলা’র্জি অথচ ডক্টর দেখাচ্ছে না কেন?
আইঢাঁই করে ফের শুধোয় স্নেহা।
“আপনি কি ডক্টর দেখান নি?”
আরিয়ান স্নেহা কে চিন্তিত দেখে অবাক হলো। স্নেহা কি তাকে নিয়ে কিছু অনুভব করছে?তার মনে কি অনুভুতি তৈরি হচ্ছে আরিয়ানের জন্য?
“কি হলো চুপ কেন বলুন?”
“ক্রিম ইউজ করি।”
স্নেহা চটজলদি বলে উঠে।
“কোথায় রেখেছেন দিন আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।”
আরিয়ান আরো এক দফা চমকে উঠে। আঙ্গুলের ইশারায় টেবিলের ড্রয়ার দেখালো।স্নেহা উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে ক্রিম নিয়ে এলো।এতক্ষণ যত্ন নেওয়ার কথা ভাবলেও এখন বেশ লজ্জা লাগছে তার।বুক ভর্তি নিঃশ্বাস টেনে বলল।
“ঘুরে বসুন।”
আরিয়ান এক মূহুর্ত অপেক্ষা করলো না।ঘুরে বসলো। লাইটের আলোয় আরিয়ানের ফর্সা পিঠ দেখতে পাচ্ছে স্নেহা।সুদেহি পুরুষ। অকস্মাৎ গলা শুকিয়ে আসছে তার। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে এদিক ওদিক। কম্পিত হাতে ক্রিম নিয়ে একটু একটু করে লাগিয়ে দিতে লাগল আরিয়ানের পিঠে। পুরুষ মানুষ আরিয়ান, নিজের অনুভূতি গুলো চেপে রাখা বড্ড কষ্টের। ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে সে! স্নেহা পিটপিট চোখ করে তাকাচ্ছে তার দিকে। ক্রিম লাগানো শেষ হতেই সরে এলো সে!ড্রয়ারে রেখে দিল আবার।হাত ধুতে ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতে বললো।
“আমি ওয়াশ রুম থেকে আসছি।”
আরিয়ান দুদিকে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো।
ওয়াশ রুমে যেতেই স্নেহার ফোন টা বেজে উঠল। আরিয়ান চেক করে দেখে ফারাহ কল করেছে।
“স্নেহা ভাবি কল করেছে।”
“আসছি আমি।”
আরিয়ান উঠবেই ঠিক তখনই ওয়াশ রুম থেকে বিকট শব্দ শুনতে পায়। আঁতকে উঠে সে।
“স্নেহা ঠিক আছো তুমি?”
“উফ!”
স্নেহার গোঙানির আওয়াজ শুনে অন্তর আ’ত্মা কেঁপে উঠলো আরিয়ানের।সে অপেক্ষা করলো না তার বাইরে আসার।দরজা ধাক্কিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। বাথটাবে পড়ে আছে স্নেহা।হাত ধুয়ে ফিরে আসতে উল্টো ঘোরা মাত্রই পা পিছলে পড়ে গেছে।ভিজে জবুথবু অবস্থা তার। অনাঙ্ক্ষিত ভাবেই তার শরীরের অনেক অংশই দেখা যাচ্ছে।চোখ এড়ালো না আরিয়ানের।
চমকালো সে, নিঃশ্বাস ভারী হলো তার।হিতাহিত জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয়েছে।
কাঁপা হাত জোড়া বাড়িয়ে দিলো স্নেহা। আরিয়ান হাত স্পর্শ করতেই উঠতে নিলে ফের পিছলে যায় স্নেহা। এবারেও পড়ে গেল সে। তবে এবার সে একা নয় আরিয়ান তার উপর ফিচলে পড়ে। অনাঙ্ক্ষিত ভাবেই দু’জনের ওষ্ঠো জোড়া একে অপরকে ছুঁয়ে যায়। থমকে গেল স্নেহা পিটপিট চোখ করে তাকালো সে।
“আমি..
আরিয়ান অপেক্ষা করে না কিছু শোনার। পরপর চুমু এঁকে দিল স্নেহার ঠোঁটে। আরিয়ানের একটুখানি স্পর্শে মুচড়ে যাচ্ছে স্নেহা
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে তার। লজ্জায় তাকাতে পারে না সে।
ফিসফিস করে বলে।
“নট ব্যাড”
ঝট করে কোলে তুলে নিল স্নেহা কে আরিয়ান।নট ব্যাড দ্বারা ঠিক কি বুঝিয়েছে তা বুঝতে পারলো না স্নেহা।তার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি দেখে হেসে ফেলে আরিয়ান। লজ্জায় সেঁটিয়ে যায় স্নেহা।
নির্জন এক অন্ধকার ঘরে জ্ঞান ফিরলো সাইফুলের। চোখ দু’টি যেন পাথরের মতো ভারী, সামনের দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। দেওয়ালের পাশ ঘেঁষে পড়ে থাকা তার শরীরের প্রতিটি স্নায়ু ব্যথায় কেঁপে উঠছে। ধাতস্থ হতে প্রায় ঘন্টা খানেক সময় লেগে গেল। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো এটা কোনো সাধারণ ঘর নয়, এ যেন একটি বন্ধ গোডাউন, যেখান থেকে মুক্তির পথ নেই।
হাত-পা শক্ত করে বাঁধা। চারপাশে ধুলো আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। নিঃশব্দ সেই ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎই সে টের পেল সে একা নয়।চোখ তুলে সামনের ছায়ামূর্তির দিকে তাকাতেই হৃৎপিণ্ডটা যেন এক লাফে গলার কাছ পর্যন্ত উঠে এলো। নিঃশব্দ, ভাবলেশহীন ভঙিমায় এক কোণে বসে আছে নিহাল।
নিহাল যার নামেই ভয় মিশে থাকে সাইফুলের বুকের ভিতর। সেই চাহনি, সেই নিস্তব্ধ রোষ, যেন নিঃশব্দেই বলে দিচ্ছে আজ রেহাই নেই।পিলে চমকে উঠলো সাইফুল। মনে হলো, এই অন্ধকার ঘরটাই তার কবর। মৃত্যু কি তবে এতটা নিঃশব্দ হয়!বাঁধা অবস্থাতেই সাইফুল গলা নিচু করে, কিন্তু কণ্ঠে ভয় আর উত্তেজনার মিশেলে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
“এখানে কেনো এনেছো আমাকে? তুমি ভাবছো না নূপুরের কি হবে?”
তার স্বর যেন এক বিষণ্ন করুণ সুরে কাঁপছে, চোখে আত’ঙ্কের ছায়া, কিন্তু তাতেও লুকানো এক আশার যদি কিছু বোঝানো যায়, যদি হৃদয় গলে যায়।
কিন্তু সেই কথার জবাবে নিহালের ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক নিষ্ঠুর, নির্ম’ম হাসি। একবারে শব্দ করে হেসে উঠলো সে, যেন সাইফুলের উদ্বেগটাই তার জন্য নিছক প্রহসন।
তার হাসির রেশ না মুছতেই তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“ভাই রে ভাই, তুই নাটক কাকে দেখাস? শা’লা হা’রামি, নাট্যকার কোথাকার। তুই যে আসলেই সাইফুল না সেটা আমরা জেনে গেছি।”
তার চোখে আগুনের মতো ঘৃণা, আর মুখের কথায় এক বিদ্রুপ যা হৃদয় ছিঁড়ে ফেলতে পারে নিমিষেই।
“নিহাল এটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না! কে বলেছে আমি সাইফুল না? আমিই সাইফুল শেখ।”
অগ্নি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নিহাল।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। সজোরে লাথি মা রে সাইফুলের পেটে। চেয়ার সহ উল্টে পড়ে সাইফুল।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৬
“ভালো না খারাপ তুই একটু পরেই বুঝতে পারবি। অপেক্ষা কর তোর জম আসছে! আর সে আসার পরেই স্পষ্ট হবে তুই সাইফুল নাকি সায়মন?”
গলা শুকিয়ে এলো সাইফুলের। তবে কি তার খেলা সত্যি শেষ?