তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৮
ফারহানা নিঝুম
ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে পুরো বাড়ি।মন যেন এক অদ্ভুত ঘোরে ডুবে যায়।চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে এক কোমল মায়াবী ঘ্রাণ, যেন প্রকৃতি নিজেই ভালোবাসার চিঠি লিখে পাঠিয়েছে বাতাসের হাতে।নতুন ফুটে ওঠা ফুলগুলো বাগানে।সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে সবাই জড়ো হয়েছে। শুধু তাশফিন নেই।
ক্লান্ত পায়ে নিচে এলো ফারাহ। ফারাহ কে দেখতেই জয়নাল আহমেদ শুধোয়।
“আম্মু তাশফিন কোথায়?”
চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে ফারাহ লক্ষ্য করলো সত্যি তাশফিন নেই। আরিফা আহমেদ একই টুনে ব্যস্ত হয়ে বলেন।
“ফারাহ যা মা তাশফিন কে তাড়াতাড়ি নিচে আসতে বল।”
চোখ দুটো আকারে বড় হয়ে গেল।সে যাবে?লোকটা যে পরিমাণে রূপ বদলায়! ফারাহ কবে যেনো প্রাণ হারায়।
“আমি পারবো না তুমি যাও।”
নূপুর নিচেই আসছিল, তাদের কথোপকথন শুনে সে বলল।
“আমি ভাইয়া কে ডেকে দিচ্ছি।”
এক পা সিঁড়ির দিকে দিতেই শুনতে পেলো মাহিরের হাঁকডাক। নূপুর ছুটে গেল তার দিকে। আরিফা আহমেদ ক্ষিপ্ত মেজাজে বলে উঠেন।
“ফারাহ তুই কি যাবি?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে এগিয়ে গেল ফারাহ। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে সে।তাশফিন কে ভীষণ ভয় লাগে তার। লোকটা বড্ড জাঁদরেল! উঁহু জাঁদরেল নয় অস’ভ্য। ফাজিল, নির্লজ্জ, একটুও লজ্জা নেই।
মনে মনে হাজার টা বকা দিয়ে এগুতে লাগলো ফারাহ।ডান দিকে গিয়ে নিজের ঘরটা দেখতে পেলো তার পাশেই আরো একটি ঘর রয়েছে ওখানেই থাকছে ফাজিল লেফটেন্যান্ট সাহেব তার।
রুমের কাছে এসে পা জোড়া থামলো ফারাহর। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো সে। আশপাশে এক নজর তাকিয়ে লম্বা ঢোক গিলে ভেতরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। দরজার কপাট খোলাই ছিলো
ধাক্কা দিতেই খুলে গেল পুরোটা।কেউ নেই ভেতরে। ফারাহ ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো তার।খট শব্দ করে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে এলো তাশফিন শেখ। পরনে শুধু টাওয়েল ছাড়া আর কিছুই নেই।সদ্য শাওয়ার নিয়েছে বোধহয় তাই তো চুল থেকে নিদারুণ ভঙিতে টুপ টুপ করে পানির ফোঁটা পড়ছে ফ্লোরে। ফারাহ অনুভব করছে তার গলা শুকিয়ে আসছে। পেটানো শরীর টা বেশ নজরকা’ড়া!চোরা চোখে বার বার তাকে দেখছে ফারাহ।
“কি চাই মিসেস শেখ? ওভাবে চোরের মতো না তাকিয়ে সোজাসুজি তাকান। আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে বললেই চলে, আমি নিজেই দেখিয়ে দিচ্ছি।”
দু কদম পিছিয়ে গেল ফারাহ, পিটপিট চোখ করে তাকালো তাশফিনের দিকে।
“আ.. আম্মু ড..ডাকছে আপনাকে।”
তাশফিন বাঁকা হাসলো!হুট করে তেড়ে এসে টেনে ধরে ফারাহর হাত খানা। হকচকিয়ে গেল ফারাহ।
“উফ্ মিসেস শেখ আপনি এত নরম কেন একদম তুলার মতো।হাত ধরতেই এমন হচ্ছে, জড়িয়ে ধরলে তো একে বারে..
“চুপচুপ। নির্লজ্জ লেফটেন্যান্ট সাহেব যান তাড়াতাড়ি খেতে। সবাই কে উদ্ধার করুন!”
“খাবার পরে দেখছি আগে আপনাকে খাই, এরপর..
বাকি কথাটা শেষ করতে পারলো না তাশফিন,তার পূর্বেই নূপুর ডেকে উঠে।
“ভাইয়া? ভাইয়া!
নূপুর ডাক শুনে সরে গেল তাশফিন। দরজার সামনে এলো নূপুর, দু’জন কে একসাথে দেখে মৃদু হাসলো নূপুর।
“ও ফারাহ তুমি এসেছো, আমি আবার এলাম ভাইয়া কে ডাকতে। ভাইয়া আন্টি ডাকছে তাড়াতাড়ি এসো।”
নূপুর প্রস্থান করতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তাশফিন, ফিসফিসিয়ে বললো।
“তোমাকে তো পরে দেখে নেব সুখ। আজকে রাতে তুমি কাঁদবে,আর কান্নার কারণ হবে এই তাশফিন শেখ।”
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ফারাহ, নূপুরের পিছু পিছু সেও ছুট লাগালো।
লোকটার ভরসা নেই,কখন কি করে বসে ইস্!
খাবার শেষে তাশফিন বেরিয়ে পড়েছে, যাওয়ার পূর্বে কোথায় যাচ্ছে কেনো যাচ্ছে? কিছুই বলে যায়নি ফারাহ কে। আরিফা আহমেদের সাথে কথা হয়েছে উনাকে বলেছেন বিকেলের দিকে ঢাকা রওনা দেবে।
বন্ধ গোডাউনের ভারী লোহার দরজাটা চাপা শব্দে খুলে গেল। অন্ধকারের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে ভেতরে পা রাখল তাশফিন শেখ। বাইরের ঝাঁঝালো বাতাস পেছনে ফেলে, সে এক নিঃশব্দ জগতে প্রবেশ করল যেখানে সময় থমকে আছে, আর আলো যেন ইচ্ছাকৃতভাবে গা ঢাকা দিয়েছে। চারপাশে পুরনো কাঠ, মরিচাধরা লোহার শেলফ, আর বাতাসে ভেসে থাকা ধুলোর গন্ধ সবকিছু মিলিয়ে একটা চাপা উত্তে’জনা ছড়িয়ে ছিল গোটা পরিবেশে। তার অপেক্ষায় ঠিক সামনের কনক্রীট দেয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল নিহাল। ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি, চোখে চাপা উত্তেজ’নার ঝলক। সে যেন জানতো, আজকের এই রাত শুধু একটা সাক্ষাৎ নয় একটা মোড়, যেখানে গল্প নতুন মোড় নেবে।তাশফিনের পা থেমে গেল কিছু দূরে এসে। দু’জনের মাঝখানে কয়েক হাত ফাঁকা জায়গা, কিন্তু বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে অজস্র না বলা কথায়।নিহাল এগিয়ে এলো ধীরে ধীরে, গলা থেকে নিঃসৃত হলো নীচু স্বরের একটাই শব্দ।
“তুই এলি শেষমেষ।ওই জা’নোয়ার টাকে বেঁধে রেখেছি।”
তাশফিন কোনো রকম বাক্যব্যয় না করে ভেতরের দিকে যেতে লাগল।
জ্ঞান হারিয়ে চেয়ারেই বাঁধা অবস্থায় বসে আছে সাইফুল। সাইফুল কে দেখেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। রাগে ফুঁসছে সে,চোখের ইশারায় নিহাল কে ওকে জাগাতে করলো।
পাশে থাকা পানির বোতল তুলে সজোরে পানির ঝাপটা দিল মুখের উপর ছু ড়ে ফেলল নিহাল। সাইফুল চমকে উঠে।বোঝার চেষ্টা করে তার সাথে কি হচ্ছে!
“তাশফিন তুমি আমাকে আটকে রেখেছো কেন?কি চাও তুমি?কেনো করছো এসব?”
“হুস সাইলেন্স!”
ফাঁকা ঢোক গিললো সাইফুল। পাশে থাকা বড় রড টা হাতে তুলে নিল তাশফিন। এগিয়ে এসে সাইফুলের সামনে রাখা চেয়ারে বসলো। দাঁতে দাঁত পিষে হিসহিসিয়ে বলল।
“তুই কেন এমন করলি সাইফুল?”
থরথরিয়ে কাঁপছে সাইফুল। প্রাণপাখি টা যায় যায় অবস্থা তার।
“কি করেছি আমি?”
চোখের কার্নিশ লাল হয়ে আছে তাশফিনের, সাইফুলের প্রতি রাগটা থরথর করে বেড়ে চলেছে।
“কি করেছিস জানিস না? সাইফুল তুই..
“দেখো তাশফিন তুমি যদি ভেবে থাকো আমাকে এসব বলে ভয় দেখাবে ভুল করছো। ভুলে যাচ্ছো নূপুরের কথা?”
কথার পিঠে থামিয়ে কথা গুলো বললো সাইফুল। রাগান্বিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো তাশফিন।
“জানো’য়ারের বাচ্চা তোর কি মনে হয় আমি তোকে আমার বোনের দ্বারে কাছে আসতে দেবো?তোকে তো আমি?”
অকস্মাৎ হো হো করে হেসে উঠলো সাইফুল।এতক্ষণে ভেতরে থাকা সব ভয় ডর উবে গেল মূহুর্তের মধ্যে।তার মধ্যে কোনো রকম অনুশোচনা নেই!হাসির শব্দ পুরো গোডাউনে ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে। হিংস্র ভঙিমায় বলে উঠে।
“আমি কি ভয় পাই তোকে তাশফিন?তুই আমাকে নূপুরের কাছে যাওয়া থেকে আটকাতে পারবি তো?”
হাত জোড়া থামে তাশফিনের। চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে পড়ে সে।পাশে থাকা নিহাল ফুঁসছে রীতিমতো। সাইফুল ফের বলে উঠে।
“যেখানে নিজের বউয়ের কাছে যাওয়া থেকেই আটকাতে পারিস নি, সেখানে আমার বউয়ের কাছে যাওয়া থেকে আটকানোর তুই কে!”
বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো তাশফিনের।থমকে দাঁড়ায় সে।কলার চেপে ধরে ধরে।
“কসম আল্লাহর আমি তোকে জবাই করে ফেলবো সাইফুল!”
তাচ্ছিল্যের ভঙিতে হাসছে সাইফুল।
“ফোনে ভিডিও আছে দেখ।যা তাশফিন আগে নিজের বউ কে দেখ!”
মাথা কাজ করছে না তাশফিনের, নিজের চুল খামচে ধরছে সে। নিহালের দিকে তাকিয়ে অস্থির কন্ঠে বলল।
“ফোন কই ওর?ফোন দে নিহাল!”
পকেট থেকে ফোন বের করে এগিয়ে দিল নিহাল। কাঁপা হাতে দ্রুত গ্যালারিতে প্রবেশ করে তাশফিন। ভিডিও অনুসন্ধান করে অবশেষে পেলো সে। নিস্তব্ধ রাতে ঘুমিয়ে আছে ফারাহ। চুপচুপ শুয়ে নেই সে!এদিক সেদিক করছে মাঝে মাঝে। নড়াচড়ার কারণে শাড়ির অনেক অংশ সরে গিয়েছে, ফলস্বরূপ শরীরের অনাবৃত অংশ গুলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় সব কিছু খোলামেলা। স্তম্ভ হয়ে গেছে তাশফিন।
ফারাহ তাকে বলেছিল সে ফিল করতে পেরেছে কেউ একজন তাকে দেখছিল।সে বার বার বলেছিল রুমে কেউ ছিলো!
ফোনটা শব্দ করে নিচে পড়ে গেল।থমকে গেল তাশফিন।সে একটি বার যদি ফারাহর কথা বিশ্বাস করতো!
তাচ্ছিল্যের সেই হাসি আবারো কানে এলো তাশফিনের।
“ভাই তোর বউ এত হট কি বলব?জাস্ট ফিদা হয়ে গেছি। শুধু আমি না, আমার সাথে সাথে তো সৌহার্দ্য ওর উপর ফিদা হয়ে গেছে! উফ্ মাইরি একবার হলেও ওয সাথে..
“জানো’য়ারের বাচ্চা!”
সপাটে লাথি দিয়ে উল্টে চেয়ার সহ ফেলে দিলো নিহাল তাকে।
“কুত্তার বাচ্চা তুই শেষমেষ ফারাহর দিকে..
“তোর তো বউ নেই নাহলে তোর বউটেও আদর করতাম নিহাল!”
সাইফুলের কথা গুলো কাঁটা দিচ্ছে নিহালের গায়ে!তাশফিন দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।সে এখন যা করতে চলেছে তা কেউ ভাবতেও পারবে না।
“তুই আর যাই করতি আমি তোকে বাঁচিয়ে রাখতাম সাইফুল। কিন্তু তুই আমার সবচেয়ে পার্সোনাল জিনিসের দিকে নজর দিয়ে বড্ড ভুল করে ফেলেছিস!”
চোখ উঠিয়ে তাকালো সাইফুল।নিহাল বোঝার চেষ্টা করছে তাশফিনের ভাবান্তর।তাশফিনের রাগ একমাত্র সেই দেখেছে! আজকে সাইফুলের সাথে ঠিক কি হতে চলেছে তা সে আন্দাজ করতে পারছে।
“নাম সায়মন, বহুরূপী এক। তোর ভাই সাইফুল যে আপাতত অস্ট্রেলিয়ায় বসে আছে। তুই ওর ছোট ভাই তাই তো! নূপুরের সম্পর্ক হয় সাইফুলের সাথে, বিয়ে হয় সাইফুলের সাথে অথচ সে অস্ট্রেলিয়া চলে যায় আর তার জায়গা নিলি তুই।”
তাশফিনের কথা শুনে চমকে তাকালো নিহাল। তার মানে ও সাইফুল নয় সত্যি,এর মানে নূপুরের সাথে এই লোকটা এত বছর ধরে অবৈধ সম্পর্ক করে চলেছিল?
তাশফিন আবারো বলতে শুরু করলো।
“মুখে প্লাস্টিক সার্জারি করানো হয়েছে,এক মাত্র আমাদের ধোকা দেওয়ার জন্য। এবং কি ওই যে মাহির ওকেও তুই ব্যবহার করেছিস।”
বাঁকা হাসলো সাইফুল নামক ছদ্মবেশী সায়মন।
“আরে বাহ্ সব তো দেখি জানিস।”
হাতে নেওয়া ছুরি দিয়ে কব্জি কেটে দিল তাশফিন। গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল সাইফুল।
“শা’লা, তোদের মতো পাচারকারী খুব বেশী দিন টিকতে পারে না। আগে তোকে শেষ করব এরপর তোর অস্ট্রেলিয়ার ভাই কে। তোর এত্ত সাহস আমার বোনের সাথে এত বড় ধোঁকাবাজি করিস। কু’ত্তার বাচ্চা!”
কথাটা বলেই ধারালো লম্বা ছু’রিটাই তুলে নিল তাশফিন।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৭
“হ্যালো!”
“শেষ সব কিছু শেষ আরিয়ান।”
নিহালের ফোন পেয়ে প্রথমে চমকালো। কিন্তু সব শেষ শুনে আঁতকে উঠে সে!কি হলো নতুন করে?
“কি হয়েছে বলবি প্লিজ?”
“সাইফুল…