তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৬
ফারহানা নিঝুম
ঘটা করে বৃষ্টি কে আমন্ত্রণ জানাতে হয়নি।বিনা আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছে তিনি। টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে পৃথিবীর পৃষ্ঠে।গাছের পাতা গুলো ধুয়ে পানি ঝরছে। রাস্তার ধারে গর্ত গুলোতেও পানি জমতে শুরু করেছে রিতিমত।
সালোয়ার কিছুটা উপরে তুলে হেঁটে যাচ্ছে ফারাহ। আজকে বুঝি তার সাথেই এমন হওয়ার ছিল? কিছুটা দূরে লালটুর চায়ের দোকানের কাছে দাঁড়ালো। বৃষ্টি টা একটু কমে এলেই কলেজে যেতে হবে।এডমিট কার্ড ইতিমধ্যেই দেওয়া শুরু করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
আজকে স্নেহা আসেনি,বলল তার ভালো লাগছে না।এখন কাউকে না কাউকে তো যেতেই হবে!সেই সুবাদে ফারাহকেই আসতে হয়েছে। বিধিবাম হঠাৎ করে বৃষ্টিটাও শুরু হলো।
ভালো হয়েছে বেশী বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই চলে এসেছে না হলে ভিজতে হতো তাকে।
বাইরের অবস্থা দেখে চিন্তিত হলেন আরিফা আহমেদ। মেয়েটা ছাতা ছাড়াই কলেজে বেরিয়েছে। ওদিকে স্নেহা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছেন তিনি। নবীন টা জয়নাল আহমেদের সঙ্গে বাইরে গিয়েছে, পুরুষ বলতে সাজ্জাদুল আহমেদ ছাড়া বাড়িতে কেউই নেই।
সুরাইয়া বাইরের জামা গুলো কেচে ধরিতে মেলে দিয়ে বাইরে এলো।
“ছোট চাচি আমার কাপড় গুলা মেইলা দিছি।”
কপাল চাপড়াচ্ছেন আরিফা আহমেদ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“হায়রে কপাল! আচ্ছা সুরাইয়া তুই কি চোখে কম দেখিস?”
সুরাইয়া মাথা চুলকাতে লাগলো,সে আবার কি ভুল করলো?
“কেন গোঁ ছোট চাচি আমি আবার কি করলাম?”
“এই যে বৃষ্টি পড়েছে তুই দেখছিস না?কাপড় গুলো নিশ্চয়ই ছাদের দড়িতে দিয়ে আসছিস?”
জিভ কা’টল সুরাইয়া। সত্যি ভুল করে ফেলছে সে। ইস্ কী লজ্জা।
“আমি এখুনি নিয়ে আসছি।”
সুরাইয়া এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না,ছুটে গেল ছাদের দিকে।
আরিফা আহমেদ রান্না ঘরে গেলেন। মাছের টুকরোগুলো পলিথিনে মুড়িয়ে ফ্রিজে রেখে দিলেন শায়লা আহমেদ।
“জানো আপা সুরাইয়া কি করছে?”
ফ্রিজ বন্ধ করে এলো শায়লা আহমেদ।
“কী করছে?”
“আর বলো না, বৃষ্টির মধ্যে কাপড় মেলে দিছে ছাদে।”
সহসা হেসে ফেললো শায়লা আহমেদ।
“এখন আবার গিয়েছে কাপড় গুলো আনতে।”
শায়লা আহমেদ হাসতে হাসতে বলল।
“ওর আর বুদ্ধি হবে না।”
মূহুর্তের মধ্যে মলিনতা দেখে দিল আরিফা আহমেদের মুখাবয়ব জুড়ে।
“কী রে তোর আবার কী হয়েছে?”
“আপা ফারাহ কে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয় গোঁ। মেয়েটার বুদ্ধি কবে হবে? কথায় কথায় তর্কে জড়ায়।যাকে তাকে শুনিয়ে দেয়। অতিরিক্ত চঞ্চল।”
ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখেই বললেন শায়লা আহমেদ।
“ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না। আমাদের ফারাহ যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে।আর ওকে চাঞ্চল্যের কারণেই এতটা ভালবাসি সবাই। সবসময় প্রাণবন্ত হাসিখানা ঠোঁটে ঝু লে।”
চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরিফা আহমেদ।
“তারপরেও আপা এলাকার লোকজন কি ওকে কম কথা শুনায়? সেদিন স্নেহা এসে বলল শুনলে না? চেয়ারম্যানের বড় ছেলের বউ নাকি তাকে কথা শুনিয়েছে। সেও পাল্টা শুনিয়ে দিছে।”
“ওসব নিয়ে এত ভাবিস না তো। বাদ দে।”
মৃদু শব্দে বৃষ্টি মাটিতে পড়ছে,আকাশটা ঘন মেঘে ঢাকা, সূর্যের আলো ফুঁটে উঠতে পারছে না ঠিকমতো।কাঁচা রাস্তা বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। মাটির গন্ধ আরও তীব্র হয়ে ওঠেছে। সালোয়ারের পায়ের অংশ একটু উপরে তুলে কলেজ গেটে ঢুকে ফারাহ।অফিস রুমের বাইরে ভিড় জমেছে। অনেক ছাত্র ছাত্রী আজকে এসেছে। আসবেই তো, অনেকেই তো এডমিড কার্ড নেয়নি।
দাঁড়িয়ে থাকতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে ফারাহর। ব্যাগ রেখে বসলো সে,এদিক সেদিক তাকাচ্ছে বারংবার। আনমনে ঘাড় ফিরিয়ে ডান দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আকস্মিক থমকে গেল। আবারো তাকালো সেদিক পানে। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার?
দৃষ্টি সুঁচালো! হাত বোলাচ্ছে ক্লিন সেভ গালটায়। ফাঁকা ঢোক গিললো ফারাহ, উঠে দাঁড়ালো তৎক্ষণাৎ।
বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে এলো তাশফিন। পালাতে চাইলো ফারাহ, অথচ তা করার পূর্বেই তীক্ষ্ণ ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠস্বর কর্ণ স্পর্শ করে।
“একদম পালাতে চেষ্টা করবে না। তাহলে খুব খারাপ হবে।”
পা দুটো স্থির হয় ফারাহর। কম্পন অনুভব করে সর্বাঙ্গে।
ঘুরে দাঁড়ালো তৎক্ষণাৎ, আলতো করে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল।
“দেখুন আমরা শুধু আপনাদের দেখতে রিসোর্টে গিয়েছিলাম।আর কিছু না সত্যি!এর আগে কখনো নেভিদের সামনে থেকে দেখিনি তাই। এখন এটা ধরে যদি আপনি আমাকে ফলো করেন এটা মোটেও ভালো দেখায় না। আপনি জানেন না ছোটদের বড়রা ফলো করলে ভালো দেখায় না।”
ফারাহ এক বার যদি মুখ উঁচিয়ে চাইতো তাহলে বোধহয় চমৎকার হাসি টুকু দেখতে পেতো তাশফিন শেখের ওষ্ঠ ভাঁজে।
“শুনো মেয়ে আমি মোটেও তোমাকে ফলো করে আসিনি বুঝতে পেরেছো? আমাদের ওতটা সময় নেই যে তোমার মতো চুনোপুঁটির পিছনে থাকব। আমার কিছু ব্যক্তিগত কাজ আছে তাই এসেছি।”
কথাটুকু বলে উল্টো ফিরে গেল তাশফিন।নত মস্তক উঠিয়ে তাকালো ফারাহ।সে কি বেশী বেশী বলে ফেলল? ভাবনায় পড়ে গেল।
নৈঃশব্দ্যে হাসছে তাশফিন, এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।
এখানে কলেজে আসার এক বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে তার।এই কিশোরী কন্যার ব্যাপারে জানাটা প্রয়োজন।
❝ যদি অপরিচিত কেউ হয় তাহলে সাত খু’ন মাফ। যদি পরিচিত কেউ হয় তাহলে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখের আজীবনের বন্দিনী হবে।❞
আজকে তাদের ফেরার কথা ছিল, অথচ ফিরেনি সে।বাকি টিম কে পাঠিয়ে দিয়েছে। রিসোর্টে রয়েছে শুধু সৌহার্দ্য আর তাশফিন শেখ দু’জনেই।
প্রিন্সিপালের কক্ষে অপেক্ষা করছে তাশফিন। অহেতুক সময় নষ্ট করার মতো মানুষ নয় সে। অথচ আজ তাকে এখানেই অনেকটা সময় দিতে হচ্ছে।
তবে দোষ কি তাতে? যদি একটুখানি সময় দিয়ে অসময়ে পাশে থাকা মানুষটিকে পেয়ে যায়?
“হ্যালো মিস্টার তাশফিন শেখ।”
অর্ধ বয়স্ক লোকটি ভেতরে প্রবেশ করেই তার সঙ্গে কুশন বিনিময় করে।
“হ্যালো মিস্টার জায়ান।”
“আমাদের কি সৌভাগ্য আপনার মতো একজন কমান্ডার এসেছে কলেজে।”
অল্প হাসলো তাশফিন।
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদটি নৌবাহিনীর একজন মধ্য-স্তরের অফিসারের র্যাঙ্ক, যা সাধারণত লেফটেন্যান্টের পর এবং কমান্ডারের আগে আসে। এই পদে পৌঁছানোর জন্য সাধারণত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয়।বেশিরভাগ নৌবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদে ৬-৮ বছর কাজ করার পর এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।তবে কিছু ক্ষেত্রে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ২৮-৩০ বছর বয়সেও কেউ এই পদে পৌঁছাতে পারেন।❝তাশফিন শেখ❞ বয়স ঊনত্রিশের কোটায়। নিজের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা থেকে নিজ জায়গা তৈরি করে নিয়েছে সে।নিজ সাহসীকতার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদটি।
“দেখুন এসব বলে লজ্জা দেবেন না! আমি এক বিশেষ কারণে এসেছি। বলতে পারেন ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন।”
প্রিন্সিপাল জায়ান আহমেদ চেয়ারে বসলেন।
“হ্যা হ্যা বলুন কী সাহায্য করতে পারি?”
অদূরে দাঁড়িয়ে একটি ছবি তুলেছে তাশফিন। হয়তো একটুখানি অসৎ হয়েছে সে,তবে তাতে আক্ষেপ নেই তার।
“এই মেয়েটা,ওর সম্পর্কে ইনডিটেইলস সব কিছু বলুন।”
ফারাহ কে দেখে ঈষৎ নজর লুকালেন জায়ান আহমেদ।
“ফারাহর সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন মিস্টার তাশফিন?”
“ফারাহ” দু’বার বিড়বিড় করে আওড়াল তাশফিন।
“হ্যা ওই যে বললাম একটু ব্যক্তিগত প্রয়োজন আছে।”
গোপনে নিঃশ্বাস ফেললেন জায়ান আহমেদ। মুখাবয়ব খুব একটা সুবিধার লাগছে না তার।
“কী হয়েছে মিস্টার জায়ান? কিছু বলছেন না যে?”
“ওর নাম ফারাহ আহমেদ। সাজ্জাদুল আহমেদের এক মাত্র মেয়ে।বয়স সবে সতেরো বছর। আমাদের কলেজে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট।খুব হতাশাজনক কথা হচ্ছে এক বছর আগে ফারাহর বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু… কিন্তু তার স্বামী সেদিনই ফেলে চলে যায় ।এই দুর্নাম নিয়েই গত একটি বছর ধরে কা’টছে তার।”
নৈঃশব্দ্যে উঠে দাঁড়ালো তাশফিন। হৃদপিন্ড প্রবল বেগে ছুটে চলেছে। ধুকপুক ধুকপুক শব্দটি প্রগাঢ় হচ্ছে।তার গলা শুকিয়ে আসছে, হাতের আঙুল কাঁপছে অজান্তেই। বুকের ভেতর যেন ঝড় বইছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চারপাশের পরিবেশ থমথমে, অদৃশ্য কোনো বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে তাকে।এক পা এগিয়েই থেমে যায় সে। দমবন্ধ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে শরীর জুড়ে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে ভয়ং’কর, অনিবার্য!তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে।তাশফিনের চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে,তার কানে সব শব্দ দূরে সরে যাচ্ছে, শুধু হৃদপিণ্ডের প্রচণ্ড স্পন্দন স্পষ্ট হয়ে উঠছে ধুকপুক! ধুকপুক!একধরনের অদৃশ্য শীতলতা যেন র’ক্তের শিরাগুলো বরফ করে দিচ্ছে।
আলতো করে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। প্রিন্সিপালের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো অফিস রুমের দিকে। ফারাহ লাইনে দাঁড়িয়েছে।হাত ঘড়িটায় সময় দেখে নিচ্ছে বার বার। চঞ্চল দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুরপাক খাচ্ছে। হাতে খামচে ধরেছে ওড়নার শেষপ্রান্ত টুকু। ছোটখাটো শরীর টা।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৫
তাশফিন থমকালো,চমকালোও প্রচুর।এই বাচ্চা মেয়েটা তার স্ত্রী?এই পবিত্র মুখ খানি সে এক পলক ফেরে দেখেনি।চলে গিয়েছিল একটি বছর পূর্বে তাকে ফেলে।তাশফিনের চোখ স্থির হয়ে রইল ফারাহর ওপর। এক বছর—মাত্র এক বছর, অথচ মনে হচ্ছে দু’জন্ম পেরিয়ে গেছে। এই চঞ্চল, ছোটখাটো মেয়েটা তার স্ত্রী! অথচ সে তাকে এক মুহূর্তের জন্যও বুঝতে চায়নি, চিনতে চায়নি।তাশফিনের বুকের ভেতর কিছু একটা মোচড় দিয়ে উঠল। সময় থেমে গেল যেন, অথচ ফারাহ তখনো বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে—অপেক্ষা।