তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৫৩
ফারহানা নিঝুম
বিয়ের তোরজোর শুরু হয়েছে।এই কয়েকদিনে বেশ কয়েক বার নবীন তাকে ফোন করেছে অথচ ঝুমুর ধরেনি। হয়তো তাকে সবাই বলবে সে বিশ্বাস’ঘাতক।সে ছলনা করেছে নবীনের সাথে। হয়তো সত্যিই সে ছলনা করেছে। নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে ঝুমুরের। ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছে সে।খুব ভালোবাসতো লোকটা তাকে।
বিয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবটাই শেষ। ফারাহ অনেক বার পাত্রের ছবি দেখানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ঝুমুর দেখেনি।
হলুদ রঙের নরম আলোয় ঝলমল করছে পুরো বাড়িটা। টুকরো টুকরো আলো যেন সোনালী পরশ ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে। বারান্দা থেকে শুরু করে উঠোন পর্যন্ত, প্রতিটি কোণে যেন আনন্দের এক উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে আছে। আজ ঝুমুরের গায়ে হলুদ এক কোমল, রঙিন অধ্যায়ের শুরু। ঝুমুর পড়েছে কাঁচা হলুদের শাড়ি, নিখুঁত ভাবে আঁচল টেনে নেওয়া, কপালে ছোট্ট টিপ, মুখে একটুকরো মিথ্যে হাঁসি। তার চারপাশে সাজিয়ে বসেছে বান্ধবীরা, তারাও সবাই একই রঙে সেজে উঠেছে যেন একটা হলুদের বৃষ্টিতে একসাথে ভিজে যাচ্ছে সবাই। হাসির ফোয়ারা, আলতার গন্ধ, আর মধুর গানের ছন্দে ভরে উঠেছে সন্ধ্যার আকাশ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে ফারাহ। বিয়ে মানেই একটা বড় দায়িত্ব।কখনো মাহির রাখছে তো কখনো অতিথিদের দেখছে। ভাইয়ের বউ হিসেবে ভাবি হলুদ বাটা করবে।সেই জন্য এক গাদা হলুদ নিয়ে কিচেনে চলে গেল ফারাহ।
এগুলো সে পারে করতে। মাঝে মাঝে বিয়ের আগে বাড়িতে হলুদ বেটে মুখে দিতো মুখশ্রী হলদেটে দেখানোর জন্য।
চুপটি করে হলুদ বাটতে বসে গেল ফারাহ। নিজের মনের মতো বেটে চলেছে সে।
“উঁহু উহু মিসেস শেখ!”
হকচকিয়ে গেল ফারাহ। দরজার দিকে তাকালো তৎক্ষণাৎ।
“আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?”
চোখ তুলে তাকালো ফারাহ,তাশফিন এখনো ট্রাউজার আর টিশার্ট পরে আছে।নাক মুখ কুঁচকে নিল ফারাহ।
“আপনি এখনো তৈরি হন নি? সবাই তো চলে আসবে! আপনি এখনো তৈরি হন নি কেন?”
দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো তাশফিন,দুহাত ভাঁজ করে বুকে গুঁজে।
“আপনি এসে তৈরি করে দিয়ে যান মিসেস শেখ। আপনার ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল আমি।”
তাশফিনের লাগামহীন কথায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম ফারাহর।হলুদ বাটায় মন দিলো সে। কড়া ভাবেই বললো।
“একদম দুষ্টুমি করবেন না লেফটেন্যান্ট সাহেব,যান তো গিয়ে চট করে রেডি হয়ে আসুন। আম্মু আপনাকে যে পাঞ্জাবি দিয়েছে সে ওয়াড্ররোবে রাখা আছে নিয়ে নিবেন।যান যান আমাকে কাজ করতে দিন।”
মুখাবয়ব জুড়ে গাম্ভীর্য ভাব দেখা দিলো তাশফিনের ন্যায় চোখ পাকিয়ে তাকালো সে। ফারাহ দ্বিতীয় বার লোকটার দিকে তাকানোর সাহস করলো না।তাশফিন চুপচাপ বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ফারাহ,হাফ ছেড়ে বাঁচল যেনো।
আহমেদ পরিবারের সবাই কাল আসবে। পরিবারের সবাই আসবে ভাবতেই মনটা নেচে নেচে উঠছে ফারাহর।
একটু পরেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে।
হলুদ রঙা শাড়ি পড়েছে স্নেহা,শাড়িটা দিয়েছে আরিয়ান।
হলুদের অনুষ্ঠানে যাবে বলে তৈরি হচ্ছে সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুলো বেঁধে নিলো সে। নিজেকে পরোখ করে দেখে নিলো সবটা ঠিক আছে কিনা! আয়নার দিকে তাকাতেই শরীরের প্রতিটি কোষ বিভাজন অস্থির হয়ে উঠেছে। পিছনে হলুদ রঙা ফতুয়া পরিহিত পুরুষটি তার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে।
অ্যাডামস আপেল কেঁপে উঠল তার,তার স্ত্রী,যার সৌন্দর্যে বিমোহিত হচ্ছে আরিয়ান।এদিক সেদিক তাকিয়ে নজর সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে সে।আরিয়ানের দৃষ্টি স্নেহার উপর স্থির, তাতে এক অপার বিস্ময় আর অনির্বচনীয় মুগ্ধতা। যেন চোখে চোখে একটি অনুচ্চারি প্রণয় কাব্য।প্রতিটি চাহনি যেন স্নেহার হৃদয়ে ঢেউ তোলে। স্নেহা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়, দৃষ্টিপাতের উত্তাপে গাল দুটো রক্তিম। আশপাশে তাকিয়ে নিজেকে লুকোতে চায়, কিন্তু আরিয়ানের চোখ এড়ানো যেন অসম্ভব। হঠাৎই আরিয়ানের দৃষ্টি পড়ে স্নেহার ব্লাউজের খুলে যাওয়া ফিতেতে। এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত এগিয়ে এসে তা ধরে ফেলে সে। অপ্রস্তুত হয়ে পিছু হটে স্নেহা, চোখে বিস্ময়।
কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করে সে।
“কি করছেন?”
আরিয়ানের ঠোঁটে খেলে যায় এক দুষ্টু হাসি।
“ভালোবাসবো।”
স্নেহার মনে হয়, কান দুটোতে আগুন লেগে গেছে। লজ্জা, রাগ আর অপার বিস্ময়ে ঠোঁট কাপছে তার। এমন নির্লজ্জ স্পষ্টতা! কিন্তু কে জানে, সেই সরল স্বীকারোক্তির মাঝেই হয়তো কোনো নির্মল আবেগ খেলে যাচ্ছে।ধীরে, খুব ধীরে, অপার মনোযোগে ব্লাউজের ফিতেটা বেঁধে দিচ্ছিল আরিয়ান। স্নেহার উন্মুক্ত পিঠের মসৃণ ত্বক যেন তার চোখে আগুন ধরিয়ে দিল। গলা শুকিয়ে এলো, অজান্তেই এক গালভরা নিঃশ্বাস ফেলে সংবরণ করল নিজেকে কিন্তু সেই সংযমের পর্দা টানলেই ছিঁড়ে যায়। ঝুঁকে পড়ল সে। খুব কাছে, আরও কাছে। চোখের পলকে ঠোঁট ছুঁয়ে গেল স্নেহার পিঠের ত্বক। নিঃশব্দে, নিঃসীম গভীর, আবেশী চুমু এঁকে দিলো সে, যেন ভালোবাসার সিলমোহর। স্নেহা থমকে দাঁড়িয়ে থাকল। তার হৃদয়জুড়ে কাঁপন, নিঃশ্বাসজুড়ে ঝড়।
“আই লাভ ইউ ম্যাম।”
চোখ দুটো খিঁচিয়ে বুঁজে নিল স্নেহা, দু’হাতে পিছন থেকে জড়িয়ে আছে আরিয়ান। অকস্মাৎ সামনে ফিরে পুরুষ্ট বক্ষে মুখ লুকায় স্নেহা,সহসা হেসে ফেলল আরিয়ান। লজ্জায় আড়ষ্ট স্নেহা।
ক্লান্ত শরীর আর এলোমেলো ভাবনা মাথায় নিয়ে ফারাহ ধীরে ধীরে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে এখনো হলুদের রঙে রাঙা চারপাশ, কানে আসছে গান আর কোলাহলের টুকরো টুকরো আওয়াজ। শরীরে এখনো লেগে আছে হলুদের ঘ্রাণ, সকালের শাড়িটা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে হলুদে ভিজে। তাই রুবেনা শেখের দেওয়া নতুন হলুদ পারের, থোকা থোকা ফুল আঁকা শাড়িটাই পরার সিদ্ধান্ত নিল সে। রুমের দরজাটা ঠেলেই ভেতরে ঢুকলো ফারাহ। কিন্তু এক পা এগোতেই পায়ের গতি থেমে গেল। চোখ স্থির, হৃদপিণ্ডে এক অনাহূত ধাক্কা। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে সামনে, যেন চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা বুঝে ওঠার চেষ্টা করছে।
রাগে দুঃখে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল ফারাহর ভেতরটা। মুখ ভার করে রুমে ঢুকেই চোখে পড়লো বিছানার ওপরে লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে আছে তাশফিন। যেনো কোনো দুঃসাহসিক অভিযানে নয়, পৃথিবীর সমস্ত ক্লান্তি বুকে নিয়ে শুয়ে থাকা এক যোদ্ধা। অথচ আজ তার গায়ে হলুদের দিন! এই উদাসীনতা, এই অবাধ্য জেদ সবই যেন তাশফিনেরএটা কেমন কথা?তার ভালোবাসা কী এক ঠাণ্ডা দেয়ালে এসে ধাক্কা খাচ্ছে বারবার! গলা নামিয়ে বললো সে, তবু তী’ক্ষ্ণ কাঁটার মতো ছুঁয়ে গেল কথাগুলো।
“ও লেফটেন্যান্ট সাহেব, আপনি এখনো তৈরি হননি কেন? কখন বলেছিলাম, তৈরি হতে?”
তাশফিন মুখ ফিরিয়ে তাকালো তার দিকে। কপালে বিরক্তির রেখা, চোখে কোনো উত্তর নেই শুধু নিঃসীম নিরবতা। কোনো শব্দ না করে চোখ ফিরিয়ে নিল আবার। যেন ফারাহর বলা সব কথা বাতাসে মিলিয়ে গেল। ফারাহর বুকের ভেতরটা হঠাৎ খুব ভারী লাগলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, অসহায়ের মতো হাত ধরে টেনে বসালো তাকে বিছানা থেকে।
“উঠুন না, সবাই তো বাইরে আপনার অপেক্ষায়। দেখুন, এখনো রেডি হননি আপনি।”
তাশফিন নিঃসাড় দৃষ্টিতে ফারাহর চোখের দিকে তাকিয়ে আবার গা ছাড়া ভঙ্গিতে শুয়ে রইলো। এই অনাগ্রহ, এই নির্লিপ্ততা সব মিলে যেন ফারাহর ভেতরের প্রাচীরটা ভেঙে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে। কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলো অনুরোধে।
“এমন করছেন কেন? উঠুন প্লিজ।”
“পারব না।”
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলো তাশফিন, রাগে চিকন নাকের ডগা ফুলে উঠে ফারাহর। চাপা রাগ দেখিয়ে বললো।
“কেনো পারবেন না?”
“ইচ্ছে করছে না।”
“এমন করছেন কেন?”
রাগী চোখ করে তাকালো তাশফিন, চুপসে গেল ফারাহ। ওয়াড্ররোব থেকে তার হলুদ রঙা পাঞ্জাবি টা বের করে ওয়াশ রুমে দিয়ে এলো।
“আমাকে জ্বালাতে আপনার ভালো লাগে? সবসময় এমন করেন কেন আপনি?”
প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না তাশফিন, ফারাহ টেনে দাঁড় করালো লম্বা পুরুষ কে। শক্তপোক্ত দেহের পুরুষ কে সামলাতে কত কষ্ট হয় ফারাহর।
“এবার যান গিয়ে তৈরি হয়ে আসুন।”
“পারব না।”
নাকচ করে তাশফিন,এবারেও রাগ হলো ফারাহর। কিন্তু সে চেয়েও রাগ দেখাতে পারছে না।ঠেলিয়ে ধাক্কিয়ে ওয়াশ রুমে নিয়ে গিয়ে শাওয়ার অন করে দিলো।তার পার্সোনাল বডি ওয়াশ নিয়ে মাখিয়ে দিলো তাশফিনের শরীরে।
“সবসময় এমন করতেই হবে আপনার? আমি বললাম পারব না আসতে, আপনাকে রেডি হতে বলেছিলাম অথচ রেডি হলেন না। একটা কথাও শুনেন না, সবসময় নিজের মর্জিমাফিক চলেন।এমন কেন লেফটেন্যান্ট সাহেব আপনি? আমাকে এত জ্বা’লান কেনো?”
এতক্ষণে মুখ তুলে তাকায় ফারাহ,ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাশফিন।সে মোটেও খেয়াল করেনি তাশফিনের সাথে সাথে সে নিজেও ভিজে গেছে।ভয়ে টুক করে সরে গিয়ে বডি ওয়াশ জায়গা মতো রেখে আমতা আমতা করে বললো।
“ক.. করে নিন গোসল,আ.. আপনি ববের হলে আমি..
তাশফিনের দৃষ্টি এড়াতে পারছে না ফারাহ, পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে এখনো। ফাঁকা ঢোক গিলে ফারাহ।ওয়াশ রুম থেকে বেরুতে গেলে আটকা পড়ে বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে। চমকে উঠে ফারাহ
থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো সর্বাঙ্গ।দেহের সাথে মিশিয়ে নিলো ফারাহ কে, ছটপট করছে ফারাহ।
“ছাড়ুন ছাড়ুন,কি করছেন লেফটেন্যান্ট সাহেব,ছাড়ুন প্লিজ।”
“আই কান্ট..
কথাটা বলেই ওষ্ঠো জোড়া নিজের দখলে নিয়ে নিলো অবাধ্য তাশফিন শেখ। সর্বাঙ্গ কেমন অসাড় হয়ে আসছে ফারাহর। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো,দূর্বল হয়ে নিজের সম্পূর্ণ ভার টা ছেড়ে দিলো তাশফিনের উপর,তার সাথে সাথে নিজের ধৈর্য টুকু হারিয়ে ফেলে তাশফিন শেখ। সম্পূর্ণ রূপে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় প্রণয় কন্যা কে। আলগোছে কোলে তুলে এগিয়ে গেল বাথটাবে। উষ্ণ ছোঁয়া এঁকে দিলো কপালের মধ্যেখানে। আবেশে চোখজোড়া বুঁজে নিল ফারাহ।
“কমান্ডার এমন কেনো আপনি?”
“এরচেয়ে ভয়ং’কর!”
পিটপিট চোখ করে তাকালো ফারাহ।তাশফিনের প্রশস্ত চোখের চাহনি নারী সত্তা কাঁপিয়ে তুলে।তাশফিন একটু করে এগুতেই অস্থির কন্ঠে ফারাহ বলে উঠে।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৫২
“না, না।”
“ইয়েস।”
“আপনি ইচ্ছে করে এতক্ষণ ভনিতা করছিলেন?”
“অ্যাম সরি সুখ। তোমার সান্নিধ্য পেতে একটুও তো ভনিতা করতেই হবে।”