তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৮
ফারহানা নিঝুম
রাতের বেলা চারদিকে এক নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে।শুধু মাঝেমধ্যে জলের ফোঁটা গাছের পাতার ওপর পড়ে টুপটাপ শব্দ তোলছে। চিলেকোঠার ঘরটায় টিনের চাল লাগানো।টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ে ঝন ঝন শব্দ তুলতে ব্যস্ত। বাইরে স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা জায়গায় ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে। পাশেই ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। ঠান্ডা বাতাস বইছে,সেই বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ আর সোঁদা ঘ্রাণ মিলে মিশে একাকার।
জানালার কাছে সফেদ পর্দা উড়ছে ধীরে ধীরে, বাল্বের আলোয় রুমের ভেতরে লালচে হয়ে উঠেছে।
পুরোপুরি চোখ মেলে তাকাল তাশফিন।এখন অনেকটাই স্বচ্ছন্দ বোধ করছে সে। উঠে বসার চেষ্টা করতেই কর্ণ স্পর্শ করলো মেয়েলি কন্ঠস্বর।
“ইয়া আল্লাহ কী আজব কাজকর্ম! আপনি উঠছেন কেন?আরে আরে শুয়ে থাকুন।”
তড়িঘড়ি করে ভেতরে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিল ফারাহ।
চোখের মনি ছোট হয়ে এলো তাশফিনের। শুভ্র রঙের সালোয়ার স্যুট পরেছে ফারাহ,,ছোপ ছোপ র’ক্তে’র দাগ স্পষ্ট হাত ভর্তি চুড়ি। পায়ে এক জোড়া নূপুর। হাতে থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। টেবিলের পাশে থালা রেখে বলল।
“আপনি তো অসুস্থ! এভাবে উঠছেন কেন?”
দৃষ্টি চঞ্চল! কন্ঠে তীব্র তেজ। ভেতরে ভেতরে হাসছে তাশফিন।মন পাড়ায় বয়ে যাচ্ছে প্রশান্তির ঢেউ।হাসিটুকু টুপ করে গিলে নিল অচিরেই।
“তুমি কাকে কি বলছো জানো?”
ফারাহ থমকালো,ঈষৎ কেঁপে উঠলো বক্ষপট।
“না মানে আপনি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এটা তো সেদিন বললেন কিন্তু.. দেখুন আমি কিন্তু কিছু করিনি। আপনি অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন তাই আপনাকে নিয়ে এসেছি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তাশফিন প্রত্যুত্তরে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলো না।ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। ফারাহ চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো। শার্টের অংশ টেনে নিজেকে ঢেকে নিল তাশফিন।গলা খাঁ’কিয়ে বলল।
“এতটা সাহস দেখানো মোটেও ভালো নয়।আর শুনো এই যে নিয়ে এলে এখানে,এক অপরিচিত পুরুষ আমি।যদি কিছু একটা ভুল করে ফেলতাম তাহলে!”
ছোট্ট মস্তিষ্কে কঠিন বাক্য গুলো ঢুকলো না ফারাহর। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সে।তাশফিন বুঝে গেল ফারাহ কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি।বুকের বাঁ পাশে ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করছে সে, ব্যান্ডেজ করা জায়গায় হাত স্পর্শ করে শুধোয়।
“এটা কে করেছে? ডক্টর এসেছিল?”
“আরে না এই কারি’শমা আমিই করেছি।”
অধর কোণে ঝু’লছে চমৎকার হাসি।মুখ তুলে তাকায় তাশফিন,ভ্রু দয় কুঁচকে এলো তার। সন্দিহান কন্ঠে ফের শুধোয়।
“তুমি?”
“হ্যা।”
“তুমি কি ডাক্তারি পড়ছো?”
“আরে না না আমি তো আর্টসের স্টুডেন্ট।”
আহাম্মক বনে গেল তাশফিন,ফের সন্দিহান কন্ঠে শুধোয়।
“তাহলে কি করে কি করলে?”
ফারাহ প্রাণবন্ত হাসি উপহার দিয়ে বলল।
“মুভিতে দেখে শিখেছিলাম। ভাবলাম এত দিন মুভি দেখে যখন শিখেছি সব গুলো আপনার উপরেই ট্রাই করা যাক।”
দৃষ্টি হলো তী’ক্ষ্ণ। এই মেয়ে বলে কী?কী ডেঞ্জারাস ব্যাপার স্যাপার।বউ তার মাত্রা’রিক্ত চঞ্চল। অবশ্য তা হওয়াটা স্বাভাবিক,দেখেই তো বোঝা যায় বাচ্চা একটা মেয়ে। আচ্ছা ওর বয়স কত হতে পারে? আন্দাজ করতে সক্ষম হলো না তাশফিন।মনে মনে গুনে নিল বোধহয় বিশ বা একশো বছর হবে।
হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো তাকে, ফারাহ নির্দ্বিধায় পা ফেলে এগিয়ে গেল। আকস্মিক এক হাতের মুঠোয় দু হাতের কব্জি চেপে ধরে তাশফিন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব ফারাহ।হাত ছুটাতে ধস্তাধস্তি শুরু করে।মনে মনে প্রচুর হাসলো তাশফিন।
“সত্যি বলছি আমি কিন্তু কিছু করিনি।”
তাশফিনের দৃষ্টি হলো তী’ক্ষ্ণ, কন্ঠস্বর হলো ভারী।
“ভাবতে পারছো কি করেছো তুমি? একজন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার কে নিয়ে এসেছো এখানে।তার উপর ভুলভাল জিনিস ট্রাই করছো তার উপর।”
আদল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল বিষন্নতা। কষ্টে জর্জরিত হৃদয়। ফারাহ কি তবে ভুল করে ফেলল? মস্তক নেমে এলো থুতনিতে।তাশফিন তীর্যক চোখে তাকায় তার বাচ্চা বউটার দিকে। থুতনিতে একটা কালো তিল। ফর্সা মেয়েদের শরীরে তিল থাকা মানে বিশাল কিছু।যা সর্বক্ষণ লাল টকটকে হয়ে ফুটে উঠে।তাশফিনের দেহ জুড়ে বয়ে গেল এক বিশাল ঝড়।মন আঙিনায় একটা তীব্র দুষ্টু ইচ্ছের উদয় হয়েছে। থুতনিতে চুম্বন এঁকে দিতে মন চাইছে। নিজেকে সংযত করা প্রয়োজন, অগোচরে ঢোক গিললো তাশফিন।
অতঃপর নিরবতা ভেঙ্গে ফারাহ মিনমিনে গলায় বলল।
“লেফটেন্যান্ট সাহেব আই অ্যাম ভেরী স্যরি। আমি বোধহয় ভুল করে ফেলেছি।”
“লেফটেন্যান্ট সাহেব” দারুণ লেগেছে ডাকটি তাশফিনের নিকটে।সহসা হাত ছেড়ে দিল সে। ফারাহ পিছিয়ে গেল দু কদম।বাইরে থেকে কারো পায়ের খচখচানি শব্দ কর্ণে এলো। আতং’ক ছড়িয়ে পড়লো সর্বাঙ্গে।
ফারাহ অস্থির কন্ঠে বলে উঠে।
“লেফটেন্যান্ট সাহেব দয়া করে নিজের পুটলি পাটলি উঠিয়ে চলে যান। উপ্স স্যরি আপনার তো কোনো পুটলি নেই,আপাতত নিজের বড় শরীর টা নিয়ে বিদেয় হন।”
এতটা পরিবর্তন দেখে হতভম্ব তাশফিন। মেয়েটা চা’লাক,ধরা পড়লেই অপরাধী কন্ঠে ক্ষমা চায়।আর ছাড়া পেলেই দূর থেকে সাহস দেখায়।
দরজা ঠেলে ভেতরে এলো স্নেহা। চোখাচোখি হলো তাশফিনের সঙ্গে। লোকটা কে কোথায় যেন দেখেছে সে, কিন্তু মনে করতে পারছে না।
“এই যে খাবার।”
খাবারের প্লেট রাখলো স্নেহা, ফারাহ ইতিমধ্যেই বাকি থালা গুলো এনে রেখেছে।কনুই টেনে আড়ালে নিয়ে গেল স্নেহা ফারাহ কে। ফিসফিস করে বলল।
“এই ফারাহ আমার না এই লোকটাকে সুবিধার লাগছে না!”
মাথা চুলকালো ফারাহ।এক পলক তাশফিন কে দেখে ফের শুধোয়।
“কেন রে কি হয়েছে?”
স্নেহা ফের ফিসফিসিয়ে বললো।
“দেখছিস না কেমন করে তাকিয়ে আছে তোর দিকে।”
এতক্ষণে বিষয়টা লক্ষ্য করলো ফারাহ। সত্যি তো লেফটেন্যান্ট তার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? আচ্ছা ফারাহ কি দেখতে আগের থেকে বেশি সুন্দরী হয়ে গেছে নাকি? নিজেকে সুন্দরী ভাবতেই মনে মনে হেসে কুটিকুটি অবস্থা তার
“কী রে চুপ করে গেলি যে?দেখ ওনাকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে পাঠা একটু পরেই কিন্তু চাচি আসবে তখন দেখব কি করিস!”
ঘাবড়ে গেল ফারাহ।কেউ এলে তো সর্ব’নাশ।
“তুই প্লিজ একটু বাইরে অপেক্ষা কর আমি এখুনি আসছি।”
স্নেহা বাইরে চলে গেল। ফারাহ ঠিকঠাক ভাবে দাঁড়ালো। দৃষ্টি তার তীক্ষ্ণ হলো, ওভাবে তাকানোর কি আছে?ছিহ্ ছিহ্ একজন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হয়েও কেমনে তাকায়!
“এই যে শুনুন আমি জানি আমি যে সুন্দরী তাই বলে ওভাবে তাকাবেন না।”
ডান ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো তাশফিন। ফারাহ বেশ ভাব নিয়ে আওড়ালো।
“ওমনে তাকিয়েও লাভ নেই, আমি কিন্তু বিবাহিত! জ্বি আগগে ঠিকই শুনেছেন। আমি বিবাহিত।এই যে হাতে চুড়ি,নাকে নাকফুল দেখছেন না। আমার স্বামীর জন্য এগুলো।তাই পঁচা নজর একদম দিবেন না।”
সহসা হেসে ফেলল তাশফিন। একজন বিবাহিত মেয়ের লক্ষন।হাতে চুড়ি,নাকে নাকফুল। সত্যি চমৎকার লাগছে ফারাহ কে।তাশফিনের ভীষণ ভাবে ইচ্ছে করলো তাকে বলতে”শুনো চঞ্চল মেয়ে তোমাকে না দেখে ফেলে যাওয়া অভ’দ্র স্বামী টা আমিই।”
ফারাহ অস্থির হয়ে উঠে। গায়ে রক্ত লাগানো, ব্যাপার টা তো সে দেখেই নি!
“ইয়া মাবুদ এগুলো!এমা এবার কী করব?”
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো তাশফিন, বুকে টান পড়ল হালকা।
“কী হলো?”
নাক মুখ কুঁচকে নিল ফারাহ, বিরক্তের রেশ টেনে বলে।
“আপনার শরীরের পঁচা র’ক্ত আমার গায়ে লেগে গেছে!”
নিম্নাষ্ট কাম’ড়ে হাসলো তাশফিন। বিড়বিড় করে বলল।
“একদিন আমার দেহেন র’ক্তটুকু সম্পূর্ণ তোমার দেহে ছড়িয়ে দেব মিসেস ফারাহ শেখ।মিশে যাবো তোমার অস্তিত্বের মাঝে।”
আকাশ টা আজ ম্লান। বাতাস বইছে হিম শীতল। পাখিরা ফিরছে নিজ নীড়ে। কাপড় গুলো তুলে ছাদ থেকে নেমে গেল নূপুর।ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মাহির আকস্মিক চেঁচিয়ে উঠলো।
“বড় মামা, ছোট মামা।”
কাপড় রেখে দৌড়ে এলো নূপুর,মাহির এমনি এমনি তো চেঁচাবে না! নিচের দিকে তাকাতেই নজরে এলো সেই চিরচেনা গাড়িটা।চোখ দুটো চকচক করে উঠল নূপুরের। মাহির কে নিয়ে দ্রুত পায়ে নিচে ড্রয়িং রুমে গেল।বাড়ি মাথায় তোলার ন্যায় চেঁচিয়ে উঠলো সে।
“আম্মু আব্বু কই তোমরা?দেখো ভাইয়া চলে এসেছে।”
ছেলের আগমন বার্তা শুনে তটস্থ হয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন রুবেনা শেখ এবং রিজুয়ান শেখ।
নরমাল গ্রেটআপে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো তাশফিন শেখ এবং সৌহার্দ্য শেখ।এত দিন পর ছেলে কে দেখতে কথা হারিয়ে ফেলেছেন রুবেনা শেখ।
তাশফিন বাবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে রিজুয়ান শেখ কে। এত দিন পর আপন মানুষদের পেয়ে ভেতরে তীব্র ধুকপুক শব্দটি প্রগাঢ় হচ্ছে।
চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না রুবেনা শেখ, সশব্দে কেঁদে ফেললেন তিনি। মায়ের আহাজারি দেখে মৃদু হাসলো তাশফিন। এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে ওনার।
“কী মা কাঁদছো কেন?”
ফুঁপিয়ে উঠলেন রুবেনা শেখ, অভিমানী স্বরে বলল।
“এত দিন পর মায়ের কথা মনে পড়ল?মা বলবি না খবরদার।”
“উফ্ মা তুমি তো জানো আমার কাজটাই এমন!”
“তুই চাইলেই কিন্তু ছুটি নিয়ে আসতে পারতি।এত রাগ মায়ের উপর?”
“উঁহু রাগ নয়, অভিমান।”
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৭
এত দিন পর নিজের ছেলে কে দেখে আনন্দ ধরছে না রাইমা শেখের।পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে সৌহার্দ্য শেখ কে। মায়ের কাছে এসে বাচ্চা হয়ে গেলো বোধহয় সে।মুখ ভর্তি আদুরে স্পর্শ বুলিয়ে দিল।
“আম্মু এখনো কাঁদবে নাকি কিছু খেতে দেবে?খিদে পেয়েছে যে।”
থমকে গেলেন রুবেনা শেখ, ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে।