তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৯

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৯
ফারহানা নিঝুম

দুপুর মানেই ব্যস্ততার মাঝেও এক টুকরো স্বস্তি। রোদের তাপে রাস্তাগুলো যেন ঝিমিয়ে পড়েছে, গাড়ির হর্ন কিছুটা কম, মানুষের হাঁটাচলাও শ্লথ। ফুটপাথে চায়ের দোকানে কয়েকজন বসে আড্ডা দিচ্ছে, কয়েকজন খবরের কাগজের পাতায় ডুবে আছে।উঁচু বিল্ডিংগুলোর কাচে রোদের আলো চিকচিক করছে, আর বাতাসে ভেসে আসছে কোনো দূরের ক্যাফে থেকে কফির সুঘ্রাণ।
আর যদি বৃষ্টি আসে? তখন তো শহরের দুপুর আরও মায়াময়! ভিজে রাস্তায় গাড়ির আলো প্রতিফলিত হয়, রিকশার ঘণ্টা বেজে ওঠে নরম স্বরে, আর কাঁচের জানালায় জমে থাকা পানির ফোঁটার ওপারে শহর যেন আরেকটা রূপ নেয় শান্ত, ধীর।কফি কাপ নিয়ে ছাদে উঠেছে তাশফিন ‌‌।চুমুক দিতে দিতে রাস্তায় দৃষ্টি বুলিয়ে নিচ্ছে। তপ্ত দুপুর।অথচ কাল পর্যন্ত কৃষ্ণপুর এলাকায় বৃষ্টি ছিলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সাথে শীতল বাতাস।

সেই বৃষ্টি ভেজা রমণী যাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছিল তাশফিন।তবে তা ক্ষণিকের জন্য,যদি নিজের রাগটুকু সংযত করে ভালো ভাবে সবটা বুঝে নিত তাহলে আজ সেই রমণী তার বক্ষপৃষ্ঠে পিষ্ঠ হতো।আদরে আদরে বাচ্চা সুলভ মেয়েটাকে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখতো প্রতি নিয়ত। কিন্তু এখন?চাইলেই কি তাকে কাছে টানতে পারবে? আচ্ছা তাশফিন যদি স্বামীর অধিকার টেনে কাছে টানতে চায় তাহলে?
তাচ্ছিল্যের একটুকরো হাসি ফুটে উঠল ওষ্ঠো পুটে।সে তো মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলে চলে গিয়েছে।সে চঞ্চল হরিণী তাই তো সবসময় প্রাণবন্ত হাসিটা লেপটে থাকে অধর কোণে।নিজ সত্তা বাঁচিয়ে রেখেছে বাচ্চা সুলভ আচরণে।
না তাশফিন চাইলেও পারবে না তাকে ছাড়তে।সে যাবে প্রেমের আকুল ভরা আবেদন নিয়ে।যদি মেনে নেয় তবে ভালো আর নয়তো জোরপূর্বক অধিকার না হয় খা’টাবে! তারপরেও ছাড়া চলবে না।
ছাদ থেকে নেমে নিচে গেল তাশফিন। রান্না নিয়ে ব্যস্ত রুবেনা শেখ এবং রাইমা শেখ। এদিকে উসখুস করছে তাশফিন। কিছু একটা জিজ্ঞাস করতে চাইছে রুবেনা শেখ কছ, অথচ গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। নূপুর মাহির কে গোসল করিয়ে দিচ্ছে।ছেলেটা আজকাল একটু বেশি দুষ্টু হয়েছে,কারো কথাই শুনতে চায় না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কী সমস্যা ঘুরঘুর করছিস কেন? খাবি?”
মুখ খানি চুপসে গেল তাশফিনের,তার মনের খিদে তো খাবারে মিটবে না ‌। তার জন্য চাই ফারাহ শেখের স্নিগ্ধ আদল খানি।
“বলছিলাম আম্মু একটু এসো তোমার সাথে কথা আছে ‌।”
রুবেনা শেখ কড়াইয়ে ঢেলে বললেন।
“এখন সময় নেই পরে বলিস।”
“প্লিজ আম্মু শুনো না।”
তাশফিন জোরপূর্বক রুবেনা শেখ কে নিয়ে বাইরে এলো রান্না ঘরের।তিনি যেতে যেতে রাইমা শেখের উদ্দেশ্যে বলল।
“পেঁয়াজ টা দিয়ে দিস তো রাইমা।”
“আচ্ছা আপা।”
রাইমা শেখ পেঁয়াজি দিয়ে দিল।রুবেনা শেখ কে সোফায় বসালো তাশফিন, হাঁটু গেড়ে নিচে বসলো সে। শান্ত কন্ঠে বুঝাতে হবে যে করেই হোক।
ঠোঁট গোল করে নিচের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল তাশফিন।

“আম্মু তুমি চাইতে না আমি সংসার করি?”
“হ্যা তো? তুমি তো আর আমার কথাটা রাখো নি?বউ ফেলে চলে গেছো জাহাজে।”
মুখ বাঁকিয়ে বললো রুবেনা শেখ,তাশফিন ফের বললো।
“বলছি যে না তখন তো রেগে ছিলাম কিন্তু আমি এখন একদম তৈরি। তুমি যদি বলো আমি এখন ওই ফেলে যাওয়া বউয়ের সাথে সংসার করতেই পারি।”
ভ্রুদয় কুঁচকে এলো রুবেনা শেখের।ফোড়ন কে টে বলল।
“তাই নাকি?বা রে বা হঠাৎ এত্ত সংসার করার দরদ কেন উঠছে তোমার?”
তাশফিন মেজাজ হারাচ্ছে। উফ্ রাগলে তো চলবে না?যে করেই হোক মা কে রাজী করাতে হবে।
“হ্যা আমি ভেবে দেখলাম জীবনে তো কাউকে না কাউকে প্রয়োজন পড়বেই তাই…..
তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো রুবেনা শেখ।যা আন্দাজ করার তিনি তা বুঝে গেছেন।
“দেখো বাবা এত বিয়ে বিয়ে খেলার প্রয়োজন নেই।আর এখন তো ওই মেয়ের বোধহয় বিয়ে হয়ে গেছে অন্য কোথাও, তোমার জন্য তো আর বসে থাকবে না!”
তাশফিন ব্যস্ত কন্ঠে বলল।

“আরে না ফারাহর বিয়ে হয়নি এখনো। বাচ্চা মেয়ে..
“তুই কি করে জানলি?”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো রুবেনা শেখ। ইতিমধ্যেই তিনি জেনেছেন তাশফিন কৃষ্ণপুর গিয়েছিল। কথাটা সৌহার্দ্য বলেছিল,ফেরার কিছু আগ থেকেই কেমন হাঁসফাঁস করছে তাশফিন। কিছুটা খটকা লেগেছিল রুবেনা শেখের কাছে, আজকে সেই খটকা টা সত্যি মিলে গেছে।ছেলে তার বউ কে দেখে প্রেমে পড়েছে তা বুঝতে আর বাকি নেই ওনার।
“সত্যি করে বল তো তাশফিন ব্যাপার টা কি?তুই কি চাচ্ছিস?”
ঠোঁট গোল করে ফের নিঃশ্বাস ছাড়লো তাশফিন। লম্বা দম নিয়ে আওড়ালো।
“দেখো মা আমি ফারাহ কে দেখেছি আর আমি এখন চাই ফারাহ এখানে আসুক এবং আমার সাথে সংসার করুক।”
তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠলো রুবেনা শেখ। তিরিক্ষি মেজাজে বলে।
“এতই সহজ?তুই যাওয়ার পর তো ফারাহর চাচা আর মা দু’জনেই তোর উপর ক্ষে’পে আছে। এখন তুই গিয়ে বললি আর ওরা মেয়ে দিয়ে দেবে?”

বাঁকা হাসলো তাশফিন, উঠে দাঁড়ালো সহসা।চুল গুলো ব্যাক ব্রাশ করে বলল।
“ওরা দেওয়ার কে?বউ আমার আমি নিজে নিয়ে আসবো।”
অবাক নেত্রে চেয়ে রইলেন রুবেনা শেখ। শাসা’নোর সহিতে বললেন।
“দেখ তাশফিন একদম ঝামেলা করবি না।তুই কিন্তু..
“উফ্ আম্মু একটু আধটু তো ঝামেলা হবেই, আফটার অল লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখের ওয়াইফ বলে কথা।”
ছেলের অভিব্যক্তি বোঝা দায়।তাশফিন উঠে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে লম্বা হয়ে শোয়। দৃষ্টি তার ছাদের উপর। ফিসফিসিয়ে বললো।
“মিসেস ফারাহ শেখ তাশফিন শেখ আসছে আপনাকে নিতে। এরপর দেখব ঠিক কতক্ষণ পালাতে পারেন।”

অনেক দিন টানা বৃষ্টি থাকার পর আকাশ যখন পরিষ্কার হয়ে গেছে, প্রকৃতি এক অনন্য সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। আকাশ ঝকঝকে নীল হয়ে ওঠে, মাঝে মাঝে সাদা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টির ধোয়া ধোয়া ভাব কেটে গিয়ে বাতাস আজ সতেজ ও ঠান্ডা, যেন প্রকৃতির নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেছে।গাছপালার পাতাগুলো সবেমাত্র ধোয়া হয়ে চকচকে সবুজ হয়ে ওঠে, সূর্যের আলো পড়লে তারা ঝলমল করে। মাঠের ঘাসগুলো আরও সজীব মনে হয়, বৃষ্টির জলে স্নাত হয়ে যেন তারা প্রাণ ফিরে পায়। ফুলগাছের পাতায় জমে থাকা পানির ফোঁটাগুলো রোদের আলোয় হীরার মতো ঝলসে ওঠে।

বারান্দায় চুপচাপ বসে আছে ফারাহ।হাত দুটো কাঁপছে থরথর করে।এ কি শুনলো সে? নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না মোটেও। আলতো করে শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিচ্ছে বারংবার।
এই তো কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই আরিফা আহমেদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন জয়নাল আহমেদ।তাশফিন শেখ নাকি ফারাহ কে নিতে আসবে। আশ্চর্যের ব্যাপার ফারাহ তো ওই লোকটাকে দেখেনি পর্যন্ত!হুট করেই বুঝি তার বউয়ের কথা মনে পড়লো? দীর্ঘ একটি বছর পর? অভিমানেরা ভিড় জমিয়েছে মন পাড়ায়।চিকন নাকের ডগা ফুলে উঠল ফারাহর।সে মোটেও যাবে না,যদি ওই খচ্চ’র বেডা তাকে নিতে আসে!
কিন্তু সে আসলে বলবে কী? আচ্ছা সে কি ফারাহ কে চিনতে পারবে?ধুর ছাই চিনবে কি করে?সে তো দেখেই নি তাকে!
কী একটা ভেবে উঠে গেল ফারাহ। চটজলদি দৌড়ে গেল ভেতরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল উপরের রুমে। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো খুঁ’টিয়ে খুঁ’টিয়ে।
“হুউ আমার মতো সুন্দরী বউ কী পাবে? ফাজিল বেডা,তার কোনো অধিকার নেই আমার মতো বউ পাওয়ার।যাবো তার সাথে।”
বেঁকে বসলো ফারাহ। কিশোরী মনে অভিমানের পাহাড় গুলো বড় হচ্ছে।
আকস্মিক লজ্জায় লাল হয়ে উঠে কপোলদয়। কুন্ঠিত হয় শীর্ণ বদন। আচ্ছা তার এই ছোট বয়সে বিয়ে হয়ে গেল?লোকটা তার থেকে কত-ই না বড় হবে?ভাবতেই চমকে উঠে ফারাহ।

জিপ গাড়ি এসে ঢুকলো কৃষ্ণপুর এলাকায়। পরিষ্কার আকাশ। মাঝে মধ্যে কালো মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশপৃষ্ঠে। ফুরফুরে মেজাজে এগিয়ে চলেছে তাশফিন। আজকে ম্যাডামের সঙ্গে প্রথম বারের মতো স্বামী হিসেবে নিজেকে জাহির করবে।তার অবস্থা দেখানোর জন্য চটপট করছে বক্ষপট।
দূর থেকে জিপ গাড়িটা আসতে দেখে স্নেহা চেঁচিয়ে উঠলো।
“ওই দেখ ফারাহ গাড়ি আসতেছে।”
চট করে নিচে বসে পড়ল ফারাহ।যাতে তাকে দেখতে না পায়। ফিসফিসিয়ে বললো।
“তাহলে তুই থাক আমি গেলাম।”।
ভ্রুদয় কুঁচকে এলো স্নেহার।
“কোথায় যাবি তুই?”
দুষ্টু হাসলো ফারাহ।
“এত সহজে তো ওই খচ্চ’র বেডার কাছে ধরা দেব না!”

বিনা বাক্যব্যয়ে ছাদ থেকে নেমে গেল ফারাহ।স্নেহা ছুটে গেল তার পিছু পিছু।দরজার সামনে যাওয়া মাত্র দেখলো রুবেনা শেখ আর উনার পরিবারের সদস্যরা ভেতরে আসছে। ফারাহ চুপচাপ পিছনের দিকে বের হতে লাগলো।
তাশফিন ভেতরে আসা মাত্র বাইরে চলে গেল ফারাহ। ফলস্বরূপ একে অপরের মুখ দর্শন করেনি।
নিজের চোখের সামনে তাশফিন কে দেখে চোয়াল ঝু লে গেল স্নেহার।এই জন্য লোকটাকে তার সেদিন চেনা চেনা লাগছিল।আরে এ তো ফারাহর স্বামী!
পা টিপে টিপে বাইরে এসেছে ফারাহ। এগুতে গিয়ে ফের পিছিয়ে এলো কিছু একটা ভেবে।জিপ গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল ক্ষণকাল।
“ওয়ে মশাই আমাকে ফেলে গেছিলেন না?দেখেন আপনার গাড়ির কি করি!”
আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে একটি পেরেক খুঁজে পেলো ফারাহ। এগিয়ে এলো ফারাহ,বসে পড়ল নিচে।ধীর গতিতে টায়ার পাংচার করে দিল।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৮

“ফুস,যান আপনার টায়ার পাংচার করে দিলাম মিস্টার তাশফিন শেখ।”
“ম্যাডাম।”
পুরুষালী কন্ঠস্বর, আঁতকে উঠল ফারাহ। চকিতে উঠে দাঁড়ালো সে।ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই আরো এক দফা চমকে উঠে। চোয়াল ঝু লে গেল রিতিমত।এ কাকে দেখছে সে?নেভি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার? কিন্তু তিনি এখানে কেন?
“আপনি?”

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১০