তাজমহল গল্পের লিংক || প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

তাজমহল পর্ব ১
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

“আপুরা আপনাদের কাছে একটা সাজেশন চাই। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার এক প্রতিবেশী আন্টির ছেলের সাথে। তারা বংশগত বড়লোক। আগেও বড়লোক ছিল। এখন আরও বেশি। ছেলেটা ক্লাউড ইঞ্জিনিয়ার। বেশ পয়সা হয়েছে তারও।

আমরা আগে নিম্ন মধ্যবিত্ত ছিলাম। আমার বাবা তখন দশ হাজার বেতনে চাকরি করতো একটা ফ্যাক্টরীতে। আমরা ছয় ভাইবোন কি কষ্টে বড় হয়েছি তা বলার বাইরে। তখন ওই আন্টি আমাদের পছন্দ করলেও উনার ছেলেটা আমাদের দুচোখে দেখতে পারতো না। আমাদের বাড়িতে তখন টেলিভিশন ছিল না।
তাদের বাড়িতে বাংলা সিনেমা দেখতে গেলে সে এমনভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে চলে যেতে বলতো যে লজ্জায় অপমানে মাথা হেঁট করে চলে আসতাম। তখন ছোট ছিলাম তাই অত আত্মসম্মানবোধ ছিল না। ছেলেটা না থাকলেই আমি আর আমার বোন ওদের বারান্দার দরজা ঠেলেঠুলে টিভি দেখতে মেঝেতে বসে যেতাম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে যাতে সিনেমা শেষ হওয়ার আগে না আসে তার জন্য দোয়া করতাম। অবশ্যই হুট করে চলে এলে আবারও একই চোখ রাঙানি, ঘাড় বাঁকানো, বৃদ্ধাঙ্গুলি ও মধ্যমা ঘষে তুড়ি বাজিয়ে ইশারা করতো বেরিয়ে যেতে। তার মা থাকলে কিছু বলতো না। তখন চোখ দিয়ে ইশারা করতো।
আপনাদের কাছে বিষয়টা কেমন মনে হচ্ছে জানিনা। কিন্তু ছোটবেলায় ওইসব আমার আত্মসম্মানে না লাগলেও এখন ওই কথাগুলো মনে পড়লে আমার ভীষণ আত্মসম্মানে লাগে।
এই ব্যাপারগুলোকে কেউ দয়া করে রোমান্টিসাইজ করবেন না। মোটেও এইসবের পর্যায়ে পড়েনা এই ব্যাপারগুলো। আমরা গরিব বলে সবসময় নিচু নজরে দেখতো ছেলেটা।

আরেকটা ঘটনা বলি। একবার আম্মা পিঠা বানাচ্ছিল তাদের বাড়িতে। পিঠাগুলোকে চট্টগ্রামের ভাষায় গুঁড়া পিঠা বলা হয়। তার মা ডেকেছিল পিঠা বানিয়ে দিতে। আমিও সাথে ছিলাম। তখন ক্লাস থ্রি নাকি ফোরে পড়ছি। আমিও পিঠার লতি পাকাচ্ছিলাম। চালের গুঁড়ার কাই নিয়ে হাতের তালু দিয়ে পিড়িতে হালকা করে ঘষে ঘষে লম্বা করে পাকানো হয় লতিটা। তারপর সেটাকে ছোট ছোট করে কেটে তৈরি হয় গুঁড়া পিঠা।
ছেলেটা হুট করে এল। আমাকে আর আম্মুকে দেখে তার মায়ের উদ্দেশ্য বলল,
“এগুলো আর খাওয়া যাবে?”
কথাটা শুনে আম্মুর কেমন লেগেছিল জানিনা। কিন্তু আমি অতটুকুন একটা মেয়ে ছিলাম। আমার বড্ড অপমান লেগেছিল।

তার মা অবশ্য তাকে চলে যেতে বলে আম্মুর সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল যাতে আম্মু মনে কষ্ট না পায়।
আরও একটা ঘটনার কথা বলি। তার এক চাচ্চুর বিয়ে হচ্ছিল।
প্রায় পনের ষোলটা আলাদা আলাদা পরিবার নিয়ে ছিল আমাদের গোটা সিদ্দিক বাড়ি। গ্রামের বাড়ি আসলে যেমন হয় আর কি। গোটাবাড়িতে যতগুলো মেয়ে ছিল সবার জন্য গায়ে হলুদের শাড়ি কেনা হয়েছে। আমার আম্মু টাকা দিতে পারেনি বলে আমরা তিন বোন শাড়ি পরতে পারিনি। সেদিন আমার বোন দুটো খুব কেঁদেছিল। কিন্তু আমি ছোট হয়েও কিভাবে যেন কাঁদিনি সেদিন। তবে গায়ে হলুদের বিরিয়ানি খাওয়ার পর যখন আমি আমার আপুদের সাথে অনুষ্ঠান দেখতে গেলাম ওই ছেলেটা আমাদের মুখের উপর ছাদের দরজাটা বন্ধ করে দিল। কারণ ছাদেই অনুষ্ঠান হচ্ছিল।

পরদিন সকালে আমাদের কেউ কেন দেখেনি সেটা নিয়ে যখন কথা হচ্ছিল তখন আম্মু বললো ওরা ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমি জানি আমার দুই বোন কত কেঁদেছে সেদিন।
আরও একটা ঘটনার কথা মনে পড়লো। আমাদের গ্রামের বাড়িতে এক দাদাভাইয়ের মেজবান হচ্ছিল। তখন তেরপালে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে বাচ্চা ছেলে মেয়েদের। যারা বেশি ছোট তাদের। মানে যাদের বয়স পাঁচ ছয় বছর তাদের। কারণ তারা চেয়ারে বসলে টেবিল ছুঁতে পারবেনা।

আমাদের বয়সী যারা ছিল সবাইকে টেবিলে বসে খাওয়ানো হচ্ছে। কিন্তু ওই ছেলেটা কি করলো। আমাদের ওই চেয়ারে বসে খেতে দিল না। আমাদের তেরপালে বসে খেতে দেয়া হলো। ছুঁড়ে ছুঁড়ে ডাল ভাত দেয়া হলো। বিশ্বাস করুন ওইসব মনে পড়লে আমার কি যে কষ্ট হয়। এখন অবশ্য আমরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল।
ওই ছেলেটা আমার ভাইয়াদেরকে একদম পছন্দ করতো না। একবার মেঝ ভাইয়াকে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়েছিল। আম্মু মেঝ ভাইয়ার পিঠের দাগ দেখে সারারাত চুপিসারে কেঁদেছে। যাতে ওরাও কান্নার আওয়াজ না শোনে। বিচার নিয়ে যাওয়ায় আমার চাচ্চুর গায়ে পর্যন্ত হাত তুলতে চেয়েছিল ছেলেটা। এখন আমার বড় ভাইয়া, মেঝ ভাইয়াকে সবাই সমীহ করে। তার সাথে ভাইয়াদের এখনও তেমন সখ্যতা নেই। ঈদ কোরবানের ছুটিতে দেখা হয় তখন কথাবার্তা হয়।

তারা হয়তো কল্পনাও করেনি আমাদের পরিবার কখনো উঠে দাঁড়াবে আর্থিকভাবে। আসলে অভাব অনটন আমাদের মানুষ চিনিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এখন যেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি আমি জানিনা কি করবো। গোটা সিদ্দিক বাড়ির মানুষই অবাক হয়ে আছে কিভাবে আমাকে ওই বাড়ির মানুষ বউ করে নিয়ে যেতে চাইছে সেটা ভেবে। এখনো সবাই মনে করে আমরা ওদের যোগ্য না।
আম্মা আব্বা তো এককথায় রাজী বিয়েতে। কিন্তু আমি জানিনা আমি কি করবো। আমি বোধহয় এই গোটা পৃথিবীতে আল্লাহর কোনো সৃষ্টিকে এতটা ঘৃণা করিনা যতটা ওই ছেলেটাকে করি। আমি কিভাবে বলব এই বিয়েটাতে আমি রাজী না?

আসলে বিয়ের কথাবার্তা এমনভাবে চলছে যে আমার মতামত দেওয়ার জায়গাটা পর্যন্ত নেই কোথাও। দাদীমা আমার মন খারাপ দেখে বললো, ছোটবেলায় অনেকের খাসিয়ত খারাপ থাকে। বড় হতে হতে ঠিক হয়ে যায়। ওইরকম লোকেরা বউ ভালোবাসে বেশি।
বিশ্বাস করুন দাদীমার কথায় আমার একটুও শান্তি লাগছেনা। যারা নিজেদের মানুষকে সম্মান দেয় কিন্তু অন্যজনকে সম্মান না দিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে রাখে অপমানিত হওয়ার ভয়ে সে কোনো মানুষের কাতারে পড়েনা। অন্তত আমার তা মনে হয়। খেয়াল করে দেখলাম বড় ভাইয়া, মেঝ ভাইয়া একদম রাজী নেই। ছোট ভাইয়া এইসব ব্যাপারে তেমন একটা মাথা ঘামায় না।

কিন্তু কাল বড় ভাইয়াকে দেখলাম আম্মুকে প্রশ্ন করছে, আমি ওই ছেলেকে বিয়ে করতে রাজী কিনা। অবশ্য আম্মু বললো ওর আর কি পছন্দ অপছন্দ। নিজের কি খেতে ভালো লাগে সেটা পর্যন্ত বলতে পারেনা ওই মেয়ে। ভালোই তো হচ্ছে আমার সামনে থাকবে। আমি ওর ভালোমন্দ চোখের সামনে দেখব।
আমি গত কয়েকরাত একদম ঘুমাতে পারছিনা। বুঝে উঠতে পারছিনা কিভাবে “না” বলবো। কারণ আমার একটা “না” গোটা সিদ্দিক বাড়ি এমনকি গোটা পাড়া কাঁপাবে। সবাই মনে করবে আমি বেশি পেয়ে গেছি বলে হজম করতে পারছিনা। আমাকে কেউ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করুন।”
পোস্টটা করার ঘণ্টাখানেকের মাথায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। একেকজন একেক ধরণের মন্তব্য করছে। শাইনা একজনের মন্তব্য দেখে থমকে গেল।

“আপনার পোস্ট দেখে বোঝা যাচ্ছে আপনি ভীষণ নম্রভদ্র। কারণ আমি হলে এই পোস্টে ওই ছেলেকে আরও জঘন্য জঘন্য গালি দিতাম। বড়বোন হিসেবে একটা সাজেশন দিই। যার আসল রূপ খারাপ সময়ে দেখে ফেলেছেন তার সাথে সারাজীবন কাটানোর মতো জঘন্য সিদ্ধান্তটা নিয়েন না। বিয়েটা ভেঙে দিন। You deserve better. Make the right decision. Stay well. Best wishes.
শাইনা বুকে সাহস সঞ্চয় করলো। এবার সে বলে দেবে সবাইকে।
বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সেই সাত দিন আগে শেষবার সূর্যের দেখা মিলেছিল। টানা বৃষ্টির পর আজ একটু থেমেছে। কাল পরশুর পর সূর্যের দেখা মিলতে পারে।
দাদীমা বারান্দা থেকে ডাক দিলেন,

“শানু ফেরিওয়ালা এসেছে। কী যেন কিনবি বলছিলি?”
দাদীমা তাকে শানু বলে ডাকে। শাইনা ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। উঠোনে পা দিতেই কানে ভেসে এল,
“এই চুড়িগুলো খুব সুন্দর। শাইনা আপার গায়ে হলুদের দিন পরবো। আমরা কনেপক্ষ!”
পাশ থেকে হাসতে হাসতে একজন বলল, “আমরা বরপক্ষ।”
চারপাশের চাচীরা হঠাৎ গুঞ্জন তুলে ফিসফিস করতে লাগল। শাইনাকে ঘিরে কিছু বলছে, কিন্তু স্পষ্ট কিছু শোনা যাচ্ছে না।
শাইনা থমকে গেল। কিছু বোঝার আগেই মা এসে তার হাত ধরে টান দিলেন।

“চল এখানে এসেছিস কেন?”
শাইনা ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
“আমার কিছু সেফটিপিন কিনতে হবে।”
মা কড়াভাবে বললেন,
“পরে কিনিস। এখন আয়।”
কিন্তু শাইনা গেল না। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,”ফেরিওয়ালার আর আসবে না। ওদের কাছ থেকে সস্তায় জিনিস পাওয়া যায়। তুমি ঘরে যাও। আমি আসছি।”
সে মায়ের হাত ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল। পায়ে স্যান্ডেল নেই। পায়ের আঙুলের ফাঁকে বালি লেগে আছে।
সে সেফটিপিন কিনল। কাঁচের চুড়ির দিকে হঠাৎ চোখ আটকে গেল। লাল সবুজ দুই ডজন চুড়ি কিনে ফেলল। ঠিক তখনই ছোট চাচী ছুটে এসে মাথার ওড়নাটা টেনে কপাল ঢেকে দিলেন। তারপর ইটের স্তূপের পেছনে নিয়ে গিয়ে তাকে আড়াল করে রাখলেন।

শাইনা অবাক হয়ে বলল,”তোমাদের সমস্যা কি?”
চাচী বলল,”ওই বাড়ির লোকজন এসেছে ঢাকা থেকে। তুই ওদের বাড়ির বউ হয়ে যাচ্ছিস না? এভাবে দেখলে তোকে নিয়ে নানান কথা রটাবে। পায়ে স্যান্ডেলটা অব্দি দিসনি। কি বেকুব মেয়ে তুই।”
শাইনা চাচীর হাত থেকে একঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,”ফেরিওয়ালাকে টাকা দিতে হবে।”

চাচী আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে হায় হায় করে উঠল। কারণ, উঠোনে এসে থামা চকচকে কালো গাড়িটার দরজা খুলে নামলো একজন লোক। কালো ব্লেজার, টানটান টাই, চকচকে স্যুটবুটে মোড়া। মনে হচ্ছে সিনেমার কোনো রাশভারি চরিত্রের আগমন। শাইনা ফেরিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো,
“হাতে আপাতত টাকাপয়সা নেই। টিউশনির বেতন পেতে ঢের দেরী। দাদীর পেকে যাওয়া চুল আছে। নেবেন?”

তাজমহল পর্ব ২