তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড গল্পের লিংক || প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ১
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

শাহিদা বেগম শাইনাকে হাত ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন। সিদ্দিক বাড়ির উঠোনে তখন জমজমাট আমেজ। অন্যদিকে জুমার নামাজের তাড়া চলছে।
এক এক করে গাড়ি থেকে সবাই নামতে শুরু করলো। আশরাফ আর আনিস বড়দের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠলো। দাদীমা আনোয়ারা বেগমকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন শাহিদা বেগম। আজ দুপুরের খাওয়াদাওয়া হবে শাইনাদের বাড়িতেই। রওশনআরা, জোহরা বেগমসহ সবাই একে একে ভেতরে চলে এলেন। দীর্ঘ জার্নির কারণে ক্লান্তি স্পষ্ট তাদের মুখে।

তৌসিফ আর তিতলি ব্যাগ আর স্যুটকেস সামলে বাড়ির দরজা খুলতে এগিয়ে গেল।
সবশেষে ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নামল তাজদার সিদ্দিকী। গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। দীর্ঘদিন শুয়ে-বসে কাটানোর কারণে শরীরে ভর জমেছে। মুখমণ্ডলও কিছুটা ভারি লাগছে। গালে বাড়তি দাঁড়ি, মাথার চুলও অযত্নে লম্বা হয়ে এসেছে। সবসময় ফিটফাট থাকে বলে হঠাৎ এ পরিবর্তন তাকে অস্বাভাবিক লাগছে। তাকে কেটে আসতে বলেছিল সবাই। সে বলেছে এবার তার পছন্দের সেলুন থেকে কাটবে।
গাড়ি থেকে নামামাত্রই আনিস শাওন এসে তার সাথে হাত মিলালো। আনিস বলল,”জুমার নামাজের সময় হয়ে গেছে কিন্তু। তুই যাবি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রায়হান বলে উঠলো,”এখনো উবু হতে পারছেনা ভালোভাবে। বুকে সমস্যা হবে। বাড়িতে পড়ে নেবে।”
তাজদার তার কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করলো। সে মসজিদে যেতে চায়। সেখানে গেলে অনেকের সাথে দেখা হয়ে যাবে।
আশরাফ বলল,”আচ্ছা ওখানে মোড়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যদি মোড়া ছাড়া পড়তে পারে তাহলে তো সমস্যা নেই।”
রায়হান রাজী হলো।
তাসনুভা গাড়ি থেকে নামামাত্রই চেঁচামেচি করছে। গাড়িতে এখনো অনেক জিনিসপত্র। এগুলো না নামিয়ে সবাই চলে গিয়েছে কেন? সে নামাতে পারবেনা একটা ব্যাগও। গরমে ঘেমে উঠেছে সে। চুলের উপর আটকানো চশমা। পরনে একটা কালো কূর্তি।
শাওন আনিসের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা দুজনেই তাসনুভার চেঁচামেচি শুনে একসাথে তাকালো। শাওন তাসনুভাকে দেখামাত্রই হেসে বলল,”পাপা কি পারি হাজির।”
আনিস ধমকে বলল,”চুপ থাক।”

শাওন হেসে উঠে সরে গেল।
তাসনুভা হাত দিয়ে বাতাস করতে করতে তাদের বাড়ির দিকে চলে যেতে লাগলো। শাইনার চাচাতো বোন সানজু এসে বলল,
“নুভা আপু জেম্মাদের বাড়িতে যেতে বলছে বড়ো আম্মু।”
তাসনুভা বিরক্ত হয়ে বলল,”আমি ওই বাড়িতে যাব কেন? বলে এসো আমি ওখানে যাব না।”
সানজু তার কথা শুনে আর কিছু না বলে চলে গেল।
চাবি কাজ করছেনা। দরজা খুলতে একটু সময় নিচ্ছে। তাসনুভা সবার মাথা খেয়ে ফেলছে।
“উফ এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো?”
তৌসিফ বলল,”আর একবার প্যানপ্যান করলে কান বরাবর দেব তোকে।”
তাসনুভা রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো।
আশরাফ তাকে ডেকে নিল।

“নুভা আমাদের বাড়িতে যাও। ওখানে সবাই আছে।”
আশরাফের কথা ফেলা যায় না। বড়ো হিসেবে সমীহ করতেই হয়। তাসনুভা বিরক্ত হয়ে শাইনাদের বাড়িতে যাওয়ার সময় আনিসের মুখোমুখি পড়ে গেল। আনিস বলল,
“তোমাকেই ডাকতে যাচ্ছিলাম।”
তাসনুভা হাত দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল,”এখানে এত গরম কেন আনিস ভাই?”
আনিস পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে ঠোঁট উল্টে বলল,”এখানে তো শীত পড়ছে কয়েকদিন ধরে। তোমার মেজাজের গরম বোধহয়।”

তাসনুভা চলেই যাচ্ছিল। আনিসের শেষের কথাটা শুনে থমকে দাঁড়ালো। তারপর আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না সে। সোজা তাদের বাড়িতে চলে গেল গটগট পায়ে হেঁটে। তৌসিফ ততক্ষণে বাড়ির দরজা খুলে ফেলেছে। তাসনুভাকে ওভাবে আসতে দেখে তিতলি আর তৌসিফ একে অপরের দিকে তাকালো। তিতলি বলল,
“মৌচাকে আবার ঢিল ছুঁড়লো কে?”

শাইনা শ্বাশুড়িদের সামনে এল শরবতের ট্রে নিয়ে। তার শারীরিক পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। তবে বেশ শুকিয়েছে সে। সবাইকে জড়িয়ে ধরে অল্প কথাবার্তা বলে আবারো রান্নাঘরে চলে গিয়েছে সে। রওশনআরা দাদীমাকে বললেন,
“ও এত শুকিয়েছে কেন?”
দাদীমা বললেন,”খাওয়াদাওয়া করতে পারছেনা ঠিকমতো এইসব আর কি।”
জোহরা বেগম বললেন,”সারাক্ষণ শুয়ে শুয়ে থাকে নাকি?”
দাদীমা কাষ্ঠ হাসলেন।

“ও আর কি কাজ করবে? মেঝেতে শুয়ে থাকে অশান্তি লাগলে।”
তিতলি এসে সোজা রান্না ঘরে চলে এল। এসেই শাইনাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। শাইনাও তাকে দেখে খুশি হয়ে গেছে। তিতলি তাকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“ওটা কোথায়।”
শাইনার পেট আলতো করে গুঁতো দিয়ে কথাটা বললো সে। শাইনার সাথে সাথে সাবরিনা, শারমিলা সবাই হেসে ফেললো। সাবরিনা বলল,
“শাইনা তোমার বড়ো ননদিনী কোথায়?”
তিতলি দিল জবাবটা।
“এসেছিল। কে নাকি কি বলেছে তাকে তাই আবারো চলে গিয়েছে।”
শাহিদা বেগম চিন্তিত হলেন।
“আবার কে কি বললো? শাওন কিছু বলেছে বোধহয়। আহা কতবার বলেছি মেয়েটার সাথে মশকরা করিস না। ও মশকরা বোঝেনা।”
আনিসের কথা উনি মাথায়ও আনলেন না। আনিস মশকরা করার মতো ছেলে নয়।

শাইনার শ্বশুর, চাচা শ্বশুর সবাই মিলে বসার ঘরে বসেছে তার বাপ ভাইদের সাথে। তাজদার বাড়ি আসতে না আসতেই সবাই ওখানে ভিড় জমালো। দাদীমা তো আগেভাগেই হাজির। তাজদারকে দেখে উনি বললেন,
“লন্ডনওয়ালা আমাদের কত কাঁদালো বাপরে।”
তাজদার কপাল উঁচিয়ে মুখের কাছে হাত রেখে বলল,”মরাকান্না কেঁদে নিয়েছিলেন নাকি?”
সবাই তার প্রশ্নের ধরণ দেখে হেসে উঠলো। আফসার সাহেব গুরুতর ভঙ্গিতে বললেন,
“যাই বলো বাবা, আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। মহিষে মারার পর কাউকে তো আর ফিরতে দেখিনি। তোমার জন্য পাঁচ ওয়াক্তে পাঁচ বার আল্লাহর কাছে হাত তুলেছি।”
উনি সাধাসিধা মানুষ। সোজাসাপটা মনের কথাটা বলে দিলেন সবাইকে। দাদীমা আনোয়ারা বেগম বললেন,
“সবার দোয়ায় ফিরে এসেছে। তোদের দোয়া না থাকলে তো ফিরতো না।”
আফসার সাহেব তাজদারের চুলে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন এই বলতে বলতে, “ওদের আর বসিয়ে রাখিস না। খেতে দে। অনেক জার্নি করে এসেছে।”

ডাইনিং টেবিল সাজানো হচ্ছে। তিতলি ঢাকনা উল্টে উল্টে দেখছে কি কি রান্না করা হয়েছে। চিংড়ি দেখে সে লোভ সামলাতে পারছেনা। শাহিদা বেগমকে বলল,”আমি কিন্তু চিংড়ি দুইটা খাব।”
শাইনা হেসে বলল,”যত ইচ্ছে খেও। মেঝ আপুকে একটু ডেকে আনলে ভালো হতো।”
“ভাই না না। আমি পারব না এসব।”
শাবরিন বলল,”তুই গিয়ে ডেকে নিয়ে আয়।”
শারমিলা ধমকে বলল,”ও যাবে কেন? কাউকে পাঠা। নইলে তৌসিফকে বল।”
শাহিদা বেগম বললেন,”ও ওর বড়ো ভাইদের ভয় পায়। এভাবে ডাকলে আসবে না বোধহয়।”
ডাইনিং টেবিল সাজানো হয়েছো হরেক রকমের রান্নায়। সবাই খাবার দাবার নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখুনি আফসার সাহেব বড়ো দুই মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

“জামাইয়ের সাথে ওকে দেখা করাসনি কেউ?”
শাইনা এককোণায় দাঁড়িয়ে হাতের নখ কুটছিল। বাবার কথায় সে চমকে উঠলো। সবাই একে অপরের দিকে তাকালো। তিতলি খপ করে শাইনার হাত ধরে বলল,”শাইনা চলো ভাইয়ার সাথে দেখা করবে।”
শাইনা বলল,”না না এখন না।”
“কেন?”
“অনেক লোকজন।”
তিতলি মজা করে বলল,”লজ্জা পাচ্ছ?”
শাইনা আঙুল দিয়ে চোখ চেপে নিয়ে বলল,”পরে যাব। এখন না।”
তিতলি বলল,”আচ্ছা ভাইয়াকে আসতে বলি।”
শাইনা খপ করে তার হাত ধরে ফেলল।
“না না প্লিজ। পরে। আগে খাওয়াদাওয়া হোক।”

খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই আনোয়ারা বেগম বললেন, “বাড়ির বউ আমরা সবাই বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। অনেকদিন থেকেছে বাপের বাড়িতে। রায়হানের মা এইদিকে আসো। তোমার ছেলের বউকে তুমি বুঝে নাও।”
শাহিদা বেগম বললেন,”ও যখন তাজের সাথে যাবে না তখন আমি চাচ্ছিলাম যে ডেলিভারি পর্যন্ত এখানে থাকুক। এখন নিয়ে যান। কয়েকদিন থেকে আবার চলে আসবে। প্রথম বাচ্চা তাই।”
রওশনআরা কিছু বলার আগেই আনোয়ারা বেগম বললেন,”ওরা বর বউ আগে কথাবার্তা বলে ঠিক করুক কখন কি করবে। আমরা আগেভাগে সিদ্ধান্ত নিলে সমস্যা হবে। এখন মেয়েকে বিদায় দাও।
শাহিদা বেগম কাষ্ঠ হেসে বললেন,”ও কাজবাজ হালকা পাতলা করতে পারে। ভারী কাজের সময়..
শাইনা চোখ রাঙিয়ে বলছে চুপ করতে। কিন্তু শাহিদা বেগম বলেই গেলেন।
“প্রথমবার তো তাই ও নিজের ভালোমন্দ তেমন বুঝতে পারছেনা। একটু সাবধানে রাখবেন বড়োমা।”
আনোয়ারা বেগম বলল,”আমাদের বাড়িতে অত কাজ কোথায়? সমস্যা নেই। ওকে কিছু করতে হবে না।”
জোহরা বেগম বললেন,”কাজবাজ করলে নর্মাল ডেলিভারি হয়। সারাক্ষণ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দিন পার করলে সমস্যা আরও বাড়ে।

সবার কথাবার্তা সেখানেই সমাপ্ত হলো।
বসার ঘরে তখনো সবাই বসে আছে।
শাইনা ধীরে ধীরে রওশনআরার পেছন পেছন ড্রয়িংরুমে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকেই তাজউদ্দীন সিদ্দিকী আর তৈয়ব সিদ্দিকীকে সালাম জানাল। তাজউদ্দীন সিদ্দিকী সালাম নিয়ে হালকা হাসি দিয়ে বললেন,
“তোমাকে দেখার আগেই খেতে বসিয়ে দিল ওরা।”
আনোয়ারা বেগম সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “ছেলের বউ-ই তো বলছিল আগে খেয়ে নিতে।”
শাইনা মৃদু একটুখানি হাসার ভান করলো। চোখের কোণা একবার ঘুরে গেল তাজদার সিদ্দিকীর দিকে। সোফার গায়ে এক হাত ছড়িয়ে তিনি বসে আছেন নিস্তেজ ভঙ্গিতে। ক্লান্ত শরীর, অন্যমনস্ক দৃষ্টি।
তারপরই শাইনা রওশনআরার পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ঠিক সেই মুহূর্তে তাজদার সিদ্দিকীর দৃষ্টি একবার এসে পড়লো তার উপর।
গায়ে শাল টেনে নিয়ে শাইনা হাতদুটো এমনভাবে সামনে জড়ো করে রাখলো যে তার বাড়ন্ত শরীরটা আর কারো চোখেই পড়ছেনা। ওভাবে হাত দুটো জড়ো করে রেখে ধীরেধীরে হেঁটে সে বেরিয়ে গেল।
তিতলির উপর দায়িত্ব পড়েছে তার ব্যাগটা নিয়ে আসার।
তাসনুভার জন্য খাবার পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বাড়িতে। সে সেখানে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সবকিছুর আগে তার ঘুমটা জরুরি।

রওশনআরা উঠোনে আসতেই পাড়াপড়শিরা ডাক দিল, “বউ নিয়ে চলে যাচ্ছ নাকি রায়হানের মা?”
রওশনআরা হেসে জবাব দিলেন, “হ্যাঁ আর কতদিনই বা থাকবে? অনেক তো নাইওর হলো।”
শাইনা চুপচাপ তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর দল বেঁধে সবাই বের হলো শাইনাদের বাড়ি থেকে।
বারান্দার সিঁড়ি পেরোনোর সময় শাইনা অল্প একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। ঠিক সেই মুহূর্তেই তাজদার সিদ্দিকীর দৃষ্টি এসে পড়লো তার চোখে। এক মুহূর্তের বেশি হলো না তাড়াতাড়ি সামনে ফিরে গেল শাইনা।
তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে তাজদার সিদ্দিকী হালকা করে শাইনার বাহুর সঙ্গে নিজের বাহু লাগিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে গেল।

শাইনা এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস আটকে রাখলো। এখনো পাজি রয়ে গেছে।
আনোয়ারা বেগম তাজদারকে ডেকে বলল,”দাদুভাই বউকে দেখেছ?”
তাজদার সিদ্দিকী ফোনের ভেতর চোখ গেঁথে রেখে যেতে যেতে মাথা নাড়লো।
“উহু।”

তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here