তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ১৩
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা কিন্তু শীতের কারণে মনে হচ্ছে যেন মাঝরাত। ঘন কুয়াশার একটা ভারী চাদর গ্রামকে একেবারে মুড়িয়ে রেখেছে। আকাশ থেকে ঠান্ডা ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো নেমে আসা এই কুয়াশায় দূর-দূরান্তের গাছপালা, বাড়িঘর সব আবছা, ছায়া-ছায়া মনে হচ্ছে। উঠোনের বৈদ্যুতিক আলোটিও ম্লান, কুয়াশার কারণে তার তেজ হারিয়ে ফেলেছে।
চারিদিকে গভীর নিস্তব্ধতা। এই ঠাণ্ডায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকও থেমে গেছে। শুধু মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে আসা হিমেল বাতাসের সাঁই সাঁই শব্দ নারিকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পথের ধারে কুকুরের দীর্ঘ ডাক নিস্তব্ধতাকে আরও বাড়িয়ে তুললো। শাইনা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। উঠোনটা নীরব। আজ কেউ ব্যাটমিন্টন নিয়ে নামেনি। তৌসিফও আজ বাড়িতেই ছিল না সারাদিন। এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে কোথায় যেন গিয়েছে আর ফেরেনি।
তাসনুভা আর তিতলির মধ্যে আবারও ঝগড়া লেগেছে। দুজনের চেঁচামেচি ভেসে আসছে। বিকেলে রওশনআরা তিতলিকে একটা চড় দিয়েছিল। সেই চড় খেয়ে তিতলি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন ঘুম থেকে উঠে আবারও কাঁদতে বসেছে বোধহয়। বিয়েতে সে যাবেই। তাসনুভাও তাকে নিয়ে যেতে যাবে না বলে দিয়েছে। সে এককথার মানুষ।
শাইনা ওদের ঝামেলার মধ্যে আর গেল না। তৌসিফ ভাইয়া অথবা বড়ো ভাইয়া কেউ এলেই ওদের ঝগড়া থামবে। এর আগে অসম্ভব। তাজদার সিদ্দিকী থাকা অবস্থায় এদেরকে এভাবে ঝগড়া করতে দেখেনি সে। থামার নাম নেই।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শায়নার পা অবশ হয়ে এল। একঘেয়েমি কাটাতে সে পাশ থেকে কাঠের চেয়ারটা টেনেটুনে বসলো। হঠাৎই মনে হলো এই নির্জন বারান্দায় একটা বই এনে পড়লে মন্দ হয় না। ঘরের চার দেয়ালের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিন্তু ঘরের ভেতরে গিয়ে বই খোঁজার চিন্তা আসতেই শরীরে আলস্যের ঢেউ লাগল। এই সামান্য ঝক্কি আর ক্লান্তির কারণেই এতগুলো দিন একটাও বই খোলা হয়ে ওঠেনি। এত বই কবে শেষ করবে, কীভাবে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে এই চিন্তাগুলো তাকে ভারাক্রান্ত করে তুললো আবারও।
কোনোরকমে একটি বইয়ের দিকে হাত বাড়াতেই ঘটলো বিপত্তি! বইয়ের তাক থেকে গড়গড় করে একরাশ বই মেঝেতে আছড়ে পড়লো। শায়নার ডান পায়ের কাছে এসে পড়লো এক মোটা বাঁধাইয়ের বই। আঙুলটা টনটন করে উঠলো। অসহ্য ব্যথা! প্রচণ্ড শব্দের মধ্যেও তার কানে ঠিকই এলো ফোনের ভাইব্রেশনের মৃদু গুঞ্জন। চমকে উঠে সে ফোনের দিকে তাকালো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ফোনের কাছে গিয়ে দ্রুত কল রিসিভ করলো। ভিডিও কল!
ব্যাথায় কপাল তখনও কুঁচকানো। হালকা এলোমেলো কিছু শব্দ কানে এলো। ধীরে ধীরে দেখা গেল একটা পরিচ্ছন্ন ঘর ম্লান আলোয় ভাসছে। টেবিলের ওপর কফির মগ, খোলা ল্যাপটপ, কিছু নোটবুক, একটা ঘড়ি, পেন তারপর মাথাভর্তি ভেজা এলোমেলো চুল। তারপরেই তাজদার সিদ্দিকীর মুখ। শাইনা বড়োসড়ো একটা শ্বাস ছাড়লো।
“আসসালামু আলাইকুম।”
গম্ভীর, শান্ত স্বরটা ভেসে এলো সাথে সাথে,”ওয়া আলাইকুমুস সালাম। হাই! কি খবর?”
শাইনার চোখ বারবার নিজের পায়ের দিকে চলে যাচ্ছে। আঙুলটা টনটন করছে ব্যাথায়।
তারপর হঠাৎ সচেতন হয়ে ক্যামেরাটা ঘুরিয়ে নিল সে। চুল ঠিক করল, মাথার ওড়নাটা গুছিয়ে নিয়ে তারপর ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল সামলে তাজদার সিদ্দিকীর দিকে তাকালো।
ওদিকে তাজদার একটু ঝুঁকে কী যেন একটা কাজ সেরে আবার ক্যামেরার দিকে মুখ তুলল।
“শোনা যাচ্ছে?”
শাইনা বলল, “জি, এতক্ষণ লাগলো কেন?”
তাজদার হালকা ক্লান্ত স্বরে উত্তর দিল, “একটা ঝামেলায় পড়েছিলাম। আব্বু আর ভাইয়ার সাথে কথা বলে তারপর তোমাকে ফোন দিয়েছি।”
শাইনা চুপ। কী বলবে খুঁজে পেল না। ফোনে কথা বলার সময়ও কথা জোটে না তার। ভিডিও কল তো আরও জটিল ব্যাপার স্যাপার।
তাজদার কফির মগ তুলে একটা চুমুক দিল।
“বাড়িতে কী অবস্থা?”
“সবাই টেনশন করছিল আপনার ফোন না পেয়ে।”
“সবাই মনে হয় ভেবেছে প্লেনটাই নিয়ে গায়েব হয়ে গেছি! কারণ আমি যেখানে, ঝামেলা সেখানে।”
শাইনা হেসে ফেলল হালকা করে মাথা নেড়ে। তাজদার জানতে চাইল,“মামারা বাড়িতে গিয়েছিল?”
“না, এয়ারপোর্ট থেকেই চলে গিয়েছিল। বড়োআব্বু অনেক বলেছিলেন কিন্তু রাজি হননি।কফি কে বানিয়ে দিয়েছে?”
প্রশ্নটা মুখ থেকে বেরিয়ে যেতেই শাইনা বুঝল, ভুল কথা বলে ফেলেছে। কিন্তু প্রশ্নটা ফিরিয়ে নেয়ার আগেই তাজদার সিদ্দিকী গুরুতর ভঙ্গিতে বলল,
“এখানকার বউ।”
শাইনা ঠোঁটের কোণে জোর করে হাসি টেনে বলল,
“ভালোই তো।”
তাজদার সিদ্দিকী ঠোঁটের কাছে হাত রেখে হাসি আড়াল করলো। তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে বসে ডানেবামে দুলতে দুলতে,
“লিসেন শাইনা মমতাজ আমি রান্নাবান্না কাটাকুটি সব পারি। তুমি অলরাউন্ডার একটা হাসবেন্ড পেয়েছ। শুকরিয়া করো।”
“দেশে থাকতে বলেননি কেন? আপনার হাতের রান্না খেতে পারতাম।”
“অসম্ভব। এখানে এলে রান্না করে খাওয়াতে পারি। দেশে নট পসিবল।”
শাইনা বলল,”কী কামচোর! দেশে এলে পানিটাও ঢেলে খায় না মা বোনের সেবা নেওয়ার জন্য।”
“কি পাষাণ তুমি! ওখান থেকেই আমাকে কামচোর ডাকছো। আর আমাকে এত কাজ করে খেতে হবে এটার চিন্তা একবারও করছো না।”
শাইনা গালে দুহাত রেখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলল,”আপনার লন্ডনওয়ালী আছে না? উনাকেই বলুন রান্না করে খাওয়াতে। পারলে এখনি বলুন আপনার ভেজা চুলটা মুছে দিতে।”
“ভেজা চুল মুছে দেয়ার মতো কেয়ারিং বউ আমি বাংলাদেশেই পাইনি। এখানে পাব এটা ভাবা বিলাসিতা।”
“আপনি এত নির্যাতিত পুরুষ মানুষ ভাবতেই খারাপ লাগছে। ইশশ!”
তাজদার সিদ্দিকীর কপাল কুঁচকে এল। চেহারা ম্লান হয়ে এল।
“আচ্ছা ফোন রাখি। আবার করবো।”
শাইনা ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসির রেখা টেনে বলল,”আপনি চাইলে রেখে দিতে পারেন। আমি এখন রাখতে চাই না।”
তাজদার সিদ্দিকীর কপাল আরও কুঁচকে গেল।
“কেন তুমি কি আমার লন্ডনওয়ালী বউয়ের সাথে আমি কি করছি তা দেখতে চাও?”
“মন্দ হবে?”
“ননসেন্স!”
শাইনা শব্দ করে হেসে উঠে বলল,”না আমি তো কাউকে ভালোটালো বাসি না। দেখি কে কেমন বেসে টেসে উল্টিয়ে ফেলছে।”
তাজদার সিদ্দিকী চেহারা রঙ পরিবর্তন এবার স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
“আমি রাখছি। আই হ্যাভ এ এমারজেন্সি ফোনকল!”
শাইনা ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,”ওকে।”
সে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এসেছে। তাজদার সিদ্দিকী মুখ গম্ভীর করে কল কেটে দিল। শাইনা টেবিলে মাথা ফেলে হাসতে লাগলো।
শাইনা টেবিলে মাথা রেখে বসেছিল। তিতলি কিছুক্ষণ পর এসে বলল,”এই এই ভাইয়া তোমাকে ফোন করেছে? আব্বুকে নাকি করেছে।”
শাইনা মাথা তুলে তার দিকে তাকালো। তিতলি বলল,”একি চোখে পানি কেন? আবার হাসছোও।”
শাইনা তাকে সবটা খুলে বললো। তিতলি গালফুলিয়ে বলল,”আমার ভাইয়া তোমাকে ওখানে গিয়ে মিস করছে আর তুমি মজা নিচ্ছ?”
শাইনা বলল,”আমাকে খোঁচালে আমিও খোঁচাতে জানি। আমাকে বলে কিনা এখানকার বউ কফি বানিয়ে দিয়েছে! নিজেই আমাকে খোঁচায় আর আমি কিছু বললে গাল ফোলায়।”
তিতলি বলল,”তাই বলে তুমি মজা নেবে? বলবে আই মিস ইউ হানিইইই।”
শাইনা তার কথা শুনে হাসতে লাগলো। তিতলি বলল,”চা নিয়ে আসি?”
“অল্প করে।”
সে গান গাইতে গাইতে ঘর ছাড়লো।
“ওওও কত্তো কি যে ভাবি আমি।
কেমন হবে আমার স্বামী।
দুচোখে ঘুম নাই রে।
আমার দু’চোখে ঘুম নাই রে।”
তাসনুভা ঘর থেকে তার গানের গলা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ডাকল,”তিতলি!”
তিতলি গান থামিয়ে তার দিকে তাকালো।
“কি হয়েছে?”
“এইসব কি ধরণের গান গাইছো তুমি?”
তিতলি অকপটে বলল,
“অবিবাহিত সংগীত।”
“হোয়াট এ চয়েস! তোমার লজ্জা করছে না এইসব গাইতে?”
তিতলি সরাসরি বলল,”না, লজ্জা করছে না।
মনটা আমার উরু উরু,
বুকটা করে দুরু দুরু।
বিয়ের লগন এলোরে,
বিয়ের লগন এলোরে।”
তাসনুভা রেগে গিয়ে চিৎকার করে ডাকলো,”ছোটো ভাইয়া? দেখো তিতলি কিসব গান গাইছে। আম্মু? আব্বু?”
শাইনা, ঝিমলি দুজনেই এসে পড়লো তার চিৎকার শুনে। ঝিমলি বললো,”এরা দুজন আজ কি শুরু করেছে!”
তৌসিফ সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছে। গোসল করার জন্য গলায় তোয়ালে জড়িয়ে ওয়াশরুমে যাচ্ছিল ঠিক তখুনি তাসনুভার চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে এল। বিরক্ত হয়ে বলল,
“কি হয়েছে? তোদের জ্বালায় ঘরে এসে শান্তি নেই। সমস্যা কি? দুটোকেই ঘাড় ধরে বের করে দেব।”
তাসনুভা তিতলিকে দেখিয়ে বলল,”ও অসভ্যের মতো গান গাইছে।”
“তো গাক। তোর কি? সারাক্ষণ চিল্লাচিল্লি ছাড়া কিছু পারিস না? যা ফুট!”
বলেই বিরক্ত হয়ে চলে যেতে লাগলো সে। তিতলি তাসনুভাকে মুখ ভেঙচিয়ে আবারও গানটা গাইতে লাগলো,
“ওওও কত্তো কি যে ভাবি আমি।
কেমন হবে আমার স্বামী।
দুচোখে ঘুম নাই রে।
আমার দু’চোখে ঘুম নাই রে।”
গানটা শুনেই তৌসিফ থেমে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই তিতলির তাকে দেখামাত্রই জিভে কামড় দিয়ে পালাতে যাচ্ছিল তার আগেই তৌসিফ জুতো খুঁজে নিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে মারলো। তিতলি বাপ বাপ বলে পালিয়ে গেল। অভিশাপ দিয়ে গেল,
“তৌসিপ্পে তোর জীবনেও বিয়ে হবে না।”
তাসনুভা বান্ধবীর বিয়েতে এসেছে। অনুষ্ঠান হচ্ছে শহরের একটা নামি-দামি ক্লাবে। আজ গায়ে হলুদ। সে একাই এসেছে।
তিতলিকে নিয়ে আসেনি। আসার সময় তিতলি অনেক কান্নাকাটি করেছে কিন্তু তারপরও আনেনি। তিতলি খুব ছটফটে। তাকে সারাক্ষণ চিন্তায় থাকতে হবে তাকে নিয়ে। তাই নিয়ে আসেনি। যেকোনো অনুষ্ঠানে গেলে তিতলি একটা না একটা ঝামেলা বাঁধাবেই।
তাছাড়া রাত বেশি হয়ে গেলে তাকে থেকে যেতে হবে এখানে। তিতলি সাথে থাকলে এক্সট্রা ঝামেলা।
তিতলিকে নিয়ে আসেনি বলে মুক্তা আর মুক্তার মা, মুক্তার ছোটোবোন তাসনুভার উপর রেগে গেছে। ওদের কথা শুনে তাসনুভার মনে হলো তিতলিকে নিয়ে আসা উচিত ছিল। তৌসিফ খুব ব্যস্ত ছিল। তাই সেও আসতে পারেনি। কাল বিয়েতে আসবে সে আর রায়হান। তাসনুভা ভাবলো কাল ভাইয়াকে বলবে তিতলিকেও নিয়ে আসতে।
এত আনন্দ, হৈহল্লার মধ্যে তিতলির কথা বারবার মনে পড়ছে তার। বাড়িতে ফোন করবে কিনা ভাবতে ভাবতে আর ফোন দিল না।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান তাড়াতাড়ি শুরু হয়েছে। যেহেতু শীতের রাত। সেহেতু দূর দূরান্তের আত্মীয় স্বজন ভোররাত অব্দি ক্লাবে থাকতে পারবে না। তাই তাড়াতাড়ি কেক কেটে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে।
নিচতলায় খাওয়াদাওয়া হচ্ছে। দোতলায় বউকে স্টেজে বসানো হয়েছে। কেক কাটা আর ছবি তোলা হচ্ছে।
তাসনুভা আর তার বাকি বান্ধবীরা সবাই একসাথে শাড়ি পরেছে বউয়ের লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করে। শাড়ির রঙ গাঢ় সবুজ আর লাল খয়েরী। ব্লাউজ সবুজ, তবে বেশ কাজ আছে হাতায়। কাঁচা ফুলের গহনা পরেছে সবাই। তাসনুভা গলায় কিছু পরতে পছন্দ করে না। তাই শুধু কানের টানা দুলটা পরেছে। হাতে অবশ্য চুড়ি পরেছে শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে।
কেক কেটে বান্ধবীদের সাথে গ্রুপ ছবি তোলার পর
মুক্তার সাথে তাসনুভা বিয়ের শাড়ির রঙ নিয়ে বেশ তর্কতর্কি জুড়ে দিল। মুক্তা শেষমেশ লাল শাড়ি কিনেছে তার বরের পছন্দে। কথা ছিল কোনো লাইট কালারের শাড়ি কিনবে। তাই সব বান্ধবীরা মিলে গাউন কিনেছিল শাড়ির সাথে ছবিতে ভালো দেখায়। কিন্তু সব গোলমাল হয়ে গেল।
তাসনুভা নাক সিটকে বলল,”তুমি বলেছিলে লাল রঙের শাড়ি তুমি জীবনেও কিনবে না তাহলে?”
সারা হাসি চাপা দিয়ে বলল,”নুভা বাদ দাও না।”
জ্যোতি বলল,”তোমার বিয়েতে আমরা ম্যাচিং গাউন পরবো। এবার এসব বাদ দাও।”
জেনি হেসে বলল,”নুভা কাল তোমার সাথে ছবি তুলবে না মুক্তা। দেখে নিও।”
বলতে বলতে তারা হাসছে একসাথে। একেকজনের একেক কথা শুনে তাসনুভা অবাক হয়ে বলল,
“এত হাসাহাসির কি আছে?
লাল পরবে নাকি অন্য কালার দ্যাটস হার চয়েস। কিন্তু আমাদের মিথ্যে বলার কি দরকার ছিল?”
মুক্তা হতাশ হয়ে বলল,”আমার কি করার ছিল বলো তো। তোমাদের জিজুই এমন বলেছে। উনার নাকি লাল পছন্দ। দেখো তোমার বরও যদি চায় লাল শাড়িতে তোমাকে বউ সাজে দেখতে তখন তোমারও ইচ্ছে করবে লাল পরতে।”
তাসনুভা নড়েচড়ে বসে বলল,
“কেন আমাকে বরের পছন্দে শাড়ি পরতে হবে? আমার বিয়েতে সব আমার চুজ করা জিনিস থাকবে। আশ্চর্য! বর কি আমাকে কিনে নিয়েছে? বিয়ের দিন থেকেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে পরে কি হবে? সব তার পছন্দের কাজ করতে হবে। এটা কেমন না?”
“আচ্ছা দেখবো আমরা। তোমার বিয়ে এখনো বাকি আছে। দেখবো দেখবো।”
“দেখে নিও।”
সে গা মোচড়ে সরে গেল সেখান থেকে। মুক্তা ডেকে বলল,”তোমাদের জিজু আসছে। ঝগড়া আজকেই সেড়ে নিতে পারবে।”
তাসনুভা কপাল কুঁচকে বলল,”কখন আসছে?”
“এসে পড়বে এক্ষুণি।”
রাত দেড়টার ঘরে। এই ক্লাব থেকে গাড়িতে করে প্রায় বিশ মিনিটের পথ গেলে বরপক্ষের ক্লাব। তারা জানিয়েছে কয়েকজন বন্ধু বান্ধব সহ বর আসছে। আসতে চায়নি। মুক্তা জোর করেছে বলে আসতে হলো।
তাসনুভা সব শুনে বলল,”তোমার বর আসছে শুনে খুশি হতে পারছি না সরি। কারণ আমি ফিতা কাটার দলে নেই। ওসব আমার কাজ নয়।”
তার বান্ধবীরা সবাই হেসে ফেললো একসাথে।
“তোমরা হাসছো কেন আজব!”
মুক্তা বলল,”আমরা ভাবছি অন্য কথা।”
“কি কথা?”
“তোমাকে আজকে যা লাগছে। বরের অবিবাহিত বন্ধু টন্ধু কেউ যদি থাকে তাহলে তো..
তাসনুভা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,”বিয়েবাড়িতে এসে প্রেমে পড়ার মতো চিপ ব্যাপার স্যাপার এখনো হয়?”
মুক্তা হাসি থামিয়ে বলল,”আচ্ছা বাদ। তোমার সাথে আমি আর কোনো কথা বলছি না।”
বাকিরা সবাই হাসছে।
তাসনুভা এদিকওদিক তাকিয়ে ক্যামেরাম্যানকে ডাকলো হাত বাড়িয়ে। তারপর মুক্তাকে বলল,
“তোমরা একটু নিচে নামবে? আমি একা কিছু ছবি তুলবো।”
মুক্তা বললো,”আসো সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুলি?”
“অনেক তুলেছি। এবার আমি একা কিছু ছবি তুলবো। প্লিজ নামো।”
সবাইকে স্টেজের নিচে নামিয়ে ছাড়লো সে। তারপর একা একা বিভিন্ন পোজ দিয়ে ছবি তুলতে লাগলো। ক্যামেরা ম্যান তৌসিফ হলে এতক্ষণে তার দিকে ক্যামেরা ছুঁড়ে দিয়ে পালাতো। ছেলেটা অল্পবয়সী। তাসনুভাকে রাগী দেখে কিছু বলতেও পারছেনা আবার সইতেও পারছে না।
জেনি এত ছবি তুলতে দেখে শেষমেশ বলল,”নুভা মনে হচ্ছে আজ তোমার বিয়ে!”
তাসনুভা সাথে সাথে বলল,”আবার এটা বলে বসো না যে বরও আসবে কিছুক্ষণ পর।”
ক্যামেরাম্যান হঠাৎই ক্যামেরা নিয়ে ছুটছে। তাসনুভা হাত বাড়িয়ে ডাকলো,”এই এই সমস্যা কি?”
ক্যামেরা ম্যান ছুটতে ছুটতে বলল,”বর এসেছে।”
বান্ধবীরা সবাই একসাথে তাসনুভার দিকে তাকালো।
“দেখেছ আমাদের কথা মিলে গেল।”
তাসনুভা শাড়ি ধরে স্টেজ থেকে নামতে নামতে মুক্তাকে বলল,”তোমার বর এসেছে। যাও নিচে যাও।”
মুক্তার কাজিনরা সবাই মুক্তাকে নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে। সবাই তাকে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। সারা জিগ্যেস করলো,”নুভা যাবে না?”
তাসনুভা চেয়ারে বসে ছোট্ট একটা আয়না মুখের সামনে ধরে ঠোঁটের লিপস্টিক দেখতে দেখতে বলল,”নো।”
মুক্তা বলল,”আরেহ এসো। জেনি ওকে টেনে নিয়ে এসো।”
জেনি তাই তাই করলো। তাসনুভাকে ধরে নিচে নিয়ে গেল।
মুক্তার বর আর বরের বন্ধু বান্ধবকে ঘিরে মুক্তার ভাই আর কাজিনদের উত্তেজনার শেষ নেই। সবাই ফুল, আর গ্লোসি স্প্রে ছুঁড়ছে, শিঁস বাজাচ্ছে, হাততালি দিচ্ছে, সাথে ফুল ভলিউমে গান তো বাজছেই একের পর এক।
তাসনুভা একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো। চুলে ফুলের পাপড়ি কিংবা স্প্রে পড়ুক তা সে চায় না। এইসব তার কাছে বিরক্তিকর লাগে।
বর আর বরের বন্ধুদের উপর গ্লোসি স্প্রে ছুঁড়ছিল সবাই মিলে। বরের বন্ধুদের একজনের চোখে গিয়ে পড়ায় সেখানে গুঞ্জন উঠতেই সাথে সাথে ফুল আর স্প্রে ছোঁড়া বন্ধ হয়ে গেল।
তাসনুভা এবার জেনিদের কাছে চলে যাচ্ছিল ঠিক সেসময় কেউ একজন পেছন থেকে তার চুলের উপর গাঁদাফুলের পাপড়ি ছুঁড়ে মারলো একগাদা। তাসনুভার পুরো মাথা ভরে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে ঝাড়ি মারলো সে!
“এই মেয়ে!”
মেয়েটি ভয়ে ভয়ে বলল,”আমি না আপু। ওই ভাইয়াটা প্লেটটা উপরে তুলে সরিয়ে দেয়ার সময় আপনার মাথায় গিয়ে পড়েছে সব। সরি আপু।”
তাসনুভা ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই ভদ্রলোকও একচোখে টিস্যু চাপতে চাপতে ধীরেধীরে ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালো। পরনে গোল্ডেন রঙের পাঞ্জাবি।
তাসনুভার চোখজোড়া ধীরেধীরে বড়ো হয়ে এল। কপাল কুঁচকে ফেলে সে অবিশ্বাসের সাথে বলল,
“আপনি!”
আনিস কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলে যাচ্ছিল তখুনি তাসনুভা পেছন থেকে বলে উঠলো,”আশ্চর্য! আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চিনতেই পারছেন না।”
আনিসের চোখটা জ্বলছে আর পানি পড়ছে। সে চোখটা চেপে ধরে রেখে আবার ছেড়ে দিয়ে তার দিকে ফিরলো। বলল,”খেয়ে এসেছি।”
তাসনুভার চোয়াল ঝুলে পড়লো,
“মানে?”
“মানে তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আমি তোমার বিরিয়ানির প্লেটে ভাগ বসাতে এসেছি। এটা হবে না। কারণ আমি খেয়েদেয়ে এসেছি।”
তাসনুভা অবাক হয়ে বলল,”আমার প্রশ্ন এটা ছিল?”
“তোমাকে সত্যিই প্রথমে চিনতে পারিনি। যা সাজা সেজেছ।”
“ফালতু কথা বলবেন না। আমি নো মেকআপ লুক দিয়েছি। একটা অন্ধ লোকও বলতে পারবে আমি কে।”
“আমি চেঁচামেচি শুনেই বুঝে ফেলেছিলাম কে হতে পারে!”
“কি বলতে চাইছেন?”
“কিছু না।”
“আমি যেখানেই যাই সেখানেই আপনাকে থাকতে হবে কেন?”
আনিস কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখুনি মুক্তার আম্মু ছুটে এল। আহ্লাদ দেখিয়ে বলল,”বাবা চোখ এখনো জ্বলছে? দেখি দেখি। ছেলেগুলোকে কতবার করো মানা করলাম। আহা চোখটা তো লাল হয়ে এল।”
মুক্তা বলল,”ভাইয়া চোখে পানি দিলে বোধহয় ভালো লাগবে।”
আনিস বলল,”না না ঠিক আছি আমি। আন্টি ব্যস্ত হবেন না। ঠিক হয়ে যাবে।”
বর পাশ থেকে বলল,”পানি খাবি?”
জেনি বলল,”ভাইয়া আগে মিষ্টি খান। সবাই খেয়েছে। আপনি খান নি। তারপর পানি। নিন।”
বলেই সে মিষ্টি কেটে এগিয়ে দিল আনিসের দিকে। আনিস মিষ্টিটুকু মুখে নিয়ে বরের দিকে তাকালো। বর ইশরাক বলল,”চোখ বেশি জ্বলছে?”
তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ১২
“না ঠিক আছি।”
আনিসের দিকে পানি এগিয়ে দিল মুক্তার আম্মু। আনিস গ্লাসটা নিয়ে একপাশ সরে গেল। চেয়ার টেনে বসে পানি খেতে যাবে তখুনি কে যেন তাসনুভাকে বলল,
“বরের বন্ধুদের মধ্যে কাউকে দেখে নাও নুভা। দুই একজন আনম্যারেড আছে।”
তাসনুভা কাঠকাঠ গলায় বলল,”সবকটা দেখতে দুই তিন বাচ্চার বাপের মতো। তারউপর ন্যাকামিতে ভরপুর। ডিজগাস্টিং!”
আনিস যতটুকু পানি খেতে নিল সবটুকু মুখ থেকে ছিটকে পড়লো সাথে সাথে।
