তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৬
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
“আমি তোমাকে যে ড্রেসগুলো দিয়েছিলাম, সেগুলো তোমার পছন্দ হয়নি?”
তাসনুভার কণ্ঠে একরাশ কৌতূহল। শাইনা সোজাসুজি বলল,”ওগুলো পরলে বাচ্চা বাচ্চা লাগে।”
তাসনুভার ভুরু কুঁচকে গেল।
“হোয়াট! বাচ্চা বাচ্চা? কে বলেছে?”
শাইনা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু তাসনুভার চাপাচাপিতে শেষমেশ বলেই ফেলল,”আপনার ভাইয়া।”
তাসনুভা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। ভাইয়া বলেছে? ভাইয়া এমন কথাও বলতে পারে? ঠিক তখনই তিতলি এসে বলল,
“শাইনা ড্রেসগুলো আমাকে দিয়ে দাও। আমি পরব। আমার খুব ভালো লেগেছে।”
তাসনুভা চটে গিয়ে বলল,”তিতলি জাস্ট শাট আপ! ওগুলো তোমার জন্য আনা হয়নি। সব জায়গায় তোমাকে নাক গলাতে হবে কেন?”
তিতলি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,”নাক আছে তাই গলাই।”
“তিতলি!”
তিতলি মুখ মোচড় দিয়ে ঘুরে গেল।
রওশনআরা পাশের ঘর থেকে ডেকে উঠলেন,
“কি হয়েছে ওখানে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তাসনুভা বিরক্ত স্বরে বলল,”ও খুব বেয়াদব হয়ে গেছে। মুখে মুখে কথা বলছে আমার!”
তার নামে অভিযোগ শুনে তিতলি আবার ছুটে এসে বলল,
“আম্মু আমার কিছু ড্রেস পছন্দ হয়েছে। কিন্তু ও আমাকে ছুঁতেও দেয়নি। এখন এনেছে শুধু শাইনার জন্য। আমারগুলো কোথায়?”
তাসনুভা ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“তোমার রুচি খারাপ তিতলি। ওই ড্রেস আমি তোমাকে পরতে দেব না। তুমি জানো না কোনটা তোমাকে স্যুট করে।”
তিতলি একটুও না ভেবে বলল,
“তোমার রুচি খারাপ। আমার নয়।”
“ঠাস করে দেব একটা এখন!”
ঠিক তখনই তৌসিফ এসে ধমকে উঠল,
“ওই তোরা থামবি? বাড়িটা মাছের বাজার বানিয়ে ফেলছিস।”
তিতলি তার দিকেই ছুটে গিয়ে বলল,
“ভাইয়ে দুই হাজার টাকা দাও। চুন্নির দোকানে দুটো ড্রেস পছন্দ হয়েছে। টাকা দিলে এখন সুড়সুড় করে ছেড়ে দেবে।”
তাসনুভা কাঠকাঠ গলায় ফেলল,
“ওগুলো তোমার মানাবে না। ওগুলো ক্যারি করার মতো স্মার্টনেস লাগে। ইউ আর নট দ্যাট টাইপ তিতলি।”
তিতলির মুখ শক্ত হয়ে গেল।
“আমার পছন্দ যথেষ্ট সুন্দর, বুঝেছ? কিছুক্ষণ বলছে রুচি খারাপ কিছুক্ষণ বলছে স্মার্ট হতে হয়।”
তাসনুভা তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,”কিপ ইয়োর মাউথ শাট তিতলি! ভাইয়ার এক্সিডেন্টের দিন তুমি আম্মুকে বোরকার সাথে যে ওড়নাটা পরিয়ে নিয়ে গেছিলে আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তোমার রুচি ভয়ানক বাজে!”
ঘরের সবাই থম মেরে গেল। শাইনা, তিতলি, এমনকি তৌসিফও হতবাক। ওরকম একটা সিচুয়েশনে কেউ মনে রাখে কে কী রঙের ওড়না পরেছিল? আজব ব্যাপার তো!
তৌসিফ কপাল চুলকে বলল,
“তোকে নিয়ে তো মহা ঝামেলায় আছি রে।”
তাসনুভা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আমি ভুল কি বলেছি? হসপিটালে যাচ্ছে বলে যেমন তেমন ওড়না পরবে? আমি সেদিন কিছু বলিনি কিন্তু খুব রাগ হয়েছিল। ননসেন্স গার্ল!”
তিতলির দিকে জ্বালাময়ী দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তিতলি পেছন পেছন গিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল,”আহা কী রুচিশীল মানুষ রে বাবা!”
তাসনুভা হঠাৎ ঘুরে তাকাতেই তিতলি এক দৌড়ে পালাতে গিয়ে ধাক্কা খেল তৌসিফের সাথে।
“উফ!”
তৌসিফ বুক চেপে ধরল।
তিতলি হেসে তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“ভাইয়ে ডুক্কু পাইছো?”
“দাঁড়া তোকে!”
তিতলি ফুড়ুৎ করে দৌড় দিচ্ছিল ঠিক তখুনি তাজদারের সামনে গিয়ে পড়লো। তাজদারের কপাল কুঁচকানো। মুখ গম্ভীর।
“সমস্যা কি? হাত পা ভেঙে হসপিটালাইজড হতে ইচ্ছে করছে?”
তিতলি নখ কামড়ে কামড়ে ধীরেধীরে হেঁটে শাইনার পাশ দিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করলো,”তোমার বরটা খুব বাজে।”
তিতলি চলে যেতেই তাজদার শাইনাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে যেতে বলল,”ঘরে আসা হোক।”
শাইনা বলল,”আমার খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই।”
তাজদার ঘরে গিয়ে তাকে একনাগাড়ে ডাকাডাকি করতে লাগলো। সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে অদ্ভুতভাবে। শাইনা লজ্জায় পড়ে গেল। এমন আজব প্রাণী সে খুব কমই দেখেছে।
সে ঘরে যেতেই তাজদার তীর্যক চাহনি নিক্ষেপ করে বলল,”হ্যালো মমতাজ!”
“হ্যালো না গেল।”
“কি গেল?”
“আপনার মাথা।”
“বউবাচ্চা রেখে লন্ডনে চলে যাচ্ছি। আমার মাথা যাবে না?”
ঘরময় একবার হেঁটে নিয়ে শাইনা আবারও ঘর থেকে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। তাজদার দরজার কাছে এসে তাকে ডেকে বলল,
“হেই মমতাজ বেগম! খুব পেইন হচ্ছে?”
শাইনা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। বলল,
“পেইন কার বেশি সেটা দেখতেই পাচ্ছি।”
তাজদার সিদ্দিকী বুক ফুলিয়ে বলল,
“তুমি বোধহয় তাজদার সিদ্দিকীর আসল রূপ ভুলে গিয়েছ।”
“ভুলে থাকার চেষ্টা করি। কি বদমাশ লোক ছিল সেটা আমি ছাড়া আর কে জানে?”
“তুমি বোধহয় আমাকে মিস করবে না।”
শাইনা প্রশ্ন করলো,”করলে ভালো হবে?”
“ভালো হতো আর কি।”
“ব্যাড নিউজ। মিসটিস করলাম না।”
“যদি কখনো শুনি কেউ কান্নাটান্না করে বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে তখন?”
শাইনা মিষ্টি হেসে বলল,”নৌকায় চড়ে আসবেন।”
তাজদার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”সর্বনাশ সর্বনাশ। এই বোকাচণ্ডী মমতাজ এত কথা কোত্থেকে শিখলো? না একে ধরে আজকে না চটকালে আমার শান্তি নেই।”
তাজদার চিড়বিড় করে তেড়ে আসতেই শাইনা এবার একটু জোরেই পালালো। বেয়াদব লোক। সারাক্ষণ চটকানো ভটকানোর তালে থাকে।
“আনিস ভাই! আনিস ভাই দাঁড়ান!”
তাসনুভা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দৌড়ে এল। আনিস তখন বাইকের ইঞ্জিন চালু করতে যাচ্ছে। অফিসে আজ দেরি হয়ে গেছে, তাই গাড়ি না নিয়ে বাইকেই বেরিয়েছে সে।
তাসনুভা এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“আমার আজ ভীষণ লেট হয়ে গিয়েছে। কয়েকজন ইনফ্লুয়েন্সার আসছে, শুটিং আছে। একটু লিফট দেবেন? আপনার অফিস তো আমার শোরুমের পথে।”
আনিস ভ্রু কুঁচকে বলল,”তোমাদের ড্রাইভার?”
“এখনো আসেনি,” তাসনুভা তাড়াহুড়োয় ঘড়ির দিকে তাকাল।
আনিস কিছুক্ষণ পর ভেবে বলল,”আমি কিন্তু খুব এক্সপার্ট না বাইক চালাতে…
“নো প্রবলেম। দাঁড়ান হেলমেটটা নিয়ে আসি।”
সে নিজে না গিয়ে চিৎকার করে বলল,”তিতলি! হেলমেটটা দাও তো।”
তিতলি একদৌড়ে হেলমেট এনে দিল। আনিস বাইকে চেপে স্টার্ট দিল।
তাসনুভা তখনো হেলমেটটা ঠিক করে মাথায় পরে বসতে যাচ্ছে এরই মধ্যে বাইক ‘শাঁ’ শব্দে ছুটে গেল রাস্তায়। মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল আনিস।
তাসনুভা হতভম্ব দাঁড়িয়ে রইল জায়গাটায়। বাইকের ধূলো মিলিয়ে যেতেই তাসনুভার ঠোঁট কাঁপলো অল্প অল্প। চোখে তীব্র অপমানের আগুন জ্বলজ্বল করছে। মনে হলো শব্দবিহীন একটা চড় খেয়েছে সে জনসমক্ষে।
আশেপাশে থাকা তিতলি, তৌসিফ, আর শাওন হো হো করে হেসে উঠল। তাসনুভা তাকাতেই দ্রুত সরে গেল সেখান থেকে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা তাজদার পুরো ঘটনাটা দেখল নিঃশব্দে। তারপর পাশ ফিরতে দেখলো শাইনাও দেখেছে ব্যাপারটা। দুজনের চোখের মিলন ঘটতেই দুজনেই সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিল। তাজদার ঠোঁটের সামনে হাত রেখে ধীরেধীরে হেঁটে সেখান থেকে চলে গেল। আনিস করলোটা কি? শাইনাও হতভম্ব হয়ে গেছে! ভাইয়া এটা না করলেও পারতো।
আনিস অফিস থেকে আসার পর শাহিদা বেগম ঘরে এসে বললেন,”ও আনিস তুই আজ কি করেছিস?”
আনিস শুয়ে একটু আরাম করছিল। মায়ের গলা শুনে শোয়া থেকে উঠে বসলো। কোলে বালিশ টেনে বসতে বসতে বলল,”কি হয়েছে?”
“ওই বাড়ির মেয়েটা নাকি আজকে সারাদিন কেঁদেছে ঘরে বসে। তুই নাকি সবার সামনে অপমান করেছিস?”
আনিস চোখ কপালে উঠলো।
“অপমান হবে কেন? আমি ভেবেছি ও বসেছে তাই বাইক ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর ফিরে আসিনি আমার দেরী হয়ে যাচ্ছিল বলে। এখানে অপমানের কি আছে?”
“আমি কি জানি? ও মনে হয় ভেবে নিয়েছে তুই ইচ্ছে করে এমন করেছিস?”
“আমি কি বাচ্চা মানুষ এমন করবো?”
“আমি কি জানি? ওর দাদী বললো আজ নাকি ভাতপানি কিছু খায়নি। চোখমুখ নাকি লাল হয়ে গেছে। অনেক কেঁদেছে বোধহয়।”
“আশ্চর্য! কাঁদার কি আছে?”
বলতে বলতে আনিস নিজেই হেসেই ফেললো। শাহিদা বেগম বলল,”তুই হাসছিস?”
আনিস চেহারায় গাম্ভীর্য টেনে এনে বলল,
“না একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত ঝামেলা করার কি আছে সেটা ভাবছিলাম।”
শাহিদা বেগম বললেন,”তুই কাজটা ভালো করিসনি। ওরা সবাই মনে করছে তুই ইচ্ছে করে এমন করেছিস।”
আনিস বলল,”আচ্ছা তুমি গিয়ে বলে এসো ওটা একটা মিসটেক ছিল। আমি ওর সাথে মশকরা করবো কেন? এর আগে কখনো মশকরা করেছি?”
তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৫
শাহিদা বকবক করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আনিস ফোনটা হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ চেক করলো। তাজদার মেসেজ করেছে,
“দ্যাট’স নট ফেয়ার আনিস। আমার বোনের অপমান আমি মানতে পারছিনা।”
আনিস মেসেজটা দেখে হেসে উঠল শব্দ করে।