তাজমহল পর্ব ১৬
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
শাইনা তবুও ধস্তাধস্তি করে কোল থেকে নেমে গেল। উঠোনে বাড়ির মানুষ, ভাবি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দু একটা গাড়িও এসে থেমেছে বোধহয়। তাজদার তার হাতটা ধরে রেখেছে। শাইনা হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে তার দিকে চোখ তুলে তাকালো। বলল,”আমি এভাবে যাব না। বাইরে অনেক মানুষ। মেঝ ভাইয়া চলে আসতে বলেছে। আমি এভাবে এখন যেতে পারব না। ভাইয়া আরও রেগে যাবে।”
তাজদারের তার হাত শক্ত করে ধরে রেখে অন্য হাতে ফোনে হয়তো কাউকে ডায়াল করছে। শাইনা বলল,”আশ্চর্য! আমার হাত কেন ধরে রাখা হয়েছে? রোজ রোজ এইসব নাটক দেখতে আমার ভালো লাগছেনা। ঘরে গিয়ে সমাধান করুক। আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন?”
তাজদার ফোন থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকালো। শাইনা চোখ সরিয়ে ফেলতেই তাজদার আবারও ফোনে ডায়াল করতে লাগলো। ফোন রিসিভ হচ্ছে না। শাইনা একফাঁকে হাতটা একঝটকায় ছাড়িয়ে নিল। তাজদার আরও শক্ত করে হাতটা ধরলো। ঠান্ডা স্বরে বলল,
“এত ছটফটানি কীসের? ফোন দিচ্ছি। রিসিভ হোক।”
শাইনা বলল,”আমার ভালো লাগছেনা। হাত ছাড়া হোক।”
“বাড়ি যেতে হবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“মেঝ ভাইয়া আসতে বলেছে। মেঝ ভাইয়া না বললে আমি কোথাও যাব না।”
ফোন রিসিভ হলো তখুনি। তাজদার ফোন কানে চেপে কর্কশ স্বরে বলল,
“মরে গিয়েছিস নাকি সবকটা? ফোন ধরছিস না কেন একটাও?”
তৌসিফ মৃদুস্বরে বলল,”সরি। এখানে সবাই কথাবার্তা বলছে। ফোন সাইলেন্ট ছিল। বলো কি বলবে?”
“শাইনাকে গাড়িতে করে কে পাঠিয়েছে?”
“আনিস ভাই। সবাই মিলে শাইনাকে কথা শোনাচ্ছিল তাই আনিস ভাই রেগে গিয়েছে।”
“কথা কেন শোনাচ্ছিল?”
“তুমি ক্লাব থেকে চলে গিয়েছ তাই। শাইনা কেন তোমাকে খেতে ডাকেনি তাই সবাই ওকে ঝেঁকে ধরেছিল।”
“আমি ক্লাব থেকে চলে এসেছি তো? আগবাড়িয়ে সবাইকে পন্ডিতগিরি দেখাতে কে বলেছে?”
শাইনা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে বলল,”সবাইকে সুযোগ করে দিয়ে এখন নাটক।”
তাজদারের কপাল কুঁচকে গেল। শাইনার দিকে তাকিয়ে রইলো সে। তৌসিফ বলল,
“সবাইকে জানিয়ে গেলে এতকিছু হতো না। এখানে বাবা, কাকা আর জেঠার সাথে আনিস ভাই আর আশরাফ ভাইয়ের ঝামেলা লেগে গেছে। শাইনা ওভাবে চলে গেল কেন ওটাই তাদের প্রশ্ন।”
“ঝামেলাটা শুরু করেছে কে?”
তৌসিফ একটু চুপ করে বলল,
“নুভা এমনি গিয়ে বলেছিল শাইনা কেন তোমাকে রেখে খেতে বসে গেছে। ওখান থেকে কথা কাটাকাটি লেগে গেছে।”
“এখন কি কথা হচ্ছে?”
“আশরাফ ভাই আর আনিস ভাই বলছে শাইনাকে এখন বাড়িতে দেবেনা।”
“কি করতে চাইছে?”
“নুভাকে মাফ চাইতে বলছে। খালামণি আর ফুপীরাও নাকি একসাথে জোট বেঁধে শাইনাকে কথা শুনিয়েছে। নানান কথা বলেছে। অপমান করেছে।”
তাজদার আর কিচ্ছু শুনলো না। ফোনটা কেটে পকেটে রেখে দিতে দিতে শাইনাকে বলল,
“ঘরে গিয়ে বাকি কথা।”
শাইনা হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বলল,”বললাম তো এভাবে যাব না। আমার কোনো ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই? সবাই যেরকম বলছে আমাকে সবসময় সেরকম করতে হবে কেন? পুতুল নাচা নাচাচ্ছে সবাই মিলে। কথা শোনাতেও কারো মুখে আটকাচ্ছেনা। মনে হচ্ছে আমি সেধে গলায় ঝুলেছি তাদের ছেলের। মাছ, মাংস কোনোদিন দেখিনি, হাভাতে ঘরের মেয়ে আর কি কি বাকি রেখেছে বলার? আমি এখন আর ছোট নেই যে যেভাবে ইচ্ছে আমাকে কথা শুনিয়ে যাবে। চামারের কথা বলবে আর আমি সহ্য করে গেলে ভালো। সহ্য না করলে বেয়াদব।”
সুযোগ পেয়ে একঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে ঘরে চলে গেল। সাবিনা এসে দেখলো তাজদার দাঁড়িয়ে আছে। শাইনা দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সে মৃদুস্বরে বলল,”ভাইয়া উনারা সবাই আসছে। আপনি বসুন।”
“বসবো না। ওকে বলুন বড় ঝামেলা হওয়ার আগে আমার সাথে যেতে। আমি বারবার এককথা বলবো না।”
সাবিনা দরজার কাছে গেল। শাইনা দরজায় খিল দেয়নি। তাই দরজা ধাক্কা দেওয়ামাত্রই সরে গেল। সাবিনা ঘরে উঁকি দিয়ে বলল,
“শাইনা ভাইয়া এখনো দাঁড়িয়ে আছে।”
“চলে যেতে বলো।”
“আমি না হয় মেঝ ভাইকে বুঝিয়ে বলবো। তুমি চলে যাও। বড়সড় ঝামেলা না হোক।”
“আমি কিছু করলেই ঝামেলা? ওরা যে আমাকে এতকথা শোনালো? আমি কারো খাই নাকি পরি? বিয়ে দিয়েছে। বেঁচে তো দেয়নি। তাদের ছেলে রাগ দেখিয়ে চলে এসেছে সেটা তাদের কাছে বড় কিছু। আর আমার রাগ গোসসা নেই? আমাকে যা তা শোনানো যায়? আমার ভাইরা প্রতিবাদ করলেই ঝামেলা? সব মেনে নিলে ভালো। তাদের দোষ ধরা যাবেনা।”
সাবিনা বলল,”যা হতে যাচ্ছে তা কি ভালো?”
“ভালো কোনটা হয়েছে? বিয়েটাই তো আমি করতে চাইনি। তাদের ছেলেও জানে সেটা। তারপরও ত্যাড়ার মতো করলো। আমাকে বুঝিয়ে দিল তিনি যা চান তাই হয়। এখনো ঝামেলা হবেনা কেন? হোক ঝামেলা। ওই বাড়িতে না যেতে পারলেই আমি বাঁচি।”
সাবিনা ফিসফিসিয়ে বলল,”উনি শুনতে পাচ্ছেন।”
শাইনা নিজেকে সামলে নিল। রেগে গেলে তার মুখ থামতে চায় না। সে দরজাটা বন্ধ করে দিল। লেহেঙ্গা পাল্টে নতুন একটা থ্রিপিস পরে নিল। কাঁধে লাগানো মিনি ব্যান্ডেজটা টেনে খুলে নিল। এত যত্নআত্তি তার কাছে নাটকীয় লাগে। যত সহ্য করছে ততই সবাই পেয়ে বসছে তাকে। দু আনা সম্মান দেয় না কেউ। আবার যত্ন!
অনেকগুলো গাড়ি এসে থেমেছে উঠোনে। কিছু মানুষ শাইনাদের বাড়িতে চলে এসেছে কিছু মানুষ কলতানে। সবার চোখমুখ থমথমে। শাহিদা বেগম বসার ঘরে বসে আছেন। বোরকাও খুলেননি। সাবিনা বুঝতে পারলো মা ওখানে তর্কবিতর্ক দেখে নরম হয়ে গেছেন। শারমিলা শাইনার ঘরের দরজা ধাক্কালো। শাইনা দরজা খুললো। সাজ ধুয়ে চুলের জট ছাড়াচ্ছে সে। মাঝখানে সোজা সিঁথি।
শারমিলা বলল,”তুই কেন চলে এলি সেটা শুনে তোর শ্বশুর খেপে গেছে। ভাইদের কথা শুনে চললে নাকি ওদের বাড়িতে আর যাওয়ার দরকার নেই।”
শাইনা বলল,”ভাবো একবার কাদের হাতে আমাকে তুলে দিয়েছ? নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য এখন সব দোষ আমার কাঁধে তুলে দিয়েছে। তাজদার সিদ্দিকী রাগ করে বাড়ি চলে এল এটা জেনেও তার আত্মীয় স্বজনরা তিলকে তাল করবে। আমাকে দোষারোপ করবে। ইচ্ছে করে এমন করেছে আমাকে হেনস্তা করার জন্য।”
শারমিলা হতাশ হয়ে বিছানার এককোণে বসলো। কোলের বাচ্চাটাকে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে বলল,”এদের সাথে কেউ কথায় পারেনা।”
শাইনা চুলটা বেঁধে বারান্দায় গেল। আনিস আর আশরাফ তখন ঘরে ঢুকেছে। শাইনাকে বলল,
“তুই ভেতরে যা।”
শাহিদা বেগম আনিসকে বললেন,”আমার ছেলেটা বাড়াবাড়ি না করলে এতকিছু হতো না।”
আনিস বলল,”ওরা কি বললো দেখলে না? ওইরকম বউ নাকি দিনে এনে দিনে দিনে দিয়ে ফেলার হেডম আছে তাদের। কাবিনের টাকা দিয়ে নাকি বউ দিয়ে দেবে বেশি বাড়াবাড়ি করলে। কতবড় কথা! মেয়ে কি কোনো ছেলের হাতে মোয়া নাকি? আমাদের মেয়ে কি ফেলনা? তুমি ওদের বলোনি কত ভালো ভালো সম্বন্ধ এসেছিল ওর জন্য? আমাদের কীসের ঠেকা পড়েছিল ওদের সাথে আত্মীয় করার? নিজেদের কি মনে করে ওরা? টাকাপয়সা এখন সবার হয়েছে মোটামুটি। এত টাকার গরম দেখাতে বারণ করে দেবে। দাস গোলামের মতো কথা বলতে বলতে স্বভাব হয়ে গেছে সবার।”
শাহিদা বেগম বললেন,”আমি আর কিছু বলবো না। তোদের যা মনে হয় তাই কর।”
শাইনা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো। বলল,”দিনে দিনে দিয়ে দিতে বলো কাবিনের টাকা দিয়ে। ওদের সাহস দেখি। মুখে ওরা অনেককিছু বলে।”
শাহিদা বেগম ধমকে বললেন,”তুই কথা বলছিস কেন এখানে? কত শিখিয়ে পড়িয়ে দিলাম তোকে। কিন্তু তুই সবাইকে নিয়ে খেতে বসে গেছিস। জামাইয়ের খোঁজ করলিনা। খোঁজ করলিনা ভালো কথা। ও যখন ক্লাব থেকে চলে আসছিল তখনও খেয়াল করলিনা।”
আনিস বলল,”তুমি ওকে বকছো কেন? আশ্চর্য! ওর কি দোষ সেখানে?”
“তুই চুপ থাক। ওদের বউ জামাইয়ের মধ্যে তুই ঢুকছিস কেন? ওরা নিজেরা ঠিক থাকলে এতকিছু হতো? বিয়ের একরাত যেতে না যেতেই বিয়ে ভাঙার কথা উঠছে। মশকরা লাগছে সবকিছু?”
“বিয়ে হওয়ার আগে আমি তো আকদ ভাঙার কথা বলেছি। যারা কথায় কথায় মেয়ে দিয়ে ফেলার ভয় দেখায় তারা কত ডেঞ্জারাস ভাবতে পারছো? ওদের মেয়েকে বেয়াদব বলায় গায়ে লেগেছে। আর আমাদেরটা মেয়ে না? ওকে সবাই এত কথা শোনানোর সাহস পায় কোথায়? নাকি মানুষের মতো লাগেনা? ওইটুকুনি একটা মেয়ে হয়ে বড় ভাইয়ের বউকে নাম ধরে ডাকছে। ডাকছে ভালো কথা আবার শাসাচ্ছে। তাকে আদেশ করছে। এসব বেয়াদবি করার সাহস পায় কোথায় ওরা?”
আফসার সাহেব এসে সোফায় বসে পড়লেন। মুখ মুছতে মুছতে বললেন,
“মেয়েটা ওখানে শান্তি পাবেনা। ওরা নিজেদের দোষ দেখেনা। ওই মেয়েটাকে একটা ধমক দিলে তো ব্যাপারটা মিটে যায়। না তাদের ছেলেমেয়ে দোষ করলে সেটা দোষ নয়। মেয়েটা কিভাবে সংসার করবে কে জানে। জামাইটাও মেজাজি।”
শাইনা পাশের ঘরে ডুকরে উঠলো।
“আমাকে জাহান্নামে ঠেলে দিয়ে সবার হুঁশ ফিরেছে।”
ঘরভর্তি মানুষজন চুপ।
কলতানে বৈঠক বসেছে বাড়ির মানুষ মিলে। তাজদার সিদ্দিকী বাড়ি নেই। আপাতত তাজউদ্দীন সিদ্দিকী আর তার দুই ভাই বোন আর অন্যান্য আত্মীয়রা উপস্থিত। সবাই কথা বলতে বলতে আবারও তর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাসনুভা এককোণায় দাঁড়িয়েছে। চোখমুখ আপাতত লাল হয়ে আছে।
রওশনআরা বলল,
“তাজদার ফেরার আগে তাসনুভা গিয়ে নিয়ে আসুক শাইনাকে।”
তাজউদ্দীন সিদ্দিকীর ছোট ভাই সম্মতি দিলেন।
“সেটাই হোক।”
বড় ফুপু রওশনআরার দিকে তাকিয়ে বললেন,”কোনোমতে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে আসো। তারপর গেঁজাবে। সবসময় ভাইদের কথা শুনে চললে সংসার হবেনা। বাপের বাড়ি কাছে আছে বলে সবসময় যেতে দেবেনা। একদম ছাড় দেবেনা কোনোকিছুতে। বেশি ছাড় দিলে মাথায় উঠে নাচে। আজকালকার মেয়েরা কত বদমাশ তা তো জানো না এখনো।”
তাজউদ্দীন বলল,”তাজদার আসার আগে নিয়ে আসো। মা তুমিও যাও। নুভা যাও। তৌসিফ ও কোথায় গেছে জেনে নাও।”
তৌসিফ বলল,”কল যাচ্ছে না।”
বলতে না বলতেই তিতলি দৌড়ে এসে বলল,”মেঝ ভাইয়া এসেছে।”
রওশনআরা তাসনুভার দিকে তাকালো। বলল,
“তুমি ঘরে চলে যাও।”
তাসনুভা গোমড়া মুখে বাবার দিকে তাকালো। তৌসিফ গর্জে বলল “যা না। আবার দেখছিস কি? লাথি দেব ধরে এখন।”
তাসনুভা চলে গেল। তাজদার এসে বলল,
“শিহাবের বউ এসেছে। সরে যাও। এত ভিড় কীসের?”
বন্ধু আর বন্ধুর মা, বউ ওয়ালিমায় আসতে পারেনি। তাই বউ দেখতে রাতেই চলে এসেছে। তাদের পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই।
তাজদার চুপচাপ সবার কান্ড দেখছে। শিহাবের মা জিজ্ঞেস করছে বউ কোথায়। তাজদার সবার উপর ছেড়ে দিয়েছে। রওশনআরা ফ্যাকাশে হেসে বললেন,
“একটু বাপের বাড়িতে গিয়েছে। কাছেই। আপনারা আসুন। বেয়াইন বাড়ি ঘুরিয়ে আনি।”
সবাই নাশতা খেয়েছে। শাইনাদের বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে মেহমান যাচ্ছে।
দাদীমা আর রওশনআরা তাসনুভাকে নিয়ে গিয়েছে। শাইনার সাথে তাসনুভাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। আনোয়ারা বেগম বলেছেন, “ননদ ভাবির মধ্যে অনেককিছু হয়। এসব মনে রেখে দিতে নেই। নুভাকে সবাই অনেক বকাঝকা করেছে। শাড়িটা পরে নাও। শিহাবের মা, বউ তোমাকে দেখতে এসেছে।”
শাইনা চুপ করে রইলো। তাসনুভা হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল দাদীমা কথা শেষ করতেই। চোখ টলমল করছিল। নাকমুখ কাল। রাগে ক্ষোভে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আনিসের সামনে পড়লো। আনিস তাকে দেখেও না দেখার ভান করে সরে দাঁড়ালো। তাসনুভা হনহনিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। এইসব ছোটলোকদের সরি বলতে বসে আছে সে। বাড়ির সামনে আসামাত্রই তাজদার তাকে দেখলো। শিহাবের সাথে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিল সে। তাসনুভা ভাইকে দেখামাত্র একটু থমকাল। তারপর বাড়ির ভেতরে চলে গেল ধীরপায়ে হেঁটে।
শাহিদা বেগম তাড়াহুড়ো করছেন মেহমানদারি করতে গিয়ে। শাইনা রেডি হচ্ছে কিনা দেখে যাচ্ছে ঘরের সামনে এসে। শাইনা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধীরেধীরে শাড়ি পরছে উদাসীনভাবে।
রওশনআরা শাইনার খালা, ফুপু, মামীদের সাথে কথা বলছে। দাদীমা এসে শাইনাকে বলল,
“তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে নে। তোর শ্বাশুড়ি পরিয়ে দিতে এলে লজ্জায় পড়ে যাবি।”
“লজ্জায় পড়বো কেন আশ্চর্য!”
“জামাই সোহাগ করছে সেগুলো দেখা যাচ্ছে কাঁধে।”
শাইনা তাড়াতাড়ি কাঁধ ঢেকে নিল। কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”ফালতু কথা বলার জায়গা পাওনা। ওখানে পিন ঢুকে গিয়েছিল।”
“জামাই তো আদর করে ব্যান্ডেজ লাগাইয়া দিছিল। খুললি কেন?”
“আদর না, জুতা মেরে গরু দান।”
শাইনা শাড়ি পরে, সিম্পল গয়না, চুড়ি করে মেহমানদের সামনে গেল। নতুন বউয়ের মুখ দেখে শিহাবের মা তিন হাজার টাকা দিয়েছে তার হাতের মুঠোর ভেতর। রওশনআরা শাইনাকে আর রাখেনি। তাদের সাথে সাথে নিয়ে এসেছে। কলতানের সামনে এসে শিহাব আর তাজদারের সামনে থামলো সবাই। শিহাব তার মাকে জিজ্ঞেস করছে, “বউ দেখেছ এবার?”
“হ্যাঁ দেখেছি। তাজদার তোমার বউয়ের সাথে কথাবার্তা বলেছি। মেয়ে ভালো লেগেছে আমার।”
শাইনাদের উঠোন থেকে কে যেন রওশনআরাকে বলল,”বউ শ্বাশুড়ি একসাথে নাইওর গেলে নাকি?”
রওশনআরা বললেন,”হ্যাঁ বউয়ের সাথে আমিও নাইওর গিয়েছি।”
শিহাবের সাথে তার মা, তাজদার কথাবার্তা বলছে।
রওশনআরাও এলেন। তার পেছন থেকে শাইনাও বেরিয়ে এল। তাজদার তার দিকে একঝলক তাকালো। শাইনা শিহাবকে সালাম দিল।
“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমরা রাতে চলে এসেছি নতুন বউকে জ্বালানোর জন্য।”
“ভালো হয়েছে এসেছেন।”
সবাই কথা বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে চলে যাচ্ছিল। শাইনা রওশনআরার পিছু পিছু হাঁটছে। হঠাৎ থেমে গেল। তাজদার সিদ্দিকী বলল,
“কে যেন আসবেনা বলেছিল।”
শাইনা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। শক্ত কণ্ঠে বলল,
“যেতে কতক্ষণ?”
“গিয়ে দেখুক।”
“আমাকে আটকে রাখার সাধ্য কার?”
“সেটা বুঝিয়ে দেয়া হবে। একা পাই।”
রাতে মেহমানদের সাথে একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া করেছে শাইনা। বাড়িতে তখনো মেহমানে ভর্তি। তাজদার বন্ধুকে যেতে দেয়নি। রওশনআরাও জোরাজোরি করে রেখে দিলেন। রাতে এসে রাতে চলে যাবে বিষয়টা কেমন দেখায়?
খাওয়াদাওয়া শেষে মেহমানরা যখন ঘুমোতে চলে গেল তখন তাসনুভার ঘরে খুব কথাবার্তা হচ্ছিল। তাসনুভা নাকি কাঁদতে কাঁদতে না খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা বাইরের মেয়ের জন্য তার ভাইয়ের কাছে সে ছোট হয়ে গেছে। ওই বাড়ির মানুষদের কাছে তাকে ছোট হতে হয়েছে। অপমান মেনে নিতে পারছেনা সে।
তাজউদ্দীন সিদ্দিকী রওশনআরার উপর খেপেছেন। তিনি ছেলেমেয়েদের কখনো বকাঝকা করতে পছন্দ করেন না। মেয়েদের তো একদমই না। তাসনুভার কান্নাকাটি দেখে তিনি রওশনআরাকে বললেন শাইনাকে যেন বলে দেয় এই বাড়িতে থাকতে হলে সবার মন যুগিয়ে চলতে হবে। ননদদের সাথে যেন ভালো ব্যবহার করে। হাসিখুশি থাকে। এত গাদ্দারি করলে, ভাইদের কথা শুনে চললে আবারও ঝামেলা হবে। তখন ঘটনা অন্যদিকে ঘুরে যাবে।
ফুপুরা বলাবলি করলেন ওই বাড়ির মেয়েকে অত পাম্পপট্টি, তেলমালিশ করে বাড়িতে আনতে হবে কেন? ওরা আগে ভালো করে খেতেও পায়নি। এই বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দিয়ে পা একদম আকাশে উঠে গেছে, মাটিতেই পড়ছেনা। আরও কত কি দেখবো আল্লাহ মালুম। কাল থেকে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে কাজ ধরিয়ে দেবে। কত মেয়ে ছিল আমার ভাইপোর জন্য। আর মেয়ে পায়নি আমার ভাইয়ের বউ।
রওশনআরা বললেন,”বিয়েটাতে সব ওর পছন্দমতো হয়েছে। গরু, ডেকোরেশন, খাওয়াদাওয়া, অনুষ্ঠান এমনকিও বউটাও। আমার কি করার আছে?”
শাইনার ঘরে দাদীমা আনোয়ারা বেগম বসেছিলেন। শাইনাকে দিয়ে গয়নাগাটি গুলো তুলে রাখছিলেন। তাজদার ধীরপায়ে হেঁটে ঘরে ঢুকলো ফোনে চোখ স্থির রেখে।
দাদীমা তাকে দেখে বললেন,”তোমার বউকে কুবুদ্ধি শিখিয়ে দিচ্ছি।”
তাজদার চোখ তুলে দাদীমার দিকে তাকালো। তারপর শাইনার দিকে। শাইনা গয়নার বাক্সগুলো গোছগাছ করছিল। তাজদার ভুরু কুঁচকে বলল,
“কুবুদ্ধির অভাব আছে নাকি যে আবার দিচ্ছ?”
শাইনা চট করে তাকালো তার দিকে। আনোয়ারা বেগম হাসলেন। তারপর দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন,”আমি আসি। বর বধূ গল্পসল্প করো।”
বলেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। তাজদার সিদ্দিকী দাদীমার জায়গায় গিয়ে বসলো। পিঠটা পেছনে হেলে দিয়ে দুহাতের ভর রেখে।
শাইনা বাক্সগুলো একটার উপর আরেকটা রাখছে। তাজদারের দিকে তাকালো না। কিন্তু তাজদার তাকিয়ে রইলো।
শাইনা বাক্সগুলো রেখে দিতেই তাজদার ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। হালকা আলো আছে অবশ্য। টেবিলল্যাম্পটা জ্বলছে। শাইনার পরনের গোলাপি শাড়িটার রঙ বোঝা যাচ্ছে। বাক্সগুলো রেখে এসে সে জগ থেকে পানি ঢাললো গ্লাসে। গলা ভিজিয়ে নিল। তাজদার জানতে চাইল,
“আমরা কখন কথা বলবো?”
শাইনা বিলম্ব না করে বলল,”কথা বলিনি কখন?”
তাজমহল পর্ব ১৫
“একজন দক্ষিণে, একজন উত্তরে। এটা বিয়ে নাকি রংতামাশা?”
“দুটোই।”
“তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?”
“আপনাকে আমি ভয় পাইনি কোনদিন? আজও পাচ্ছি। বরং একটু বেশি পাচ্ছি দরজা বন্ধ বলে।”
তাজদার চুপ। শাইনা পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিল। তাজদার তাকে টেনে এনে কোলে বসালো।