তাজমহল পর্ব ৩১
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
তাজদার একটা একটা করে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে এল। শাইনা তিতলি আর তৌসিফের সাথে লুডু খেলায় মগ্ন। আরও দশ বারো মিনিট লাগবে খেলা শেষ হতে। এমুহূর্তে টানটান উত্তেজনা! খেলা ছেড়ে উঠা যাবে না।
তৌসিফ বলল,”সাহেব এসেছেন। তোমার চলে যাওয়া উচিত।”
শাইনা বলল,”তাহলে মেনে নিন আমিই জিতলাম।”
তিতলি বলল,”তা হবেনা। আমিই জিতব।”
শাইনা বলল,”তাহলে উঠবো না। আমিই জিতব। জিতেই উঠবো।”
এমুহূর্তে অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়া কঠিন। বলা যায় যে যেভাবে পারছে নিজেদের ব্যস্ত দেখাচ্ছে। তাজদার সিদ্দিকী বাড়িতে ফিরেছে এটা নিয়ে আপাতত কোনো কথাবার্তা নেই। যা হওয়ার তা বাড়িতে তার পা রাখার আগেই হয়ে গেছে।
খেলায় শেষমেশ শাইনাই জিতলো। কিছুক্ষণ পর তৌসিফও জিতে গেল। শেষমেশ তিতলি হেরে গেল। সে তৌসিফের শার্ট চেপে ধরে বলল,
“আরেকবার খেলব। আমি জিতলে তারপর খেলা শেষ হবে।”
তৌসিফ বলল,”আবারও মারা খাবি। সাবধান।”
“না আমি শোধ করবো।”
“বেশ বেশ। শাইনা তুমি যাও। সিদ্দিক সাহেব নইলে কেলেংকারী শুরু করে দেবে।”
শাইনা রান্নাঘরে চলে গেল। গরুর দুধ যা ছিল সবগুলো দিয়ে চা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। শাইনা ঝিমলিকে জিজ্ঞেস করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ভাবি ফ্রিজ থেকে দুধের বোতল বের করবো?”
“চা তো বানানো শেষ।”
শাইনা বলল,”কফির জন্য।”
ঝিমলি বলল,”ওহহ, হ্যাঁ। মেঝ ভাই এসেছে শুনলাম। আম্মাকে জিজ্ঞেস করবো?”
জোহরা বেগম এসে দুধের বোতল বের করে দিল। বরফ হয়ে আছে। শাইনা বলল,
“এগুলো তো তরল হতে অনেক সময় লাগবে।”
জোহরা বেগম বলল,”আগে জানলে তো বের করে রাখতাম। চা খাবে কিনা জিজ্ঞেস করো।”
শাইনা বলল “আচ্ছা নিয়ে যাই।”
সে কাপে চা ঢেলে নিল। লেয়ার পরোটা ভাজা হয়েছে। তাজদার সিদ্দিকী তেলের নাশতা খাবে না এখন। সে প্লেটের উপর কাপটা রেখে বিস্কিটের বৈয়াম খুললো। দুই তিন রকমের বিস্কিট আছে সেখানে। সে এক র্যাপার বিস্কিট তুলে নিল প্লেটে। জোহরা বেগম বলল,
“তাজ লেক্সাসটা খায় মাঝেমধ্যে। ওখান থেকে দু প্যাকেট নাও।”
শাইনা উনার কথামতো লেক্সাস বিস্কিটের প্যাকেট থেকে ছোট ছোট দুটো প্যাকেট প্লেটে তুলে নিয়ে ছোট ট্রে তে তুলে নিল সব। তারপর মাথায় ঘোমটা তুলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। পথে তিতলির সাথে দেখা। সে র্যাপার থেকে বিস্কিট তুলে মুখে পুরে দিল। শাইনা হাসলো। তিতলি তার সাথে হেসে নেচে-কুঁদে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
পথিমধ্যে আবার তৌসিফের সাথে দেখা। তৌসিফ হেসে বলল,
“অল দ্য বেস্ট।”
শাইনা বলল,”আপনি রেডি থাকেন। হুকুম আসতেছে।”
“আর মনে করিয়ে দিওনা।”
শাইনা হেসে ফেললো।
তারপর নিজের ঘরে ঢুকলো ধীর পায়ে হেঁটে। টেবিলের উপর আস্তে করে ট্রে’টা রাখলো। তাজদার সিদ্দিকী এখনো ওয়েস্ট কোটটা খোলেনি। শাইনার উপস্থিতি টের পেয়ে কোণা চোখে তাকালো। শাইনা টেবিলের সাথে কোমর ঠেকিয়ে দাঁড়ালো।
তাজদারের দিকে তাকাতে তাকাতে বিস্কিটের গায়ে কামড় দিল। তাজদার ওয়েস্ট কোটটা খুলছিল ঠিক তখুনি শাইনা গলা ঝাড়লো।
তাজদার তার দিকে সরাসরি তাকালো। শাইনার ইশারা বুঝেও না বোঝার ভান ধরে ওয়েস্টটা কোটটা রেখে দিয়ে হাতের ঘড়িটা খুলতে লাগলো।
শাইনা কাপটা নিয়ে ততক্ষণে তার সামনে হাজির। কাপটা বাড়িয়ে দিতেই তাজদার তার দিকে তাকালো। গলা ঝেড়ে বলল,
“আমি ফ্রেশ হওয়ার আগে চা খাব?”
শাইনা পাল্টা প্রশ্ন করল,”ফ্রেশ হয়ে এসে ঠান্ডা চা খাবেন?”
তাজদার কাপটা হাতে নিল। শাইনা বলল,
“আবার ঢেলে দেবেন না যেন। শ্বশুরবাড়ির কাপ ভাঙতে আমার মায়া হয়।”
তাজদার তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। শাইনা মনে করিয়ে দিল,
“চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
তাজদার চোখ সরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক বসালো। শাইনা আবারও আগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। প্রশ্ন করলো,
“তো কোথায় ছিলেন এতদিন?”
তাজদার গম্ভীরমুখে উত্তর দিল,
“আমার থাকার জায়গার অভাব নেই।”
“জায়গাটা কোথায়?”
“ঢাকায়।”
“ভালোই।”
তাজদার যান্ত্রিক স্বরে, ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে জিগ্যেস করল,
“ইউ মিসড মি শাইনা মমতাজ?”
শাইনার ঠোঁটের কোণায় একটুখানি হাসির রেখা দেখা দিল। সে মিথ্যে বলল,
“ইয়েস। আফটার অল বিয়ে করা বর। মাথার চুল আর গালের দাঁড়িটাড়ি দেখছি বেড়েছে বেশ। ব্যাপারটা দেখার মতো। ইন্টারেস্টিং!”
তাজদার গালে হাত দিয়ে দাঁড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল,”ভাবছি রবীন্দ্রনাথ সাজব।”
শাইনা বলল,”ইয়োর লাইফ, ইয়োর চয়েস।”
তাজদার সাথে সাথে বলল,”এগজ্যাক্টলী! অবশ্য আমার চয়েস দারুণ।”
শাইনা তার চোখের দিকে তাকালো। তাজদার বলল,”সামনেই তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ দাঁড়িয়ে আছে।”
শাইনা মিষ্টি হেসে বলল,”থ্যাংকস!”
“হাসি নয় যেন ধারালো খঞ্জর।”
শাইনা জানতে চাইল,”খঞ্জর?”
“ইয়েস, নো ডাউট।”
“আপনার কি কেটে নিয়েছে?”
“মাথা, মগজ। সামনে আরও কিছু কেটে নেয়ার ধান্ধা চলছে।”
শাইনা আরও হেসে বলল,
“আগে বলবেন না অস্ত্র আমার কাছেই আছে?”
তাজদার সিদ্দিকী গম্ভীরমুখে বলল,
“জানতাম তুমি এটা জানার পর এর সদ্ব্যবহার করবে না।”
শাইনা চায়ের কাপটা তার হাত থেকে নিয়ে ফেললো। বলল,
“বাইরে থেকে যে পারফিউম গায়ে মেখে এসেছেন সেটা ধুয়ে ফেলা হোক। সামনে দাঁড়ানো যাচ্ছে না।”
তাজদার বুঝে ফেললো তার ঘামের গন্ধকে বোঝাচ্ছে শাইনা মমতাজ। তার ঘাম নিয়ে যত আপত্তি। এদিকে অন্যান্য মেয়েরা বরের গায়ের ঘ্রাণকে পারেনা পারফিউম হিসেবে ইউজ করতে।
সে গমগম করে বলল,”আমার ঘাম নিয়ে এই ধরণের কথাবার্তা আমি শুনতে চাই না শাইনা মমতাজ। রেস্ট্রিকশন দেওয়া রইলো।”
শাইনা রসিকতা করে বলল,”আপনার ঘামও দেখছি অপমানিত বোধ করে! সরি সরি। আপনি একটা কাজ করুন। নিজের শার্টটা খুলে নিজে একবার শুঁকে দেখুন।”
তাজদার সিদ্দিকী ভীষণ অপমানিত বোধ করলো। অপমানিত বোধ করলে তার চেহারার রঙ এভাবে পাল্টে যায়। শাইনা মনে মনে হাসলো। বলল,
“আপনি জানেন মেয়েদের সবচেয়ে প্রিয় ঘ্রাণ কোনটি?”
তাজদার তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো। যেন শাইনা মমতাজ তাকে এখন একটা পারফিউমের নাম বলবে। সে বলল,
“আই ডোন্ট থিংক তোমার পছন্দের কোনো পারফিউমও আমার গায়ে মাখলে তুমি তা এপ্রিশিয়েট করবে।”
শাইনা বলল,”আমার মুড নষ্ট। আনসারটা করতে পারলাম না সরি।”
তাজদার সোজাসাপটা বলল,”আমি আজকে গোসল করব না। ডিসিশন ফাইনাল।”
শাইনা ট্রে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“বিছানা থেকে ঠেলে ফেলে দেব প্রমিজ।”
তাজদার বোতাম খুলতে খুলতে আয়নার দিকে তাকালো।
তাজদার আসায় রাতের জন্য আলাদা করে সবজি রান্না করতে হয়েছে তেল মরিচ কম দিয়ে। সে একটু কাঁচা থাকে এমন সবজি খেতে পছন্দ করে। শাইনাও এমন। বর বউয়ের পছন্দের মিল আছে এদিক থেকে। তাই সবজি রান্নার কাজটা শাইনাকেই করতে হলো।
তাজদার ঝোল দিয়ে রান্না করা মাছ খেতে পছন্দ করেনা। তাই তার জন্য কয়েক টুকরা ভাজতে হলো। রওশনআরা জানতে চাইলেন,
“এতদিন কোথায় ছিল বলেছে?”
“ঢাকায়।”
“সন্দেহ ঠিক ছিল। কিছু বলেছে তোমাকে?”
“না।”
শাইনা ছোট ছোট ওলকচু, পটল, কাঁকরোল আর আলুর মধ্যে কয়েকটা ছুরি শুঁটকি দিয়েছে। এক কেজি বারোশো টাকা নিয়েছে শুঁটকিগুলো। তরকারিতে কয়েক টুকরো দিলে ভীষণ স্বাদ আসে। এখানে শুঁটকি ছাড়া তরকারি কেউ খায় না বললেই চলে।
শাইনা তারকারিটা রেঁধেছে, আর আমড়া দিয়ে চিংড়ি মাছ রেঁধেছে, সাথে কয়েকটা টুকরো রুই মাছ ভুনা করেছে।
তাসনুভা ঘর থেকে বেরই হচ্ছে না ইদানীং। রওশনআরা তাকে বলেছে সব তোমার জন্য হয়েছে। বিয়ের কথা ঠিকঠাক হলে মেয়েদের একটু সাবধান থাকতে হয়।
তাসনুভা ভীষণ বিরক্ত। ওই বাড়িতে বউ হয়ে যাওয়াটা তার জীবনের মাইলফলক নয় অফকোর্স। বরং একটা কমিটমেন্টে জড়ানোর আগে তাদের সরূপ দেখে ফেলাটা তার জন্য একপ্রকার ব্লেসিং। সে এবার সেন্টমার্টিন গিয়ে এনজয় করবে বন্ধু বান্ধব নিয়ে। কে তাকে আটকায় সে দেখবে।
তিতলি আর শাইনা মিলে টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর সেখানে তৌসিফ এল। ঢাকনা উল্টে চিংড়ি দেখার পর তিতলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“সঙ্গী হলে চিংড়ির ভাগ পাইবেন।”
তিতলি হেসে বলল,”দুইটা তুলে নাও।”
তৌসিফ চামচে করে চিংড়ি মাছ তুলে একটা তিতলির দিকে বাড়িয়ে দিল। আরেকটা নিজের মুখে। তিতলি আরেকটা নিয়ে জোরাজোরি করে শাইনার মুখে ঢুকিয়ে দিল। খেতে খেতে বলল,
“চোরদের সঙ্গ দেবে কিন্তু নিজে সাধু সাজবে তা হয় নাকি?”
শাইনা চিংড়িটা মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হতবাক হয়ে। ঠিক তখুনি তাজদার চলে এল। তৌসিফকে বলল,
“বাড়ির বাকি সদস্যরা কোথায়?”
তৌসিফ শাইনার দিকে তাকালো। চিংড়ি মাছটা এখনো খাওয়া হয়নি। শাইনা তো একটুও চিবোয়নি এখনো। সে তিতলির দিকে চেয়ে রইলো। তিতলি চিংড়িটা গালের একপাশে রেখে কিছু বলার চেষ্টা করবে ঠিক তখুনি জোহরা বেগম হাজির। তিতলিকে গাল নাড়তে দেখে বলল,
“এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছাগলের মতো কি চিবোচ্ছ? যাও সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো।”
তিতলি মাথা দুলিয়ে দ্রুত গা ঢাকা দিল। তৌসিফ আর শাইনা ফেঁসে গেল। দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। শাইনার তো লজ্জায় মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। অসভ্য দুটো। তাকে ইচ্ছে করে ফাঁসিয়ে দিল।
তাজদার চেয়ারে বসতে বসতে দুজনের দিকে তাকালো। শাইনা তার পাশে এসে বাসনে ভাত বেড়ে দিতে লাগলো।
তৌসিফও চেয়ার টেনে বসেছে। শাইনা তাকেও ভাত বেড়ে দিতে লাগলো। তৌসিফ তার দিকে তাকিয়ে কোনোমতে হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করছে। তাজদার কপাল কুঁচকে বলল,
“এই তুই হাসছিস কেন?”
তৌসিফ সোজা হয়ে বসলো। বলল,
“কই?”
শাইনা চিংড়িটা খাওয়া শেষ করে বলল,”এখান থেকে দিচ্ছি।”
“দাও।”
তাজদার তৌসিফের দিকে তাকিয়ে বলল,”এই তোর বাপ জেঠা কোথায়?”
“আসছে।”
“নাকি আমার সামনে বসে খেতে চাইছেনা?”
“পরে খাবে বোধহয়।”
“পরে তো খাবেই। আমাকে ফেস করার সাহস ওদের আছে? ওদের পলিটিক্স আমি ধরে ফেলেছি তাই ওরা আমার সামনে সহজেই আসবেনা।”
রায়হান এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
“কখন এলি?”
“দেরী হয়েছে।”
“জার্নি করে এসেছিস। খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমা।”
“আমি ঘুমালে সব সলভ হয়ে যাবে?”
“তুই সলভ করার চেষ্টা করেছিস কখন?”
তাজদার খাওয়া থামিয়ে বলল,
“সলভ করার পথটা বন্ধ করেছে কে?”
ঝিমলি এসে বলল,”থাক না। আপনারা ভাইয়ে ভাইয়ে এইসব তর্ক করে কি সমাধান করবেন?”
তাজদার খেয়েদেয়ে ঘরে চলে গেল সোজা। দাদীমা এসে বিছানায় বসলো। বলল,
“বউ বিছানা টিছানা ঠিকঠাক করে রেখেছে। মেজাজ ঠান্ডা করে ঘুমাও। এইসব নিয়ে আর কোনো কথাবার্তা তুলো না। পরের মেয়েরা কি ভাববে? ভাববে ওরা নিজেরা ঠিক নেই আবার আমাদের দোষ ধরে। পরের মেয়ের সামনে মাকে নিয়ে কটুক্তি করা ভালো কাজ নয় দাদুভাই। মা তো কষ্ট পাবে।”
তাজদার ল্যাপটপটা বন্ধ করে দাদীমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“চার সন্তানকে চার চোখে দেখলে এরকম কষ্ট পেতে হবে। ওই মহিলা আর তার স্বামীর সমস্ত পলিটিক্সের শিকার আমি। আমি এতদিন কোথায় ছিলাম তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল?”
“তুমি তো তার সাথে কথা বলো না। ফোন ধরো না তাজ।”
“কথা বলা কে আগে বন্ধ করেছে? মহিলা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ তো করবেই তার আগে আমাকে মুখ দেখানো বন্ধ করে দেবে। বয়স তো কম হচ্ছে না। তিনি এখনো এইসব বাচ্চামো আচরণ কেন ছাড়ছেন না? মা বলে আমি অনেককিছুতে তাকে ছাড় দিই। দোষত্রুটি বলিনা। কিন্তু আসল কালপ্রিট উনি আর উনার স্বামী। আমি কোনো ভুল করলে তাদের মেইন কাজ হবে সেই ভুলটাকে আরও প্রকট করে তোলা। এই ফ্যামিলি পলিটিক্স কি আজকের?”
শেষে তাজদারের গলার আওয়াজ বড় হয়ে এল। দাদীমাও ভড়কে গেছেন। এসেছেন শান্ত ভাবে কথা বলার জন্য। এখন মনে হচ্ছে না আসাটাই উচিত ছিল।
তৌসিফের ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছে সবাই জটলা পাকিয়ে। ওখানে দাঁড়িয়ে তাজদারের কথাগুলো শোনা যাচ্ছে যেহেতু সে বড় বড় করে বলছে। রওশনআরা নিজের বুকে কিল মারছেন। তিতলি, ঝিমলি আটকাতে চাইছে কিন্তু তিনি থামছেন না। শাইনা ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এইসব কি হচ্ছে এই বাড়িতে? সে এখানে বউ হয়ে না এলে তো এসব কথা জানতেই পারতো না। জোহরা বেগম রুক্ষ স্বরে তাকে বলল,
“এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ওকে থামতে বলো। মাকে চলে আসতে বলো ঔষধ খাওয়ার জন্য। ছেলেটা ওর মাকে মেরেই ছাড়বে।”
শাইনার পা কাঁপছে। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে ভেতরে ঢুকে এসে বলল,
“দাদু আপনাকে ডাকছে ছোট মা।”
“হ্যাঁ যাচ্ছি। ঔষধটা খাওয়া হয়নি।”
উনি বেরিয়ে যেতেই শাইনা দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাজদারের দিকে তাকালো। তাজদার সিদ্দিকীর নিঃশ্বাস রাগে ফেঁপে উঠেছে। শাইনা বলল,
“ছাদে যাবেন?”
তাজদার কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকালো।
শাইনা বলল,”ওখানে ইচ্ছেমতো চিল্লাতে পারবেন।”
তাজদার বলল,
“তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই। তুমিও আমার বিরোধী দলের সদস্য। তুমি তোমার শ্বশুর
শ্বাশুড়ির দোষ দেখবেনা। দেখবে আমার। সব দোষ আমার। কারণ আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। আর আমি বুঝে গেছি মহিলা আর তার স্বামী আমার উপরে এর শোধ তুলেই ছাড়বে। কারণ আমি তাদের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করিনি। ইটস আ ডার্টি ফ্যামিলি পলিটিক্স শাইনা মমতাজ। তুমি এসব বুঝবে না। ওরা তোমাকেও আমার বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে পেরেছে।”
“বড় আম্মু কষ্ট পাচ্ছে। আপনি ভেবেচিন্তে কথা বলেন। আশ্চর্য!”
“বুকে কিল মারছে তাই তো? এটা তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। সে রুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে, বুকে কিল মারবে, সিজদায় পড়ে যাবে, আমার মুখও দেখবে না, মুখ দিয়ে আমার নাম নেবে না। শী ইজ আ মোস্ট ডেঞ্জারাস লেইডি ইন দিস ফ্যামিলি। তিনি আমার সাথে এমন বিহেভ করেন যেন আমি তার পেট থেকে জন্মগত শত্রু হয়ে বের হয়েছি।”
শাইনা বিছানায় উঠে বসলো। না এই লোকটার কথা শোনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তার চিল্লাচিল্লি কথা কাটাকাটি করার এনার্জি নেই। বলতে থাকুক।
সে কোলে বালিশ টেনে নিয়ে গালে হাত চেপে তাজদারের সব কথা শুনে যেতে লাগলো।
তাজদার কিছুক্ষণ পর তার বসার ধরণ পরখ করে কপাল কুঁচকে তাকালো। কথা থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এভাবে বসে কি শুনছো?”
“আমি যা বলছেন।
তাজদার মুখ ফিরিয়ে নিল। শাইনা বলল,
“যা বুঝলাম, আপনার আসল শত্রু আপনার এই মুখ। শুধু মুখের কথা দিয়ে আপনি হাজারটা শত্রু বানিয়েছেন।”
তাজদার বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল,
“তারমধ্যে তুমিও একটা। ভবিষ্যতে তুমিও এইসব করবে। তুমি তোমার শ্বাশুড়ি থেকে আরও বেশি বাড়বে।”
শাইনা এখনো গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। তাজদার চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর হাত সরিয়ে দেখলো শাইনা একই ভঙ্গিতে বসে আছে। সে কপালটা আগের চাইতে দশগুণ কুঁচকে ফেলে বলল,
“তুমি এভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছো?”
শাইনা বলল,”দেখছি আর কি।”
“কি দেখছো? কোনো ভণিতা করবেনা বেয়াদব।”
শাইনা হেসে উঠে বলল,
“মানে আপনি যে পরিমাণে ইয়ে আপনি কোনোদিন মেয়েদের প্রেম নিবেদন টিবেদন করেননি?”
“ইয়ে আবার কি?”
“মানে অসহ্যকর, বিরক্তিকর।”
“ওইসব নিবেদন টিবেদন বখাটেদের কাজ।
শাইনা হেসে বলল,”ভুল বলেছেন। আপনি অমন ছেলে নন যাকে দেখলে মেয়েরা প্রেমে পড়বে। মেয়েরা প্রেমে পড়ে কেয়ারিং, সাপোর্টিং পুরুষ মানুষের উপর।”
“আমি ওইসব প্রেমিক ম্যাটেরিয়াল না। আমি হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল।”
শাইন ফিক করে হেসে উঠলো। হাসতেই থাকলো। তাজদার বলল,
“পাগল নাকি? থামো।”
শাইনা হাসি থামানোর চেষ্টা করে বলল,
“আপনি না সত্যি!”
“কি সত্যি?”
শাইনা হাসতে হাসতে বলল,
“হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল পুরুষ মানুষ বউপাগলা হয়।”
“আমাকে এখন পাগল হতে বলছো?”
শাইনা গালে হাত চেপে হেসে বলল,
“তার আগে প্রেমে তো পড়তে হবে। বইয়ের ভাষায় ভালোবাসা বলেও একটা কথা আছে। এইসব বাসাটাসাও আসতে হবে।”
“তোমার কি মনে হয়? যার এত এত ডিগ্রি আছে সে এই সামান্য কাজটুকু পারবে না?”
শাইনা বলল,”আপনার কাছে প্রেম, ভালোবাসা এইসবের মানে কি? এইসব কি বাজারের পণ্য যে চাইলেই নিজের মধ্যে ধারণ করা যায়?”
“তাহলে?”
শাইনা বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। বলল,
“এইসব প্রেমট্রেম খুব বড় একটা ফাঁদ। যে পড়েছে সে আর উঠতে পারেনি। আমি জানি আপনি জেনেশুনে এইসব ভুল কাজ করতে যাবেন না। কারণ বুদ্ধিমানেরা প্রেমে পড়েনা।”
তাজদার সিদ্দিকী বলল,
“ওহজাস্ট শাটআপ শাইনা মমতাজ! তাজদার সিদ্দিকী পারেনা এমন কোনো কাজ নেই।”
শাইনা বলল,”আচ্ছা?”
“তাহলে মাটিতে ঘুমিয়ে দেখান তো।”
“এইসব না বলে সিরিয়াস কিছু বলো।”
শাইনা কিছুক্ষণের জন্য ভাবুক হয়ে গেল। তেমন কোনো কিছু খুঁজে পেল না। শেষমেশ প্রশ্ন করলো,”আমার প্রিয় সিনেমার নাম কি বলুন তো।”
“পারলে কি দেবে?”
“চাওয়ার মতো কিছু চাইলে।”
তাজদার সিদ্দিকী বেশ ভাব নিয়ে গদগদকণ্ঠে বলল,”আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা।”
শাইনা বলল,”প্রিয় সংগীত শিল্পী?”
“হাবীব ওয়াহিদ।”
শাইনা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। তার ফেসবুক আইডি থেকে জানতে পেরেছে। এই লোক কি চালাক রে বাবা।
তাজদার বলল,
“ওয়েল, এবার আমি চাওয়ার কথা বলি।”
শাইনা জানে কি চাইবে। সে বলল,”জানি।”
তাজদার সিদ্দিকী তার উপর উঠে এসে বলল,
তাজমহল পর্ব ৩০
“ওই সিনেমাটা আমি দেখলাম। জঘন্য একটা সিনেমা। সেখানে জঘন্য একটা সিন আছে। হাওয়ায় নামের একটা গানে ছাদ থেকে টুপ করে একটা দোলনা পড়ে। আর মেয়েটা দোলনার নিচে পড়ে সাপের মতো মোচড়ামুচড়ি করে। নায়কটা তার উপর দুলে দুলে গান গায়। আমি সেটা তোমার উপর এক্সপেরিমেন্ট করবো এটাই আমার চাওয়া।!
শাইনা বলল,” অ্যাহ! আপনার নিচে পড়ে এমনিতেই চ্যাপ্টা হয়ে আছি। দোলনা থেকে পড়লে সোজা মরে যাব। কোনো এক্সপেরিমেন্টের দরকার নেই।”
তাজদার বলল,”আমি যেটা বলি সেটা করি। বি রেডি।”
বলেই শাইনাকে সাপের মতো প্যাঁচিয়ে জড়িয়ে ধরলো।