তাজমহল পর্ব ৬
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
শাইনার বিয়ের জন্য জমিয়ে রাখা টাকাপয়সা আজ হাতে পেয়েছেন আফসার সাহেব। তিন ছেলেকে নিয়ে ঘরে বসে আলাপ আলোচনা করছিলেন তিনি। সেখানে শারমিলা আর শাবরিনও এল কিছুক্ষণ পর। শাইনা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। বাবা আর ভাইবোনের কথাবার্তা শুনতে পেল।
বাড়ি আর স্টেজ ডেকোরেশনের দায়ভার তাজদার সিদ্দিকীর উপর পড়েছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকজন আসবে। তারা তাদের মতো সুন্দর করে সাজাবে।
কলতান নিবাসের সামনে চেঁচামেচি হচ্ছে। শাইনাদের বাড়িটা দোতলা। বাবার অনেক স্বপ্নের বাড়ি বলে বাড়ির নাম দেয়া হয়েছিল স্বপ্ননীড়।
বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে দেখলো কলতান নিবাসের সামনে গায়ে কাঁদা মেখে ফুটবল হাতে দাঁড়িয়ে আছে তাশফিন।
তাজদার সিদ্দিকীর চাচা তৈয়ব সিদ্দিকীর ছোট ছেলে। তাসমীন, তৌসিফ আর সে তিন ভাইবোন।
তাসনীমের বিয়ে হয়েছে দশ বছর। তার এক ছেলে এক মেয়ে। সামিরা আর সিনান।
তৌসিফ শাওনের সমবয়সী। মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। তাশফিন সবে ইন্টারে পড়ছে।
সে গতবছর ফুটবল খেলতে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছিল। প্রায় ছয়মাসের মতো ঘরে বসা ছিল। এখন অবশ্য সুস্থ কিন্তু আজ আবারও ফুটবল খেলতে গিয়েছিল বলে মা জোহরা তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তাসমীনের ছেলেমেয়েরা হাসছে মামাকে বকা খেতে দেখে। তিতলি এসে ভেংচি কেটে বলল,
“কেমন লাগে? বড় ভাই আর মেঝ ভাই এখন চলে এলে জমে যাবে।”
তাশফিন চোখ রাঙিয়ে বলল,”ফালতু কথা না বলে সাবান আর তোয়ালে এনে দে।”
“আগে আপু ডাক।”
“ডাকব না। সর।”
তিতলি বলল,”তাহলে সাবান তোয়ালে পাবিনা। দাঁড়িয়ে থাক বাঁদর।”
কথাবার্তার ফাঁকে তিতলি দেখলো তাসনীমের স্বামী জাহিদের পেছন পেছন তাজদার সিদ্দিকী বাড়ির উঠোনে পা রেখেছে। তিতলি একদৌড়ে ভেতরে চলে গেল। তৌসিফকে বলল,
“ভাইয়া আসছে। আমার নাম বলবে না খবরদার। বলবে তোমার কোনো বান্ধবী দিয়েছে স্ক্রিনশর্টটা।”
তৌসিফ বলল,”তোর নামই বলব। আমার কীসের বান্ধবী জিজ্ঞেস করলে তখন? আমাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছিস চালাকি করে? তোর নামই বলবো আমি।”
তিতলি তার মাথার চুল টেনে দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে ঘরে চলে গেল।
শাইনা কথা বলছিল ছোট খালাম্মার সাথে ভিডিও কলে। তাজদার সিদ্দিকীকে দেখে সে একমুহূর্তও দাঁড়ালো না। তাসমীনের স্বামী জাহিদ তাজদার সিদ্দিকীর চেহারার দিকে তাকালো। নিরুত্তাপ।
মেঝ ভাই আর দুলাভাইকে দেখে তাশফিন লজ্জা পেয়ে গেল। সে বড় ভাই আর মেঝ ভাইকে ভয় কম, লজ্জা বেশি পায়। এত লজ্জা পায় যে তা ভয়ের চাইতেও বেশি। চোখ তুলে তাকিয়ে কথা বলতে পারেনা।
অস্বস্তিতে কান চুলকাতে লাগলো সে। তাজদার সিদ্দিকী তার দিকে সরু চোখে তাকালো। পকেটে ফোনটা রেখে দিতে দিতে বলল,”কি অবস্থা?”
তাশফিন মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
জাহিদ হেসে বলল,”শালাবাবু ফুটবল খেলতে গিয়েছে আবার।”
জোহরা বেগম এসে তাজদার আর জাহিদকে দেখামাত্রই মুখের সামনে আঁচল টানলো। তারপর অভিযোগের সুরে বলল,
“দেখেছ ওর কান্ড? গতবছর পা টা ভেঙে কত কষ্ট পেল। আবার খেলা শুরু করেছে। বাড়ির কারো কথা শোনেনা। ওর জেঠার কথা অব্দি শোনেনা।”
তাশফিন মাকে চোখ রাঙাচ্ছে থামার জন্য। কিন্তু জোহরা বেগম থামলেন না।
তাজদার সিদ্দিকী সরু চোখে তাকিয়ে রইলো তাশফিনের দিকে। জোহরা বেগম বিচার দিয়ে চলে গেলেন।
তাশফিন ধীরে ধীরে মেঝ ভাইয়ের দিকে তাকালো। তাকে তাকাতে দেখে তাজদার সিদ্দিকী হালকা মাথা বাঁকালো। তারমানে গোসল করে আসা হোক। তাশফিন ইশারা বুঝে ফুটবলটা নিয়ে পুকুরে চলে গেল দ্রুত। কাঁদা ধুয়ে বাড়িতে ঢুকতে হবে। তারপর বাথরুমে গোসল নিতে হবে।
তৌসিফ বাইরে এসে জাহিদের সাথে হেসে তাজদার সিদ্দিকীর দিকে তাকালো। হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ সিন করেছে কিন্তু নো রিপ্লাই। জাহিদ ভেতরে চলে যেতেই তৌসিফ আপনা-আপনি বলে উঠলো,
“তিতলি আমাকে পাঠিয়েছে ওটা। আমি সোজা তোমাকে পাঠিয়েছি।”
তাজদার সিদ্দিকী শুধু একটাই প্রশ্ন করলো,”তার আগের স্ট্যাটাস?”
তৌসিফ গেল ফেঁসে। শাইনার আগের স্ট্যাটাস কি ছিল সে কি করে জানবে? নিশ্চয়ই সিঙ্গেল থেকে সিঙ্গেল হয়নি? মিঙ্গেল থেকে সিঙ্গেলও নিশ্চয়ই নয়। তবে?
সে চট করে বলল,”মেবি কম্পলিকেটেড। আমি ওর আইডিটা চিনতাম না। আজকেই রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছি। দেবর হওয়ার সুবাদে দুই ঘন্টার মাথায় একসেপ্ট হয়েছে।”
তাজদার সিদ্দিকী মাথা নাড়লো অল্প করে। তৌসিফ তার মাথা নাড়ানোর ভঙ্গি দেখে নিশ্চিত হয়ে গেল আজ রাতের মধ্যেই শাইনা মমতাজ তার কঠোর জবাব পেয়ে যাবে।
আফসার সাহেব কাকে কাকে দাওয়াত করবেন তা বসে বসে লিস্ট করছিলেন আনিসকে নিয়ে। শাইনা তার ফোনটা চার্জে দিয়ে নতুন ফোনটা নিয়ে বসেছে। সেখানে নতুন সিম সেট করা। তিতলি তাকে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এড করে দিয়েছে। সেখানে তাজদার সিদ্দিকীও আছে। তাদের অনেকগুলো মেসেজ জমা হয়েছে। শাইনা বসে বসে মেসেজগুলো পড়তে লাগলো।
গ্রুপে সবাই একটিভ সে আর তাজদার সিদ্দিকী ছাড়া। তাসনুভা গায়ে হলুদের ড্রেস আর অর্নামেন্টস নিয়ে ব্যস্ত। সে একেকটা ড্রেসের ছবি দিচ্ছে। তা দেখে তৌসিফ বিদ্রুপ করে বলছে, “এইসব জরিনা সখিনারা পরে।”
তাসনুভা রেগে আগুন। তৌসিফের সাথে তর্ক লেগে যাচ্ছে সেখানে।
শাহিদা বেগম শাইনাকে ডাকছেন রান্নাঘরে। শাওন বাজার এনেছে। তেলাপিয়া মাছ এনেছে। মনে হয় পুকুরপাড়ে যেতে হবে। আম্মা পুকুরঘাটে মাছ পরিষ্কার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
শাইনা ফোনটা রেখে দিল। চার্জলাইট নিয়ে মায়ের সাথে পুকুরপাড়ে গেল। যদিও নারিকেল গাছটার সাথে বাল্ব দেয়া আছে। কিন্তু আলো নীচের ঘাটগুলো অব্দি পৌঁছায়না ভালো করে। তাই চার্জলাইট লাগে। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে ঝোপঝাড়ে। শাইনা ঘাটে বসলো। শাহিদা বেগম মাছের পিঠ পরিষ্কার করতে করতে বলল,
“মাছ কাটা শিখবি কবে তুই?”
শাইনা বলল,”আমার বমি আসে মাছের পেটের ভেতরের জিনিসগুলো দেখলে।”
“শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আমাকে গালি খাওয়াবি তুই।”
“জোর করে বিয়ে দিলে গালি খাবেই।”
শাহিদা বেগম ধমক দিলেন,”মুখে মুখে তর্ক করিস না বেয়াদব মেয়ে।”
শাইনা চুপ করে রইলো। উচিত কথা বললে সে বেয়াদব।
মাছ কাটা শেষ হতেই শাইনা মায়ের পিছু পিছু ঘরে চলে এল। ফোনটা চার্জ থেকে খুলে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকতে গেল। ঠিক তখনই রিলোড হতে হতে পুরো নিউজফিডটা উধাও হয়ে গেল। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো “Please log in again.” বুক ধকধক করে উঠলো তার। পাসওয়ার্ড দিচ্ছে, কিন্তু কাজ করছে না। বারবার চেষ্টা করেও ঢুকতে পারছে না সে।
আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে সে দ্রুত নিজের ফেক আইডি থেকে আসল আইডিটা সার্চ করলো।
চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগলো তার আইডিতে যত চুড়ি পরা ছবি ছিল, সব মুছে ফেলা হয়েছে।
আর ঠিক তার নিচে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস আপডেট Engaged with Tajdar Siddiqui।
শাইনা পাথর হয়ে গেল। তব্দা খেয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। হাত-পা কাঁপছে, কপালে ঘাম, বুকের ভেতর কিছু একটা ধড়ফড় করছে। রাগ, লজ্জা, অপমান সবকিছু একসাথে তাকে জমিয়ে দিয়েছে। আইডিটা হ্যাক হয়েছে।
তার বুঝতে বাকি রইলো না কে এসব করেছে।
তার এই আইডিটা কত পুরোনো! সব শেষ হয়ে গেল এভাবে?
সে রেগেমেগে রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের সামনে বসে ফোঁপাতে লাগলো। শাহিদা বেগম তেলে পেঁয়াজ ছেড়ে তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো। আবার কি হলো এই মেয়ের?
শাইনা নাকফুল, চুড়ি, আংটি খুলে মায়ের সামনে রেখে দিল। তারপর হনহনিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। শাহিদা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,
“ভূতে পাইছে তোরে? এগুলো খুললি কেন?”
শারমিলা আর শাবরিন এসে বলল,”কি হলো?”
“চুড়ি, আংটি সব খুলে রেখে চলে গেছে।”
তারা দুইবোন একে অপরের দিকে তাকালো। শাহিদা বেগমকে বলল,”আমরা নেই এসবে। পাগল হয়ে যাব তোমার মেয়ের মুড বুঝতে গেলে।”
শাইনা ছাদে গিয়ে রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসেছে। মনটা খারাপ হয়ে আছে। বুকটা ভার লাগছে। সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। না কাঁদছে, না ভাবছে, শুধু শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে সামনের অন্ধকারে।
মাথায় বারবার একটা কথাই ঘুরছে আইডিটা যদি সে আর ফেরত না পায় তাহলে?
সে এখন কী করবে, কোথায় যাবে, কাকে বলবে কিচ্ছু বুঝতে পারছেনা।
নতুন ফোনটা হাতে নিয়ে সে আবার ফেক আইডি থেকে নিজের আইডিটা সার্চ করলো। ঠকঠক করে কাঁপতে থাকা আঙুলে প্রোফাইল খুলে দেখলো তাজদার সিদ্দিকী পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে তার আইডির। নাম, ছবি, সব কিছু বদলে ফেলেছে। আইডির নাম দিয়েছে শাইনা মমতাজ। তার আগের আইডির নাম ছিল Shy Na.
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার তার ইনবক্স।
ওইখানে আছে স্প্যারোজ গ্রুপের কয়েকজন আপুর সঙ্গে করা চ্যাট, যেখানে সে নিজের বিয়ে নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কথা বলেছে। ছিঃ ওসব তাজদার সিদ্দিকী পড়বে? হায় আল্লাহ কি লজ্জার বিষয়!
রীতিমতো ঘামছে সে। হঠাৎ ছাদের দরজাটা খুলে গেল। তিতলি উঁকি দিল। শাইনাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল,”কাল তুমি আমাদের সাথে পার্লারে যাবে। হাইড্রা ফেসিয়াল করবে। মেঝ আপু বললো তোমার কোনো কালার চয়স আছে কিনা মেহেদী অনুষ্ঠানের ড্রেসের জন্য?”
শাইনা তার এত কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো না। অস্থির হয়ে বলল,”ফেসবুক আইডি হ্যাক হলে কিভাবে ফেরত পাব জানো?”
তিতলি সোজাসাপটা বলল,”মেঝ ভাইয়া জানে।”
শাইনা মুখটা দেখার মতো হলো। মনে হচ্ছে সে আরেকটু হলে কেঁদে দেবে। এত অপমান, এত রাগ লাগছে তার। তিতলি এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে কাজটা কার হতে পারে। তার দুঃখও হচ্ছে। হাসিও পাচ্ছে। মেঝ ভাইয়া এভাবে শোধ নিল? বেচারি শাইনা!
শাইনা তার এক বন্ধুকে ফোন দিয়েছে তিতলির সামনে। পায়চারি করতে করতে বলল,
“তোকে পাঁচশো টাকা দেব। না না একহাজার টাকা দেব। রাতের মধ্যে ব্যাক এনে দিবি আমার আইডি। তোর জানাশোনা কেউ থাকলে তাড়াতাড়ি যোগাযোগ কর।”
শাইনার বন্ধু মেজাজ দেখিয়ে বলল,”ওই আইডি যে চালাচ্ছে আমি তাকে তাকে মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করেছি কেন এমনটা করেছে। সে এখন আমার আইডি নিয়ে পড়েছে। বলছে আমার আইডিও খাবে রাত ১২টার মধ্যে। ভাই তুই কোন ফালতু লোকজনকে চেতিয়ে দিয়েছিস কে জানে। সবসময় নারীবাদী টাইপ পোস্ট করিস কেন? ভালো হয়েছে। এবার যা ইচ্ছে তাই কর।”
শাইনার হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। সে তিতলির কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,”আরেহ আমি জানি কে এই কাজটা করেছে।”
“কে করেছে?”
“তিতলির ভাই মেঝটা।”
“তোর জামাই?”
“তোর মাথা। রাখ ব্যাটা। লাগবেনা তোর সাহায্য।”
রেগেমেগে ফোন কেটে দিল শায়না।
তিতলি বলল,”কাল রাতে আমরা শপিং করতে যাব। তুমিও যাবে। ঠিক আছে? তাহলে সকালে রেডি থেকো। আসি।”
বলেই সে চলে গেল ছাদ থাকে। শাইনা কলতান নিবাসের ছাদের দিকে তাকালো চোখ তুলে।
ওই দূরে একটা ছায়া আলতো পায়ে হাঁটছে। শাইনা সেদিকে খেপাটে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অনেক্ক্ষণ।
তারপর ঘরে এসে বসে রইলো থম মেরে। যদি ওই লোকটা ইনবক্সের মেসেজগুলো পড়ে? উফ! আজ টেনশনে সে আজ আর ঘুমাতে পারবে না।
শাহিদা বেগম এসে তারপাশে বসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করতে করতে হাতে চুড়িগুলো পরিয়ে দিতে লাগলো। শাইনা চুড়িটা খুলে পাশে রেখে দিয়ে বলল,
“আমার আইডি ফেরত না দিলে আমি কাল ফেসিয়াল করতেও যাব না। মেহেদী অনুষ্ঠানের শপিং করতেও যাব না।”
শাহিদা বেগম কপাল কুঁচকে ফেললেন।
“এই মেয়েকে নিয়ে তো আমি মহাজ্বালায় পড়েছি। কীসের আইডি ফাইডি?”
শাইনা গোটা রাত একটুও ঘুমাতে পারেনি টেনশনে। ভোররাতে একটু ঘুম নেমেছে চোখে ঠিক তখুনি নামাজের ডাক পড়লো। সে ঘুমঘুম চোখে নামাজ পড়তে উঠে গেল। নামাজ পড়ে আবারও শুয়ে পড়লো বিছানায়। উঠলো একেবারে আটটায়। তিতলি এসে তাকে ডেকে দিল,
“শহরে যেতে সময় লাগবে। উঠো। আমাদের বেরোতে হবে।”
শাইনা ঘুম থেকে উঠলো। গায়ের আলসেমি ঝেড়ে কাঁথা ভাঁজ করতে করতে বলল,”ফেসিয়াল করাতে শহরে কেন?”
“হাইড্রা ফেসিয়াল করায় না পটিয়ায়। হেয়ার স্পাও দরকার। উঠো, মেঝ আপু চেঁচামেচি করবে এখন।”
শাইনা চা নাশতা খেল। শাহিদা বেগম বলল,”দুটো ভাত খাইয়ে দিই?”
শাইনা বলল,”শুধু ভাত আর ভাত। আর কিছু চেনো না তুমি?”
শাহিদা বেগম আর কিছু বললেন না। ভাত নিয়ে এলেন। তাকে ভাত খাইয়ে দিলেন। শাইনা চার লোকমা খেয়েছে।
খাওয়াদাওয়া পর তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আংটি, চুড়ি, নাকফুলটা পরার জন্য রাজী করালেন শাহিদা বেগম। শাইনা চুপচাপ মায়ের সব কথা শুনলো। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে হতাশার সুরে বলল,
“এসব করে করে আমাকে জাহান্নামে ঠেলে দিয়েছ। অপছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে মানে বোঝো আম্মা? আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি আমি যদি অসুখী হই তার কারণ তোমরা। সব দায় তোমাদের।”
শাহিদা বেগম মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। শাইনা আলমারি থেকে নতুন কাপড় বের করে পরে নিল। মাথার চুল আঁচড়ে নিল। তারপর হালকা সাজগোছ করে ওড়নাটা মাথায় তুলে বাম কাঁধে একটা কোণায় তুলে দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো।
তৌসিফ গাড়িটা নিয়ে এল গ্যারেজ থেকে। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল,
“শাইনা মুখে হাসি না থাকলে ফেসিয়াল টেসিয়ালে কিছু হবে না।”
শাইনা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। কথাটা শুনে তাকালো। এগিয়ে এসে বলল,
“ভাইয়া আমার আইডি।”
তৌসিফ ঠোঁট উল্টে বলল,”আমি এই ব্যাপারে কিছু জানিনা।”
শাইনা আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে তাজদার সিদ্দিকীর গলা খাঁকারি দিল। শাইনা চমকে উঠলো। পাশে মুখ ফিরিয়ে থুতু ফেলে শাইনার পাশ কেটে গাড়ির সামনের সিটে এসে বসে পড়লো তাজদার সিদ্দিকী। তাসনুভা আর তিতলি এল দৌড়ে দৌড়ে তখুনি। রওশনআরা পেছন থেকে বললেন,
“সাবধানে যেও সবাই। তৌসিফ গাড়ি আস্তে চালাবে।”
তারপর শাইনার দিকে তাকিয়ে বললেন,”মুখ শুকনো কেন? কিছু খাওনি?”
শাইনা বলল,”আম্মা ভাত খাইয়ে দিয়েছে।”
তিনি তবুও তাজদার সিদ্দিকীর উদ্দেশ্য বললেন মাঝপথে তাদের যেন রেস্টুরেন্টে নামিয়ে কিছু খাওয়ায়।
শাইনা তিতলির পেছন পেছন গাড়িতে গিয়ে বসলো। তাজদার সিদ্দিকী তাদের পার্লারে নামিয়ে দিয়ে তৌসিফকে নিয়ে অন্য জায়গায় যাবে। গাড়িটা চলতে শুরু করলো কিছুক্ষণ পর।
শাইনা স্পষ্ট দেখলো তাজদার সিদ্দিকী তার আইডির নিউজফিডে স্ক্রল করছে। সে একদৃষ্টি সেদিকে চেয়ে রইলো। তাজদার সিদ্দিকী স্ক্রল থামিয়ে মিররের দিকে তাকালো হঠাৎ!
শাইনার সাথে চোখাচোখি হওয়ামাত্রই শাইনা ছটফটিয়ে উঠলো। তাজদার সিদ্দিকী সিটে মাথা রেখে ঠোঁটের কাছে হাত রেখে বসেছে।
তাজমহল পর্ব ৫
ঠোঁটদুটো হাতের আড়ালে সম্ভবত হাসছিল শাইনা মমতাজকে খেপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য। কিন্তু শাইনা শান্ত মেয়ের মতো বসে রইলো। কারণ সে তার ফেক আইডি থেকে মস্তবড় একটা গালি দিয়েছে তাজদার সিদ্দিকীকে। এখন শান্তি লাগছে। গালিটা বলা যাবেনা।