তুমি শুধু গল্প না আমার ভালোবাসা পর্ব ৩৩
আমেনা আক্তার
বর্তমান..
অতীতের কথাগুলো মনে পরতেই আয়নার মনটি আবার বিষিয়ে গেল। কিন্তু আয়নার চোখ থেকে এক ফোঁটাও পানি ঝরতে দেখা গেল না।দেখা যাবেই বা কি করে আগের আয়না ও এখনকার আয়নার মাঝে যে বিস্তর তফাৎ।আয়না নিজেকে সামলাতে শিখে গিয়েছেন। এখন আর নিজের অশ্রু কেনো এমন ব্যাক্তির সামনে ব্যয় করে না যে এই অশ্রুর যোগ্য না।আয়না এখানে কষ্ট পাচ্ছে ও যাকে নিজের সর্বত্র দিয়ে ভালোবেসেছে তার থেকে কষ্ট পেয়ে।আর একই গাড়িতে আয়নার সামনের সিটে বসে আব্রাহাম কষ্ট পাচ্ছে যে ওকে ভালোবেসেছে বা যাকে আব্রাহাম এখন নিজের সর্বত্র দিয়ে ভালোবাসতে চায় তাকে কষ্ট দেওয়ার অপরাধ বোধে। দুজনের মনেই কষ্টের নদী প্রবাহিত হচ্ছে কিন্তু কারণ ভিন্ন। এখন দুজনের অনুভূতি ভিন্ন দুজনের চাওয়া ভিন্ন।
আজ প্রায় দশদিন হতে চললো রাজিব জেল হাজতে বন্ধি।যেই দিন রাজিবকে পুলিশ গ্রেফতার করে এনেছে তারপরের দিনই ওকে কোর্টে চালান করে দেওয়া হয়।আদালতে তিতির যেই সকল প্রমাণ পেশ করে জজ সাহেবের সামনে। তার ভিত্তিতে জজ রাজিবকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।যা শুনে রাজিব ও তার মায়ের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পরে। কিন্তু তখন ওদের কিছুই করার ছিল না। কারণ উকিল ওদের ছাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে।
এইসকল কিছুর মাঝে রাজিব এটি খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে। তিতির এই সকল কিছু আগের থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল। কিন্তু তিতিরের এই সকল কিছু করার পিছনের কারন কিছুতেই বুঝতে পারছে না রাজিব।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রাজিব জেলের ভিতরে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কারণ তিতির জেলে ওর সাথে দেখা করতে আসছে। রাজিব নিজের মনের ভিতর থাকা প্রশ্নগুলোর জবাবের জন্য অপেক্ষা করছে।আজ তিতিরের কাছ থেকে নিজের মনের ঘূর্ণায়মান প্রশ্নের জবাব ও জেনেই ছাড়বে।
একটি মেয়েকে আসতে দেখা যাচ্ছে যে রাজিবের সাথে দেখা করতে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে রাজিবের দিকে। কিন্তু রাজিব এখনো মেয়েটির চেহারা স্পষ্ট ভাবে দেখতে পায়নি। কিন্তু তবুও রাজিব দূর থেকে দেখে বলতে পারছে এটি তিতির নয় কারণ মেয়েটির পোশাক অনেক সাধারণ। কিন্তু তিতির তো এত সাধারণ ভাবে থাকে না।ও সবসময় মর্ডান থাকতেই পছন্দ করে।তাই রাজিব সেই মেয়েটির চেহারা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে সেই দিকে।
মেয়েটি যত এগিয়ে আসছে রাজিব মেয়েটির অবয়ব ততোই স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে।মেয়েটি যতই কাছে আসছে রাজিবের অস্থিরতা যেনো বেড়ে চলেছে।ও চাইছে না ও যা ভাবছে তা যেনো কখনো না হয় তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।
মেয়েটি এসে দাঁড়ায় সেলের সামনে এসে দাড়াতেই রাজিব কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো।
মি..মিহিকা তু.. তুমি, তুমি এখানে কি করছো।
রাজিবের কথা শুনে সেলের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিহিকা মুচকি হাসলো। এবং রাজিবকে উদ্দেশ্যে করে বলল।
মনে রেখেছ তাহলে, অবশ্য আমি মনে রাখার মতোই ব্যাক্তি যার সর্বস্ব তুমি লুটে নিয়েছ তাঁকে মনে কি করেই বা না রাখবে।
মিহিকার কথা শুনে রাজিব শুকনো একটি ঢোক গিলে বলল।
এখানে তো তিতিরের আসার কথা ছিল, তুমি কি করছো এখানে আর তিতির কোথায়।
মিহিকা আবার মুচকি হেসে বলল।
তিতির কে দেখতে চাও তাহলে তোমাকে ওর সাথেই দেখা করাচ্ছি।
কথাটি বলেই মিহিকা নিজের চোখের থেকে মোটা ফ্রেমের চশমা খুলে ফেলল। নিজের ঝলমলে চুল গুলো টান দিতেই তা খুলে বেড়িয়ে আসলো লেয়ার কার্ট করা কালার চুল। রাজিব শুধু সেলের ওপাস থেকে দেখে যাচ্ছে মিহিকাকে। নিজের আসল চুল বের করা শেষ হতেই এইবার একটি টিস্যু পেপার হাতে নিয়ে নিজের মুখ ভালো ভাবে মুছে নিতেই বেড়িয়ে আসলো মিহিকার আড়ালে থাকা তিতিরের চেয়ারা।
মিহিকার আসল রুপ দেখে রাজিবের মনে হচ্ছে ও বোধহয় খারাপ কেনো স্বপ্ন দেখছে।এটি কেনো কালেই সম্ভব না।মিহিকা তার সাথে এত দিন তিতির সেজে অভিনয় করেছে। আর ও ওকে চিন্তেও পারেনি।মিহিকা রাজিবকে বিচলিত অবস্থায় দেখে বলল।
কেমন লাগলো আমার সারপ্রাইজ, অবশ্যই অনেক বড় ঝটকা খেয়েছ।দেখো আমি হিসাব নিকাশ শেষ করে ফেলেছি। তুমি যেমন কিছু বছর আগে আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে ব্যবহার করে ছুঁড়ে মেরেছিল ঠিক তাই আমি তোমার সাথে করেছি।মনে আছে তোমার কিছু। আমি কতটা পাগল ছিলাম তোমার জন্য। আমি মনে করেছিলাম আমার চেহারার জন্য ও আমার সাধারণ ভাবে জীবন কাটানোর জন্য অন্য সকলে আমাকে অপছন্দ করলেও তুমি আমাকে ভালোবাসো আমি এত সাধারণ হওয়ার পরেও তুমি আমাকে ভালোবেসেছ। কিন্তু,
কথাগুলো বলে থামে মিহিকা জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আবার বলা শুরু করলো।
কিন্তু তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসো নি। তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছ। তুমি আমাকে নিঃস্ব করে ছেড়েছ।আমার সাথে মিথ্যে বিয়ের নাটক করে আমার শরীর দিয়ে নিজের চাহিদা মিটিয়ে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছ। আমাকে নিজের জীবন থেকে শুধু তুমি সরিয়ে ফেলো নি আমাকে আমার পরিবারের কাছে কলঙ্কিনি করেছ। আমাদের একান্ত মুহূর্তের ভিডিও তাদের কাছে পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে একেবারে দূর করে দিয়েছিলে তুমি। আমার বাবা মা যখন আমাকে দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ছিল তখনি আমি নিজেকে ওয়াদা করেছিলাম। তুমি যেমন আমার কাছ থেকে আমার সব কিছু কেড়ে নিয়েছ তেমনি তোমার কাছ থেকেও আমি তোমার সব কিছু কেড়ে নিবো।
কথাগুলো বলে জোড়ে জোড়ে হাসতে লাগলো মিহিকা।মিহিকা রাজিবের দিকে তাকাতেই তার হাসি থেকে গেল।ওর চোখ দিয়ে যেনো এখন আগুন বের হচ্ছে ও রাজিবের দিকে তাকিয়ে আবার বলা শুরু করলো।
পাঁচ বছর, পাঁচ বছর ধরে আমি নিজেকে তৈরি করেছি। তোমার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমি আমার পুরো পরিচয় বদলে ফেলেছি। না চাইতেও তোমার যেমন মেয়ে পছন্দ ঠিক সেই রকম ভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছি।আর দেখ তুমি কত সহজে আমার সকল পরিকল্পনা সফল করে দিয়েছ। তোমাকে শাস্তি দিতে পেরে আমি কত খুশি হয়েছি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না।
এখন তুমি জেলে বসে বসে এইটা আফসোস করতে করতে জীবন অতিবাহিত করো। কেনো তুমি আমার জীবন নষ্ট করেছ।আর আমি মুক্ত বাতাসে নিজের জীবন আবার গুছিয়ে ফেলবো।এই জঘন্য কৃত্রিম রুপ যেই রুপ কে আমি ঘৃণা করি সেই রুপকে আমি আমার জীবন থেকে বিলিন করে দিবো।এই কৃত্রিম খোলশ ছেড়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিবো।নিজেকে আমি ওইভাবে তৈরি করব যেভাবে থাকতে আমি পছন্দ করি। কিন্তু এইবার আর আমাকে তোমার মতো মানুষরা ধোঁকা দিতে পারবে না।
কথাগুলো বলেই মিহিকা কিছুক্ষণ রাজিবের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যায়।আর রাজিব সেলের ভিতরে ঠিক আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে হয়তো ও বুঝে গেছে এখন আর ওর বাঁচার কেনো উপায় নেই।ও যেই সকল পাপ করেছে সেই সকল পাপের শাস্তি ওকে এই জেলের ভিতরে থেকে পেতে হবে।ওর সকল বাঁচার আশা শেষ হয়ে গিয়েছে।আর কেউ ওকে এখন শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারবে না।ও নিজের উপযুক্ত শাস্তি পেয়ে গেছে।এই শাস্তি ওর সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে ।
ভার্সিটিতে আজ নবীন বরণ অনুষ্ঠান।তাই আজ ভার্সিটির আনাচে কানাচে সেজে উঠেছে এক নতুন সাজে। ভার্সিটির সকলের মাঝে চলছে উৎসবের আমেজ।এই ভার্সিটিতে নবীন বরণ একটি বিশেষ উৎসবের মতোই পালিত হয়। নবীন বরণ শুধু নতুন স্টুডেন্ট না পুরাতন সকল স্টুডেন্ট ও অংশগ্রহণ করতে পারে।তাই নবীন বরণ অনুষ্ঠানে জাঁক জমকতা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। শুধু মাত্র ভার্সিটির মাঝে নতুনত্বের সাজ দেখা যাচ্ছে তা নয় স্টুডেন্টরাও সেজে এসেছে নিজেদের পছন্দ মতো বিভিন্ন সাজে।অনেক মেয়ে ও ছেলেরা সাড়ি পরে এসেছে আবার অনেক ছেলেরা পরে এসেছে পাঞ্জাবি।
রুদ্র, আরশাদ,রাজ ও আব্রাহাম তাদের হৃদিতা ও নূরের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু অনুষ্ঠান প্রায় শুরুর পথে তবুও তাদের কোনো খবর নেই।তার উপর প্রধান অতিথিকে ফুল দিয়ে বরণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নূর ও হৃদিতাকে। কিন্তু ওদের এত লেট দেখে তো মনে হচ্ছে ওরা অতিথিদের না অতিথিরা ওদের বরন করবে। কিছুক্ষণের মাঝেই নূর ও হৃদিতাকে গেইট দিয়ে ঢুকতে দেখা যায়।
হৃদিতা কে দেখে আরশাদ ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। নূর ও হৃদিতা এগিয়ে আসছে তাদের বন্ধুদের দিকে। হৃদিতা ও নূর দুজনে সারি পরেছে ও সাথে পরেছে ম্যাচিং হিজাব।ওদের দুজনকেই দেখতে অপরুপ লাগছে।ওরা দুজন রুদ্রদের কাছে এসে দাড়ানোর পরেও আরশাদের অভিব্যক্তি বদলাই নি।ও যেনো কেনো ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছে।ও এখনো একই ভাবে তাকিয়ে আছে হৃদিতার দিকে আরশাদের অবস্থা দেখে হৃদিতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।
ওর কি হয়েছে ও এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেনো।
তোকে দেখে মনে হয় ও আবার প্রেমে পরে গেছে।তাই ও তোর দিকে এভাবে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে।
রাজের কথায় হৃদিতা বলল।
তোর ফালতু কথা বাদ দিয়ে ওকে ঠিক কর।
হৃদিতার কথা শুনে আব্রাহাম বলল।
এখনি করছি,
কথাটি বলতে দেরি কিন্তু আব্রাহামের আরশাদের পেটে ঘুষি মারতে দেরি হয়নি। ঘুষি খেয়ে আরশাদ ঘোরের মধ্যে থেকে বের হয়ে আসলো। আরশাদ তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো সকলে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
তোরা আমার দিকে এভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছিস কেনো।
আরশাদের কথা শুনে নূর বলল।
আমরা দেখতে চাইছি। এভাবে এক দৃষ্টিতে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে তুই ঠিক কি দেখতে চাইছিস।হয়তো আমরা তোর দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুটা হলেও বুঝতে পারবো।
আরশাদ কথাগুলো শুনে বাঁকা হাসি দিয়ে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে বলল।
তোরা ভালো মতো দেখতে কোথায় দিলি,আগে আমি ভালোভাবে দেখে নেই তারপর তোদের বলবো কি দেখেছি।
আরশাদের কথাটি বলার সাথে সাথে হৃদিতা ওর গালে একটি ঘুষি বসিয়ে দেয় এবং বলল।
কি দেখবি শয়তান তুই,তোর দেখার সাধ আমি একবারের জন্য ঘুচিয়ে দিবো।
আরশাদের কথা শুনে আরশাদ কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসে।
নূর ও তার বান্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। অনুষ্ঠান এখনো শুরু হয়নি কেননা এখনো প্রধান অতিথি আসেনি। ভার্সিটির সামনে এসে একে একে ছয়টি গাড়ি এসে থামলো। ভার্সিটির সকলে এখন তাকিয়ে আছে সেই গাড়ি গুলোর দিকে। সকলের ভিতরেই এখন গাড়ির ভিতরে থাকা মানুষগুলো কে দেখার আগ্রহ যেনো চেপে ধরেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই প্রিন্সিপাল ও বাকি শিক্ষকদের দৌড়ে গাড়িগুলোর সামনে আসতে দেখা গেল। প্রিন্সিপাল কে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে সকলে খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়েছে গাড়ির ভিতরে কেনো সাধারণ মানুষ বসে নেই বরং কেনো ক্ষমতাবান ব্যাক্তি বসা।
তুমি শুধু গল্প না আমার ভালোবাসা পর্ব ৩২
গাড়ি থেকে সামনে ও পিছনের চার গাড়ি থেকে বডিগার্ড নেমে এসে মাঝের গাড়ি দুটোর সামনে এসে গাড়িটিকে ঘিড়ে দাড়ালো।একজন বডিগার্ড মাঝের দুটি গাড়ি থেকে প্রথম গাড়ির দরজা খুলতেই সেখান থেকে বেড়িয়ে আসলো একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ। এবং দ্বিতীয় গাড়িটির দরজা খুলতেই বেড়িয়ে আসলো একজন সুদর্শন পুরুষ। সুদর্শন পুরুষটিকে দেখে সকলের মুখ যেনো হা হয়ে গেল।