তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১২
ভূমিকা তালুকদার
ফোনটা হাতে নিয়ে আবার সেই একই নম্বর একবার, দুইবার, তিনবার, প্রতিবারই ঠান্ডা, যান্ত্রিক উত্তর—
The number you have dialed is currently switched off।
লিয়ানার চোখের ভেতর ধীরে ধীরে জমে উঠলো তীক্ষ্ণ বিরক্তি। গলা শক্ত হয়ে উঠলো।শেষবার স্ক্রিনের আলো নিভতেই সে প্রায় ঝটকা মেরে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল। কালো স্ক্রিনে নিজের রাগান্বিত প্রতিবিম্ব এক মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠলো, তারপর মিলিয়ে গেলো, ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো। রুমের দরজার পাশে রাখা তোয়ালে কাঁধে ফেলে বাথরুমের দিকে এগিয়ে ডুকে পড়লো দরজা বন্ধ হতেই টাইলসের ভেতরে শোনা গেলো পানির ধারার ধ্বনিটুপটাপ থেকে ঝরঝর, তারপর একটানা ঝরনার শব্দ।
পানি চুল বেয়ে, গলা বেয়ে, পিঠ বেয়ে নেমে যাচ্ছে,যেন ঠান্ডা জলে সব চিন্তা ধুয়ে ফেলতে চাইছে, অথচ মন জানে,কিছুই ধোয়া যাবে না।শাওয়ার বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো লিয়ানা। মুখে ফোঁটা ফোঁটা জল, চোখদুটি লালচে, কিন্তু দৃষ্টি ঠান্ডা। তোয়ালে দিয়ে ভিজে চুল মুছে নিয়ে হেয়ার ড্রায়ার চালালো,গরম বাতাসে চুলগুলো উড়ে উঠছে, যা রুমের মধ্যে নরম হাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়েছে।চুল শুকিয়ে আলমারি খুলে ভেতর থেকে বের করলো একেবারে হালকা মেরুন কুর্তি পড়ে নিলো।তারপর ড্রেসিং টেবিলের কাছে বসে পেছনের দিকে চুলগুলো ঢিলে করে গুছিয়ে একটা জুটি বাঁধল। গলায় জড়িয়ে নিল পাতলা একটা স্কার্ফ,রঙে সাদা আর হালকা মেরুন মিশ্রণ,যা লিয়ানাকে বেশ ভালোই মানিয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সবকিছু শেষ করে দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই করিডরের আলোয় তার মেরুন পোশাক যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠল।নীচতলার ডাইনিং স্পেসে বিকেলের চা-নাশতার আয়োজন চলছিল,বড় গোল টেবিলে সাজানো গরম চায়ের কাপ, প্লেটে বিস্কুট,সমোসা, আর পাশে ফলের টুকরো। লিয়ানা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। সিঁড়ির বাঁকের কাছে থেমে তাকাল বুক শেলফের দিকে। আঙুলের ডগা দিয়ে শিরোনাম ছুঁয়ে ছুঁয়ে একখানা উপন্যাস টেনে বের করলো। বই হাতে নিয়ে সোফার কোণায় গিয়ে বসলো,যেনো তার চারপাশের কথাবার্তা, টিভির শব্দ, এমনকি চায়ের সুগন্ধও তার কাছে এখন অর্থহীন মনে হয়।পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎই মনে পড়ে গেল ইশানের কথা। ঠোঁটের কোণে এক তির্যক হাসি ফুটে উঠল, তারপর প্রায় ফিসফিস করেই বললো,
ওই লোকটার তো মানসিক হাসপাতালে থাকার কথা, তা না করে আমাকে এসে বিয়ের কথা বলছে! ফাউল! যদি পারতাম, কষিয়ে দুইটা থাপ্পড় মারতাম!
পাশে বসে থাকা মাইশা তখন চিপস চিবোচ্ছে আর টিভিতে কোনো রিয়েলিটি শো দেখছিলো, লিয়ানার ফিসফিস কথাগুলো কানে যেতেই মুখ ঘুরিয়ে কটমট করে বলল,
কাকে মারবি?
কাউকে না,তোকে! চুপ থাকলেই ভালো হবে তোর জন্যে।
টেবিলের মাথায় বসা সোলেমান খান গভীর মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। চশমার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি স্থির, ঠোঁট শক্ত করে চেপে রাখা,কোনো শব্দ যেন তার মনোযোগ ভাঙতে পারবে না।
ঠিক তখনই নাফিসা খান ট্রের ওপর চা নিয়ে এলেন। তার সামনে কাপ রেখে হাত বাড়িয়ে দিলেন,
এই নাও, গরম থাকতে খেয়ে নাও।
তারপর ফাহিম খানের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন,
জায়ান কি ফোন ধরেছে রে? নাকি এখনো বন্ধ?
ফাহিম খান মাথা নাড়লেন,
হ্যাঁ, এখনো বন্ধই আছে।
সোলেমান খান খবরের কাগজ নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গলার স্বর ঠান্ডা, কিন্তু ভেতরে যেন দীর্ঘদিনের চেনা হতাশা জমে আছে,
এমনটাই হবে আমি আগেই বুঝেছিলাম,এই ছেলেকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।
চিনবেই তো,তোমার ছেলে, তোমার থেকেও ভালো কে চিনবে?তারপর আঙুল দিয়ে চায়ের কাপের ধোঁয়া সরিয়ে নিয়ে ধীরে নাফিসা খান বললেন,
কিন্তু আমি তো মা,আমার মনটা হঠাৎ হঠাৎ চিন চিন করে ব্যথা করে ছেলের জন্য। সেটা তোমরা কেউ বুঝবে না।
তার কথার শেষে ঘরে এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এল। টিভির আওয়াজ, কাপের টুংটাং, আর দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি,সব মিলিয়ে সেই নীরবতাকে আরও গভীর করে তুললো।
সোলেমান খান খবরের কাগজ ভাঁজ করে পাশে রাখলেন। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, গলায় ঠান্ডা অথচ দৃঢ় সুর,
যেই ছেলে নিজের দাদার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও একবারের জন্য দেশে আসেনি,সে হঠাৎ করে কেন আসবে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া? বিয়ের ব্যাপারটা তো শুধু কথা এড়িয়ে যাবার অজুহাত ছিলো। আর সে ভালো করেই জানতো আমি থাকতে সেটা কখনোই সম্ভব নয়।
তার কথার শেষ শব্দগুলো যেন বাতাসে ধাক্কা খেয়ে সবার কানে গিয়ে লাগল। আরিশা, মাইশা, লিয়ানা, আর রিহান চারজনেই থমকে গেল। চোখে বিস্ময়, ঠোঁটে অর্ধেক খোলা প্রশ্ন।
প্রথমে আরিশা, তারপর মাইশা, একসাথে প্রায় ফিসফিস করেই বলে উঠল,
মানে,জায়ান ভাই কি,সেদিন বিয়ের কথা বলেছিলেন।
রিহান ভ্রু কুঁচকে লিয়ানার দিকে তাকালো,সবার কণ্ঠ মিলেমিশে এক অদ্ভুত নীরব গুঞ্জন তৈরি করলো, আর সেই মুহূর্তে খান বাড়ির মধ্যে চায়ের ধোঁয়া আর দমবন্ধ করা কৌতূহল একসাথে ঘুরপাক খেতে লাগলো।
জায়ানের দাদা বীর বিক্রম খান একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন, যার হাতে গড়ে উঠেছিলো আজকের খান বাড়ি। কথায় আছে, তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন জমিদার, সেই জমিদারিত্বের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রক্তে মিশে আছে খান বংশের গর্বে। সেই পুরনো দিনের গৌরব আর বর্তমানের শক্তি,সবকিছুর প্রতীক ছিলেন বীর বিক্রম খান।আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন তিনি তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই, সেদিন পুরো ঢাকার মানুষ শোকাহত হয়েছিল। জানাজায় হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিল,ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, গ্রাম-শহরের সাধারণ মানুষ,সবাই শেষবারের মতো দেখতে এসেছিল সেই মানুষটিকে,
কিন্তু সেই ভিড়ে ছিল না একজন মানুষ,জায়ান খান।খবর পাঠানো হয়েছিলো তাকে,তবুও সে আসেনি শেষ বারের মতো দাদার কবরে গিয়ে মাটিটাও ছুঁতে পারলো না।
বিকেলের আলো ম্লান হয়ে আসছে, আর চায়ের ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা বাতাসে। যেনো কেউ কিছু বলতে চাইছে না,শুধু দমবন্ধ করা স্থিরতা। এমনকি পিন পড়লেও সেই শব্দ শোনা যাবে।হঠাৎ, সেই স্থিরতা ভেঙে দিল একটানা ইঞ্জিনের গর্জন।গেটের বাইরে থামল তিনটি কালো রঙের মার্সিডিজ।মসৃণ ধাতব গাড়িগুলো গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই রক্ষীরা স্যালুট দিয়ে দাঁড়াল।প্রথম গাড়ির দরজা খুলে নামলেন এক মধ্যবয়সী নারীগায়ে সমৃদ্ধ জাঁদরেল জামদানি সিল্কের শাড়ি, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, চুল গুছিয়ে বাঁধা, মুখে কর্তৃত্বের ছাপ।তাকে দেখামাত্রই যে কেউ চিনে ফেলবে,রাজনৈতিক নেত্রী রিনা শেখ। তার পদক্ষেপে ছিল এমন এক দৃঢ়তা, যা সাথে সাথেই চারপাশের বাতাস বদলে দিল।পেছনের গাড়ি থেকে নামলেন ইন করা শার্ট-প্যান্ট পরা, চশমাধারী এক পুরুষ,ইশান শেখ,পরিপাটি, স্থির চেহারা। আর তৃতীয় গাড়ি থেকে নেমে এলেন কয়েকজন লোক, হাতে ফল, মিষ্টির বাক্স, আর নানা উপহার।তারা যখন খান বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো, ভেতরের সবার দৃষ্টি একসাথে সেই দিকে ঘুরে গেল।
সোলেমান খান সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালেন,এগিয়ে গিয়ে রিনা শেখের সাথে হাত মেলালেন, পাশাপাশি শার্ট-প্যান্ট পরা ইশানের সাথেও করলেন কুশল বিনিময়।তাদের ভেতরে নিয়ে আসা হল, আর সবাইকে ডেকে বসতে বলা হল ড্রইং রুমের নরম সোফায়।মিষ্টির বাক্স আর উপহারের প্যাকেটগুলো একে একে সেন্টার টেবিলে সাজানো হচ্ছিল, যেন কোনো বড় উপলক্ষের প্রস্তুতি চলছে,কিন্তু কেউই এখনও জানে না, সেই উপলক্ষটা আসলে কী।সোলেমান খান ধীরে ধীরে রিনা শেখের দিকে তাকালেন। চোখে সামান্য অবাক ভাব, গলায় ভদ্র, কিন্তু স্বর গভীর। তিনি মায়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
চিনতে পেরেছেন তো, মা, হ্যাঁ, তিনি ইব্রাহিম শেখের স্ত্রী, রিনা শেখ।
মায়ের চোখে প্রথমে হালকা বিস্ময়, তারপর স্মৃতির ঝলক।
সোলেমান খান ধীরে ধীরে বললেন,
ওনিতো ছিলেন আমার ব্যবসায়িক পার্টনার। দুঃখের বিষয়, এই যে অকাল মৃত্যু হয়েছে তাঁর।
তবে, হঠাত আমার বাড়িতে আপনাদের আগমনে আমি সত্যিই খুবই খুশি হয়েছি।
পাশে বসে থাকা লিয়ানা কিছুই বুঝতে পারছিল না।হঠাৎ সেই লোক সোজা তার বাড়িতে ঢুকে পড়লো। বড় আব্বু, ও দেখি তাকে চিনে তার পরিবারের সাথে পরিচিতো,এসব ভেবেই তার মাথা out of control হয়ে যাচ্ছে, ইশানকে দেখতেই রাগ, হতাশা, আর ধোঁয়াটে বিস্ময় সব একসাথে তার ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়লো।মাথায় ধাক্কা খেয়ে যায়, বুকের ভেতর যেন অদৃশ্য আগুন জ্বলে উঠল। তার ঠোঁট কেঁপে উঠল, কিন্তু সে বলতে পারছিলোনা। চোখে ক্রোধের ঝলক, মস্তিষ্কে ব্যথা,সব মিলিয়ে যেন এই মুহূর্তটাই তার সব নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিচ্ছে।তার রাগ ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছে। হাতগুলো মুঠোতে শক্ত হয়ে গিয়েছে। লিয়ানা নিজের অনুভূতিগুলো গিলতে গিলতে সোফায় বসে থাকলো। চারপাশে মৃদু নীরবতা। হঠাৎ মনে হলো।স্পেসে চা-নাশতার টেবিল সাজানো। গরম চায়ের কাপ, প্লেটে সমোসা ও বিস্কুট।
রিনা শেখ ধীরে ভদ্র স্বরে বললেন,
আচ্ছা, আসল কথা আসি, আসলে আমি অনেক আশা নিয়ে আজ আপনাদের বাড়িতে এসেছি। আশা করি আপনারা আমাকে নিরাশ করবেন না।
কিন্তু তার পরের কথা যেনো সবাইকে স্তব্ধ করে দিলো
আমি আপনাদের বাড়ির বড় মেয়েকে আমার ছেলের বউ হিসেবে নিতে চাই।
ঘরে হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো। নাফিসা খান চেয়ার থেকে একটু উঠে নিজের শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে ঢুক গিলে নিলেন।
সোলেমান খান কিছুটা অবাক হলেও তার যেনো ব্যাপার টা বেশ ভালোই লাগলো,সোফায় ঠেস দিয়ে বসে বললেন,
এটা তো খুবই ভালো কথা,আমি তো ইশানকে খুবই পছন্দ করি।
ফাহিম খান,
দেখুন, মিসেস শেখ, আমার মেয়ে এখনও ছোটো, এসব বিয়ে নিয়ে এখনই কিছু ভাবছিনা। সামনে তার এইচএসসি পরীক্ষা।
সমস্যা নেই, মিস্টার খান। আমি এখন শুধু বিয়ে ঠিক করতে এসেছি। অনুষ্ঠান না হয় হবে পরীক্ষার শেষে।
এই রিনা শেখের এমন কথায় খান বাড়ির প্রত্যেকে যেমন অবাক তার থেকে বেশি লিয়ানা, এই মেয়েটার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়েছে।এইতো সকালেই এই লোক তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো,কিন্তুু এভাবে যে এই লোক তার মাকে নিয়ে এভাবে তাকে বিয়ে করতে হাজির হয়ে যাবে তা লিয়ানার কল্পনারও বাহিরে।সে কি করে এই লোককে বিয়ে করবে?আর তার বড়ো আব্বু কেনো রাজি হচ্ছে?এখন কি হবে তার?তার কি সত্যি বিয়ে হয়ে যাবে?না কখনোই না লিয়ানা কিভাবে অন্য এক পুরুষকে বিয়ে করে তার সাথে সংসার করবে?এইসব ভাবতে ভাবতেই লিয়ানার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সে যেনো এমন এক মাইনকার চিপায় ফেসে যাচ্ছে যেখান থেকে বের হওয়া ভারি কঠিন।তার বড়ো আব্বু সম্মতি দিচ্ছে যেখানে, সেখানে বাড়ির কারোর সাধ্যে নেই বড়োআব্বুর মুখের উপর কথা বলার একমাত্র জায়ান খানকে ছাড়া, কিন্তুু তিনি তো নেই,কোনো খুঁজ নেই তার,এখন কি হবে লিয়ানার? কে বাঁচাবে তাকে?এইসব ভাবতে ভাবতে এসির নিচে বসেও ঘেমে ভিজে যাচ্ছে মেয়েটা, আপাতত বাড়ির সম্মান এর কথা ভেবে রেগে হনহনিয়ে চলেও যেতে পারবে না।তারপর বিরক্তি নিয়ে ইশানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
মন চাচ্ছে এই হাতির বাচ্চাকে এখানেই মেরে বালি চাপা দিয়ে দিতে,বেহায়া লোক।বিয়ে করার জন্য কি দুনিয়াতে মেয়ের অভাব নাকি।
এইবার রিনা শেখ হালকা হাসি দিয়ে চারপাশে তাকালেন—
এই বিয়ে নিয়ে কারো কোনো আপত্তি তো নেই তো? আসলে আমার ছেলেটাকে আমি অনেক আদরে মানুষ করেছি। সে যা চায়, আমি তা দিইনি,এমন হয়নি কোনোদিন, আর আজ সে যা চাইছে,তা দিতেই আমি এলাম খান বাড়ির মেয়েকে আমার ছেলের বউ করতে।
ঘরের ভেতর নীরবতা নেমে আসে। সবার দৃষ্টি ঘুরে যায় সোলেমান খানের দিকে।
সোলেমান খান:না কারো কোনো আপত্তি নেই। আমি রাজি মানে,এই বাড়ির সকলে রাজি। আমার কথাই শেষ কথা।
তার মনে এই বিয়েতে রাজি হওয়ার পেছনে একটা গোপন হিসাব আছে। এটা কেবল একটি প্রস্তাব নয়,এটাই সুযোগ,লিয়ানাকে চিরতরে জায়ান থেকে দূরে সরানোর। নইলে জায়ানের জেদের কাছে হয়তো তাকেও হার মানতে হবে,আর সেটা সোলেমান খান হতে দেবেন না।এই বাবা ছেলের জেদের কাছে পুরোপুরি ফেসে গেলো লিয়ানা।অন্যদিকে ইশান পাশের সোফায় বসে, লিয়ানার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে উঠছে।
তার চোখে খেলা করছে বিজয়ের ঝিলিক—
যা চাইছিলাম, সেটা হাতের মুঠোয়। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
আজ কেউ কিছু বললো না, কেউ সোলেমান খানের বিপরীতে দাঁড়ালো না।
লিয়ানার পাশে থাকার মতো কেউ নেই,চারদিক ফাঁকা।
ঠিক তখনি রিনা শেখ হঠাৎ ব্যাগ থেকে বের করলেন ঝলমলে একটি ডায়মন্ড রিং।লিয়ানা অবাক চোখে বড় আব্বুর দিকে তাকালো,প্রশ্ন, প্রতিবাদ, অনুরোধ,সব মিশে আছে তার দৃষ্টিতে।কিন্তু সোলেমান খান কেবল মাথা নাড়লেন।লিয়ানা না চাইতেও ধীরে হাত বাড়ালো, আঙুলে ঠাণ্ডা ধাতব আঘাত লাগতেই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।কোনো শব্দ বেরোলো না তার ঠোঁট থেকে।এক নিঃশ্বাসে উঠে দাঁড়ালো সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে।তার পায়ের শব্দ ফাঁকা করিডোরে
প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
বিয়েটা তো ঠিক হয়ে গেলো,এখন কি হবে,কি আছে তার কপালে? কি হবে এর শেষ পরিনতি।
(রাত প্রায় এগারোটা)
ঘর অন্ধকার, শুধু টেবিল ল্যাম্পের হলদেটে আলো। বাইরে রাতের ঝিঁঝিঁর ডাক।হঠাৎ
ঠক ঠক! ঠক ঠক!
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
“লিয়ানা! লিয়ানা! দরজাটা খোল দেখি দাদুমনি
লিয়ানা কিছুক্ষণ চুপ,তারপর ধীর পায়ে দরজার কাছে গিয়ে খুলে দেয়। মুখ ঘুরিয়ে ভেতরে চলে যায়,চোখে ঠান্ডা রাগ।
এই বুড়ো মানুষটার ওপর রাগ করছিস?
কেন? এসেছো, সেটাই বলো,তোমরা যা চেয়েছো তা তো হলই আর কি চাই আমার কাছে?আজকের ঘটনার পর বুঝতে পারলাম জায়ান খান কেন এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।এত স্বার্থপর লোকদের সাথে কিভাবেই বা থাকবেন। এখন তো আমারও নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।কি সুন্দর সবাই হাসিমুখে মেনে নিলো এইসব,একটাবার কেউ আমার মনের কথা জানতে চাইলোনা।
মেয়ে হয়ে জন্মেও ভুল করে ফেলেছি, না পারছি কিছু বলতে, না পারছি সহ্য করতে। যদি পারতাম, জায়ান খানের মতো আমিও ভিন দেশে চলে যেতাম।
দাদিমা ধীরে ধীরে এসে বিছানায় বসেন, লিয়ানার হাত নিজের হাতে নেন।
এই দিকে তাকা, দাদুমনি। আমার কি দোষ বল তো? জানিস তো, তোর বড়ো আব্বু যা বলে, তাই হয়। আমি যদি তখন কিছু বলতাম, আমার কথাও শুনতো না আমার ছেলেটা। কিন্তু বিশ্বাস কর। আমি চাই না এই বিয়েটা হোক। আমি তো চেয়েছিলাম তোকে সারাজীবন এই বাড়িতে রেখে দিতে..আমার বড়ো দাদুভাইয়ের…
বাক্য শেষ করতে না পেরে থেমে যান দাদিমা। চোখে জমে ওঠে জল।
লিয়ানার গলাও বুজে আসে। এক মুহূর্তে আবেগে ভেসে গিয়ে সে দাদিমার পায়ের ওপর শুয়ে পড়ে, কপাল চেপে ধরে কাঁদতে থাকে।
লিয়ানার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দাদুমনি বললেন,
কথায় আছে না,ভাগ্যের লিখন যায় না খন্ডন।
জানিস তো আমি না খুব করে ভাগ্যে বিশ্বাসী।জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে এ সবি যে উপরওয়ালার হাতে।প্রত্যেক মানুষই সাথে করে ভাগ্যে নিয়েই জন্মায়।
তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১১
এখন তোর কপালে ঐ রকস্টার ব্যাটা
নাকি এক ছন্নছারা, রাগী,বেপরোয়া পুরুষ আছে, তা তো তোর ভাগ্যই বলে দিবে রে বোকা মেয়ে,মানুষ চাইলেই কি তার ভাগ্যর লিখন বদলাতে পারে?
যেই পুরুষের পাজরের হাড় দিয়া তোরে আল্লাহ বানাইছে তুই তার ঘরেই যাবি।আর কাঁদিস না।
কে জানে লিয়ানা তার দাদির বলা কথাগুলো শুনতে পেলো কি না,নাকি বুঝতে পারলো।তবে চুপ করে থাকলো কোনো জবাব দিলো না।
