তোমাতেই আসক্ত পর্ব ২৮
তানিশা সুলতানা
বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের জন্য বিখ্যাত। আর সমুদ্রের রেশ ধরে বিখ্যাত হয়েছে এবি হোটেল। দশ তালা বিশিষ্ট এই হোটেল থেকে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় গভীর রাতে। জোছনা রাতে বেলকনিতে বসে সমুদ্রের ঢেউ এর সঙ্গে চাঁদের আলোর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বাংলাদেশে নামি-দামি সকল মানুষ কক্সবাজারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বরাবরই চড়া দামে এবি হোটেল এর রুম বুক করে।
এই হোটেলের মালিক ছিলেন আরিফ রহমান। নিজের সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ এবং শশুরের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে এবি হোটেল বানিয়েছিলেন। বড় শখ করে হোটেল এর নাম দিয়েছিলো এ বি। এ তে আরিফ এবং বি তে বর্ষা। আরিফের প্রথম স্ত্রী আদ্রিতার মা।
বর্ষার বাবা বশির ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। এক কন্যা এবং একটা ছেলে নিয়েই ছিলেন তার সংসার।
ছেলেকে লেখা পড়া করিয়ে বাড়ি গাড়ি করে দিয়েছিলেন৷ এবার মেয়ের পালা।
যখন আরিফ এসে বলেছিলো “বাবা আমি কক্সবাজারে একটা হোটেল দিতে চাই”
বশির দ্বিমত করেন নি। বরং ব্যাংকে যত টাকা গচ্ছিত ছিলো সবই তুলে দিয়েছিলেন। তাতে যখন হলো না ভিটেমাটি সবই বিক্রি করে দিলো।
আদ্রিতার যেদিন জন্ম হয় সেইদিনই হোটেল উদ্ভোদন করা হয়।
তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। প্রথম বছরই হোটেল এর নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহর জুড়ে। লাভ বাড়তে থাকে হু হু করে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আদ্রিতার যখন তিন বছর বয়স তখন আরিফ সাফল্যের দ্বারে পৌঁছে গিয়েছেন। একটা হোটেল তাকে কোটিপতির খাতায় নাম লিখিয়ে দেয়। সিদ্ধান্ত নেয় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি তৈরি করবে। বরাবরের মতো বর্ষা স্বামীর সিদ্ধান্তে সায় জানায়। তাকে উৎসাহ দেয়। আর এটাই ছিলো বর্ষার জীবনের ভুল সিদ্ধান্ত।
আরিফ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি তৈরি করার জন্য জমি খুঁজছিলো। কক্সবাজারে যেহেতু হোটেল দিয়ে লাভবান হয়েছে সেহেতু কক্সবাজারেই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খুললে লাভবান হবে। এমনটাই আশা করে কক্সবাজারে জমি খুঁজতে শুরু করে। এবং হোটেলের সিকিউরিটি সাহায্যে পেয়েও যায়।
জমিটি ছিলো ইমান আলী নামক একটা লোকের। লোকটির একটা মেয়ে ছিলো নাম ইমা।
জমি কেনার সূত্র ধরেই ইমার সাথে পরিচয় হয় আরিফের। মেয়েটি খুব সুন্দর দেখতে ছিলো।
প্রথম দেখায় আরিফের ভালো লেগে যায়।
তারপর তাদের বন্ধুত্ব হয় এবং একটা সময় প্রণয় ঘটে। গোপনে বিয়েও করে নেয় তারা।
বর্ষা অত্যাধিক বিশ্বাস করতো স্বামীকে। কখনোই তার ফোন ঘাটতো না। কখনোই কোনো প্রশ্ন করতো না। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কাজ শেষ হওয়ার পরে সেই ফ্যাক্টরিটির নাম রাখে “আদ্রিতা ফ্যাশন হাউজ” এবং ছোট্ট মেয়েটিই তার উত্তরাধিকারী হবেন এমনটাই উইল করে রাখে। বর্ষা শতবার বারণ করেছিলো। বাবার সম্পত্তি মানেই আদ্রিতার সম্পত্তি। কিন্তু বোকা বর্ষা তখন বুঝতেই পারে নি কি হচ্ছে তার সাথে।
একদিন আরিফ বললো সে সিঙ্গাপুর যাবে৷ সেখানেও একটা ব্যবসায় দ্বার করাবে। দেশ বিদেশে সব জায়গায় তিনি পরিচিতি পেতে চায়। এবারেও কোনো বাঁধা দেয় নি বর্ষা। আরিফ চলে যায় সিঙ্গাপুর।
এভাবেই কিছু বছর চলে যায়। আরিফ দেশে ফিরেছে কিছু মাস হলো। কক্সবাজারের ফ্যাক্টরি এবং হোটেল দেখতে গিয়েছে। সেখানে মাসখানেক থাকবে এমনটাই বলেছে।
আদ্রিতার দশতম জন্মদিন চলে এসেছে। রাত বারোটার পরেই মেয়েটার দশ বছর পূর্ণ হবে। বর্ষা চিন্তা করে
“আরিফকে সারপ্রাইজ দিবে”
মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার চলে যাবে। ওদের দেখে আরিফ নিশ্চয় ভীষণ খুশি হবে। এবং এক সাথে সমুদ্রের পারে বসে কেক কাটবে।
যেই ভাবা সেই কাজ।
ঘুমন্ত আদ্রিতাকে তুলে রাতের বাসেই কক্সবাজারে রওনা হয়।
পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোরের আলো ফুটে ওঠে। বর্ষা মেয়েকে নিয়ে এবি হোটেলে উঠে। কাউন্টারে যেতেই স্টাফরা সালাম দেয় এবং জানায় “স্যার ২০২ নং কক্ষে আছে।
বর্ষা মুচকি হেসে চাবি নিয়ে চলে যায়।
২০২ নং কক্ষের দরজা খুলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক অবিশ্বাস্যনীয় কাহিনি।
কেঁপে ওঠে বর্ষা। দুই হাতে চেপে ধরে ছোট্ট আদ্রিতার চোখ দুটো। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে নিজের আঁখি পল্লবও বন্ধ করে নেয়।
অপ্রস্তুত আরিফ তারাহুরো করে উঠে বসে। ইমা গায়ে চাদর জড়িয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে
“এই কে আপনি? নক না করে কক্ষে ঢুকছেন কেনো?
বর্ষা জবাব দিতে পারে না। মাথা নুয়িয়ে থরথর করে কাঁপছে থাকে। আদ্রিতা নিজের চোখের ওপর থেকে মায়ের হাত সরানোর চেষ্টা চালায়। বিরক্তির স্বরে বলে
” মাম্মা চোখ ধরেছো কেনো?
সারপ্রাইজ তো পাপাকে দিবো? পাপার চোখ ধরবে।
আরিফ নিজের গায়ে শার্ট জড়িয়ে এগিয়ে আসে আদ্রিতার পানে। ভয়ার্তক স্বরে বলে
“বর্ষা তুমি এখানে?
বর্ষা চোখ খুলে। আদ্রিতার চোখের ওপর থেকেও হাত সরিয়ে নেয়। বাবাকে পেয়ে যেনো সর্গ পেয়ে গিয়েছে আদ্রি। এমনিতে বছরে একবার কি দুইবার বাবার দেখা পায় সে। তবে কথা হয় প্রতিদিন। ভিডিও কলে বাবা মেয়ের দারুণ খুনসুটি চলে ঘন্টা খানিক সময় ব্যয় করে।
লাফিয়ে বাবার কোল দখল করে নেয়। দুই হাতে গলা জড়িয়ে চুমুতে ভরিয়ে দেয় বাবার মুখশ্রী। শতবার ভালোবাসি বাক্যটা আওড়ায়।
আরিফ নিত্য দিনের মতো মেয়ের আদরে সায় জানাতে পারে না। মনের মধ্যে ভয় জেঁকে ধরেছে তার। ক্ষণে ক্ষণে বর্ষার পানে তাকাচ্ছে।
বোকাসোকা বর্ষাকে আজকে অন্য রকম লাগছে।
” এই গ্রেস এটাই তোমার সিঙ্গাপুর? এখানেই তোমার কাজ।
তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে বর্ষা।
ইমা ওয়াশরুম ঘুরে এসেছে। জামাকাপড় ঠিকঠাক করেছে। সে আরিফের পাশে দাঁড়ায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেয় বর্ষাকে।
আরিফ নিজের সাফাই গাওয়ার স্বরে বলে
“বর্ষা তুমি
জিহ্বা গহ্বরে আসা কথাখানা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে বর্ষা পূর্ণরায় বলে ওঠে
” তুমি আমায় ঠকাও নি। বিশ্বাস ভেঙেছো। তোমার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই আমার।
তোমার যেটা ভালো মনে হয়েছে সেটাই করেছো।
আমার মেয়েটা ছোট। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমি চাই না সে তোমায় ঘৃণা করুক।
এনজয় করো। আমরা আসছি।
নিজের বক্তব্য শেষ করে আদ্রিতার হাত ধরে বর্ষা। মিষ্টি হেসে বলে
“মাম্মাম সমুদ্র দেখে আসি চলো।
ভোরে সমুদ্রের ঢেউপ্রচুর ঝিনুক নিয়ে আসে। আমরা কুড়িয়ে নিবো সব।
আদ্রিতা নেমে পড়ে বাবার কোল থেকে। মায়ের হাত ধরে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দু পা এগিয়ে পূণরায় বলে ওঠে
” পাপা যাবে না?
“এই আন্টিটার সাথে বিজনেস ডিল করছে। ফাইনাল করেই চলে আসবে আমরা যাই চলো।
বর্ষা আদ্রিতাকে নিয়ে চলে যায়। চিন্তিত আরিফ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে ফ্লোরে। ইমা বিরক্ত স্বরে বলে
” তোমার বউ মেনে নিয়েছে৷ তুমি কেনো আপসেট হচ্ছো?
“বর্ষা আমায় প্রচন্ড ভালোবাসে। অসম্ভব বিশ্বাস করে। তার বিশ্বাস ভেঙেছি আমি। বর্ষা বাঁচবে না ইমা। আমার মেয়েটাকে মা হারা করে চলে যাবে বর্ষা।
পুরোনো কথা গুলো মনে করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আরিফ। হাতে থাকা ফটোফ্রেম লুকিয়ে ফেলে তোষকের নিচে। ইমা দেখে ফেললে ঝামেলা করবে। বাচ্চার সামনে গালাগালি করবে৷
অশান্তি সহ্য করতে করতে অতৃপ্ত হয়ে উঠেছে সে৷ এবার একটু শান্তির খোঁজে কোথাও একটা চলে যেতে ইচ্ছে করে।
আজকে আদ্রিতার ফোন কল তার অতৃপ্ত হৃদয়কে নতুন চিন্তায় জর্জরিত করে তুলেছে। কলিজার টুকরো মেয়েটা ভালো নেই৷ আতিয়া বেগম তাকে ভালো রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
কথা রাখতে পারে নি সে।
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আদ্রিতা। এলোমেলো চুল গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোটা বিছানা জুড়ে। ডান পাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে। আঘাত প্রাপ্ত হাত খানা গুটিয়ে রেখেছে। বালিশের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে ঠোঁট দুটো ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। সেই ফাঁকা দিয়েই লালা পড়ছে। মাঝেমধ্যে মৃদু স্বরে নাক ডাকছে। আবার বিরক্ত স্বরে বিরবির করে কাউকপ বকছে।
আবরার আদ্রিতার সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। পায়ের ওপর পা তুলে গভীর মনোযোগে রমনীটিকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
নাকের ওপর তেল জমে চিকচিক করছে। কপালের ঠিক মাঝ খানে বিশাল আকৃতির ব্রণের দেখা মিলেছে। আজকেই বোধহয় পোঁটলাপুটলি বেঁধে আগমন ঘটিয়েছে। গোটা কপাল জুড়ে রক্তিম রং ধারণ করেছে।
আবরার বিরক্ত হয়। ডান হাতে কপাল চুলকে মনে মনে কঠিন কিছু গালি আওড়ায় ব্রণের উদ্দেশ্যে। ইচ্ছে করছে রিভলবার দিয়ে ব্রণটাকে শুট করতে। বা ধাঁড়ালো চা/কুর সাহায্যে কুটি কুটি করে ক/টে ফেলতে। কতো বড় সাহস। আবরার তাসনিন এর বউয়ের মুখে বাসা বেঁধেছে।
আদ্রিতা নরেচরে ওঠে। আঘাতপ্রাপ্ত হাতখানা খাটের ওপর রাখে শক্ত করে। একটু ব্যাথাও পেলে নিশ্চয়। কপাল কুঁচকে ঠোঁট গোল করে “উফফ” শব্দ টা আওড়ায়। এবং পরপরই নিরব হয়ে যায়। আবরার হাতে থাকা মলম খানা হতে কিছুটা মলম বের করে লাগিয়ে দিতে থাকে হাতে।
“মিউ, মিউ”
খাটের ডান পাশ হতে মৃদু শব্দে ডেকে ওঠে এ্যানি। খাটে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে সে। তবে প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছে। লালা রংয়ের ড্রিম লাইটে এ্যানির চোখ দুটো জ্বলছে।
আবরার ভ্রু কুচকে ফেলে। এমনিতে তো লাফাতে লাফাতে গোটা বাড়ি মাথায় তুলে রাখে আর এখন খাটে উঠতে পারছে না?
আশ্চর্য ব্যাপার তো।
“এ্যানি কাম হেয়ার।
নিজের কন্ঠস্বর শুনে নিজেই বিরক্ত হয় আবরার। এভাবে ডাকলে এ্যানি তো আসবেই উল্টে ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাবে। পরপরই নিজের কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালায় তবে ব্যর্থ হয়। নিত্যদিন এই ভঙ্গিমায় কথা বলতে বলতে এটাই রুলস হয়ে গিয়েছে। চাইলেও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। গম্ভীর মুখশ্রীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কন্ঠ খানাও গম্ভীর হয়ে গিয়েছে।
সিয়াম গোল গোল নয়ন ঘুরিয়ে সব গুলো বন্ধুর পানে তাকায়৷
আমান কৌতুহল স্বরে বলে
” আদ্রিতা বাদ দিয়ে এ্যানিকে ডাকছে কেনো?
সিয়াম চাটি মারে আমানের মাথায়। বিরক্ত স্বরে বলে
“এই জন্যই তুই সিঙ্গেল। শালা নির্বোধ বোকা হনুমান।
এ্যানি কে?
আদ্রিতার বাচ্চা৷ তাহলে আবরার কে? এ্যানির বাবা।
আবরার চাচা বাচ্চার সামনে রোমাঞ্চ করবে না কি? প্রাইভেসির দরকার আছে না?
এখুনি এ্যানিকে ধরে চোখে পট্টি বেঁধে দিয়ে রোমাঞ্চ শুরু করবে। তুমুল রোমাঞ্চ।
ফালতু না বকে ভালো করে কান লাগা গাঁধার বাচ্চা। একটা পয়েন্টও মিস করা যাবে না।
আমান অনবরত মাথা নেরে পূণরায় দরজায় কান ঠেকায়।
এ্যানি আসে না আবরারের নিকটে। অগত্য আবরার নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নেয় এ্যানিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদ্রিতার পাশে নামিয়ে দেয়৷
ছোট্ট প্রাণীটি নিজের মালিককে পেয়ে যেনো খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছে। মুহুর্তেই গা এলিয়ে দেয় আদ্রিতার বুক ঘেসে। দুই পা দিয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা চালায়। জিহ্বা বের করে চেটে দেয় মালিক এর গাল। মিউ মিউ আওয়াজ তুলে উপস্থিতি জানায় দেয়। ঘুমে কাঁদা আদ্রি বুঝতেও পারে না বাচ্চার আগমণ।
এই সুন্দর দৃশ্য খানা ক্যামেরা বন্দী করে নেয় আবরার।
অতঃপর কিছু একটা মনে পড়ে। ফোন খানা বিছানার পাশে রেখে মাথা চুলকে দরজার পানে পা এগোয়৷ খট করে দরজা খুলে দিতেই হুরমুরিয়ে একটার ওপর আরেকটা পড়ে যায় আমান আহাদ ইভান এবং সিয়াম।
সবার নিচে পড়েছে সিয়াম। সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে
তোমাতেই আসক্ত পর্ব ২৭
“ওরেহহহহ আল্লাহ
গেলো আমার কোমর
গাঁধার দল আমায় মে/রে ফেললো।