তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৩

তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৩
তানিশা সুলতানা

অহনা কন্যা সন্তানের জননী হয়েছে। ফোনের স্কিনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আতিয়া বেগম। তার সেই ছোট্ট মেয়ে। যে কি না সর্বক্ষণ মায়ের আঁচল ধরে ঘুর ঘুর করতো। সেই মেয়েটি মা হয়েছে। চান্দের মতো ফুটফুটে একটা বাচ্চা সে হাত পা নেরে নেরে খেলছে। তারই পাশে ক্লান্ত ভঙ্গিমায় শুয়ে আছে আতিয়া বেগম এর কলিজার টুকরো অহনা।

বহু বছর হয়ে গেলো মেয়েটাকে সামনে থেকে দেখা হয়। বুকে জড়িয়ে আদর করা হয় না। কলেজে উঠতেই সম্পর্কে জড়িয়েছিলো পড়ে সুইজারল্যান্ড এর বাসিন্দা এক ছেলের সাথে। বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তার সেই সিদ্ধান্ত হাফিজুর চৌধুরী কিংবা আতিয়া কেউ ই মেনে নেয় না। অগত্য আঠারো বছর পেরুতেই সেই ছেলের সাথে পাড়ি জমায় সুইজারল্যান্ড। ভুলে যায় মা এবং দাদাকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আতিয়া বেগম এর দুটো সন্তান দুজনই তার থেকে বহু বহু মাইল দূরে। মাঝেমধ্যে একটু আতটু ফোনে কথা বলে এই যাহহহ৷ তারও ইচ্ছে করে ছেলেমেয়ে নিয়ে এক ছাঁদের তলায় বাস করতে৷ ঘুম থেকে উঠে ছেলেমেয়ের মুখ দেখতে। মা ডাক শুনতে। টুপ করে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে ফোনের স্কিনে। প্রাণ ভরে দোয়া করতে ভুলে না মেয়ে এবং নাতনিকে। তখনই ফোন বেজে ওঠে আতিয়া বেগম এর ফোন।
কন খানা রিসিভ করে কানে তুলতেই ভেসে আসে ছেলের গম্ভীর কন্ঠস্বর
“আম্মু আমি টিকিট পাঠিয়েছি। কাল সকাল ছয়টায় তোমার ফ্লাইট। আর কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আতিয়া। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে মলিন স্বরে বলেন

“এতিম মেয়েটাকে ফেলে রেখে আমি যেতে পারবো না। তিনটে মাস অপেক্ষা কর। আদ্রির বাবা দেশে আসুক। তার কাছে মেয়েকে বুঝিয়ে দিয়ে আমি চলে যাবো তোদের কাছে।
“ফা***কিং সিমপ্যাথি বিরবির করে আওড়ায় আবরার। এবং বলে
“দুটো টিকিট পাঠিয়েছি।
একটু অবাক হয় আতিয়া বেগম৷ তার ছেলে দুটে টিকিট পাঠিয়েছে? ঠিক শুনলো?আবরার আদ্রিকে নিতে চাচ্ছে তার কাছে?
” আদ্রি যেতে না চাইলে
“কান ধরে টেনে নিয়ে আসবে।
ব্যাসস কল কেটে যায়৷ মৃদু হাসে আতিয়া বেগম। অবশেষে আদ্রি আর আবরার মুখোমুখি হবে।

ভার্সিটির মাঠে তিন বান্ধবী এবং এক বন্ধুর সাথে বসে আছে আদ্রি। মনটা তার একদমই ভালো নেই। সর্বক্ষণ ঠোঁটের কোণো হাসি লেগে থাকা আদ্রির মুখটা আজকে মলিন। বকবকের রাণী মুখে কুলুপ এঁটে আছে।
শুভ ইতোমধ্যেই কয়েকবার আদ্রিকে খুঁচিয়েছে। “কি হয়েছে” জিজ্ঞেস করতে করতে ক্লান্ত সে। তবুও আদ্রিতা মুখ খুলছে না। হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে দূরে ঘাসের ওপরে খেলতে থাকা এ্যানিকে দেখছে৷ সে যেখানেই যায় এ্যানিকে সাথে নিয়েই যায়। চৌধুরী বাড়ির কেউই তেমন পছন্দ করে না। সুযোগ খোঁজে ফেলে দেওয়ার।

“এই আদ্রি ওই দেখ তোর আসিফ আদনান আসছে আমাদের দিকেই।
চট করে মাথা তোলে সে। অনবরত দৃষ্টি ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। ভার্সিটির গেইটের ভেতরে ঢুকতে থাকা লম্বা এক যুবককে দেখে নিমিষেই মলিন ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। চুলের ভাজে হাত ঢুকিয়ে ঠিকঠাক করে নেয়। শুকনো ঢোক গিলে “মাশাআল্লাহ” আওড়ায়।
এই যুবককে ভালোবাসে আদ্রিতা। একটু বেশিই।
তার স্বয়নে স্বপনে শুধু এই মানুষটিই রয়েছে। বলা বাহুল্য এই মানুষটিকে দেখার জন্য ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মাঠে বসে থাকে। কিন্তু কখনোই তার সামনে দাঁড়ানোর সাহস হয় নি৷ কখনোই চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার কথা জানাতে পারে নি সে। বহুবার ভেবেছে আজকে প্রপোজ করেই ফেলবো তবে সাহস জোগাতে পারে নি।
স্মৃতি পূণরায় বলে ওঠে

“আদ্রি এটাই সুযোগ আজকে মনের কথাটা বলে দে তাকে।
জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় আদ্রিতা। দৃষ্টি সরায় আসিফের পান থেকে। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা চিন্তা করে। পরপরই চোখ খুলে পূণরায় তাকায় আসিফের পানে। ওই তো এ্যানির কাছে এসে থামলো। হাঁটু মুরে বসে ডান হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো এ্যানিকে। এবার বুকের সাথে চেপে ধরে চুমু খেলো ঠোঁট দাবিয়ে। গলা শুকিয়ে আসে আদ্রিতার। যেনো চুমুটা এ্যানির নয় তার গালেই পড়েছে। লজ্জায় কান গরম হয়ে ওঠে। হাঁসফাঁস করতে করতে দাঁড়িয়ে পড়ে। আদ্রিতার দাঁড়ানো দেখে বাকিরাও দাঁড়ায়। এশা বলে

” কি হলো আদ্রিতা? কি ভাবছিস?
আদ্রিতা জবাব দেয় না। শুভ কপাল কুঁচকে বলে
“আদু ব্ল্যাশ করছিস কেনো তুই? স্বপ্নে কি আসিফ আদনানকে নিয়ে কক্সবাজারে চলে গেলি না কি?
বাকিরা হেসে ওঠে। আদ্রি চোখ পাকিয়ে তাকায় শুভর পানে। তখনই ভেসে আসে হাসোজ্জল সুন্দর এক কন্ঠস্বর
” আদ্রিতা
বিড়ালটা তোমার?

স্মৃতি খোঁচা মারে আদ্রিতাকে। ধীরে ধীরে তাকায় আসিফ আদনানের পানে। বুক কাঁপছে তার। লোকটার শরীর থেকে ভেসে আসছে জেন্টস পারফিউম এর সুঘ্রাণ। কেমন মাতাল মাতাল লাগছে। ইচ্ছে করছে সাদা পানজাবিতে নাক ডুবিয়ে সমস্ত ঘ্রাণ শুষে নিতে।
আদ্রির থেকে জবাব না পেয়ে মুখের সামনে তুড়ি বাজায় আসিফ। চমকায় আদ্রিতা।
স্মৃতি বলে ওঠে
“একচুয়েলি ভাইয়া। সে আপনাকে ভালোবাসে। তাই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে।
কপাল কুঁচকায় আসিফ। আদ্রিতা চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। ইসস এভাবে মুখে ওপর বলতে হয়? এবার কোন দিক দিয়ে দৌড় দিবে আদ্রিতা? কোন দিকে পালাবে?
পরপরই আসিফ হেসে ওঠে।
আদ্রিতার কপালে দুই আঙুলে টোকা দিয়ে বলে

” ভালোবাসলে বলে দিতে হয়৷ মনের মধ্যে কথা জমাতে নেয়। পঁচে যায়।
সকলেই “ওহহহ হোওওও” বলে ওঠে। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে আদ্রিতা। ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক করে ঢুকে পড়ছে।
আসিফ এ্যানিকে নামিয়ে দেয়। তারপর আদ্রিতার ডান হাত খানা মুঠো করে ধরে ওপরে তোলে। স্মৃতির থেকে কলম টেনে নিয়ে নিজের ফোন নাম্বার খানা লিখে দেয়। এবং সাথে সাথেই হাত ছাড়ে।
আদ্রিতা বড় বড় নয়নে তাকিয়ে আছে আসিফের পানে। লোকটা তার হাত ধরলো?
“কল করিও।
অপেক্ষায় থাকবো।
তারপর?
তারপর আসিফ আদনান চলে যায় ভার্সিটির ভেতরে। পেছনে রেখে যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রিতার এবং তার বন্ধুদের।
এতেটাই সহজ? মানে আসিফ আদনানও পছন্দ করতো আদ্রিতাকে? বাহহহহ

বাড়ি ফিরে দেখতে পায় আতিয়া বেগম বড় বড় দুটো লাগেজ গুছিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে আছে। দেখতে তাকে বড়ই উদাসীন লাগছে। বড় মা মেঝ মা কি মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে? বুকটা কেঁপে ওঠে। চিন্তিত আদ্রিতা এ্যনিকে কোল থেকে নামিয়ে দৌড়ে গিয়ে বসে পড়ে আতিয়া বেগমের পাশে। এবং দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে শুধায়
” মা কোথায় যাচ্ছো তুমি? আমাকে কেনো বললে না? আমি যাি আর একটু পরে আসতাম তাহলে কি আমাকে রেখেই চলে যেতে?
আতিয়া বেগম হাসে। আদ্রিতার হাতের ওপর হাত রাখে।
“তোর জন্যই বসে আছি। তোকে নিয়ে যাবো।
” কোথায়?
“সুইজারল্যান্ডে
ললাটে ভাজ পড়ে আদ্রিতার। ছেড়ে দেয় আতিয়াকে।
” কেনো? তোমার ছেলের কাছে?
“অহনার বাবু হয়েছে দেখতে।
” কতোদিন থাকবো?
“দশ পনেরো দিন।
” সত্যি তো?

“হুমম এখন যা চট করে জামা পাল্টে আয়।
” হুমম
আদ্রিতা উঠে পড়ে। কয়েকপা এগোতেই এ্যানির কথা মনে পড়ে। সে চলে গেলে এ্যানিকে রেখে যাবে কার কাছে? মুহুর্তেই পেছন ঘুরে প্রশ্ন করে
“মা এ্যানি?
” সেও যাচ্ছে আমাদের সাথে।
আদ্রিতার খুশি আর দেখে কে? সে নাচতে নাচতে চলে যায় রুমে। হাতের নাম্বার খানা খাতায় লিখে ফেলে তারপর বিছানায় তাকাতেই দেখতে পায় তার জামাকাপড় রাখা সেখানে।
মাঝেমধ্যে আদ্রিতার মনপ নয় আতিয়া বেগমকে কয়েকটা চুমু দিতে। এই মানুষটা এতো ভালো কেনো?
এই যে আদ্রিতার পরনের জামাকাপড়ও ঠিক করে রেখেছে।
মনে মনে মাকে হাজারবার ভালোবাসি ভালোবাসি বলতে বলতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। মিনিট দশেকের মতো সময় নিয়ে তৈরি হয়ে নেয়। এবং এ্যানিকেও তৈরি করায়।

অনবরত বেজে চলেছে কলিং বেল। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে আবরার। মনিটরে চলছে ইংলিশ মুভি। অতি মনোযোগ সহকারে মুভির মজা উপভোগ করছিলো সে।
মনিটরে মুভি পজ করে খাট হতে নেমে পড়ে। শক্তপোক্ত হাতে এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করতে করতে কক্ষ হতে বের হয়৷ ততক্ষণে সিয়াম দরজা খুলো দিয়েছে। একে একে ভেতরে ঢুকে পড়েছে চারজন পুরুষ এরা আবরারের বন্ধু। নিহান, আমান, ইভান, আহাদ।
তারা ভেতরে ঢুকে একটুও নিরব নেই। প্রথমেই সিয়ামকে চেংদোলা করে ধরেছে। এবং একেরপর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। মূলত প্রশ্নের সঠিক জবাব না পেলে তাকে নামানো হবে না।
সিয়াম চিল্লিয়ে ওঠে এবং বলে

“আবরারের বোনকে পছন্দ হয়েছে আমার। এবং আবরার শুধুমাত্র আমার জন্য ওর বোনকে সুইজারল্যান্ড আনছে। এই তো আর দুই ঘন্টা পরেই ল্যান্ড করবে।
সিয়ামকে সোফায় শুয়িয়ে দেয় ওরা।
ঘন্টা খানিক আগে ওদের চ্যাট গ্রুপে সিয়াম বলেছে “গাইস আবরার আমাকে ভীষণ ভালোবাসে”
ব্যাসস এই টুকুই। মুহুর্তে ওরা যে যার কাজ ফেলে ছুটে এসেছে আবরারের বাসায় রহস্য উদঘাটন করতে।
আবরার ওদের কার্যকলাপ সবটাই দেখে। পরপরই হাত ঘড়িতে নজর রাখে। তিনটে বেজে চার মিনিট। এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে।

লং জার্নি করার অভ্যাস নেই আদ্রিতার। আর প্লেন ভ্রমণ তো এই প্রথমবার। অনেক এক্সাইটেড ছিলো। ভেবেছিলো মেঘ দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবে সুইজারল্যান্ড। কিন্তু গোটা জার্নি ঘুমিয়েই পার করেছে। প্লেন ল্যান্ড করার পরপরই ঘুম ছুটেছে। এবং তখন থেকেই আক্ষেপ করছে।
লাগেজ হাতে পাওয়ার পরে সেটা সংগ্রহণ করে এগোতেই দেখা মেলে আবরারের। দেখেছেন আতিয়া বেগম। আদ্রিতার সেদিকে খেয়াল নেই। সে ব্যস্ত এ্যনিকে এয়ারপোর্ট দেখাতে।
“ইসস রে এ্যানি। যদি তোর বাবা আসিফ আদনানের সাথে এখানে আসতে পারতাম। তাহলে তোর জন্য নতুন একটা ভাই বোন নিয়ে ফিরতে পারতাম।

কথাটা বেশ জোরেই বলেছে। এবং কথা শেষ হওয়ার পর মুহুর্তেই ধাক্কা খায় শক্তপোক্ত কিছুর সাথে।
বিরক্ত আদ্রিতা কপাল কুঁচকে তাকায়। মুহুর্তেই আঁখি পল্লব বড় বড় হয়ে যায়। এটা কি রে ভাই? এতো লম্বা মানুষ হয়? আর এভাবে কেনো তাকাচ্ছে? ধাক্কা খেলার বলে? বাপ রে বাপ এমন ভাবে তাকিয়েছে যেনো আদ্রিতাকে কাঁচা গিলে খাবে একটুও ঢেকুর তুলবে না।
দৈত্য যেনো কোনো একটা। শুকনো ঢোক গিলে আদ্রিতা। পাশে তাকাতেই দেখতে পায় আতিয়া বেগম দৈত্যটার হাত জড়িয়ে কাঁদছে। চতুর আদ্রিতা বুঝে ফেলে এটূই হচ্ছে আবরার তাসনিন।
তাই সে একটু হাসার চেষ্টা করে এক হাত কপালে তুলো সেলুট করার পরে করে বলে

তোমাতেই আসক্ত পর্ব ২

” আসসালামু আলাইকুম বড় ভাই।
ভালো আছেন? আমিও ভালো আছি। শরীর ভালো তো? আমারও ভালো। তাহলে চলুন যাই।
বলতে বলতে আবরারকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আবরার বিরবির করে আওড়ায় “আসিফ আদনান”

তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৪