তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৫০
তানিশা সুলতানা
বেলকনির রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে আদ্রিতা। আসমানে মেঘ জমেছে যখন তখন বৃষ্টি ঝরবে। ঠিক তেমনই ভাবে মেঘ জমে আছে আদ্রিতার হৃদয়ে।
পনেরো ষোল ঘন্টা হবে এক ফোঁটা পানিও পেটে পড়ে নি। তার সামনে হাজার রকমের খাবার সার্ভ করা হয়েছে। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করে নি। আবরার তাসনিনকে না দেখা ওবদি গলা দিয়ে খাবার নামবে না।
ওর হাতে ছোট্ট একটা ফোন। এই ফোনটি চুরি করে এনেছে টনির কক্ষ থেকে। তিন ঘন্টা যাবত কয়েকশো বার কল করে আবরারের নাম্বারে। কিন্তু বার বার ফোন বন্ধ বলছে।
আদ্রিতার ভয় হয়। ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছে “হারিয়ে ফেললো বোধহয় আবরারকে। আর কখনোই দেখতে পাবে না গম্ভীর ওই মুখ খানা। আর চুমু খাবে না বেপরোয়া ভঙ্গিমায়। কষ্টে জর্জরিত করে তুলবে না আদ্রিতাকে। বলবে না লাগামহীন কথা।”
যতবারই এই কথা গুলো মনে পড়ছে ততবারই বুক খানা ফেঁটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যেতে ওই মানুষটার কাছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অসহায় ভঙ্গিমায় বলতে ইচ্ছে করছে
“এই বিরহ সহ্য করতে পারছে না আমি।
প্লিজজ দূরে সরিয়ে দিয়েন না আমায়। আপনাকে ছাড়া বাঁচতে কষ্ট হয়।
ভাবতে ভাবতেই পূণরায় কল করে আবরারের নাম্বারে। এবারেও বন্ধ বলে।
আদ্রিতা আঁখি পল্লব বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। বিরবির করে আওড়ায় প্রিয় গানের দুটো লাইন
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আমি তোমার সাথে আমাকে খুঁজে পাই
এখনো যত্ন করে যাই
যদিও তুমি বহুদূরে
আমি আজও পাগল তোমার ওই প্রেমে
গেছি হারিয়ে রাতের আকাশে
তবে কি কাহিনি শেষ আমাদের?
আমি ভাবি যদি আবার ছুঁতে পারতাম তোমাকে
স্বপ্ন বা সত্যিই হোক
এ দুরত্ব শেষ হয়ে যেতো যে
গান শেষ হতেই দু ফোঁটা অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ে আদ্রিতার দুচোখ বেয়ে।
বাইরে থেকে আওয়াজ আসে
” আদ্রিতা চেঞ্জ করে নাও। আমরা বেরবো।
ইমা বেগম বললো কথা খানা। এই কন্ঠ চেনে আদ্রিতা। চিনবে না? গতকাল এই বাড়িতে মহিলাটি এসেছিলো। আদ্রিতা নিজের চোখে দেখেছে তাকে বাবার সঙ্গে। হেসে হেসে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলো। দুজন এক সাথে খাবার খেলো। কতো ভালোবাসা তাদের। আদ্রিতা অভিশাপ দেয় না। বরং দোয়া করে
“আল্লাহ তাদের ভালো রাখুক। আদ্রিতার মতো এতিম যেনো ওনাদের ছেলেমেয়ে না হয়। বাবা মা ছাড়া বড় হওয়া বড্ড যন্ত্রণার।
হাসপাতালের পাশেই বিশাল বড় ফুটবল মাঠে। সেই মাঠে এক খানা হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে। আবরার তাসনিন হোটেল থেকে বেরিয়ে নিজের লেম্বারগিনিতে বসে পড়ে। সিয়ামকে দুজন গার্ড ধরে এনে গাড়িতে বসায়।
হাঁটাচলা করতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। ডাক্তার ছাড়তে চাচ্ছিলো না। কিন্তু আবরার জোর করে রিলিজ করিয়েছে।
দশ মিনিটের মধ্যেই গাড়ি খানা হেলিকপ্টারের কাছাকাছি গিয়ে থামে। আবরার নিজে নেমে সিয়ামকে নামায়৷ এখানেও কিন্তু সংখ্যক মানুষ রয়েছে৷ তারা সিয়ামকে হেলিকপ্টারে বসাতে সাহায্য করে।
দুজন বসতেই হেলিকপ্টার উড়তে শুরু করে। একদম প্লেন এর কাছাকাছি গিয়ে থামে।
আদ্রিতা প্লেন এর সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। তখনই হেলিকপ্টারের আওয়াজ পায়। মন বলে “এখানে আবরার এসেছে” কিন্তু মস্তিষ্ক বলে “ধুর সে কি করে জানবে?”
মন এবং মস্তিষ্কের যুদ্ধের মাঝেই ইমা বেগম চাপা স্বরে বলে
“দাঁড়িয়ে পড়লে কেনো? পেছনে আরও মানুষ রয়েছে।
আদ্রিতা হেলিকপ্টারের পানে এক পলক তাকিয়ে উঠে পড়ে। নিজের জন্য বরাদ্দকৃত সিটে গিয়ে বসে। তার পাশে বসে ইমা বেগম। আরিফ তার দুটো সন্তানকে নিয়ে পেছনের সিটে বসেছে। আর টনি অন্য সিটে।
আদ্রিতা প্লেন এর জানালা দিয়ে আশপাশটা দেখার চেষ্টা করে তবে ব্যর্থ হয়।
হঠাৎ তার নাকে শুমুখ পারফিউম এর ঘ্রাণ আসে। এই পারফিউম আবরার ব্যবহার করে। এই সুঘ্রাণ শুধুমাত্র আবরারের গায়েই পাওয়া যায়। আদ্রিতার কলিজা লাফিয়ে ওঠে। চাতক পাখির মতো এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে খুঁজতে শুরু করে। মনে মনে বলে
” ইয়া আল্লাহ আমার মানুষটির সঙ্গে একটা বার দেখা করিয়ে দিন। একটা বার তার মুখ খানা দেখতে চাই।
আদ্রিতাকে ছটফট করতে দেখে ইমা বেগম ধমকে বলে
“চুপচাপ বসো। এমন করছো কেনো?
তোমার আবরার তাসনিন এখানে নেই। আর আসবেও না।
আদ্রিতা মৃদু হেসে বলে
” আসবে। আমার আবরার আসবে।
ইমা বেগম বলে
“অভার কনফিডেন্স ভালো নয়। চব্বিশ ঘন্টা হয়ে যাবে তোমায় তুলে এনেছে। এসেছে সে?
আদ্রিতা মাথা নিচু করে ফেলে। বিরবির করে বলে
” আসবে উনি আসবে।
আসবে
আসবে আসবে
আসতেই হবে। হবে হবে হবে
ইমা বেগম শোনো না আদ্রিতার কথা। সে তার মতো ফোন দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরে। ইতোমধ্যেই বিমানবালা হুশিয়ার দিয়েছে এখনই প্লেন চলতে শুরু করবে।
আদ্রিতা সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। বড্ড ক্লান্ত লাগবে। আবরার আসছে না কেনো এই টেনশনে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে একটু ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়।
প্লেন এর দুটো সিট দখল করে ঘুমিয়ে আছে আদ্রিতা। একটা সিটে জরসরো হয়ে বসে আছি ইমা। যখন তখন আদ্রিতা লাথি মেরে দিবে আর সে ধপাস করে পরে যাবে নিচে। তার ইচ্ছে করছে একটা থাপ্পড় মেরে ঘুম ছুটিয়ে দিতে। কিন্তু প্লেন এ আবরার থাকতে পারে ভেবে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে। বলা বাহুল্য ইমা বেগম মনে মনে বেশ ভয় পেয়ে আছে।
আদ্রিতাদের সিটের পাশাপাশি সারির তিন নাম্বার সিটে বসে আছে আবরার। ইচ্ছে করেই এই সিট বেছে নিয়েছে। যাতে দেখতে পারে তার পাখিকে। সিয়াম পাশের সিটে ঘুমিয়ে আছে। তার মাথা আবরারের কোলে। ঘুমন্ত আদ্রিতাকে বেশ অনেকটা সময় নিয়ে দেখে আবরার। এক পর্যায়ে সামান্য নরে ওঠে আদ্রিতা। আবরারের কপালে ভাজ পড়ে। চিন্তিত দেখায় মুখ খানা। ডান হাত দিয়ে কপাল চুলকে কিছু একটা ভাবে। তারপর নোটপ্যাড হাতে নেয়। গভীর মনোযোগ দিয়ে ইংরেজিতে কিছু একটা লিখে। লেখা শেষ হতেই শুকনো কাশি দেয়। ইমা বেগম চমকায়৷ কাশির আওয়াজটা পরিচিত মনে হয়৷ তাই এদিক ওদিক নজর ফিরিয়ে খুঁজতে থাকে। অবশেষে পেয়েও যায় দুটো সিট পরে। উনি তাকাতেই আবরার নোটপ্যাড দেখায়। যেখানে লেখা ছিলো
“আমার বউ পড়ে গেলে বা ব্যাথা পেলে। গোটা প্লেন তছনছ করে ফেলবো। বি কেয়ার ফুল
ইমা বেগম আবরারের থেকে নজর ফেরায়। নিজের কপালে দুই চারটা থাপ্পড় মেরে বিরবির করে বলে
” কোন দুঃখে যে এই পাগলের বউকে কিডন্যাপ করেছিলাম। আল্লাহ এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দিন।
আদ্রিতার পেটের ওপর হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে। যাতে নারাচরা করলেও পড়ে না যায়। এটা দেখে হাসে আবরার। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে নেয় আরিফ এবং তার দুটো সন্তানকে। একটা মেয়ে আরেকটা ছেলে। মেয়েটার বয়স ১১-১২ হবে। আর ছেলেটার পাঁচ ছয় বছর৷ বাবার সঙ্গে গল্প করছে তারা।
চোয়াল শক্ত করে ফেলে আবরার। বিরবির করে বলে
“গড প্রমিজ পাখি
তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৪৯
তোমাকে যারা এতিম করেছিলো। তোমার মা যাদের জন্য দুনিয়া ছেড়েছে। তাদের বাচ্চাদের দিয়ে আমি রাস্তায় বসিয়ে ছাড়বো। আবরার তাসনিন ছেড়ে দিবে না কাউকেই।