তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৬৩

তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৬৩
তানিশা সুলতানা

“আমান ভাবছি একটা পানের দোকান দিবো।
বাদাম খেতে খেতে চার বন্ধু হাঁটছে সরু রাস্তা ধরে। আজকের বিকেলটা সুন্দর। আকাশ মেঘ জমেছে কিন্তু বৃষ্টি আসছে না। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। জুরিখ নদীর নীল রংয়ের পানি সেই হাওয়ার সঙ্গে দুলছে। দেখতে বেশ লাগছে।
এমনই সুন্দর মুহুর্তটা উপভোগ করার জন্য সিয়াম সবাইকে টেনে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। বাদ যায় নি আবরারও। সে পিংক রংয়ের হুড়ি গায়ে চাপিয়েছে৷ মাথায় হুড়ির চুপি এবং হাত দুটো পকেটে পুরে আনমনে হাঁটছে।
বাকি চার জন পিছনে।
আমান বাদামের খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুরতে পুরতে বলে

” পানের দোকান কেন? গাঁজার দোকান দে।
“না রে শালা
পান সুইজারল্যান্ড এ এবলএবল নেই৷ তো একটা পানের দোকান দিলাম। সুন্দরীদের ডেকে ডেকে ফ্রী তে পান খাওয়ালাম। দুই একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনালাম। এতে পানের মতো সুস্বাদু খাবারের প্রমোট করা হয়ে গেলো সাথে আমার কবিতারও শোনানো হলো।
আহাদ হতাশ স্বরে বলে
” ভাই তুই তোর ভাঙা
বাকিটা শেষ করার আগেই সিয়াম কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করে
“ওহে সুন্দরী খাবে কি পান?
জর্দা দিয়ে বানিয়েছি একটু খানি খান
ভালো না লাগলে দিয়ে যান চুমু
আর ভালো লাগলে চলুন প্রেম করি
ইভান সিয়ামের কাঁধে হাত রেখে বলে

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” এই কবিতা শুনে মেয়েরা জুতো খুলে পেটাবে তোকে। আর নাহলে ওই নদী
বাকিটা শেষ করার আগেই দেখতে পায় একটা মেয়ে ধাক্কা খেলো আবরারের সঙ্গে। পড়ে গেলো নিচে।
আবরার ভ্রু কুচকে মেয়েটার পানে তাকায়।
আমান দৌড়ে আসে। মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে
“আর ইউ ওকে?
মুচকি হাসে মেয়েটা। আমানের হাত ধরে উঠে পড়ে। এবং বলে
” ইয়েসস এ’ম ওকে।
আবরার তাসনিন আপনাকে চিনি আমি। নাইস টু মিট ইউ আমি টিশা।
আবরার জবাব না দিয়ে সামনে হাঁটতে থাকে। টিশা অপমানিত হয়। হাসিমাখা মুখ খানা মুহুর্তেই চুপসে যায়। তাকিয়ে থাকে আবরারের চলে যাওয়ার পানে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সিয়াম বলে ওঠে

“টিশা ম্যাম আমার বন্ধু আবরার একটু পাগল টাইপের।
বাদ দিন ওর কথা। আপনি কোথায় থাকেন?
টিশা আঙুল তুলে দেখায়
” এই যে জুরিখ নদীর ব্রিজ। ওই পাশে যে উঁচু বাড়ি দেখা যাচ্ছে সেখানেই থাকে।
“ওয়াও
নদীর এই পাড়ে আমাদের বাড়ি ওই পাড়ে তোমার।
আরও কিছু আলাপ চলতে থাকে ওদের মাঝে। আবরার নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। মাথা হতে টুপি খুলে আসমান পানে তাকায়। কপালের ডান সাইডে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো। তিন মাস হবে চুল দাঁড়ি সেটআপ করে কাটা হয় না। কেমন অদ্ভুত দেখায় তাকে।

আসমান হতে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে আবরারের গালে। পরপরই আরেক ফোঁটা। এবার ঝমঝম করে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। ওয়েদার খারাপ ছিলো আগে থেকেই। বৃষ্টি তো হওয়ারই ছিলো।
তবে এই মুহুর্তে বৃষ্টি মন্দ নয়।
সিয়ামের গলা শোনা যাচ্ছে। চিৎকার করে ডেকে যাচ্ছে। কিন্তু আবরার ফিরে তাকায় না।
হাত পেতে দু ফোঁটা বৃষ্টির পানি হাতে জমায়। পরপরই সেই পানি শূন্যে ফেলে দিয়ে বলে
” বৃষ্টি তুমি ছুঁয়ে দিও তাকে
আবরার তাসনিন প্রতি মুহুর্তে অনুভব করে যাকে।

বাংলাদেশের ওয়েদার অস্বাভাবিক। কাঁধ ফাটা রোদ্দুরে জান যায় যায় অবস্থা। গাছ পালা নদী নালা সহ মানুষ গুলোও বোধহয় শুকিয়ে কাঁঠ হয়ে যাবে।
আদ্রিতা তার দুই বান্ধবী ইশা এবং মিলির সাথে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছিলো। বাসা থেকে ভার্সিটির দুরত্ব খুব বেশি নয়। তাই তিন বান্ধবী হেঁটেই যাচ্ছে।
মিলি বলছে
“বোইন হট নিউজ
আসিফ আদনান আছে না? আমাদের ভার্সিটির সিনিয়র। আদ্রিতার হাতে নাম্বার লিখে দিয়েছিলো। সে এখন মন্ত্রী হচ্ছে। ৩ তারিখ শপথ গ্রহণ করবে। ভাই আমার ক্রাশ মন্ত্রী হবে।
ইশা বলে

” বালের হট নিউজ। এসব তো আগেই জানি আমি। এক মাস যাবত আলোচনা চলছে।
হট নিউজ আমার থেকে শোন। আবরার তাসনিন ফাস্ট টাইম বাইক রেস কম্পিটিশনে পার্টিসিপ্যান্ট করবে। ভাই বুঝতে পারছিস কি হতে চলেছে?
আদ্রিতার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। পা জোড়া থেমে যায়। লোকটা বাইক রেস এ পার্টিসিপ্যান্ট করবে মানে কি? যদি এক্সিডেন্ট করে? ব্যাথা পেলে কি হবে? পরমুহূর্তেই থেমে যায় আদ্রিতা। সে ব্যাথা পেলে তার কি?
যা খুশি করুক। যে মানুষটা মাঝ পথে আদ্রিতাকে ছেড়ে গিয়েছে তার কথা ভাবার কোনো মানেই হয় না।
ঠিক সেই মুহুর্তেই কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে আদ্রিতার মুখে। কাঁঠফাটা রোদ্দুরে খাঁ খাঁ করা প্রকৃতি হঠাৎই রূপ পরিবর্তন করে ফেলে। আসমানে এক টুকরো কালে মেঘের দলা দেখা যায়। সেখান হতেই কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছে জমিনে।
ব্যাসস কয়েক ফোঁটাই। তারপর আবারও আসমান পরিষ্কার। মেঘের দলা খানা উড়ে উড়ে গায়েব হয়ে যায়।
আদ্রিতা হাসে। এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি এখনো রয়ে গিয়েছে তার হাতে।

বাসায় ফিরেই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আদ্রিতা। সকালে নাস্তা বানিয়ে ভাত রান্না করে রেখে গিয়েছিলো। থালাবাসন ওমনই রয়েছে। সেগুলো ধুঁয়ে মুছে গোসল করতে হবে।
আতিয়া বেগম এর শরীর ভালো নেই। কয়েকদিন হবে প্রচন্ড জ্বরে ঘায়েল হয়ে আছে। ডাক্তারের কাছে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ঔষধ খেয়েও কাজ হচ্ছে না। আদ্রিতা ভেবেই ফেলেছে আজকের রাতটা দেখবে। না কমলে সকালে অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।
হাতের কাজ শেষ করে গোসল সেরে নেয় আদ্রিতা। আতিয়া বেগম এর তার জন্য খাবার বেরে আগিয়া বেগম এর কক্ষে যায়। দেখে তিনি বসে বসে বই পড়ছে।
আদ্রিতাকে দেখে মলিন হাসে

“আবরার কল করেছিলো।
আদ্রিতা কথা বলে না। চুপচাপ খাটের ওপর ভাতের থালা নিয়ে বসে। আতিয়া বেগম এর থালা এগিয়ে দিয়ে নিজের প্লেটে হাত দেয়। পাঙ্গাশ মাছ রান্না করা হয়েছে। খুবই পছন্দ আদ্রিতার।
মাছ দিয়ে ভাত মেখে মুখে পুরতে পুরতে বলে
” তুমি রান্না করতে গেলে কেনো? আমি করতাম।
“আজকে জ্বর কমেছে। শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না।
“আচ্ছা খাও।
ভাত ঠান্ডা হয়ে যাবে। সবেই গরম করে এনেছি আমি।
” আবরারের কল ধরিস না কেনো?
আদ্রিতা তাকায় আতিয়া বেগম এর পানে। চোখে চোখ রেখে জবাব দেয়
“তোমার ছেলেকে আমার প্রয়োজন নেই। সে যেনো কল না করে।
” রেগে থাকিস না। ওর কাজের জন্যই চলে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি আমাদের নিয়ে যাবে।
আদ্রিতা জবাব দেয় না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে এঁটো থালাবাসন নিয়ে চলে যায়। আতিয়া বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। কষ্ট তারও হয়।

আবরার কেনো চলে গেলো? তাদের একবার বলেও গেলো না। এতো গুলো দিন ছেলের সঙ্গে থেকে অভ্যাস খারাপ হয়ে গিয়েছে। এখন রোজ দেখতে ইচ্ছে করে। বাড়ি খানা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ইচ্ছে করে দৌড়ে চলে যেতে আবরারের কাছে।
মাঝেমধ্যে মনে হয় আর বাঁচবে না সে। এই বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।
ইসস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে আর একবার যদি ছেলে মেয়ের মুখ খানা দেখতে পারতো।

রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। আদ্রিতা পড়ালেখা শেষ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখনই ফোন খানা বেজে ওঠে। আরিফ কল করেছে। বাবার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ইদানীং সব সম্পর্কেই তুচ্ছ মনে হয়। পালিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে।
আরিফ ইদানীং প্রচুর কল করে আদ্রিতাকে। সকালে বিকেলে রাতে। যেনো মেয়ের সাথে কথা না বললে তার ভালো লাগে না।

ইমা টনির সাথে সুইজারল্যান্ড চলে গিয়েছে। আর আরিফ তার দুই বাচ্চা নিয়ে বাংলাদেশেই রয়ে গিয়েছে। আবরারের তাসিন ফ্যাশন হাউস এ জব নিয়েছে।
কল খানা বাজতে বাজতে কেটে যায়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আদ্রিতা। যাক এখন আর ঠোঁটের কোণে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে কথা বলতে হবে না।
বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করতে পূণরায় কল বেজে ওঠে। আদ্রিতা চোখ বন্ধ রেখেই বালিশের পাশ থেকে ফোন খানা হাতে নেয়। এবং রিসিভ করে কানে তুলে।
“হ্যাঁ বাবা বলো।
ওপাশ থেকে ভেসে আসে অতি পরিচিত ঝাঁঝালো গম্ভীর স্বর।

তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৬২

“ফা***** বাপ
হানি ডাক ইডিয়েট
চমকায় আদ্রিতা। বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এক লাফে উঠে বসে।
পূণরায় আবরার বলে
” শয়তানের বাচ্চা চাপকে কানের তালা ঝুলিয়ে দিবো। আমাকে ইগনোর করিস?
আদ্রিতা শুকনো ঢোক গিলে। ইচ্ছে করছে লোকটাকে অনেক কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না।

তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৬৪