তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩০
নীল মণি
তিন বছর পর
ফেব্রুয়ারির শিকাগো শহর জুড়ে কনকনে শীতের দাপট।আকাশ কালচে ধূসর, তুষারের পাতলা কণা ঝরে পড়ছে নিঃশব্দে,ঠিক যেন জমে থাকা অতীত ধীরে ধীরে ছুঁয়ে দিচ্ছে বর্তমানকে।চারদিক সাদা
সড়ক, গাছের ডাল, ঘরের কার্নিশ সবকিছুই বরফে মোড়া।তাপমাত্রা নামছে হিমাঙ্কের নিচে,শ্বাস ফেললেই তা ধোঁয়ায় রূপ নিচ্ছে।
রাস্তাগুলো প্রায় শুনশান।টিমটিমে ল্যাম্পপোস্টের আলো বরফে প্রতিফলিত হয়ে শহরটাকে আরও নিঃসঙ্গ, আরও ঠান্ডা করে তুলছে।গাছগুলো ন্যাড়া, ট্র্যাফিক স্লো, মানুষজন মোড়ানো লম্বা কোটে নিজেকে ঢেকে হেঁটে যাচ্ছে দ্রুত পায়ে।
সবকিছুতেই যেন এক বিষণ্ন শীত নেমে এসেছে–
রঙহীন, শব্দহীন, অথচ গভীর। গাড়ির চাকা বরফ কাটতে কাটতে একটানা শব্দ করছে।আর সেই আওয়াজ যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে কারো বুকের গভীর ক্ষত।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে শিকাগোর এক অভিজাত প্রাইভেট বার ডাউনটাউন —
ভিতরে উষ্ণ আলো, হালকা জ্যাজ মিউজিক আর দামি বোতলের সুবাসে মোড়ানো পরিবেশ।
কাঠের ফ্লোর আর ক্রিস্টাল ঝাড়বাতির আলোয় ঝলমল করছে পুরো ঘরটা।বার কাউন্টারে নানা দেশের দামি মদের সারি,বাতাসে গন্ধ আছে ওকহুইস্কির,তবুও রোজ কারের মত আজ ও এক ধরনের ভারী নীরবতায় ঢাকা।
শিকাগোর এই ফেব্রুয়ারির হিমেল রাতে,প্রাইভেট বারের জানালার পাশে বসে আছে এক অন্য রকম জায়ন চৌধুরী।শুধু মনের ভেতর নয়,চেহারাতেও লেগেছে সময়ের ছাপ—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তবে তা ক্ষয়ে যাওয়ার নয়, বরং আরও প্রখর হয়ে ওঠার।তার গায়ের রঙ এখন আগের চেয়ে আরও উজ্জ্বল,চামড়ায় লেগে থাকা সতেজ দীপ্তি আর কঠিন যত্নের ছোঁয়া–
বুঝতে বাকি থাকে না,নিজের শরীরের প্রতি এই মানুষটা এখনো ভীষণ সচেতন।
বয়স ছুঁইছুঁই করছে ৩২,তবুও সেই অনন্য সৌন্দর্যে তার উপস্থিতি আজও তীক্ষ্ণ, তীব্র,আর ঠিক তেমনই ধ্বংসাত্মক।
সাদা ফ্রেমের এক জোড়া ট্রান্সপারেন্ট চশমা শোভা পাচ্ছে চোখে,যা তাকে দিয়েছে এক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ড্যাশিং লুক।চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করা,
জেল দিয়ে সযত্নে গোঁছানো–
মাথা নাড়ালেই যেন আলো পড়ে তার কেশরেখায়।
শার্টের হাতা কনুইয়ের নিচ পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা,
আর সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা হাতের উঁচু ভেইনস,তাঁকে আরো পুরুষালী, আরো রহস্যময় করে তুলেছে।হাতের কবজি জুড়ে থাকা এক দামি ঘড়ি আর সিগারেটের গন্ধে তার চারপাশে গড়ে উঠেছে এক গভীর, পরিণত চরিত্রের চেহারা,যা দেখলেই কারও বুক ধক করে উঠবে।হুইস্কির গ্লাস ঠোঁটে তুলল সে,চুমুক দিয়ে অল্প করে ঢেলে দিল নিজের গলায়,
তরলের উত্তাপ গলার ভিতর দিয়ে নেমে গেলে
তার আদাম’স অ্যাপলটা একবার ওপর-নিচ করল নিঃশব্দে।সেই দৃশ্য, সেই মুহূর্ত যেকোনো নারীর হৃদয় দুর্বল করে তোলার জন্য যথেষ্ট।
চেহারার ওই উজ্জ্বলতার আড়ালেও লেগে আছে কিছু অন্ধকার চিহ্ন,সিগারেটের তামাটে ছোঁয়া ঠোঁটে,
চোখের নিচে হালকা ছায়া,আর প্রতিদিনের সেই অভ্যস্ত ধোঁয়া।আগে যেখানে দিনে একটা সিগারেট খেতো,এখন সেখানে নির্দ্বিধায় পাঁচ-ছয়টা পুড়িয়ে ফেলছে।ঠিক যেমন করে ধীরে ধীরে পুড়িয়ে ফেলছে নিজেরই ভেতরটা।জায়ন এখন এক নিখুঁতভাবে ভাঙা মানুষ,যার গড়ন যতটা পরিপাটি,তার ভেতরটা ঠিক ততটাই অগোছালো।আর সেই অগোছালো মনেই জমে আছে ,তিয়াশার ফেলে যাওয়া প্রতিটি নিঃশ্বাস,
তিয়াশাকে ছোঁয়ার সেই অনুভুতি যা মনে পড়লেই যেন কুঁকড়ে খায় তাকে । এই তিন বছরে বদলায় নি তার মনের অনুভূতি বদলেছে শুধু নিজেকে , জ্বালিয়ে চলেছে প্রতিটা রাত ভুলতে পারেনি এক মুহূর্ত তার প্রাণ প্রিয় কিশোরী কে , বরং বারংবার হানা বেঁধেছে তার মনে ।
বরাবরের মত জায়নের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট জেমসও তার সঙ্গেই এসেছে বারে।সব সময়ের মতো আজও দায়িত্বশীল, হাসি খুশি , এক মজার মানুষ , ঠিক যেন ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলেছে সে। জেমস এর মা বাংলাদেশী কিন্তু বাবা আমেরিকান তাই তার বাংলা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না।
তবে আজ জেমস একা নয়, সঙ্গে এসেছে এক বিদেশিনী মেয়ে জায়ন এর অফিস এর বেস্ট এমপ্লয়, জেমস ই তাঁকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে।চোখে পড়ার মতো উপস্থিতি তার,গাঢ় লাল রঙের bodycon ড্রেস,
যেটা হাঁটুর অনেক উপরে উঠে এসেছে,চামড়ায় আঁটা সেই পোশাক যেন শরীরের প্রতিটি রেখাকে প্রকাশ করে দিচ্ছে স্পষ্টভাবে।চুল খোলা, ঠোঁটে হালকা চকচকে লাল লিপস্টিক,চোখে ঘন কাজল আর আত্মবিশ্বাসে ভরা হাঁটা,পুরো চেহারাতেই এক ধরণের পুরুষদের প্রলোভনের আমন্ত্রণ।
সে আসার পর থেকেই নজর ছিল জায়নের দিকে।
নরম গলায় হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছিল,চোখে চোখ রাখার চেষ্টা,মেয়েটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বসেছিল জায়নের পাশে।চোখে ইচ্ছাকৃত আকর্ষণ, ঠোঁটে লাল হাসি।এক হাতে চুল সরিয়ে কান ছুঁয়ে দিলো,
অন্য হাতে জায়নের হাতের পাশে নিজের আঙুল ছুঁইয়ে রাখল।তার ঠোঁট থেকে ভেসে এল এক কোমল গন্ধ আর নরম স্বরে বলা—
“You look… lonely tonight boss”
জায়ন গ্লাসটা নামিয়ে রাখল ধীরে,কোনো শব্দ না করে মেয়েটির দিকে তাকাল।তার মুখ স্থির, ঠোঁট বন্ধ কিন্তু চোখ… চোখে যেন আগুন।চোখের গভীরতায় স্পষ্ট রাগ,তীব্র বিরক্তি আর অসম্মানিত হবার ক্ষোভ।
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে গলা নামিয়ে দাঁতে দাঁত পিসে বলল—
“Miss Julie If you dare to touch me again ,I will forget you are a women. If you don’t want to loose your job then don’t try to seducing your boss .
Do u understand?
জুলি ভয়ে কেঁপে উঠল, সে জানে তার বস কতটা কঠিন সে নিজেকে প্রস্তুত করে এমন এক কঠিন, নিয়মতান্ত্রিক রূপে যার কাঁধে দায়িত্বের ভার আর চোখে জ্বলন্ত সিদ্ধান্তের ছোঁয়া। অফিসে তার আগমনে যেন সময় থমকে যায়,আর প্রতিটি এমপ্লয়ি নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে,কারণ আবরার জায়ন চৌধুরীর সামনে ভুলের কোনো জায়গা নেই।আর মিথ্যা তার চির শত্রু।কিন্তু জুলি তবুও এক নিঃশব্দ গভীর আশায় চেষ্টা করে গিয়েছিল,যদি তার লোভনীয় সৌন্দর্যে এই কঠিন মানুষটাকে গলিয়ে ফেলা যায়।কিন্তু সে জানে না—
এই পুরুষ কোনো নারীসুলভ চাহনিতে গলে না।
তার এই কঠিন চোখের পেছনে লুকিয়ে আছে এমন কারো স্মৃতি,যার হাসিতে লুকিয়ে ছিল এক পৃথিবী শান্তি।এই কঠিন হৃদয়ের পেছনে আছে এক তার প্রাণপ্রিয় কিশোরীর ছায়া, যে তার হৃদয় টা চুরমার করে দেবার পরেও তবুও তার ।যার নিঃশব্দ সৌন্দর্যের কাছে জুলি সম্পূর্ণ তুচ্ছ। জুলির সাজানো শরীর তার কাছে মূল্যহীন, কারণ তার মনে এমন কাউকে বসিয়েছে যার ছোঁয়া কল্পনায়,আর যার অনুপস্থিতি প্রতিদিন তাকে জ্বালিয়ে মারে। ফেলে আসা সেই রাত যা তাকে পুড়িয়ে চলেছে।
মেয়েটি মাথা নিচু করে পিছিয়ে গেল আস্তে আস্তে।
জায়ন চোখ ফিরিয়ে জানালার তাকাল জেমস এর দিকে , যেই চাহনিতে জেমস ও খুব ঘাবড়ে গেল।হুংকার দিয়ে সামনের কাউন্টার টায় এক থাবা দিয়ে বলে উঠল , যেই আওয়াজে কেঁপে উঠল আসে পাশের লোকজন ও —
” কত বার বলেছি তোমায় যে আমার সামনে কোন মেয়ে কে আনবে না । Say how many times I told u ,if you don’t want to listen to me you can resign .”
এই বলে সে গট গট করে বেরিয়ে গেলো বাইরের দিকে,পার হয়ে গেল সেই লম্বা, বিশাল, ভারী দরজাটা পেরিয়ে।যেটার শব্দও যেন তখন থেমে গিয়েছিল তার পদক্ষেপের সামনে।
জেমস ও খুব ঘাবড়ে আছে, মনে মনে ভাবছে —
” এই জুলি নামক প্যারা টার কথায় যে কেন সে রাজি হয়ে ছিল আল্লাহ জানে। আর তার স্যার আবরার এর ই বা মেয়েতে এত এলার্জি কেন ? ” বুঝে পায়না সে,
এই ভাবতে ভাবতেই সে দ্রুত পায়ে জায়ন এর পেছনে ছুটলো ।
আকাশটা নীল, কিন্তু হালকা ধোঁয়াশায় ঢাকা।
হিমের ছোঁয়া যেন বাতাসে জমে আছে এখনো শীত পুরোপুরি কাটেনি, আবার বসন্তও ঠিক পুরোপুরি আসেনি।বিকেলের দিকে রোদটা নরম হয়ে নামে,
চোখ জ্বালায় না, বরং গায়ে একরাশ শান্তি মেখে যায়।
গাছের পাতাগুলো রোদে ঝলমল করে,তবুও হালকা হাওয়ায় মাঝে মাঝে একটা দুটো শুকনো পাতা মাটিতে ঝরে পড়ে,ঠিক যেমন কারো না বলা কথা পড়ে থাকে বুকের জমিনে।ফাগুনের আগমনী সুরে ফুলে ফুলে ভরে উঠছে কৃষ্ণচূড়া আর শিমুল গাছ।আর বাতাসে লেগে থাকে এক অদ্ভুত মাটির গন্ধ,যেন কোনো পুরনো স্মৃতি ঘুরে বেড়াচ্ছে পরিচিত উঠোনে।রাস্তার ধারে গরম বাদাম, চা আর পিঠার গন্ধ ছড়ায়,এই সময়টাই যেন সবচেয়ে আপন,সবচেয়ে আবেগঘন,কারণ এই মাস শুধু ঋতুর পালাবদল নয়।এই মাস ভাষার, ভালোবাসার, আর অপেক্ষার —-
এই অপেক্ষায় বসে আছে চৌধুরী বাড়ির প্রতিটা মানুষ।তাদের বড় ছেলে, জায়ন চৌধুরীর জন্য–
যে এখন হাজার হাজার মাইল দূরে,তবুও মা চাচিদের হৃদয়ের সবচেয়ে কাছে।
এবার বিদেশ যাওয়ার পর থেকে সে আর আগের মতো নেই।না ফোন করে, না খোঁজ নেয় নিয়মমতো।
বাসা থেকে কেউ কল করলেই কণ্ঠে ঠান্ডা, সংক্ষিপ্ত উত্তর—
“হ্যাঁ, ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো? সাবধানে থেকো।”
ব্যস। আর কিছু না।
আর বাড়ির কর্তাদের সঙ্গে কোন কাজ ছাড়া অন্য কোন কথা বলে না । নিজের বাবার সঙ্গেও না , কথা যা হওয়ার তা একমাত্র ইউভি আকাশ আর তার প্রাণের বন্ধুদের সঙ্গে। বাড়ির ফোন তো বেশির ভাগ সময় ধরেই না।
মাঝে মাঝে শুধু রূহেনা বেগমকে ফোন করে,
একটা দুটো প্রশ্ন—-
“শরীর কেমন, প্রেসার ঠিক আছে তো?”
তারপর আবার নিস্তব্ধতা।
মেহজাবীন বেগম দিন দিন ভেঙে পড়ছেন।এই ছেলেটা তো এমন ছিল না,
আগেও তো বিদেশ গেছে কৈ এমন তো করেনি ,যে প্রতিদিন মা, চাচি, ফুফু সবার খোঁজ না নিয়ে থাকতে পারত না,তাহলে এখন কেন এমন?
উনি ভাবেন, নিশ্চয়ই বৃষ্টির জন্যই এই ছেলেটা এতটা বদলে গেছে।ভেবেছেন, ছেলেটা হয়তো এখনো সেই অতীত ভালোবাসার ভারে ভেঙে পড়েছে,তাই কারও সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারছে না।
সেই ভেবে ছেলেকে আবার বিয়ের কথা বলতে গেলেই ছেলে ফোন কেটে দিয়ে আবার কদিন ফোন ধরাই বন্ধ করে দেয়,
তাই ছেলে কে এখন বিয়ের কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছে।
কিন্তু কেউ জানে না—
এই দুরত্বের কারণ বৃষ্টি নয়…
এই নিরবতার পেছনে আছে রোদ।একটা নাম, একটা মুখ,
যার কথা শুনলেই ভেতরটা কেঁপে ওঠে জায়নের।
সে জানে, বাসায় বেশি কথা হলে,চোখ বন্ধ করলেই যার মুখ ভেসে ওঠে,সেই প্রেয়সীর নাম কেউ না কেউ ঠিকই উচ্চারণ করবে।আর সে শুনতে চায় না সেই নাম।সে চায় না, তার ভালোবাসার সেই নিষিদ্ধ অনুভব,তার একমাত্র প্রণয়,কোনো পরিণতি ছাড়াই তার সামনে আবার দাঁড়িয়ে যাক।
জায়নের এই না বলা ব্যথা, এই পালিয়ে যাওয়া—
এটা এক নিঃশব্দ আত্মরক্ষা,যার বোঝা আজো কেউ বুঝে উঠতে পারেনি।
এই দহনের আগুনে আজ তিন বছর ধরে জ্বলে পুড়ে মরছে তিয়াশা ও , মেয়ে টা হঠাৎ করেই কেমন বদলে গেছিল , সেই বদল নজরে পড়েছিল বাড়ির সব ব্যক্তির চোঁখেই।
বৃষ্টির নাম এখন আর কেউ চৌধুরী বাড়িতে তোলে না।
এ বাড়ির দেওয়াল জানে, যে নামটা একদিন ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াত,আজ সেটাই নিষিদ্ধ—
কারণ প্রান্তিক সাহেব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন,
“যে এই নাম উচ্চারণ করবে, তাকে এই বাড়ি ছাড়তে হবে।”
ইউভি নিজে থেকেই বহু চেষ্টা করেছে বৃষ্টিকে খুঁজে পাওয়ার,তবুও কোনো হদিস মেলেনি।এই খোজার পেছনের নির্দেশ কিন্তু এসেছিল,বিদেশ যাওয়ার আগে জায়নের কাছ থেকেই–সে নিজেই বলেছিল ইউভিকে,
সে যেন বৃষ্টিকে খোঁজে। শুধু ইউভি কে না বলে গেছিল তার বন্ধুদের ও।
তিয়াশা এখন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের ছাত্রী।
সে আর আগের মতো নেই , রূপেএসেছে পরিপক্বতা চেহারায় যৌবনের দীপ্তি। এখন সে আর পিচ্চি নেই তবে জায়ন এর পাশে এখনও পিচ্চিই লাগবে ,
শরীরজুড়ে এক অভিজাত নারীত্বের প্রকাশ। এই চেহারায় এমন এক সৌন্দর্য আছে ,যা চাইলে যে কোনো পুরুষ কে মুগ্ধ করে ফেলতে পারে , হাঁটু গেঁড়ে বসিয়ে “প্লীজ” বলাতে পারে যে কোন পুরুষ কে । কিন্তু
কোন পুরুষের যে তার আসে পাশে আসার ও নির্দেশ নেই। ইউনিভার্সিটির সব ছেলেরা তাকে “খালামনি”
বলে ডাকে , সে বুঝে ঊঠতে পারে না ইউনিভার্সিটির বড় ছোট সব ছেলেরাই বা কেন তাকে ‘খালামনি’
বলে। বিনা মাক্স এ ইউনিভার্সিটি যাওয়া নিষেধ তিয়াশার , আর এই সব নিষেধ ইউভির তরফ থেকে এসেছে । কৈ আগে তো এত নিষেধ ছিল না ।
তিয়াশা জায়ন একে অপরের মুখ দেখেনি এই তিনটে বছর , সে যদি জানত তার প্রাণ প্রিয় রমনীর এই নতুন
রূপের কথা , তাহলে হয়তো তার এই উপেক্ষার
আসসালামু আলাইকুম হয়ে যেত ।
কিন্তু শুধু তিয়াশাই নয় বদলে গেছে অনন্যা রাত্রিও ।
সে এখন অষ্টাদশে পা রাখা এক সম্ভাবনাময় কিশোরী।
তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে এক নিঃশব্দ আকর্ষণ। সৌন্দর্যের যৌলতা ফুটেছে তার শরীরে।
রায়ান ও অনন্যা—-
এই বছরই এইচএসসি দেবে। সেই কিউট রায়ান এর মুখে এখনো শিশুসুলভ কোমলতা টিকে আছে, বদলেছে তাঁর চোয়াল এর গঠন , চোয়ালের গঠন বলে দেয়–
সে বড় হয়ে উঠছে, ধীরে ধীরে পুরুষ হয়ে উঠছে।
চোখ দুটো বড়, গভীর,যেখানে কৌতূহলের সাথে মিশে থাকে একরাশ চাপা চিন্তা।
ইউভি এখন পুরোপুরি ভাবে অফিসের হাল ধরেছে ।চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এখন তার দায়িত্বে
গম্ভীর, পরিণত, এবং সিদ্ধান্তে দৃঢ়। সঙ্গে আছে আর ও একটি গুরু দায়িত্ব।
আকাশ এখন এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ার।
তার সামনে শুধু ইন্টার্নশিপ বাকি,
আর এরপরই শুরু হবে হাসপাতাল জীবনের নতুন অধ্যায়।
আর ছোট্ট মারিয়া?সে এখন কিশোরীর প্রথম ধাপে,
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে,কাঁধে ব্যাগ, চোখে স্বপ্ন, আর মুখে এখনো সেই চঞ্চলতা,যা একদিন চৌধুরী ও খান বাড়ির উঠোনে ভেসে বেড়াত।
“ভাইয়া, আমার একটুও ভালো লাগে না তোমার এই রোজ দিয়ে আসা-নিয়ে আসা।”
তিয়াশার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি।
“কেন, ড্রাইভার চাচার সঙ্গে গেলে কি এমন হয়?”
ইউভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রাখলো।
“আমার নিজেরই বিরক্তি লাগে, বনু।”
তিয়াশার চোখদুটো একধরনের অভিমানে চিকচিক করে উঠলো।
ভ্রু কুঁচকে দাঁতে দাঁত পিষে বলল—
“বিরক্তি লাগে, তাও কেন যাও?”
ইউভি চোখ বুজে ভেতরে ভেতরে গুমরে উঠলো।
“যাই কি আর সাধে ?নিজের ভালোবাসার রাফা-দাফা না হয় তার জন্যই যাই। জানি না কবে এইসব প্যারা বিদায় হবে আমার জীবন থেকে।
“””ওই কাগজ টা যে কেন নিতে গেছিলাম কে জানতো ভাইয়া কাগজে এইসব লিখে রেখেছে । “””
এই বনুর পেছনে সময় দিতে দিতে নিজের ভালোবাসার প্রস্তাবটা
আর এ জন্মে দিতে পারবো কিনা আল্লাহই জানে।
ওহ আল্লাহ, এইসব দিয়ে একটু মুক্তি দাও।”
“আরে ভাইয়া, কিছু বলো না কেন?”
তিয়াশার গলা এবার একটু কোমল, কিন্তু স্পষ্ট প্রশ্নবোধক।
“কি বলবো? বেশি না বকে চুপ করে থাক তো।”
ইউভির কণ্ঠে এক ধরণের ক্লান্তি।
তিয়াশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে জিজ্ঞেস করল—
“আচ্ছা ভাইয়া… উনি কেমন আছেন?”
এই কথাটাই যেন হঠাৎ করে ভারি করে দিলো চারপাশের বাতাস।ইউভির মুখে এক গভীরতা নেমে এলো।কি বলবে সে?একদিকে প্রিয় বোন, অন্যদিকে প্রিয় ভাই সেই মানুষ যার নামটাই এখন চৌধুরী বাড়িতে শোনা যায় দেখা আর যায় না।
সে তো না পারে এদিকে কিছু বলতে, না পারে ওদিকে কিছু বলতে। পড়েছে এক জ্বালায়, এক ঠোক্করে।
তবুও, বনুর চোখের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল—
“ভালো।”
এই একটুকু শব্দেই যেন পুরো গাড়িটা নীরব হয়ে গেল।
তিয়াশা মুখে হাত রেখে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইলো—
চুপচাপ।
অভিমান আর না পাওয়ার এক মিশ্র অনুভূতিতে।
গাড়ি এসে থামলো ভার্সিটির সামনে , তিয়াশা গাড়ি থেকে নামার আগে রোজকারের মত পরে নিল মাক্স
টা ।
” আমি এসে ফোন না করা পর্যন্ত যেন , ভার্সিটির গেটের বাইরে বেরোবি না ।”
তিয়াশা বিরক্তি হয়ে যেতে যেতে বলল —
” জী ভাইয়া।”
ক্লাস রুমে যেতেই দেখা হলো আরোহী ও পরির সঙ্গে। রুবিনা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশান নিয়েছে । তাই এখন চার বান্ধবীর মধ্যে এই তিন জনকেই দেখা যায় ।
” বুঝলি দোস্ত তোরে দেখলে আমার করোনা পেশেন্ট মনে হয় ।”
আরোহীর এই কথায় তিয়াশা বিরক্তি স্বরে বলে উঠলো —
” শুধু তোর না আমার নিজেরই নিজেরে করোনা পেশেন্ট মনে হয়।
পরি একটু হেসে বলে উঠলো —-
” তোরে দেখলে আমার শুধু করোনা পেশেন্ট না, আরো অনেক কিছু মনে হয় ।
তিয়াশা এবার একটু রেগে গিয়েই বলে উঠলো —
” মানে ?”
আরোহী তিয়াশার কাধে হাত দিয়ে বলল —
” মানে আমি বলতাসি শোন, ২ বছর পড়লি মহিলা কলেজে তোর জালায় আমার আব্বু ও ওই মহিলা কলেজেই পাঠালো , এই যে তুই হাতে ফোন তো পাইসিস কিন্তু ফোনে কোন পোলার নাম্বার নাই, তাও তোর ভাইয়া দুই দিন বাদ বাদ চেকিং দেয় ।
ফেসবুক একটা খুলছিস যাতে তোর কোন পিক নাই , ওই ফেসবুক এ একটাও পোলা নাই । ভার্সিটির আধ দামড়া পোলা গুলো ও তোরে খালামনি কইয়া ডাকে ।
রাস্তার পাশে দাঁড়ায় ফুচকা খাওয়া টুকু ও তোর বন্ধ।
তো তোর কি মনে হয় তুই কোন নরমাল লাইফ এ
আছোস?”
” এই তুই বেশি বকিস না নইলে আমার আকাশ ভাইয়ারে বিচার দিব ।”
” তোর ভাইয়া আগে পইড়া নিক তারপর বিচার দিস,
বেটা প্রপোজ টা পর্যন্ত করে না, এইদিকে আবার কোন
পোলার লগে আমার সেটিং পর্যন্ত হইতে দিতাছে না , আমার এও যে ভার্সিটির সব পোলা গুলান আপু কইয়া ডাকে এইটা ভুলি কি করে । হায় আল্লাহ –”
হ্যাঁ এই তিন বছরে বদলেছে অনন্যা আকাশের সম্পর্ক ও।
“খালামণি, তোমার ফেসবুক আইডিটা দিবা?”
একটা ছেলে এসে একগাল হেসে তিয়াশার সামনে দাঁড়ালো।তিয়াশা শুনেও যেন লজ্জা পেলো না
বরং ভিতরে ভিতরে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা ছুঁয়ে গেল তাকে, কারন সে জানে তার ফেসবুক আইডি নিয়ে কেউ নড়াচড়া করে তাই ইচ্ছে করেই কোন ছেলে এসে অ্যাড করতে চাইলে মানা করেনা।
এরকম হয় প্রায়ই।
অনেকেই আইডি চায়, মেসেজ দেয়, অ্যাড করে…
কিন্তু বাসায় ফিরে ফ্রেন্ড লিস্টে গিয়ে খুঁজলে–
তাদের কোনো অস্তিত্বই মেলে না। তিয়াশা মুচকি মুচকি
হাসে আর বলে —
” আমার কথা শুনতে পর্জন্ত চায় না , আবার আমার ফোন ল্যাপটপ হ্যাক করে রাখেন বাঘের বাচ্চা।
একবার সামনে পাই না দেখাবো নিজের বাঘিনী কে ছেড়ে যাওয়ার মজা।”
তবুও আজ সে হেসে বলল,
“হ্যাঁ, নিশ্চই।”নিজের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এইটা আমার আইডি ভাইয়া।”
ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে অ্যাড করল,তিয়াশাও একসেপ্ট করে ফেললো,একটা মিষ্টি অভ্যেসে। তার শখের পুরুষ এর ছোঁয়া পায় এসবের মধ্যে ।
তার আইডি ওপেন হয়ে আছে ,কোনো এক বিশাল স্ক্রিনে, পাশে আছে আরো অনেক স্ক্রিন । হালকা ডিম লাইট আলা ঘরের ভেতরে বসে থাকা এক জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে।
হঠাৎ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা সে দৃষ্টির মালিক
ঠোঁট উল্টে হেসে উঠল,একটা কাঁটার মতো কন্ঠে বলল
“করো অ্যাড…
যতো জোন পারো তত জোনকে অ্যাড করো Moy kotoynok ( মাই কিটি ক্যাট)।
তবুও একজনের ও আইডি খুঁজে পাবে না,
তাদের আইডি থাকলে তো খুঁজে পাবে জান…”
তার চোখ দুটো তীব্র ঠান্ডায় ভরে উঠলো,
আর সেই হাসির তলায় জমে রইলো অদ্ভুত এক অভিমান,
নাম না নেয়া এক অভিমানের ভালোবাসা।
একটা নরম সন্ধ্যার আলোয় আজ চৌধুরী বাড়িতে যেন হঠাৎ করেই খুশির হাওয়া বইছে।
সবার চোখেমুখে হাসি, যেন বহুদিন পর মন খুলে নিঃশ্বাস নিচ্ছে এই বাড়ির বাতাস।
প্রান্তিক সাহেব, প্রণয় সাহেব আর মেহজাবীন বেগম–
তাদের চোখে মুখে খুশির রেখাটা যেন একটু বেশিই স্পষ্ট।
অন্যদিনের তুলনায় আজকে ওনাদের হাসি অনেক গভীর, অনেক সত্যি।
ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল ইউভি।
সবাইকে একসঙ্গে এত খুশি দেখে তার নিজের মনটাও ভরে উঠলো।
একধরনের প্রশান্তি,যেটা দীর্ঘদিন ধরে তার মনে ছিল না।প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
চোখ চলে গেল অনন্যার দিকে।
অনন্যা তাকিয়ে ছিল তার দিকেই,চোখে একরাশ মিষ্টি, নিশ্চুপ হাসি।
ইউভিও একটা মুচকি হাসি দিল ।না বলা অনুভূতির ছায়া লেগে রইল চোখে।
সে হয়তো কখনো মুখ ফুটে বলেনি অনন্যাকে কিছুই,
তবুও অনন্যা বোঝে,
তার ইউভি ভাইয়ার চোখে সে কেমন করে জায়গা করে নিয়েছে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনন্যার ভেতরেও
বুঝে ফেলার বয়স এসে গেছে।
ইউভির অদৃশ্য যত্ন, নীরব দায়িত্ব, নিঃশব্দ দেখা,সবই সে টের পায়।একটা মেয়ে খুব ভালো করেই টের পায়,
কে তাকে কীভাবে দেখে, কে তার নাম না নিয়েও তাকে নিজের করে রাখতে চায়।
ইউভি অন্যান্যর কাছে এসে বলল —
” কি হয়েছে রে পাখি সবাই এত খুশি কেন ?”
” জানিনা ইউভি ভাই আমি তো এই মাত্র নিচে আসলাম।”
ইউভি আবার ও একটু মুচকি হাসলো কারন সে জানে অনু প্রতিদিন এই সময় তার জন্য নিচে নামে ।
“ইউভি এদিকে আয় না বাবা একটু ”
প্রান্তিক সাহেব এর ডাকে পিছন ফিরে বলল
— ” জী বড় আব্বু ”
–” এদিকে আয় বোস ।”
— ” কিছু বলবা বড় আব্বু?”
মেহজাবীন বেগম বলে উঠলেন
–” হ্যাঁ বলবো বলেই তো ডাকলাম রে বাবা। ”
ইউভি রূহেনা বেগম এর দিকে তাকিয়ে বলল –
” আম্মু একটু পানি হবে ?”
একটু হাসি মুখ নিয়েই বললেন —
” হ্যাঁ রে তোর ছোট আম্মু তোর জন্য শরবৎ আনতেই গেছে ।”
মেহজাবীন বেগম মুখে খুশির পরশ ছড়িয়ে বলে উঠলেন —
” আমাদের অয়ন বিয়ে করতে চেয়েছে বুঝলি ।”
কথা টা শুনেই ইউভি মনে মনে বলল —
” যাক বাচা গেছে একজন তো বিদায় নিল। কিন্ত মাল টা ছিল কৈ এতদিন ? যাক বাবা বিয়ে করে আমার প্যারার লিস্ট দিয়ে বিদায় হোক।”
এর মধ্যেই সুরাইয়া বেগম শরবৎ এনে দিলো ইউভি কে,
ইউভি একটু খুশি হয়েই বলল —
” বেশ খুব ভালো কথা বড় আম্মু । তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দাও অয়ন কে । তো মেয়ে কোথাকার বড় আম্মু ?”
এই বলে শরবৎ টা ছুঁইয়ে নিল নিজের ঠোঁটের সঙ্গে ।
” মেয়ে আবার কোথাকার , আমাদের বাড়ির আমাদের তিয়াশা আম্মু ।”
ইউভি একটু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল,
“ওহ… ভালো কথা।”
কিন্তু কথাটা মাথায় পুরোপুরি ঢুকতেই, হঠাৎ যেন মাথার ভেতর ঘণ্টা বাজল।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে,
এক ঝটকায় সোফা থেকে উঠে চিৎকার করে উঠল–
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২৯
“কি-ই-ই-ই-ই!”
এই বলে মুখের জুসটা এক চুমুকে গিলে ফেলতে গিয়ে
হাতে-পায়ে গরম ঠাণ্ডা একসাথে লাগল।
কাশতে কাশতে মুখভর্তি জুস চারদিকে ছিটকে পড়ল।
মনে মনে বির বির করল —
“আ আমি স্যাস”