তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৪

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৪
নীল মণি

পশ্চিমের দিকের বড় জানালা দিয়ে রোদের শেষ ছায়াটা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে ।চুপ করে দেয়ালে গিয়ে পড়ে, যেন পুরনো স্মৃতির মতো গা ঘেঁষে বসে থাকে।চৌধুরী বাড়ির সন্ধ্যাগুলো এখন আর আগের মতো কোলাহলে ভরা থাকে না।এক সময় এই বাড়ির প্রতিটি কোণ হাসিতে মুখরিত হতো । ড্রয়িং রুম থেকে শুরু করে বারান্দার দোলনায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তো গল্পের গুঞ্জন।কিন্তু আজ সেই আলো নিঃশব্দ।
এদিকে সন্ধ্যা নামার খানিক পর…

চৌধুরী পরিবারের তিন কর্তা প্রান্তিক সাহেব, প্রণয় সাহেব আর তাহসান সাহেব,
একসঙ্গে গেট দিয়ে ঢুকলেন অফিস ফেরত।
গাড়ি থেকে নামতেই লোহার ফটক পার করে , সদর দরজা পার করে ড্রইং রুমের দিকে সবাই অবাক চোখেই তাকালেন । প্রণয় সাহেব,একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন —
“আজ সবাই গেল কোই বড় ভাই? এক গ্লাস পানি নিয়েও কেউ আসলো না তো।”
তাহসান সাহেব চোখ সরু করে বললেন —
আরে আজ তো হাফিজার মা কেও দেখা যাচ্ছে না ।ঘরও কেমন নিঃশব্দ লাগছে না বড় ভাই?
প্রান্তিক সাহেব সোফায় বসতে বসতে একটু চশমা ঠিক করে বললেন —
“ হুমম খুব অবাক করা বিষয় , এত বছরে হয়তো আমি এই প্রথম এই অনুভূতির স্বীকার হচ্ছি। এই বাসায় কিছু একটা ঘটতে চলেছে বুঝলি ছোট…
প্রণয় সাহেব একটু জোরে হাঁক দিয়েই বললেন —

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” এই বাসায় কি মানুষ জন আছে ? না মানে ইয়ে এই অধম রা একটু পানি দিয়ে তৃষ্ণা মেটাতে পারলে খুশি হতো ।
কারো কোন শব্দ নেই —
প্রণয় সাহেব নিজেই তিন গ্লাস ঠান্ডা পানি কিচেন থেকে নিয়ে আসলেন।
প্রণয় সাহেব পানি দিতে দিতে বললেন
“বাসায় ঢুকে দেখি চা তো দূরের কথা, নিজেরাই পানি বয়ে এনে খব্বিও।
এর মধ্যেই রায়ান গুণ গুণ করতে করতে উপর থেকে নিচেই আসছিল দ্রুত , ড্রয়িং রুমে তিন কর্তাকে দেখে একটু মুচকি হাসি দিয়ে চলার গতি ধীরে করে দিল।
রায়ান কে দেখেই তাহসান সাহেব বলে উঠলেন —
” ওই রায়ান তোর আম্মু, চাচিরা কোই রে ?”
রায়ান একটু মাথা চুলকে জবাব দিল —

“”আসলে আব্বু , বড় আম্মু , মেজো আম্মু , আম্মু সবাই আজ ধর্মঘটে আছে। আমি আজ সন্ধ্যায় নাস্তা পাই নাই তাই নাস্তা করতেই বাইরে যাচ্ছি আব্বু।”
এই বলেই রায়ান চলে গেল । তিনজনই এবার খানিকটা উদ্বিগ্ন মুখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন।শুধু শোনা যাচ্ছে ঘড়ির টিকটিক শব্দ আর এক নিঃশব্দ স্নায়ুচাপে ডুবে আছে ঘর।
তাহসান সাহেব আবার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন —
“কি হতে চলেছে বলতে পারো বড় ভাই? হঠাৎ এই ধর্মঘট কোন উপলক্ষে।”
চৌধুরী বাড়িতে যেন এখন চলছে এক কোন পুরাতন সিনেমার দৃশ্য।”
প্রান্তিক সাহেব একরাশ শঙ্কা নিয়ে বললেন —
“না রে ভাই, কিন্তু আচ ঠিক ই করতে পারছি। যদি আমার সন্দেহ ঠিক হয় ।নইলে একসাথে সব মুখ গুলো উধাও হয় না।

মনে মনে প্রশ্নে প্রশ্ন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
তাঁরা জানেন না, এ বাড়ির গিন্নিরা আজ এক নতুন সাহসের সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন…
চৌধুরী বাড়ির অভিমান যে আজ ঘরের পুরুষদের দ্বারে এসে কড়া নাড়বে তা তারা ঠিক বুঝতে পারছে।
তিন কর্তা প্রান্তিক, প্রণয় আর তাহসান সাহেব তখন নিজেদের ঘরে পা বাড়াতে যাচ্ছিলেন,
কিন্তু সামনের এ দৃশ্য দেখে সবাই একদম স্থির।
চৌধুরী বাড়ির মূল হল ঘরটা যেন মুহূর্তে একটা পারিবারিক ট্রাইব্যুনালে রূপ নিল ।তিন গিন্নী মেহজাবীন বেগম, সুরাইয়া বেগম আর রূহেনা বেগম একসঙ্গে যেভাবে বেরিয়ে এলেন,
তাতে যেন বাতাসটাও কয়েক মুহূর্ত থমকে গেল।
প্রান্তিক সাহেব চোখ সরু করে, চশমা নামিয়ে মেহজাবীন বেগম এর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলে উঠলেন–

” ব্যাপার কি মেডাম , কিছু বুঝতে পারছি না কি চলছে ? মনে মনে কি ফন্দী করছো জানতে পারি?”
মেহজাবীন বেগম, আজ আর সেই শান্ত স্নিগ্ধ বধূ নন,
মুখ ঘুরিয়ে সোজা গলায় বললেন—
“অবশ্যই জানাবেন কিন্তু তার আগে
কথা দিতে হবে যে আপনি সেই কথায়, রাজী থাকবেন?”
প্রণয় সাহেব, তাহসান সাহেব বুঝতে পাড়ছে তাদের বড় ভাবি কি বলতে চলছে ।
এই ফাঁকে তাহসান সাহেব একটু বাঁদিকে সরে গিয়ে সুরাইয়া বেগমের হাত টেনে নিয়ে চাপা স্বরে ফিসফিস করে বললেন–

“কিসের পাঁয়তারা করছো বউ তোমরা সবাই মিলে?”
তুমি তো জানো, আমি তো তোমাদের পক্ষেই থাকি সবসময়…”
এই ফাঁকে বাসায় পা রাখলো ইউভি।ইউভি ভেতরে ঢুকেই থমকে গেল।ঘরের ভেতরের সেই ‘চোখে চোখে আগুন’ পরিস্থিতি দেখে একটু হকচকিয়ে উঠলো।আর ইউভি বুঝে উঠতে পারছে আজ বাসার বাতাস অন্য কিছু বলছে । কিন্তু এর মাঝেই চোখ চলে গেল তাহসান সাহেব দের দিকে —
ইউভি ওনাদের দেখে মনে মনে বিড়বিড় করল —
” হায়রে আমার শ্বশুর মশাই নিজের রোমান্স বাদ দিয়ে আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার রোমান্স সেট করায় দেন , যাতে এই বয়সে রোমান্স না করে নাতি নাতনির সঙ্গে খেলতে পারেন , হায় আল্লাহ বউ তো মুখ ফুলায় আছে আমার কপালে আর রোমান্স।”

এদিকে সুরাইয়া বেগম তাহসান সাহেবের হাত টা ছড়িয়ে ধীম গলায় কড়া স্বরেই বলে উঠলেন —
” এই যে হঠাৎ ভালো মানুষ হয়ে উঠছো না, এই জিনিসটাই তো আপনার সমস্যার শিকড়। যখন যে থালায় ভাত বেশি দেখেন সেই থালায় বসে পরেন। তবে একটা কথা বলে দেই পাঁয়তারা এখনো শুরু করিনি , বড় আপা যা বলবে সেই কথা না মানলে পাঁয়তারা শুরু হবে ।”
এই বলে সুরাইয়া বেগম পুনরায় রূহেনা বেগম এর পাশে এসে দাড়ালেন। রূহেনা বেগমও তখন মেহজাবীনের পাশে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছেন ।
একটুও চোখ ফেরালেন না প্রণয় সাহেবের দিকে,
যদিও প্রণয় সাহেব এর চোখে তখন স্পষ্ট একটা ইশারার প্রতীক্ষা।
কিন্তু তাহান সাহেব থ মেরে দাড়িয়ে রইল —
মনে মনে বলছেন —

” কি বলে গেল তার স্ত্রী? অপমান করে গেল না ধমকি দিয়ে গেল কোনটা?”
এই ভাবতে ভাবতে মাথা চুলকে ইউভির পাশে গিয়ে দাড়াল , ইউভির পাশে গিয়ে বিড়বিড় করে বলল —
” বুঝলি ইউভি এই মেয়ে জাতটা বোঝা বড় দায় , এই কুড়ি বছরে হারে হারে টের পাচ্ছি।”
এই বলে একটু মাথাই নিচু করে রইল , তখন ইউভি
মনে মনে বলে উঠলো —
” শ্বশুড় আব্বা আপনি ২০ বছর ধরে টের পাচ্ছেন আর আপনার মেয়ের সঙ্গে রিলেসন গেলাম এখনো ৫ দিন ও হয় নাই এর মধ্যেই আমায় নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে ।”
তাহসান সাহেব মাথা নিচু করেই জিজ্ঞেস করে উঠলেন —
” কিচ্ছু বললি ইউভি ?
ইউভি একটু মুচকি হেঁসে বলে উঠল —

” না না চাচু আমি কিছু বলি নাই, আসেন আমার বুকে আসেন ।”
তাহসান সাহেব বুঝতে পারলেন ইউভি ও তার মজা নিচ্ছে তাই কটমট করে তাকিয়ে পরলেন ।
এর মধ্যেই প্রান্তিক সাহেবের কণ্ঠে ভেসে এলো এক গম্ভীর উচ্চারণ—
“শোনো মেহজাবীন, কথা যদি রাখার মতো হয়, তবে নিশ্চয়ই রাখবো। কিন্তু যদি আমার সন্দেহ সঠিক হয়, তাহলে জেনে রেখো— কোনো ধর্মঘটেই ফল হবে না।”
এই কথায় মেহজাবীন বেগম ঠোঁট বাঁকিয়ে, অপলক চাহনিতে জবাব দিলেন—
“হয়তো আপনার সেই সন্দেহই সত্যি। আর আমি আজ সেই দাবি নিয়েই এসেছি। আজ দেখবো, আপনার জেদের সামনে এই মায়ের মমতা কতটুকু স্থান পায়।”

প্রান্তিক সাহেব তাঁর স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে বজ্র গর্জনে উঠলেন, এতটাই তীব্র যে অনন্যা দৌড়ে নিচে নেমে এলো।
“মেহজাবীন! এই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল আমার একদম সহ্য হয় না।”
সেই রুদ্রস্বরে মেহজাবীন বেগমও গর্জে উঠলেন—
“আমারও সহ্য হয় না ছেলেমেয়েদের এত দূরে রাখা। নিজের ছেলের সঙ্গে তাঁর বয়সের অর্ধেক সময়ও কাটাতে পারিনি, শুধুমাত্র আপনার জেদের কারণে। আর এই বাড়ির বড় মেয়ে বৃষ্টি আম্মু , সে এমন কী অপরাধ করেছিল যে তার নামটুকু উচ্চারণ করাও এখানে অপরাধ?
সবাই স্তব্ধ। এই শান্ত, নরম সুরের মানুষটি এত দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছেন দৃশ্যটি যেন অবিশ্বাস্য।
পর মুহূর্তে মেহজাবীন বেগম রূহেনা বেগমের বাহু চেপে ধরে নিয়ে এলেন সামনে–
“দেখতে পাচ্ছেন এই মায়ের মুখ? দেখুন, কতটা কষ্ট চেপে রেখেছে ,একজন পুরুষ কখনও বুঝবে না সন্তান জন্মদানের যন্ত্রণা, আর যদি সেই সন্তানকে দূরে রাখতে হয় তবে সেই কষ্ট কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না , তিন বছর আগে আমাদের মতামত অনুযায়ী ওই ছেলে মেয়ে দুটোর হাত এক করে দিতাম তাহলে কখনো ওরা সুখে থাকতে পারত ? দেখেন নি তিয়াশা
আম্মুর জন্য আপনার ছেলের পাগলামো। দেখেন নি বৃষ্টি আম্মু ভলোবাসার খাতিরে পড়িবার পর্জন্ত ছাড়তে বাধ্য হয়েছে ।”

প্রান্তিক সাহেবের চোখ জ্বলে উঠছে রাগে।এর মধ্যেই প্রণয় সাহেব বলে উঠলেন —
” বড় ভাবি এইসব কি বলছো ? না জেনে এইসব বলা ঠিক না ভাবি । বড় ভাইয়া তার সন্তান দের খবর রাখে না
এই কথা টা একদম ঠিক না ।”
তখনই মেহজাবীন বেগম বজ্রকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন–
“তোমরা কেউ মুখ খুলবে না।কেন সব সময় এই মানুষ টার ঠিককে ঠিক বলবে আর ভুল কে ভুল । তোমার কি মনে পড়েনা বৃষ্টি আম্মুর কথা । তিয়াশা আম্মুর কথা । আরে তোমাদের জেদের জন্য এই বাসাটা আর বাসা নেই শুধুই এক জেদি দেয়ালের সমষ্টি।”

পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তাহসান সাহেব তখন ইউভির কানে কানে ফিস ফিস করলেন–
“ওরে ইউভি, বড় ভাবির মধ্যে কি কোনো জিন ঢুকেছে নাকি রে?”
কিন্তু ইউভির মন সেখানেই নেই। চোখে কেবল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে দাড়িয়ে থাকা হৃদয় পাখির দিকে , ইশারায় চেষ্টা করছে মান ভাঙাতে।
হঠাৎই মেহজাবীন বেগম আবার ফিরে তাকালেন স্বামীর দিকে। এবার স্বরটা কোমল, কিন্তু দৃঢ়–
“একবার অন্তত মেনে নিন ছেলেমেয়েগুলোকে… মানুষ মাত্রেই ভুল হয়…”
প্রান্তিক সাহেব কঠিন মুখে এক কথায় বললেন–
“অসম্ভব।”
এই কথায় মেহজাবীন বেগম চোখের জল মুছতে মুছতে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন —
“তাহলে আমরাও এই পরিবার ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”
তিনি চোখ ফিরিয়ে চাইলেন রূহেনা ও সুরাইয়ার দিকে

“চল ছোট, চল মেজ।”
এই কথা যেন বজ্রপাতের মতো আঘাত করলো উপস্থিত সবার উপর।
প্রণয়, তাহসান, ইউভি, অনন্যা কেউ কিছু বলার শক্তিও খুঁজে পাচ্ছে না।
প্রান্তিক সাহেব রুদ্র স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন–
“মেহজাবীন ।এই ছেলেমানুষি বন্ধ করো।”
ঠিক তখনই সদর দরজার দিক থেকে এক গভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো–
“বউ।”
চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি মুখ থমকে গেল।ঘড়ির কাঁটাও যেন স্থির হয়ে দাঁড়াল সে মুহূর্তে।সবার দৃষ্টি একসাথে ঘুরে গেল দরজার দিকে।সামনে দাঁড়িয়ে আছে জায়ন।মাথা সামান্য নিচু, চোখে জেদ আর ক্লান্তির ছায়া।যার কণ্ঠে ‘বউ’ শব্দটা এল,তা যেন এই শান্ত সন্ধ্যার বুক চিরে হঠাৎ এক তীব্র বজ্রপাত।
প্রান্তিক সাহেব চোখ সংকুচিত করে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন–

“তুমি এখানে কী করছো, ?
তোমায় না বলেছিলাম এই বাড়িতে তোমার আর কোনো জায়গা নেই।”
জায়ন ঠোঁট বাঁকিয়ে এক বিষণ্ণ হাসিতে জবাব দিল-+
“এই বাড়িতে আসার ইচ্ছা আমারও ছিল না, বাবা।
আমি শুধু আমার বউকে নিতে এসেছি।ওকে নিয়ে ফিরে যাব, এক মুহূর্তও দেরি করবো না।”
এক মুহূর্তের নিঃশব্দ বিস্ময় ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে।
প্রত্যেকেই একে অন্যের মুখের দিকে তাকালো।এই ছেলেটা ঠিক কী বলছে?
প্রান্তিক সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন–
“তোমার বউ এখানে কেন থাকবে?নিজের বাসায় খোঁজো।আজকাল তো বউ এর ভার্সিটির সামনেও গুন্ডামির করছো,এখন বুঝি সেই কাণ্ড এই বাড়িতেও করতে এসেছো?”
এই শেষ কথাটায় যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটলো পরিবেশে। সবাই চমকে উঠলো ‘ গুন্ডামি?’
ইউভি থমকে দাঁড়াল চোখে মুখে ভয়ের ছায়া,
মনে মনে বিড়বিড় করে উঠলো —

“বড় আব্বু জানলেন কীভাবে? ”
এই কথাগুলোর মধ্যেই মেহজাবীন বেগম আর রূহেনা বেগম যেন কিছু শুনলেনই না–
পথ ফাঁক করে দৌড়ে এলেন জায়নের কাছে।
মেহজাবীন চোখে উদ্বিগ্নতা আর মমতার ঝড় বয়ে চলছে , রূহেনা বেগম বললেন–
“জায়ন বাবা, তুই তিয়াশা এখানে কেন খুঁজছিস?”
জায়ন শান্ত গলায়, কিন্তু দৃষ্টি অটুট রেখে জবাব দিল–
“মেজো আম্মু, আমার বউ এখানে এসেছে। তাই ওকে এখানে খুঁজতেএসেছি।”
তারপর ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল প্রান্তিক সাহেবের চোখে,আর বলল–

“হ্যাঁ, আমি রাগ করি। হ্যাঁ, আমি চিৎকার করি।
হ্যাঁ, প্রয়োজনে গুন্ডামিও করি…কিন্তু সবটাই করি আমার বউয়ের জন্য।কারণ ও আমার জীবন, এখন ও আমার অস্তিত্ব।
আপনি শুধু আমাকে আমার বউ কোথায় বলে দিন।
আমি কোনো ঝামেলা না করেই এখান থেকে চলে যাব।”
তখনই মেহজাবীন বেগম নিঃশব্দে কাঁপা গলায় বলে উঠলেন,“মেজো আম্মু তো এখানে নেই রে বাবা…”
জায়নের চোখে যেন মুহূর্তে অন্ধকার নেমে এলো।
তার দৃষ্টি শূন্য হয়ে গেল ।
কিন্তু জায়নের মুখের অন্ধকার তখনো কাটেনি।
তার ঠোঁটে একপ্রকার বিরক্তির হাসি খেলে গেল, যেন একটা তিক্ত বিশ্বাসঘাতকতাকে জোর করে ঠাট্টায় ঢেকে দিতে চাইছে।

সে বলে উঠল,
“মজা করো না মা…”
তারপর চোখ সরাসরি ইউভির দিকে।স্বরের ভিতরে অস্থিরতা–
“আমার বউকে ডেকে নিয়ে আয়, ইউভি। এক্ষুনি।”
ইউভি হতবাক।কিছুটা দমবন্ধ গলায় বলল–
“ভাইয়া… বনু সত্যি এখানে নেই।”
জায়ন থেমে গেল। তার চোখে যেন মুহূর্তে ধোঁয়াশা জমে উঠল।না, এটা মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
সে তখন নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চিৎকার করতে করতে নিচতলার একে একে সব ঘর খুঁজতে লাগল–
“রোদ… রোদ জান, সামনে আয়… প্লিজ… জান, প্লিজ সামনে আয় না…”
তার কণ্ঠে ভয়, ভাঙা হৃদয়ের ছাপ।ড্রয়িং রুম জুড়ে থমথমে এক বাতাস।
তখনই প্রান্তিক সাহেব গম্ভীর গলায় গর্জে উঠলেন–
“বলেছি তো, মেজো আম্মু এখানে নেই।”

কিন্তু জায়নের কানে যেন কিছুই ঢুকছে না।পাগলের মতো সে আবার ছুটে ওপরে চলে গেল, একেকটা ঘরের দরজা ধাক্কা দিতে দিতে বলছে–
“রোদ… জান, কোথায় তুই? সরি না জান,ভালো লাগছে না কিছু… প্লিজ সামনে আয়…”
এদিকে ইউভি আর প্রণয় সাহেব ছুটে গেল ওপরে, ভয় যেন ঘিরে ধরেছে দু’জনকেই।
ইউভির চোখে-মুখে আতঙ্ক, গলা শুকিয়ে এসেছে তবু বলল–
“ভাইয়া, বনু সত্যিই এখানে আসেনি।
আপনাকে ঠকানোর মত ভুল কেউ করেনি ভাই। বিশ্বাস করো…”
প্রণয় সাহেবের গলায় কাঁপন সৃষ্টি হয়েছে মেয়ের চিন্তায় –
“জায়ন… আমার মেয়েটা কোথায় রে?”
সেই প্রশ্ন যেন কানে ঢুকতেই জায়ন এক চিৎকারে ফেটে পড়ল–
“একটা কথাও বলো না মেজো আব্বু।আমার রোদকে ফিরিয়ে দাও…আমি চলে যাচ্ছি… এক মুহূর্তও থাকব না, কসম… কিন্তু শুধু ওকে ফিরিয়ে দাও…”

তার চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে ।প্রিয়তমাকে ছাড়া এই মুহূর্তে কিছুই ভালো লাগছে না।
ইউভি দাঁত চেপে বলল—
“ভাইয়া, প্লিজ… বিশ্বাস করো, বনু নেই… এই বাসায় ও আসেইনি…”
জায়ন পাগলের মতো এক দৌড়ে নিচে নেমে এলো।
তার চোখে শুধুই বেপরোয়া যন্ত্রণা।
প্রান্তিক সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে সে যেন নিজেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল–
“বাবা… প্লিজ বলো না, কোথায় লুকিয়ে রেখেছো…
আমি আর পারছি না… প্লীজ বলো, আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এরকম করছো , সব শাস্তি মেনে নেব… বাবা, শুধু রোদ কে দাও …”
তার এই ভগ্ন অবস্থা দেখে সবাই স্তব্ধ।কেউ ভাবেনি , জায়ন ভয়ানক পাগলামির সঙ্গে নিজের কঠিন সত্তা টাকেও ছুঁরে ফেলবে ।
রূহেনা বেগম কেঁদে কেঁদে বললেন—

“জায়ন… আমার মেয়ে সত্যিই এখানে আসেনি রে বাবা…কোথায় গেল সে… কোথায় আমার মেয়ে?”
জায়ন অস্ফুট গলায় চিৎকার করে উঠল —
“না… না… ও লিখে এসেছে এই বাসায় আসবে… তাহলে নেই মানে কী?”
সে মেহজাবীন বেগমের কাছে গিয়ে মাটিতে বসে পা ধরে বলল–
“মা… মা তুমি তো সব জানো… বলো না আমার রোদ কোথায়… প্লিজ, মা…”
মেহজাবীন বেগমের চোখে তখন এক দৃষ্টিহীন জলরেখা, আর হৃদয়ে একটা আতঙ্কিত মাতৃত্ব।তার ছেলেটা চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে, আর তিনি কিছুই করতে পারছেন না।
জায়ন তাকাল সুরাইয়া বেগমের দিকে, দৃষ্টিতে হাজারটা প্রশ্ন–
“ছোট মা… তুমি তো সব জানো… প্লিজ বলো তুমি…”
সুরাইয়া বেগম ধীরে মাথা নেড়ে বললেন–

“জায়ন… সত্যিই বলছি বাবা, তিউ এখানে আসেনি…”
জায়ন তখন নিজের চুলের মুঠি ধরে নিজের মাথা টানছে।
চারপাশে এত পরিচিত মুখ, অথচ কেউই বলছে না তার ভালোবাসা কোথায়।
জায়ন এর এই পাগলামো যেন প্রান্তিক সাহেব কেও
নাড়িয়ে তুললো । তখন প্রান্তিক সাহেব এগিয়ে এসে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন–
“নিজেকে একটু সামলে নে, …মেজো আম্মু সত্যিই এখানে নেই।তুই তো জানিস, ও আমাদের কতটা আদরের।ওর জন্য আমরা সব করব… কিন্তু এখন শান্ত হ।”
তাহসান সাহেব ধীরে বললেন—
“জায়ন… এমন করিস না… খুলে বল, আসলে কী হয়েছে?”
প্রণয় সাহেবের গলায় শুধু একটাই কথা —

“আমার মেয়েটা কোথায় …?”
ইউভি কিছু টা আন্দাজ করতে পারছে।এদিকে জায়ন কিছু বলছে না।
এবার যেন জায়নের ভিতরের কিছু চুপচাপ থেমে গেল।কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল চারপাশের নিস্তব্ধতার সাথে। কেন যে সে তিয়াশার ফোন টা ভাঙতে গেল ।
যোগাযোগ করতেও পারছে না কিন্তু হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গেল একটা ছোট্ট জিনিস —
তিয়াশার সেই পেন্ডেন্ট, যেটা সে নিজেই দিয়েছিল জিপিএস ট্র্যাকার লাগিয়ে।
“আমি এতক্ষণ এটা ভুলে গেলাম কী করে।”

বলেই পকেট থেকে মোবাইল বের করল।
চোখে চাপা আতঙ্ক, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনে।
“ইউভি”
চিৎকার করে উঠল সে ।“তাড়াতাড়ি আকাশকে ফোন কর এখনই ।”
“জী ভাইয়া, এক্ষুনি ডাকছি ।”
বলেই ইউভি ফোন লাগালো আকাশ কে।
জায়ন পাগলের মত দরজার দিকে ছুটে গেল।
“আমরাও যাচ্ছি রে বাবা।” —
পিছনে বলে উঠলেন তাহসান সাহেব আর প্রণয় সাহেব।
কিন্তু জায়ন দাঁড়িয়ে ঘুরে বলল–
“না না কারো আসার দরকার নেই।তোমরা সবাই এখানে থাকো। তোমাদের কেউ কোথাও যাবে না।”
সে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল–
“মা… আমার রোদের যদি একচুলও ক্ষতি হয়…
তাহলে তোমার ভাতিজার জন্য আজই এই পৃথিবী শেষ।
এই কথা বলেই যাচ্ছি…”

এক মুহূর্ত, তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল জায়ন–
চোখে আগুন, হৃদয়ে একটাই নাম–
‘ রোদ ‘
অনন্যা , মেহজাবীন বেগম, রূহেনা বেগম , সুরাইয়া বেগম সবার চোখে জল। আর বাসার পুরুষ দের চোখে নেমে এসেছে এক চিন্তার ছায়া ।
“নয়ন ভাইয়া… আপনি কেন আমায় মিথ্যে বললেন? আপনি তো বলেছিলেন বাসায় নামিয়ে দেবেন… তাহলে এখানে কেন আনলেন? আর আমার হাত বেঁধে রেখেছেন কেন? আমি খুব ভয় পাচ্ছি… প্লিজ, আমাকে বাসায় পৌঁছে দিন…”
তিয়াশার কণ্ঠ তখন কাঁপছে কান্নায়, তার প্রতিটি চিৎকারে যেন ভয় আর অসহায়তার আর্তি।
নয়ন এক মুহূর্ত চুপ থেকে ধীরে বলল–
“সরি তিয়াশা… মিথ্যে বলেছি ঠিকই… কিন্তু আমি বাধ্য ছিলাম… নিজের ভাইয়ের জন্য… আমি মজবুর ছিলাম তিয়াশা…”

তিয়াশা হতাশ, হতভম্ব, ক্ষোভে আর কান্নায় চিৎকার করে উঠল–
“আমি পাগল। সত্যিই পাগল। বুঝে নেওয়া উচিত ছিল আমার… তুমি বনানীর বাসার সামনে কী করে এলে, তখনই বোঝা উচিত ছিল”
ঠিক তখনই দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করল অয়ন।
চেহারায় ব্যান্ডেজ, কপালে পট্টি, চোখেমুখে কালশিটে কিন্তু চোখে সেই পুরনো উন্মাদনা।
সে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে তিয়াশার সামনে, চিবুকে হাত রেখে বলল–
“তুমি কাঁদছো কেন? আর কেউ আমাদের মাঝে আসবে না, তিয়াশা। এবার আমরা একসাথে হবো।”
তিয়াশা জ্বলে উঠল–
অয়ন এর হাত এক ঝটকায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলল

“আপনি ভুল ভাবছেন। সেদিন রাতে যে কথাগুলো বলেছিলাম, সেগুলো আপনার জন্য ছিল না। আমার স্বামী… আবরার জায়নের জন্য ছিল ওগুলো। সবটা ছিল একটা ভুল বোঝাবুঝি… এখন আমাকে যেতে দিন প্লিজ।”
অয়নের ঠোঁটে ফুটে উঠল এক বিদ্রুপের হাসি।
“তুমি জায়নের ভয়ে এসব বলছো, আমি জানি।
আর ভয় নেই। খুব শীঘ্রই আমাদের বিয়ে হবে। চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা রহমত সাহেব আর সুনিতা বেগম গলা কাঁপিয়ে বলে উঠলেন–
“অয়ন, দয়া করে… ওকে ছেড়ে দে।

তুই যা ভাবছিস, সেটা আর বাস্তব না।
তিয়াশা এখন জায়নের স্ত্রী। পাগলামি বন্ধ কর।”
কিন্তু অয়ন কারো কথায় কর্ণপাত করল না।
তিয়াশা গলা কাঁপিয়ে বলে উঠল+-
“বিয়ে মানে একটা বন্ধন, একটা পবিত্রতা, যা আমি আমার স্বামীর সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি। আমাকে যেতে দিন… প্লিজ, আমার হাতটা খুলে দিন…”
অয়নের সোজাসাপটা উত্তর–
“না দেবো না।”
তিয়াশা এবার হুঁশিয়ারির সুরে বলল–
“আপনি জানেন না… যদি একবার উনি জানতে পারেন, আপনি কী করেছেন… আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, আপনার কী অবস্থা হবে।”

অয়ন ঠোঁট উল্টে হেসে বলল—
“যতক্ষণে সে জানতে পারবে, ততক্ষণে তুমি আমার হালাল স্ত্রী হয়ে যাবে। তখন আর কিছুই করার থাকবে না ওর…”
তিয়াশা আর সহ্য করতে না পেরে বুক চিরে চিৎকার করে উঠল–
“নয়ন ভাইয়া… প্লিজ… আমাকে যেতে দিন।আমাকে কেন নিয়ে এলেন এখানে?
রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা। সবাই চুপ। কারো মুখে কোনও শব্দ নেই।
অয়ন পিছন ফিরে বলল–

“আমি বলেছিলাম, ওকে তোমাদের পেছনে যেতে। যখন জায়ন আমাকে মারছিল, তখন ও ওইখানেই ছিল।”
ঠিক তখনই দরজায় এক বিকট শব্দ।এক ধাক্কায় যেন রুমের হাওয়া বদলে গেল।সবচেয়ে চেনা সেই অস্তিত্ব ।
তার চোখে জ্বলছে র**ক্তমাখা প্রতিশোধ, তার শরীর থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে।
সুনিতা বেগম, রহমত সাহেব, নয়ন সবাই ভয়ে এক ধাক্কায় পিছিয়ে গেলেন।
আর তিয়াশার মুখে ফুটে উঠল এক আশার হাসি।
তবুও একটুখানি ভয়, যদি জায়ন আবারও কিছু ভুল বুঝে বসে?
জায়ন চোখে চোখ রাখল তিয়াশার।দেখামাত্রই স্তব্ধ হয়ে গেলো।তিয়াশার চোখ ভেজা, হাত বাঁধা।
এই চিত্র যেন তার বুক চিরে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে সবকিছু।এক সেকেন্ডের মধ্যে চোখে জমে উঠল র*ক্ত, চোয়াল হয়ে উঠছে শক্ত।অয়নের দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছু না বলেই সজোরে এক লাথি মারল মুখে।
অয়ন ছিটকে পড়ল মেঝেতে।

তিয়াশার কাছে ছুটে গিয়ে হাতে বাধা দড়ি খুলতে খুলতে জায়ন বলল–
“সরি জান… সরি জান… এই কু***র বাচ্চা তোর এই অবস্থা করেছে ওকে তো আমি শেষ করে দেব? সোনা কোথাও টাচ ওই জানোয়ার তোকে ?”
তিয়াশা তো হতবাক।এতটা ভয়ংকর রাগের মধ্যে জায়ন তাকে কী সুন্দর করে “সোনা” বলে ডাকছে।
তবে কি সে সেই লেখা চিরকুট গুলো পড়েছে?
হাত খুলে দিয়ে, তার চিবুক ছুঁয়ে জায়ন আবার বলল–
“বল জান… কোথাও টাচ করেছে ওই হারামির বাচ্চা?”
তিয়াশা মাথা নাড়িয়ে “না” বোঝাল।
ঠিক তখনই রুমে ঢুকল ইউভি আর আকাশ।
জায়ন ধীরে জিজ্ঞেস করল–

“কি করে আসলি এখানে জান?”
তিয়াশা কান্না চেপে, কাঁপা কণ্ঠে বলল–
“আমি ওই বাসায় যাওয়ার জন্য সিএনজির জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ নয়ন ভাই এলেন, বললেন আমায় বাসায় পৌঁছে দেবেন… আমি অনেকবার না করলাম, তাও বললেন উনি ঐদিকেই যাচ্ছেন। আমি বিশ্বাস করে উঠে পড়েছিলাম… আমি জানতাম না…”
এটুকু বলেই হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল তিয়াশা।
নয়নের গলা শুকিয়ে এসেছে, সে চুপচাপ।জায়ন বিদ্যুৎ গতিতে নয়নের দিকে ছুটে গেল, কলার ধরে এক ঘু**ষিতে দেওয়ালে ছুড়ে মারল তাকে। চারপাশে র*ক্ত ছিটকে পড়ল।
সুনিতা বেগম কাঁদছেন, চিৎকার করছেন।
অয়ন, নয়ন,দু’জনেই ব্যথায় গোঙাচ্ছে।
ঠিক তখন রহমত সাহেব কেঁপে কেঁপে বলে উঠলেন–
“ওর দোষ নেই। অয়ন আমাদের আ**ত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিল… আমরা বাধ্য হয়েছি তাকে সাহায্য করতে… ছেড়ে দে ওকে ”

জায়ন তেড়ে উঠল–
“একদম চুপ, মামা। আমি বলেছিলাম আমার বউয়ের আশেপাশে নেক্সট টাইম জ্যান্ত পুঁতে দেব, আজ তাই করবো।”
সুনিতা বেগম ছুটে এসে জায়নের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন–
” যা বলিস, সব মেনে নেব। আমরা দেশ ছেড়ে চলে যাবো। ওদের ছেড়ে দে এখন… প্লিজ…”
জায়নের মুখে ঠান্ডা বিদ্রুপ হাসি , এই হাসি যেন পুরো ঘরে বেজে উঠলো।
“অনেক সুযোগ দিয়েছি, মামী…আজ আর না। এবার তোমাদের পরিণতি কেউ ঠেকাতে পারবে না।”
সে গর্জে উঠল–

“ইউভি। এক মিনিটের মধ্যে আমার বউকে নিয়ে তোদের গাড়িতে বসিয়ে রাখ ,রাইট নাও।”
ইউভি এক মুহূর্ত দেরি না করে তিয়াশাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
“আকাশ, তুইও যা,”— পেছন না তাকিয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বলল জায়ন।
“জ্বী ভাইয়া,”— বলে আকাশও বেরিয়ে গেল।
ওরা যেতেই জায়ন নিজ হাতে দরজা বন্ধ করে দিল।
রুমের ভেতর থর থর করে কাঁপছে দুই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।
জায়ন ধীরে এগিয়ে এসে অয়নের সামনে দাঁড়াল, ঠোঁটে সেই চিরচেনা শীতল হাসি–
“কতবার তোকে বারণ করেছিলাম, হা**র বাচ্চা।
তবু শোনলি না। এবার শুনতে হবে ঠিকমতো।”

অয়নের চোখে এখন শুধু ভয়… কিন্তু এতটা যন্ত্রণায় সে মুখ দিয়ে শব্দও বের করতে পারছে না।
হঠাৎ, পেছন থেকে পি**স্তল বের করে জায়ন, ঠান্ডা গলায়,—
দুই পায়ে গু**লি চালাল।
গুলির শব্দে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল।সুনিতা বেগম সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পরে গেলেন ।রহমত সাহেব নিথর দাঁড়িয়ে।

জায়ন এবার ওনার সামনে এসে নিচু গলায় বলল–
“পঙ্গু ছেলেকে নিয়ে যেন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া হয় মামা।ইচ্ছা ছিল মে*রে ফেলি,কিন্তু তোমাদের মুখ দেখে আধা-মরা করে ছেড়ে দিলাম আবার।
পুলিশে যেতে পারো, কেসও করতে পারো…
কিন্তু আবরার জায়নকে ছোঁয়ার সাহস পুলিশের বুকেও থাকতে লাগবে ।”
এই বলেই সে ঘুরে দাঁড়াল।আর কিছু না বলে দরজা খুলে হেঁটে বেরিয়ে গেল সেই ঝড়ের মতো আগত পুরুষটি—
আবরার জায়ন চৌধুরী।

এদিকে ইউভি ফোন করে বাসায় সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে–
“বোনকে পেয়েছি, চিন্তার কিছু নেই, এখন ও আমাদের সাথেই আছে।”
ফোন রেখে ইউভি একটু নিঃশ্বাস ফেলতেই তিয়াশা ধীরে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল–
“ভাইয়া… ওইটা কিসের আওয়াজ ছিল একটু আগে?”
এক মুহূর্তের জন্য যেন গাড়ির ভেতর হাওয়াটাও থমকে গেল।
ইউভি আর আকাশ দুজনেই জানে, ঠিক কীসের আওয়াজ ছিল সেটা।
তিয়াশাও হয়তো বুঝেছে…

তবু হয়তো মন মানতে চাইছে না…
হয়তো বিশ্বাস করতে চাইছে, তার জন্য কেউ এভাবে অস্ত্র তুলে নেয়নি।
ইউভি একটু হেসে মুখ ফিরিয়ে বলল–
“কোন আওয়াজ, বোন? আমরা তো কিছু শুনিনি।”
তারপর চোখ টিপে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল–
“আকাশ, তুই কিছু শুনলি?”
আকাশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেসে ফেলল–
“না ভাইয়া, আমি তো জানালা দিয়ে সন্ধ্যার হাওয়া ছাড়া আর কিছুই শুনিনি।”
দুজনে হেসে ফেলল একটা বেখেয়ালি হাসি,
যেখানে লুকিয়ে আছে সযত্নে লুকানো একটা নাটক,
যার পর্দা যেন তিয়াশার চোখে না পড়ে।
তিয়াশা চুপ করে বসে রইল।মনে মনে ভাবল, সে কি তাহলে ভুল শুনেছিল?না কি… ওরা ইচ্ছা করেই বলছে না কিছু?কিছু ভাবতে পারছে না।

এমন সময়ে সেই চেনা গর্জনের মতো কণ্ঠ,
গাড়ির দরজাটা খুলে গেল…
“বউ ”
জায়ন,একটানে তিয়াশাকে গাড়ি থেকে টেনে বের করে
নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরল।
বুকে মুখ গুঁজে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল —
“সরি বউ… সরি আমার কিটিক্যাট… সরি জান… আমি দেরি করে ফেলেছি,।
তিয়াশার বুক কেঁপে উঠল।তিয়াশা মনে মনে একটু খুশি হচ্ছে কিন্তু এত তাড়াতাড়ি গোলে গেলে হবে না।
ওর চোখে জল এলেও, সে মুখ গোমড়া রেখেই
নিজের সমস্ত জোর দিয়ে জায়নকে ঠেলে সরিয়ে দিল।
“লাগবে না আমার আপনার সরি। আপনি একটা বিরক্তিকর, বদমাইশ, বাজে বাঘের বাচ্চা। শুধু কষ্ট দেন, শুধু ব্যথা দেন।

জায়নের চোখে এখনো জল, কিন্তু ঠোঁটে লেগে আছে এক মায়াবী হাসি।
“সরি জান… এবার থেকে আর কষ্ট দেবো না।
চাইলে এইখানেই তুই আমাকে মার, বউ…
তোর ইচ্ছামত এক ঘা, দুই ঘা… আমি হাসিমুখে মেনে নেবো।”
তিয়াশা মুখ ঘুরিয়ে সামনে দ্রুত হাঁটা শুরু করল,
দুই হাত সামনে গুঁজে নিয়ে গম্ভীরভাবে বলল–
“আমার বয়েই গেছে আপনাকে টাচ করতে। ফাউল বুড়ো লোক,”
জায়ন ও পিছন পিছন হাঁটছে, হাতে ফুল না থাকলেও মুখে প্রেমের পাগলামি।
“জান ছুঁতে তো হবেই, নইলে আমার ব্লাড লাইনের জন্য ইনভেস্টমেন্ট কোথায় করবো ,বয়স তো হচ্ছে, এখন তো একটু একটু খেয়াল রাখতে হবে নাকি?”

ওদের এই নাটক দেখে ইউভি আর আকাশ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে কুটিকুটি।
“এই দুইটা মানুষকে দেখলে মনেই হয় না এতক্ষণ আগে র**ক্তার**ক্তি হয়ে গেছে,”–আকাশ ফিসফিস করে বলল।
“প্রেমের ব্যথা চুপিচুপি গুলি খায় আর পরে দৌড়ে যায় আদরে মিশে…” —ইউভি মুচকি হেসে বলল।
আর ওই সন্ধ্যার রঙে, আকাশের বুক জুড়ে চাঁদের আলোর মতো নেমে এলো এক জোড়া ভালোবাসা।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৩

দুজন মানুষ, যারা আজ বুঝে গেল
ভালোবাসা মানেই শুধু চোখের জল না…
ভালোবাসা মানে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা,
ঝড়ের মুখে বুক টান করে দাঁড়ানো।
তিয়াশা আবার হাঁটতে হাঁটতে একটু পেছনে তাকাল…
জায়নের চোখে সেই পাগলামি…
আর হৃদয়ে তার জন্য বুনে রাখা চিরন্তন ভালোবাসা।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here