তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৬
নীল মণি
২ ঘণ্টা আগে (ফ্ল্যাশব্যাক)🍁
চৌধুরী বাড়ির ভিতরে তখন যেন এক অদ্ভুত স্তব্ধতা।
জায়ন বেরিয়ে যাবার পর কেউ আর ঠিক করে কথা বলছে না।প্রত্যেকটা মুখে অদ্ভুত এক দুশ্চিন্তা–
“তিয়াশা কোথায়?”
প্রান্তিক সাহেব ধীরে ধীরে সোফায় বসে পড়লেন।
কোনো কথা নেই মুখে।চোখদুটো যেন অতল ক্লান্তিতে ডুবে আছে।একটু থেমে নিজের দুই ভাইকে লক্ষ্য করে যেন করে বলে উঠলেন—
“মেজো, ছোট… আমার ছেলে কে আমি আর চিনতে পারছি না…এই উন্মাদ পাগল ছেলে তো আমার ছিল না । এই উন্মাদ, এই দুরন্ত, এই অস্থির ছেলেটা তো আমি গড়িনি।
কেউ কিছু বলছে না।
প্রান্তিক সাহেব একটু চুপ করে থেকে বললেন
প্রান্তিক সাহেব একটু চুপ করে থেকে বললেন—
“ওইদিন যেভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করল, আজ ও নাকি আবার ইউনিভার্সিটির সামনে গুন্ডামি করেছে। নেশা পর্যন্ত করে, আজ নেশা করে পড়েছিল।
এখন আবার পাগলের মত কান্নাকাটি করছে মেজো আম্মুর জন্য । এই ছেলে কি সত্যি পাগল হয়ে গেলো?”
এই কথা শুনে সবাই অবাক।কে বলল উনাকে এসব?
যেন কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।
মেহজাবীন বেগম ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বসে পড়লেন প্রান্তিক সাহেবের পাশে।চোখ ভর্তি জল, গলা বুজে এসেছে–
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আপনি জানলেন কীভাবে? জায়ন নেশা করেছে… গুন্ডামি করেছে… কে বলল আপনাকে?”
প্রান্তিক সাহেব মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
এই দুর্বলতা, এই অস্থিরতা তিনি কাউকে বলতে পারেন না।
প্রণয় সাহেব ধীরে গলা নামিয়ে বললেন–
“ভাবি তোমাদের কি মনে হয় বড় ভাই এতটা নির্দয়, বড় ভাই সবার খবর রাখেন।তোমরা ভাবো উনি কঠিন, কিন্তু ওই কঠিন মুখের আড়ালে কতটা চিন্তা জমে থাকে তা কজন বোঝে? তোমাদের কাছে একটাই অস্র
নিজেদের চোখের পানি। ”
তিনি থামলেন না, বলতেই লাগলেন– “বৃষ্টি চলে যাওয়ার পর ,তার খবর পাওয়ার জন্য কি কি করেছেন জানো? কতটা চিন্তার মধ্যে উনি থাকেন সেটা খবর রাখো তোমরা, সে কোথায় আছে, কার সঙ্গে, ভালো আছে কিনা উনি সব জানেন।জায়নের প্রতিটি চলাফেরা, প্রতিটি পাগলামি…উনি যানেন, তবু কিছু বলেন না।রাগ করেন একটাই বিষয়ে ,কেন সব সময় পরিবারের মান সম্মান নষ্ট হবে।আমাদের সন্তানরা সব সিদ্ধান্ত পরিবারের অজান্তে নিয়ে ফেলে।তখন যখন কিছু করার থাকে না…”
সবার মুখে এবার এক অজানা ভার।প্রণয় সাহেবের কথায় যেন সবাই থমকে গেল —
মেহজাবীন বেগম,রূহেনা বেগম , সুরাইয়া বেগম , অনন্যা,রায়ান ও তখন উপস্তিত ছিল।সবাই যেন একসঙ্গে শূন্যতায় ডুবে গেল।
ঠিক তখনই রূহেনা বেগম বিস্ফোরিত চোখে উঠে দাঁড়ালেন,ওনার স্বামীর দিকে এগিয়ে ভেজা চোঁখে গলা কাঁপিয়ে বলে উঠলেন—
” কি বললেন আপনারা সব জানতেন ? তাহলে আমাদের কেন বলেন নি? আমি কি আমার মেয়ের খবর জানার অধিকার রাখি না ?”
প্রণয় সাহেব এবার গর্জে উঠলেন–
“তোমার মেয়ে কখনো নিজে থেকে চেয়েছে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে?যে মেয়ে রাতের অন্ধকারে সাহস করে এক ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যেতে পারে,
সে সাহস করে একবার বলতে পারল না নিজের পরিবারকে?”
প্রান্তিক সাহেব কপাল চেপে ধীম কন্ঠে বললেন–
“মেজো ভাই, থামো…”
“না ভাইয়া, আজ বলতেই হবে!”
প্রণয় সাহেবের চোখে আগুন জ্বলছে।
তখন ই মেহজাবীন বেগম তাহসান সাহেব এর দিকে ফিরে কাঁপা গলায় বললেন–
“আর বলবে না মেজো ভাই।আমরা আসলে কোনোদিন তোমাদের পুরুষদের আত্মাটা বোঝার চেষ্টাকরিনি।”
তিনি এবার স্বামীর দিকে ফিরলেন।
ভেজা চোখে, ফ্যাকাশে হাসি দিয়ে বললেন—
“নিজের কঠিন রূপটা ধরে রাখতে গিয়ে আপনি ভেতরে ভেতরে এত ভেঙে পড়েছেন যে, ছেলের চোখে পানি দেখে সেই সত্তা কে আর অটুট রাখতে পারলেন না ।”
প্রান্তিক সাহেব অসহায় চোখে তাকিয়ে আছেন স্ত্রীর দিকে , এক দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন —
” আমি হাপিয়ে গেছি মেহজাবীন , বয়স হয়েছে আমার পক্ষে আর সম্ভব না , আমার উন্মাদ ছেলে কে ঠিক করার কোন উপায় পাচ্ছি না । সে তো পুরো পাগল হয়ে গেছে মেজো আম্মুর জন্য ।”
মেহজাবীন বেগম চোখের পানি মুঝতে মুখতে বললেন —
” চিন্তা করবেন না , আপনার ওই উন্মাদ পাগল ছেলে কে আমাদের মেয়ে আমাদের বৌমাই ঠিক করবে ।”
“কিন্তু ……”
প্রান্তিক সাহেব কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু মেহজাবীন বেগম বাধা দিয়ে এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“কোনো কিন্তু নয় এবার আমিও আপনাকে একটু সান্ত্বনা দিতে চাই। আপনার চিন্তার বোঝাটা এবার আমাকেও কাঁধে নিতে দিন।”
মেহজাবীন বেগম রুহেনা বেগম এর পাশে গিয়ে ওনার চোখের পানি মুঝতে
মুখতে একটু ম্লান হাঁসি দিয়ে বললেন,–
” কাঁদবি না একদম তোর পাগল জামাই গেছে তো আমাদের মেয়ে কে আনতে । আমাকে দেখ আমি জানি আজ আমার ভাইয়ের বাসায় কিছু হতে চলেছে তবুও হাসছি, জানিনা আমার পাগল ছেলে কি ঝড় বয়ে আনবে । এবার চুপ কর বিয়াইন সাহেবা।”
রূহেনা বেগম চোখের জল মুছতে মুছতে জড়িয়ে ধরলেন মেহজাবীন বেগমকে।তারপর মেহজাবীন বেগম সুরাইয়া বেগম এর দিকে তাকিয়ে বললেন —-
“তুই ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? এদিকে আয়।”
সুরাইয়া বেগম ও ছুটে এলো।তিন নারী একে অপরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ।
বাসার কর্তা দের মুখেও এবার এক হাসি ফুটে উঠল।
বাই যেন কিছুটা হালকা হলো।
কিন্তু এসবের মাঝে রায়ান ফিস ফিস করে বলে উঠলো অনু কে —
” ওই পেত্নী আগে আগেই কিন্তু বাসায় ইউভি ভাইয়ের কথা বলে দিস, যদি রাজি হয়ে যায় তাহলে ভালোই হবে । পালায় যাওয়ার কথা কিন্তু মোটেই ভাবিস না , আমাদের বাপ কিন্তু সব দিয়া ডেঞ্জার।”
রায়ান এর কথা শুনে অনন্যা যেন চমকে উঠলো, চোঁখ বড় বড় হয়ে উঠলো,গলাটা শুকিয়ে এল,কাপা কাপা গলায় বলল —
” তুই তুই জানলি কি করে ? ”
রায়ান অনুর মাথায় একটু গাট্টা দিয়ে বলল —
” আমিও কাদের ভাই মনে রাখিস, কোন কিছু চোখ কে এড়ানো যায় না।”
এই বলে রায়ান চলে গেল সিঁড়ি ধরে ওপরে।অনন্যা একা দাঁড়িয়ে রইল,নিজের ভিতরের কথাগুলো নিয়ে হঠাৎ করে এক নতুন চিন্তায়।
( ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড)
চৌধুরী বাড়ির সামনে দরজা বন্ধ।জায়ন দাঁড়িয়ে চোখে রাগ, কপালে ভাঁজ, ভেতরে আগুন।
সেই আগুন তার বুকের ভেতর ছটফট করছে, কারণ তার “রোদ” এখন বাসার ভেতরে আর সে দাঁড়িয়ে বাইরে, দরজার ওপারে।
জায়নের চোখ পড়ছে সেই দরজার দিকে,
যেটার ওপারে তার স্ত্রী, তার ভালোবাসা, তার বেঁচে থাকার শেষ কারণ দাঁড়িয়ে।
সে দাঁতে দাঁত চেপে চিতকার করছে
“বেইবি বেরিয়ে আয় বলছি,না হলে… যা করবো… সেটা আমি নিজেই জানি না…”
‘ আমার লাইফ সাপোর্ট বউ আয় না রে”
কিন্তু কেউ সারা দিচ্ছে না”
” এই রোদের বাচ্চা , বেরো বলছি।”
” মা আমার বউ না দিলে কিন্তু আমি ও যাব না।”
তিয়াশা দরজার ওপাশে লজ্জায় নাক কাটা যাচ্ছে পরিবারের সামনে , আর ভেতরের সকলে হাঁ করে তাকিয়ে।
জায়ন থামছে না, এবার একটু হেঁচিয়ে আরও জোরে বলল।
” আমার জাস্টিস চাই বাবা , আসলাম দুজন যাবো একজন কেন?”
ভেতর থেকে সবাই পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে বাইরের দিক থেকে আসা জায়নের পাগলামো চিৎকার।
“মা, দরজা খোলো
আমি মামলা করবো
আমার বউ চাই , আই রিপিট, আই নিড মাই ওয়াইফ।”
তাহসান সাহেব চমকে উঠে চোখ বড় বড় করে ইউভি
আর আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না, হঠাৎই রীতিমতো সিনেমার ডায়লগে ভরা গলায় বলে উঠলেন–
“ওই তোরা বল তো, এইটা কি আসলেই আমাদের জায়ন? নাকি জায়নের শরীরে কেউ ঢুকে গেছে? এ যে রীতিমতো প্রেমের রজনীগন্ধা বানাইতেছে রে।”
ইউভি আর আকাশ দুই ভাই মিলে এক অদ্ভুত অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে–
একদিকে ভাইয়ার এই উন্মাদ, প্রেমে-গলে-পড়া চেহারা দেখে খারাপ লাগছে,অন্যদিকে নিজেকে হাসির বন্যা থেকে ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই।কিন্তু কিছু করার নেই, কারণ এই মুহূর্তে কেউই ঠিক জানে না,
এই মানুষটা তাদের পরিচিত সেই গম্ভীর, সংযত জায়ন কিনা–নাকি কারো প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া এক নতুন মানুষ।
প্রান্তিক সাহেব কিছুই বলেন না।চোখ নামিয়ে, পা টেনে ধীরে ধীরে চলে যান নিজের রুমের দিকে,চেহারায় একরাশ নীরবতা,যেন নিজের সন্তানের এই অপরিচিত রূপ দেখে বুকের ভেতর চেপে রাখা লজ্জা আর গোপন গর্ব একসাথে লুকোচুরি খেলছে।
রুহেনা বেগম আর সুরাইয়া বেগম তো যেন থামতেই পারছেন না।চোখে মুচকি হাসির রেখা, ঠোঁটে অদ্ভুত স্নেহময় দৃশ্যের প্রশ্রয়।সুরাইয়া বেগম মনে মনে বলছেন—
“যে ছেলেটার চোখ কখনো মুখের আগে কথা বলত, যে মুখে কিছু না বলে তাকিয়েই সব বুঝিয়ে দিত,
সে এখন সবার সামনেই বউ চাইতেছে চিল্লাইয়া,এও একদিন দেখতে হবে?”
আর অনন্যা? সে তো এমন সুযোগ ছাড়বে কেন?
তিয়াশার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে হাসতে হাসতে বলল—
“আপু, জায়ন ভাই তো দেখি পুরাই পাগল প্রেমিক হইয়া গেছে,তুমি না আসলেই পারতে… এখন তো অবস্থা এমন, ভাইয়া ঘরে ঢুকতে পারলে আমাদের ঘুম শেষ, সারারাত রোম্যান্টিক নাটক চলবে”
তিয়াশা কিছুই বলে না,শুধু দাঁড়িয়ে থাকে থমথমে মুখে,
রাগে ঠোঁট কামড়ে মনে মনে গর্জে ওঠে–
“এই লোকটা কেন সব সময় এমন করে? কেন সব কিছু নিয়ে এতো উন্মাদ হয়।”
কিন্তু সেই রাগের মাঝেই হঠাৎ যেন মনটা এক ঝলকে দুর্বল হয়ে পড়ে,কারণ যতই সে নিজেকে শক্ত করে, যতই মুখে বলুক কিছু আসে যায় না,জায়নের চিৎকার, তার সেই চোখের ভাষা,তার উত্তপ্ত কণ্ঠের ভেতর লুকানো ভালোবাসাতিয়াশার হৃদয়টাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়।
“এই মানুষটাই তো আমার জন্য এমন করে…
যে মানুষটা চোখে চোখ রাখতে লজ্জা পেত,
সে আজ সবার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় চিৎকার করছে,
আমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে চায় না।”
তিয়াশা চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলে–
“কি করে থাকবো আমি ওনাকে ছেড়ে?
মাত্রই তো সব ঠিক হলো…
আর এখন যদি আবার দূরে থাকতে হয়?”
চোখের কোণে জমে ওঠে এক বিন্দু জল,ভিতরের কান্নাটা যেন কণ্ঠ ছেড়ে হৃদয়ের গহীনে গড়িয়ে পড়ে।
এদিকে চৌধুরী বাড়ির ভেতর এক অদ্ভুত উত্তেজনা,
চারদিকে ফোনের শব্দ বেজেই চলেছে–
ইউভি আর আকাশের ফোন বারবার কাঁপছে,
কিন্তু মেহজাবীন বেগম যেন বজ্রগম্ভীর গলায় সবার উপর চাপিয়ে দিয়েছেন এক অলিখিত আদেশ–
“এই মুহূর্তে কেউ কোনো ফোন ধরবে না। জায়ন এখন যেভাবে আগুন হয়ে আছে,
তার সামনে কেউ সাহস করে ফোন কানে তুললে… সেটা শেষ ফোন হইতে পারে!”
আর ঘরের সবাই?তারা শুধু তাকিয়ে আছে,চোখে বিস্ময়, মুখে চাপা উত্তেজনা, আর মনে মনে ভাবছে—
এই জায়ন তো আগের সেই মানুষটা না,এ এখন প্রেমে পড়া এক দুঃসাহসী পুরুষ,যার চোখে আগুন, গলায় দাবী,আর হৃদয়ে এক নাম–
‘ রোদ ‘
সবাই চুপচাপ।একের পর এক কল ঢুকছে, কিন্তু সবাই এমন ভাব করে বসে আছে, যেন ফোনটায় চার্জে নেই।
ইউভি আর সাগর ইতিমধ্যে চুপিচুপি নিজের নিজের সোর্সকে ফোন করে দিয়েছে–
“তাড়াতাড়ি যানো ,ভাইয়াকে নিয়ে যায় বাসায়, না হলে আজ রাতে নিজেও ঘুমাবে না কাউকে ঘুমাতেও দেবে না।”
নিঃশব্দ চুপচাপ ভাঙল মেহজাবীন বেগমের কণ্ঠের আগুন। চোখে জলভেজা ধোঁয়া, ঠোঁটে কঠোর আদেশের রেখা–
“মেজো আম্মু, ওপরে যা। অনু, তুইও সঙ্গে যা।”
এক মুহূর্তের জন্যও প্রতিবাদ করার সাহস হল না তিয়াশা কিংবা অনন্যার,
মাথা নিচু করে তারা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।
তিয়াশার বুকের ভেতর তখন ঢাক বাজছে, মন বারবার বলছে–
“এই লোকটা এমন উন্মাদ কেন আল্লাহ।”
রুমে ঢুকেই সে আর কিছু না ভেবে ছুটে গেল বেলকনির দিকে।
চোখ পড়তেই দেখে নিচে দাঁড়িয়ে আছে জায়ন–
চোখে দাবানল, ঠোঁটে অভিমান, শরীরজুড়ে গুমোট রাগ।তিয়াশা ভয়ে, লজ্জায়, রাগে চোখে ইশারা করলো, যেন এখান থেকে চলে যায়…
চলে যায়, প্লিজ…
কিন্তু জায়ন কি আর কারো ইশারায় চলে?
সে তো ভালোবাসার ভাষা বোঝে না, বোঝে শুধু নিজের চেতনার আগুন।
সে চিৎকার করে উঠল, যেন বুক ফেটে যাচ্ছে–
“রোদ, নিচে আয় এখনই বাসায় যাব আমরা না আসলে… খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
তিয়াশা আঁতকে উঠে গেল,ভেতরে ঢুকে মনে মনে বলল–
“এই লোকটা তো একদমই পাগল। আমি চোখে ইশারা করি যাও, আর উনি যেন চিৎকারে মাইক লাগায়া দিলো।”
তারপর… একসময় চৌধুরী বাড়ির সামনে শোরগোল থেমে যায়।
সাগর, পলাশ, আহান মিলে কোনোমতে জায়নকে গাড়িতে তোলে,না হলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল।জায়নের বাইকটা পলাশ চালিয়ে এনেছে,
আর গাড়িতে বসে আছে আগুনচোখের সেই মানুষটা,
যার রাগ এখন শুধু তিয়াশার না পুরো দুনিয়ার উপর।
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামতেই
সবাই যখন নামতে যাবে,
হঠাৎ জায়ন কড়া গলায় বলে উঠল,“তোরা কেউ আমার বাসায় ঢুকবি না।”
আহান হতভম্ব, কপাল কুঁচকে বলল,
“কেন রে ভাই? আজ তো ভাবি নাই… তা একা ঘরে গিয়ে কি করবি?”
আহানের চোখে এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি–
সে যেন পড়ে ফেলছে জায়নের ভিতরের দগদগে ক্ষত।
চোখ লাল, মুখ শুকনো, ক্লান্তির ছাপ,
আর পলকহীন দৃষ্টিতে আটকে থাকা এক বেদনার চিৎকার।
সাগর এবার ঠাণ্ডা গলায় বলে–
“আজ তো ভাবি নাই, তাইলে আবার তোর সমস্যা কিসে হইতেছে রে ভাই?”
জায়নের গলায় সেই চিরচেনা রাগ,
কিন্তু তার সাথে এবার যুক্ত হয়েছে একরাশ অভিমান আর বিষন্নতা–
“আমি একা থাকতে চাই। আর কারো নাটক দরকার নাই এখন।
তোরা বিদায় হ।”
পলাশ এবার একটু রেগে গেল। ঠোঁট ফুলিয়ে, ঠোঁটে ঝাঁজ এনে বলল–
“তুই একা থাকতে চাস বুঝলাম,
কিন্তু এতক্ষণ দাঁড়ায়া ধন্না দিছলি ক্যান রে ভাই?
তোর তো বাসায় ঢুকতে হইব না, বাইরেই থাকতি পারতি।”
কিন্তু জায়ন কিছু বলল না।
শুধু তাকিয়ে রইল এমন এক দৃষ্টিতে,
যেন ওই চোখ দিয়েই সে সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে–
সোজাসাপটা নয়, বরং তীব্র, নিঃশব্দ, ধ্বংসাত্মক।
সাগর, আহান, পলাশ তিনজনই বুঝে গেল–
আজকের এই জায়ন আর পাঁচজনের মতো নয়।
আজ সে নিজের রক্তে, রাগে, ভালোবাসায় পুড়ছে।
তাকে কিছু বলা মানে হল
তেল ঢালা জ্বলন্ত আগুনে।
তারা আর কথা বাড়ালো না,গাড়িতে চুপচাপ উঠে পড়ল।তবে সাগর জানালার কাচ নামিয়ে
একবার গলা উঁচিয়ে বলে উঠল–
“বেটা তুই তো একেবারে পাগলায় গেছস রে।”
আর জায়ন?
সে একা দাঁড়িয়ে থাকে, গেটের সামনে,মনে হয় যেন নিজেরই নিঃশ্বাসে পুড়তে চায় সে।আজ আর কারো কথা, কারো উপস্থিতি,কিছুই দরকার নেই তার,শুধু দরকার সেই মুখটা,যটা আজ চোখের সামনে থেকেও তার নাগালের বাইরে।
রুমে ঢুকতেই জায়নের চোখ কুঁচকে গেল।
ড্রয়িং রুমের কোণায় কোণায় জ্বলছে হালকা হলুদ রঙের ফেইরি লাইট।সবজায়গায় ঝিকমিক আলো।
চোখে পড়তেই জায়নের রাগে ঠোঁট বেঁকে গেল।
মনে মনে বলল,
“ওয়াও… বউ রেখে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে, আর আমার নিজের বাসায় বাসরের ঠ্যাঙায় শোভা বয়ে বেড়াচ্ছে।”
এক ঝটকায় সামনে রাখা সোফার পাশের সুইচে হাত বাড়িয়ে একে একে সব লাইট নিভিয়ে দিল।
“হুদাই গ্ল্যামার ছাড়ছো অন্ধকার থাকুক, আমার এই অন্তরাত্মার মতো কালো অন্ধকারই ভালো এখন”
ফুঁফুঁ করে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত, ক্ষ্যাপা শরীর নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল নিজ রুমে।
রুমে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল।
“আল্লাহ্র ওয়াস্তে” — মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল।
তার পুরো ঘরটাকে কেউ যেন বিয়ের হল বানিয়ে ফেলেছে।
ছাদের ঝুলন্ত ফুলের গুচ্ছ, পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ,
আর বিছানার উপর…
সাদা তোয়ালে দিয়ে বানানো দুইটা রাজহাঁস একে অপরের দিকে মুখ করে বসে আছে।
মাঝখানে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো।
বিছানার চারপাশে মোমবাতি… যেন সিনেমার সেট।
জায়ন কয়েক সেকেন্ড নীরব, তারপর–
” রোদের বাচ্চা আমার বাসর এ যদি তোকে ভূমিকম্প না দেখাই তাহলে বলিশ।”
এক দৌড়ে গিয়ে রাজহাঁস দুইটার ঘাড় ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো—
“শা”” তোরা করবি সুখের বাসর? চুঁ চন্দ্রাবতী হইছে আমার বাসর, আর তোরা বর বউ হয়ে এখন শুয়ে আছিস আমার বিছানায়। তোরা দুইজনে সং সেজে আমার জ্বালা বাড়াইছিস।
এই বলে বিছানার মাঝখানের ফুল সমেত চাদর টাই ফেলে দিল।
রাগে গরম শরীর নিয়ে পেছনে দরজা লাগিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে রইল বিছানায়।চোখে তখনো তিয়াশার মুখ ঘুরে ফিরে আসছে ওই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে একবার তাকিয়েছিল ওর দিকে,আর সেই একবারই তার সব ধৈর্য ফুরিয়ে গিয়েছিল।
জায়ন এক হাতে নিজের চোখ চাপা দিয়ে ফিসফিস করে বলল–
“তুই কোথায় রে বউ … আমার বউ… তুই থাকলে এই রুম, এই রাজহাঁস, এই ফুলের মাঝেও আমি পৃথিবী ভুলে যেতাম।”
বাসরের রুমে একা বসে থাকা জায়ন মুখের মধ্যে বিড়বিড় করছে —
“শা** আমি তো ভাবলাম আজই মধুচন্দ্রিমা… হল কি, হল দুঃখচন্দ্রিমা। আমি বিয়ে করি নি, আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি… বলতেই পারো ‘বউ গেট স্ক্যাম ২০২৫”
জায়ন ক্লান্ত শরীর নিয়ে শাওয়ারে ঢুকেই কপাল ঠেকাল ঠান্ডা পানিতে। চোখ বন্ধ করতেই কানে যেন বাজতে থাকল তিয়াশার সেই কণ্ঠস্বর…
“কিন্তু আমি বলতে চাই, আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি…”
এই একটা লাইন যেন বুকের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দিল।পানি পড়ছে শরীর জুড়ে, কিন্তু তাতে এই আগুন নেভে না।জায়ন মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল,
চোখ বুজেই ফিসফিস করে বলল —
“রোদ… তুই আমাকে শেষ করে দিলি।”
তারপর নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় একবার দেয়ালে ঘুষি মেরে ফেলল।
জল পড়ছে গা বেয়ে… কিন্তু জায়নের দেহে লেগে আছে আরেকরকম জ্বর।একটা মিষ্টি উত্তেজনা, একটা বুনো কল্পনা আর অব্যক্ত কামনা।শাওয়ারের ভিতর দাঁড়িয়ে সে যেন অনুভব করতে লাগল তিয়াশার সেই চোখের চাহনি…
“ওই চোখ, ওই ঠোঁট, ওই কথা… আমি পাগল হয়ে যাব রোদ, প্লিজ, আর না…আমি আর কন্ট্রোল করতে পারছি না রোদ তুই থাকলে আমি তোর শরীরে আমার আত্মা ঢেলে দিতাম।”
শাওয়ার থেকে বেরিয়ে ভেজা গা নিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে।চোখে লাল ভাব, চুল ভেজা, গায়ে শুধু তোয়ালে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়েই যেন একটা দানবকে দেখছে।
আবার মাথার ভেতর তিয়াশার সেই গলা বাজল–
“কিন্তু আমি বলতে চাই, আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি…”
” উফফ বা*** ফাঁ**কিং মাইন্ড।”
এক মুহূর্তেই তার সমস্ত স্নায়ুতে আগুন জ্বলে উঠল।
ঠোঁট শুকিয়ে গেল, বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল।
তার চোখ রাগে লাল হয়ে উঠল না বরং…আকাঙ্ক্ষায়,
যেটা আর থামানো যাচ্ছে না।নিজের পেশির টান দেখে নিজেই চমকে উঠল সে,এটা কি সত্যিই ভালোবাসা, না অভিশপ্ত আকর্ষণ?
তার দৃষ্টি আবার আয়নার দিকে…শরীরটা জ্বলছে তিয়াশা যেন মনের ভেতর এক নিষিদ্ধ অথচ একমাত্র আশ্রয়।আবার সে শাওয়ারে ফিরে গেল।জলের নিচে দাঁড়িয়ে, দুই চোখ বন্ধ করে ।
সময় তখন রাত বারোটা বেজে দশ,চৌধুরী বাড়ির ছাদে ঝুলে থাকা নরম আলোয় ঘুম নেমে এসেছে সবার চোখে…সবার, কিন্তু তিয়াশার নয়।
সে বিছানায় পড়ে আছে… চোখ বন্ধ করেও বারবার যেন সেই চিৎকার, সেই রাগী মুখ ভেসে উঠছে —
“রোদ, বাইরে আয়… খুব খারাপ হয়ে যাবে”
ভেতরটা কেমন করে ওঠে, বুকের এক কোণে হালকা কষ্ট, এক কোণে গভীর টান।এত অভিমান, এত লজ্জা তবুও মনে শুধু সেই মানুষটার কথা।একবার বাঁদিকে গড়ায়, একবার ডানদিকে ঘুম কিছুতেই আসে না।
অবশেষে উঠে বসল।চোখ ভেজা, মুখটা ক্লান্ত…
একটুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।শান্ত ঘরবাড়ির নিঃশব্দ করিডোরে পায়ের শব্দ যেন শোনা যায় নিজের মনের ভেতরেও।গন্তব্য,ইউভি ভাইয়ার রুম।
দরজার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল।
একটা দীর্ঘশ্বাস… তারপর বুক ভরে সাহস টেনে নিয়ে,
টোকা দিল দরজায়—
“ভাইয়া… জেগে আছো?”
ভেতর থেকে ভেসে এলো চেনা কণ্ঠ–
“হ্যাঁ রে, দরজা খোলা আছে। ভেতরে আয়।”
রোদ ধীরে পা ফেলে রুমে ঢুকলো।মাথা নিচু, গলার কাছটা শক্ত। কিছু বলতে পারছে না।
ইউভি এগিয়ে এসে বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটেছে।বোনের মুখটা খেয়াল করতেই চোখে পড়ল–
চোখ দুটো ভেজা।
একটু নিচু হয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা ম্লান হাসি দিয়ে বলল–
“ভাইয়ার জন্য মন খারাপ করছে?”
রোদ আস্তে মাথা নাড়ল।তারপর এক গাল শব্দ তুলে বলতে চাইল, কিন্তু কণ্ঠ কেঁপে উঠল–
“ভাইয়া… আমায় একটু ওনার কাছে নিয়ে চলো না?
উনি খুব কষ্টে আছে… আমি শুধু একটু দেখতে চাই।”
ইউভি চমকে উঠল।এই ঘোর রাতে তার ছোট বোন এমন আবদার করছে।হঠাৎ রাগী গলায় বলে উঠল–
“তুই ঠিক আছিস? কেউ যদি জেনে যায় তাহলে একদম শেষ, এখন রুমে যা।”
রোদ কিছু বলল না।শুধু মুখ ঘুরিয়ে কাঁদতে লাগল।
চোখ থেকে এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা অশ্রু টুপটাপ গড়িয়ে পড়ছে…
” একটু খানি সময় ভাইয়া আবার চলে আসবো, চলো না।”
“অসম্ভব”
এই শুনে তিয়াশা হাউ হউ করে কেঁদে উঠলো, বোনের
এরকম কান্না দেখে ইউভির বুক টা কেমন কেঁপে উঠল।একটুকরো অভিমানী হৃদয় আজ ভালোবাসায় গলে পড়ছে তার চোখের সামনে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে হালকা গম্ভীর স্বরে বলল–
“ঠিক আছে… দশ মিনিট, কেবলমাত্র দশ মিনিট এর জন্য নিয়ে যাব।”
রোদের মুখে আলো ফুটল।চোখে সেই জ্বলজ্বলে তৃপ্তির ঝিলিক। বলল–
“থ্যাংক ইউ ভাইয়া”
ইউভি হেসে তিয়াশার গাল ছুঁয়ে বলল–
“থ্যাংক ইউ বলতে হবে না।
তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। এই কান্না-কান্না চেহারায় ভাইয়া তোকে দেখলে আমাকেই খুন করে ফেলবে। ভাববে আমি কাঁদিয়েছি।”
রোদ একটু হেসে চোখ মুছে চলে গেল রুমে।
কিছু সময় পর…
সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে দুই ভাইবোন চুপিচুপি বেরিয়ে গেল চৌধুরী বাড়ি থেকে।হাতের মুঠোয় কেবল ১০ মিনিট,কিন্তু সেই দশ মিনিটে রোদ দেখতে চাইছে
একটা রাগী মুখে জমে থাকা ভালোবাসা,এক জোড়া অভিমানে টলমল চোখ,আর একটা কান্নাভেজা বুক…
যেখানে কেবল তার নাম ধ্বনিত হয়।
এই নিয়ে জায়ন তৃতীয়বার শাওয়ার থেকে বেরিয়ে এলো।তাও মন ঠাণ্ডা হলো না।ভিজে চুল থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে,আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই হঠাৎ আবার মনে পড়ে গেল
“কিন্তু আমি বলতে চাই… আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি…”
ব্যাস আবার সেই ঝাঁজালো তাপ লাফিয়ে উঠল শরীর জুড়ে।আবার গলা শুকিয়ে গেল, বুকের ভেতর যেন বাজ পড়ল।হঠাৎই সে মাথা নিচু করে দুই হাত দিয়ে টেবিল আঁকড়ে ধরল।চোখ বন্ধ করে গর্জে উঠল একা একা —
“রোদের বাচ্চা, কি করছিস তুই আমার সঙ্গে।”
একপাশে ভেজা তোয়ালে ছুঁড়ে ফেলে দিল রাগে।
আবার নিজের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল–
“এটা ভালোবাসা না শাস্তি বুঝলাম না।”
জায়ন রাগে রাগে কাবার্ড থেকে রোজকার মত ব্যাগি ট্রাউজার আর টিশার্ট বের করে পরে, তারপর নিচে নেমে টিভি চালিয়ে দিল। কিন্তু বারবার মাথায় ভেসে উঠছে সেই একটা লাইন ,সমস্ত মনোযোগ ছিঁড়ে টুকরো করে দিচ্ছে।
কিন্তু স্ক্রিনে ফুটবল হোক, সিনেমা হোক কিছুই তার মন ভরাতে পারছে না।বারবার মাথায় বাজছে সেই একটাই লাইন–
“কিন্তু আমি বলতে চাই, আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি…”
রাগে উঠে দাঁড়াল।এই পাগলামি আর সামলানো যাচ্ছে না।নিজেই শরীর টানটান করে এক্সারসাইজ করতে লাগল।বারবার নিজেকে বোঝাতে চাইছে , কিন্তু হঠাৎ রাগে চিৎকার করে উঠলো–
“ওহ গড, আমি পাগল হয়ে যাবো।”
এক্সারসাইজ করে ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি বের করে গলায় ঢালছিল ঠিক তখনই…
“টিং টং।”
কলিং বেল বেজে উঠল।
জায়ন থমকে গেল। পানি খাওয়া বন্ধ করে মনে মনে ভাবল—
“এই রাতে কে এল?”
ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে লক খুলে দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে চমকে উঠল–
” জান এত রাতে কি করে আসলি ? ”
তিয়াশা,মুখে হালকা ভয়, কাঁপা কণ্ঠ, চোখে জল মেশানো একটা উষ্ণ আলো নিয়ে বলল–
“ইউভি ভাই এর সঙ্গে ,আমি আপনাকে খুব মিস ……”
কিন্তু বাক্য শেষ হবার আগেই…জায়ন ঝাঁপিয়ে পরে দুই হাতে তার গাল চেপে ঠোঁট বসিয়ে দিল তিয়াশার ঠোঁটে, যেন উন্মাদ এক ভালোবাসা উপচে পড়ছে ঠোঁট ছুঁয়ে।একটা দীর্ঘ, আবেগভরা চুম্বনে যেন সব অভিমান, রাগ, ভালবাসা ঝরে পড়ছে। তিয়াশা ও নিজেকে আটকাল না।সে জানে, এই ভালোবাসা তার প্রাপ্য তিয়াশাও নিজেকে এলিয়ে দিল জায়নের বুকে।
কিস করতে করতেই জায়ন হঠাৎ এক ঝটকায় কোলে তুলে নিল তাকে।তিয়াশা নিজের দুই পা দিয়ে জায়নের কোমর জড়িয়ে ধরল।
জায়ন এক হাতে তিয়াশার কোমর, অন্য হাতে তার চুলে আঙুল গুজে দিয়ে যেন ডুবে গেল গভীর চু**ম্বনে।
চু**মুর মাঝেই পাশে থাকা পিয়ানোর উপর বসিয়ে দিল তাকে, কিন্তু ঠোঁট সরাল না। পিয়ানো ও টিং টিং করে বেজে উঠলো হাতের খেলাও শুরু হয়ে গেল তিয়শার উদরে।জায়নের ঠোঁটে ছিল আগুন, আর তিয়াশার নিঃশ্বাসে ছিল বৃষ্টি,এই এক গভীর চুমুতে এক হয়ে গেল আগুন আর জলের গল্প।
সময় থেমে গেল যেন। শুধু শোনা যাচ্ছিল তাদের হৃদস্পন্দনের শব্দ… একে অপরের বুকে ধাক্কা খাচ্ছে।জায়ন এর হাত তিয়াশার কোমর ছুঁয়ে উপরের দিকে উঠতেই তিয়াশা হাত ধরে থামাল।ঠোঁট ছেড়ে একটু থেমে বলল–
“এরকম লাগছে কেন আপনাকে?”
জায়ন তিয়াশার ঘাড়ে মুখ গুঁজে এমনভাবে ফিসফিস করে উঠল, যেন শব্দগুলো শুধু কান নয়, গায়ের রন্ধ্র দিয়ে ঢুকে পড়ছে হৃদয়ের গভীরে–
“তুই আমার ফেভারিট ড্রা*গ কিটি ক্যাট। একবার নিলে হুঁশ হারাবে, আর ছাড়লে বুক পুড়বে।”
তিয়াশা চমকে গেল জায়নের কথায়।
জায়নের গলায় উন্মাদনা, তার চোখে আগুন, ঠোঁটে হাসি–
“”তোকে আজ ছুঁয়ে মনে হচ্ছে, পাপ করার জন্য যদি জাহা”ন্নাম হয়, তবে আমি তোর গা”য়ে ঠোঁ”ট রেখে জাহা”ন্নামকে সালাম করে যাবো, জান।”
এই বলে জায়ন এগিয়ে আসতেই যখন সে তিয়াশার ঠোঁটে আবার চুমু এঁকে দিতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই তিয়াশা দুই হাত চেপে ধরে তার মুখটা থামিয়ে দিল, আর মিষ্টি অথচ ব্যথাভরা গলায় ফিসফিস করে বলল—
“আমি মাত্র ১০ মিনিট সময় নিয়ে এসেছি… এখন যেতে হবে বর। আমি তোমাকে খুব মিস করছিলাম…”
জায়নের চোখে যেন এক ঝলকে বিস্ময় আর অভিমানের বিস্ফোরণ ঘটল।সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না, এতটা কাছাকাছি আসার পর,তার এই উত্তপ্ত ভালোবাসার মুহূর্তে,তিয়াশা তাকে রেখে চলে যাবে,মনে হচ্ছে যেন কেউ ঠিক আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে এসে বলছে–
“আমি যাচ্ছি, তুমি এখানে জ্বলে পুড়তে থাকো…”
তিয়াশা যা বলল, সেটা তার কাছে একেবারেই সহ্য করার মতো নয়।আর সেই কথা শোনার পর, জায়ন আর নিজেকে সামলাতে না পেরে,তাকে সোজা কোলে তুলে নিয়ে শক্ত গলায় বলে দিল—
“কোথাও যাওয়া হবে না। এটা আমার পক্ষে অসম্ভব রোদ। তুই আসবি, সামনে দাঁড়াবি, চোখে চোখ রাখবি… আর চলে যাবি? এইটা কোনো খেলা না, এটা আমার জীবন।”
তিয়াশা তার গলা জড়িয়ে একটু ভেজা চোখে ঠোঁট উল্টে,নরম কণ্ঠে বলল–
“প্লিজ… আমি চাই আমাদের বিয়েটা ঠিকঠাক হোক, সবকিছু সুন্দর হোক… এই বাসর, এই রাত, সবকিছু যেন আমাদের বিয়ের পরে হয়, একদম ঠিক মতো।”
জায়নের চোখে সেই মুহূর্তে রাগের আগুন লেলিহান হয়ে উঠল।চোখ লাল হয়ে গেল, দাঁতে দাঁত চেপে বলল–
“তাহলে এখানে এসেছিস কেন তুই? আমার বুকের আগুনে পানি ঢালতে? না ঘি ঢালতে?”
তিয়াশা চমকে উঠল,কিন্তু তবু হাতজোড় করে নরম গলায় কাঁপতে কাঁপতে বলল–
“প্লিজ… প্লিজ… প্লিজ… আমি তোমাকে কষ্ট দিতে আসিনি…”
জায়ন এক মুহূর্তের জন্য চুপ।তার চোখ তিয়াশার চোখে,ভেতরের উথালপাথাল জ্বালা আর ভালোবাসার ঝড় যেন একসাথে বয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ নিজের মনে বলল–
“শালা… এইভাবে প্লিজ বললে তো আমি শেষ। আল্লাহ, এত মায়াবী মেয়ে কেন জুটালে রে? আমি তো সামলাইতেই পারতেছিনা।”
কোল থেকে নামিয়ে দিল তিয়াশাকে।
তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল—
“যা, আমি তোকে আর দেখতে চাই না। কারণ দেখলে তোকে যেতে দিতে পারবো না।”
তিয়াশার মনটা হঠাৎ করেই ভারী হয়ে গেল।পেছনে হাঁটতে হাঁটতে কাঁপা কণ্ঠে বলল–
“একটা কথা শুনবেন?”
জায়ন এবার ঠোঁট কামড়ে ধরল,দুই হাতের মুঠি শক্ত করে কাঁপিয়ে উঠে বলল–
“প্লিজ রোদ… আর কিছু বলিস না।
আর ১ মিনিট থাকলে তোকে আটকে রাখব… জোর করে, ছিঁড়ে এনে নিজের পাশে রাখব।আর শোন, এই যে এখন তোকে ছেড়ে কষ্ট পাচ্ছি,ঠিক ৮ দিন পর, এই কষ্টের ৮ গুণ ভালোবাসা তোর গায়ে ঢেলে দেবো।
নাউ গো। প্লিজ যা।”
তিয়াশা আর কিছু বলল না।চোখে একরাশ জল,
পা টেনে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দরজার দিকে…
কান্নাটা যেন কণ্ঠে না উঠে যায়, সেই চেষ্টায় নিজেকে ধরে রাখল।আর ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার চুপচাপ বন্ধ হওয়ার শব্দটা যেন জায়নের হৃদয়ে শেষ কফিনের পেরেক হয়ে বাজল।
তিয়াশা চলে যেতেই জায়ন ধপ করে সোফায় শরীর ছেড়ে দিল।সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–
“এইটা কিসের বাসর হইলো ভাই? চুমু দিতেই যাই, তখনই টাইম আপ!না বিয়ের লাইসেন্স আছে, না রিচার্জ কার্ড,সব কিছুতে এক্সপায়ারি টাইম।”
তারপর এদিক-ওদিক পাগলের মতো তাকিয়ে,
মাথা চুলকে উঠে গর্জে উঠল–
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৫
“বাসর বানালাম, ফুল ছড়ালাম, আতর ছড়ালাম, গন্ধ শুকলাম আমি,আর বউ? সে এসে বলল, ‘আমি ১০ মিনিটের জন্য এসেছি।’কি বুঝি রে ভাই, বিয়ে করলাম না Uber parcel নিলাম।”
চোখ বন্ধ করে মাথা ধরে গম্ভীর গলায় ফিসফিস করে বলল–
“ওহ গড, এই বাসায় আমার শরীরের উপরেই সবচেয়ে বেশি অত্যাচার হইতেছে।এবার কারও দয়া লাগবে না, আমি নিজেই আমার দুধ-ভাতের স্বপ্ন ছিঁড়ে চিবিয়ে খাবো।”