তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭০
নীল মণ
চৌধুরী বাড়িতে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন, আর প্রতিটা দিনের সাথে পাল্টে গেছে চারপাশের হাওয়া কখনো আনন্দে ভরে উঠেছে, কখনো আবার নিঃশব্দ উদ্বেগ ছুঁয়ে গেছে। জায়ন এখন নিয়ম করে তার নতুন অফিসে যাওয়া শুরু করেছে, যদিও তিয়াশা অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে, তবুও ডাক্তারদের বলা কিছু নিয়ম তো মানতেই হয়। তাই সকালবেলা অফিসে যাওয়ার আগে বউকে যেন অজস্র ভালোবাসার চুম্বন একে দিয়ে যায় , আর বাসায় ফিরেও প্রথমেই খুঁজে নেয় তার ছোট্ট বউ কে।
এর মধ্যেই প্রান্তিক সাহেব নিজেই এগিয়ে গিয়ে পরির বাবাকে ডেকেছেন সেই অভিভাবকের মতো গম্ভীর অথচ আন্তরিক স্বরে বলেছেন, “দেখেন ভাই, দুইটা বাচ্চার মধ্যে যদি সত্যিই ভালোবাসা থাকে, তবে বাঁধা দিয়ে কোনো লাভ নেই।”
প্রথমে পরির বাবা একদমই রাজি হতে চাইছিলেন না, একমাত্র মেয়ের বিয়ে নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই হাজারটা চিন্তা কাজ করছিল তার মাথায়, কিন্তু অনেক বোঝানোর পর, প্রান্তিক সাহেবের আস্থাভরা কথার কাছে নরম হয়ে গেলেন তিনিও। ধীরে ধীরে রাজি হয়ে গেলেন ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পরি তো তাদের একমাত্র মেয়ে, তারও আবার এক ছোট ভাই আছে, তাই বাবা মা মনের ভেতর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যতদিন না জেমস ঠিকমতো সেটেল হচ্ছে বাংলাদেশে, ততদিন ওরা যেন তাদের বাড়িতেই থাকে। যেন চোখের সামনে মেয়েকে দেখতে পান, নিজের বুকের ভেতর শান্তি থাকে।
এদিকে অনন্যা আর রায়ানের পরীক্ষার টেনশনও শেষ, দুদিন হলো পুরো বাড়ি একেবারে হালকা নিশ্বাস ফেলেছে। সব মিলিয়ে বাসায় এখন বিয়ের প্রস্তুতি চলছে।
দুপুর গড়িয়ে গেছে। জায়নের অফিসের কাঁচঘেরা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে রোদের তীক্ষ্ণ আলো, শহরের উপরকার কোলাহল যেন মৃদু গুঞ্জনের মতো ভেসে আসছে। চারদিকে ফাইলের স্তূপ, মিটিংয়ের শব্দ, আর সহকর্মীদের ব্যস্ত চলাফেরা সব মিলিয়ে ভেতরে চাপা একটা গাম্ভীর্য ছড়িয়ে আছে।
টেবিলের উপর রাখা কফির কাপটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে, অথচ এক চুমুকও খাওয়া হয়নি। কলম হাতে নিয়ে ফাইলের পাতায় সই করছে ঠিকই, কিন্তু চোখ মাঝে মাঝেই থেমে যাচ্ছে জানালার বাইরে দূরের আকাশে ভাসমান মেঘের দিকে। মনে হচ্ছে, দুপুরের আলোটা যেন একেবারেই নির্জন, অথচ বুকের ভেতরে জমে থাকা অস্থিরতাকে লুকোতে পারছে না।
কাগজে সাইন করার ফাঁকেই জায়নের চোখ আটকে গেল টেবিলে রাখা ছোট্ট ফটো ফ্রেমে ,তিয়াশার নিষ্পাপ মুখখানি যেন জীবন্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, সেই ছবির দিকে চেয়ে জায়নের ঠোঁটের কোণে অজান্তেই মিষ্টি এক হাসি খেলে গেল। অথচ সেই হাসির মাঝেই হঠাৎ করেই ফোনটা কাঁপতে কাঁপতে বাজতে শুরু করল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক অচেনা বিদেশি নাম্বার। নাম্বারটা দেখে জায়নের কপাল কুঁচকে গেল মনেই ভাবল, এমন সময়ে আবার কে হতে পারে , তবু রিসিভ করল, লাউডস্পিকারে রেখে কাহগজ ছেড়ে ল্যাপটপে নিজের কাজে মন দিল।
গম্ভীর অথচ স্বাভাবিক স্বরে জায়ন বলল,
__” হ্যালো , হু ইস স্পিকিং?”
ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক পরিচিত চেনা হাসি, সাথে গম্ভীর স্বর
__” হেয় ম্যান ডিড ইউ ফরগেট ইওর সিনিয়র বাডি?”
শব্দটা কানে আসতেই জায়নের চোখ বড় হয়ে গেল, মুহূর্তেই অবাক চাহনিটা ভেঙে ঝলমলে হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে। কাছের এক বন্ধুর ডাক শোনা গেছে। হেসে উঠে উচ্ছ্বাসে বলল,
__” ও মাই গড, লুক হু ইজ কল মি ?হাউ ডু আই নো দিস ইজ ইওর নিউ নাম্বার কায়ান ব্রো ? আই হ্যাভ অনলি ইওর ইউ এস নম্বর আই কল ইউ সো মেনি টাইমস বাট ইটস নট রিচেবল।”
ওপাশে কায়ানের দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা ভারী কষ্টের চাপা আওয়াজ,
__” ইয়েস,আমি ইস্তাম্বুলে ফিরে এসেছি …. বাই দা ওয়ে হাউ আর ইউ ম্যান ?আই হেয়ার দ্যাট ইউ গট ম্যারেড?সো হাউ ইস মাই সিস্টার ইন ল?”
বন্ধুর প্রশ্নে জায়নের মুখে ছড়িয়ে পড়ল প্রশান্তির হাসি। ছবিটার দিকে চেয়ে একরাশ ভালবাসা নিয়ে জবাব দিল
__ ” ইয়েস সি ইজ ফাইন ব্রো । সি ইস সো মাচ বিউটিফুল ম্যান এন্ড আই জাস্ট লাভ হার ম্যাডলি । দ্যাটস ওহাই আই কলড ইউ সো মেনি টাইম বাট ইটস নট রিচেবল, ইউ অলস ডিড নট এক্টিভ ইন সোস্যাল মিডিয়া ।
ওপাশ থেকে কায়ান এর গলায় হালকা ক্লান্তির ছাপ, তবুও কণ্ঠে ব্যথামেশানো এক কাতরতা ,
__ ” ইয়েস আই ওয়াজ টু মাচ বিজি ইন মাই কোম্পানি, ইউ আর সো লাকি ম্যান টু হ্যাভ দ্যা পারসন ইউ লাভ, নট এভরি ওয়ান লাকি এস ইউ ,আই উইশ ইউ অল দ্যা বেস্ট । আই উইশ আই কুড হ্যাভ গেট দ্যা পারসন আই লাভ,বাট দ্যাটস নট পসিবল এনিমোর ।”
এই কথাটা বলেই ওপাশে এক ভারী নিঃশ্বাস পড়ল,মনে হলো বুকের গভীর থেকে কষ্ট বেরিয়ে আসছে।
কথা শোনা মাত্রই জায়ন এর ভ্রু কুঁচকে গেল ,
একটু দুশ্চিন্তার কৌতূহল নিয়েই বলে উঠলো,
__” হেয় ব্রো হোয়াট হ্যপেনড ? আর ইউ ওকে? হোয়াই
ইউ সেয়িং লাইক দ্যাট , আমার উড বি লেয়লা ভাবি
থাকতে তুমি এরকম বলছো ব্রো?
কায়ানের গলায় হঠাৎ করেই গভীর নীরবতা নেমে এলো, কয়েক সেকেন্ড পরে যেন শব্দগুলো দাঁত চেপে বের হলো,
__” সি ইজ নো মোর ম্যান সি ইজ নো মোর, বিকজ অফ সাম ওয়ান । ”
শব্দগুলো কানে যেতেই জায়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। শরীরের ভেতর দিয়ে যেন ঠান্ডা বিদ্যুৎ বয়ে গেল। বিদেশে থাকা কালীন তার সবচেয়ে এককাছের বন্ধু, যার ভালোবাসার মানুষ লেয়লার কথা সে বারবার শুনেছে।
তিন বছর আগে ইউ.এস. এ থাকাকালীন জায়নের গেমিং ব্যবসার প্রথম পদক্ষেপে এই কায়ান দেমির আর্সলান ছিল একমাত্র ভরসা। হয়তো কায়ান না থাকলে জায়নের এত দ্রুত সাফল্য পাওয়া অসম্ভব ছিল। পরে অবশ্য যে জার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ অনেক কম হয়ে গেছিল ।
আর আজ সেই বন্ধুর কণ্ঠে ভেঙে পড়া এই সংবাদ শুনে জায়নের বুক কেঁপে উঠল।
জায়নের মনে পড়ে গেল ভালোবাসার মানুষকে হারানোর কষ্ট কী হতে পারে, সেটা সে বুঝেছিল সেদিন যেদিন তিয়াশার দুর্ঘটনা ঘটেছিল। বুকের ভেতর যেন হাহাকার জমে গিয়েছিল তখন। তবে আল্লাহর রহমতে তিয়াশা এখন ভালো আছে। এই মুহূর্তে সেই স্মৃতিই জায়নকে আরও কষ্টে ডুবিয়ে দিল। এই ভাবতে ভাবতেই এক দীর্ঘস্বাস ছাড়লো ।
ঠিক তখনই ওপাশে কায়ানের কণ্ঠস্বর বদলে গেল, দুঃখের সাথে মিশে উঠল প্রচণ্ড ক্রোধ, গর্জন যেন বজ্রপাতের মতো কানে বাজল,
__”আই জাস্ট ওয়ান্ট টু ডেস্ট্রয় হার লাইফ, ইফ পসিবল আই উইল কিল দ্যাট বিচ। আই অলসো প্লানিং সামথিং ফর হার বাট সি গোইং ব্যাক টু হার কান্ট্রি বাংলাদেশ, দ্যাট বিচ ইস আউট অফ মাই হ্যান্ড নাউ। এন্ড আই নিড ইউর হেল্প ম্যান দ্যাটস হোয়াই আই কল ইউ ।”
কায়ানের ভাঙা কণ্ঠে জমে থাকা দুঃখের সাথে মিশে থাকা আগুন যেন জায়নের বুকের ভেতরও ছড়িয়ে পড়ল। বন্ধুটি তার জন্য কত কিছু করেছে, তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে পাশে থেকেছে আজ যদি সেই বন্ধু সাহায্য চায়, তাই জায়ন যে করেই হোক তাকে সাহায্য করবে।
জায়নের চোখে ঝিলিক খেল, কণ্ঠ গম্ভীর আর শীতল
__” আই জাস্ট ফিল লাইক হেল ম্যান জাস্ট হেয়ারিং এবাউট লেয়লা ভাবি ……..
এনিথিং ফর ইউ ব্রো জাস্ট টেল মি ? ইফ সি ইজ ফ্রম বিডি দেন ডোন্ট ওয়ারি আই জাস্ট মেক হার লাইফ হেল।”
__ ” নো ব্রো আই জাস্ট পানিশ দিস ফাঁ* গার্ল ফ্রন্ট অফ আইস উইথ মাই বেয়ার হ্যান্ড । আই জাস্ট ওয়ান্ট টু কেম বাংলাদেশ টুমোরো সো ক্যান ইউ মেক ইট ফর মি?আই ওয়ান্ট এভরিথিং হোয়াট আই নিড দেয়ার।”
__” জাষ্ট কেম ব্রো অলোয়েজ ওয়েলকাম ,ডোন্ট ওয়ারি ইউ উইল গেট এবড়িথিং রেডি। বাই দ্যা ওয়ে
হু ইজ সি?”
__ ” সাম ওয়ান যে পৃথিবীর জন্য বার্ডেন । মাই ফাঁ**কিং সো কলড কোন উড়ে আসা ভাগ্নী । আই জাস্ট ওয়ান্ট টু ফা**কিং কি*লড হার। দ্যাট বিচ দেস্ট্রয় মাই হোল লাইফ ।
কায়ান এর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো জায়ন এর কানে ।
__” প্লীজ ম্যান বিলিভ ইন গড , গড উইল থিংকিং বেটার ফর ইউ , জাস্ট ডোন্ট ব্রেক ইওর সেল্ফ।”
__”আই ডোন্ট বিলিভ ইন গড এনিমোর , গড আমার ভালোবাসা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে ।
অ্যানি ওয়ে জাস্ট লিভ ইট ব্রো এন্ড থ্যাঙ্ক ইউ ।
__” দেন বিলিভ ইওর সেল্ফ এন্ড ডোন্ট সে থ্যাংকস ইউ নো আইএফ ইউ নট দেয়ার দিস টাইম দেন আই এম নট হেয়ার , হোয়ার আই এম টু ডে। ”
কায়ান একটু মৃদু সুরেই বলল,
__” আই ডোন্ট ডু এনিথিং ইটস অল ইওর হার্ড ওয়ার্কিং। ওকে মাই ফ্রেন্ডস আর কেম দে আর অলসো গোয়িং উইথ মি , ক্যাচ ইউ সুন ব্রো।”
__” এনি টাইম ম্যান ।”
এরপরই কলটা কেটে গেল। ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তবু বাতাসে রয়ে গেল কথোপকথনের দুঃখ, রাগ আর আসন্ন ঝড়ের অঘোষিত বার্তা।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই চৌধুরী ভিলার প্রতিটি দেয়াল যেন আসন্ন আনন্দের সুরে দুলে উঠলো। দশ দিনের মধ্যেই একসাথে দুটো বিয়ে তাই ঘরে বাইরে, করিডোর ড্রয়িংরুম, সবখানেই হাসি ঠাট্টা আর উত্তেজনার রঙ ছড়িয়ে পড়েছে। কর্তারা সবাই অফিস থেকে ফিরেছেন, জায়ন ও তার অফিস থেকে কিছুক্ষন আগে ফিরেছে। গিন্নির বসে আছেন ড্রয়িংরুমে, যেন এক উৎসবের আসর। পাশে বসে আছে তিয়াশা আর অনন্যা ।
ঠিক তখনই রুহেনা বেগম অনন্যার দিকে তাকিয়ে মমতা ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন
__” হ্যা রে মা ল্যহেঙ্গা নিবি না শাড়ি নিবি, কি পরবি বিয়ের দিন ?”
,কথা শেষ হতেই অনন্যার গাল যেন এক নিমিষে টকটকে লাল হয়ে উঠলো। তার চোখ নামানো, ঠোঁটে কাঁপন ধরা হাসি, হাত-পা অস্থির হয়ে ওঠা মনে হচ্ছিল সে যেন একেবারে এখনই বধূ সাজতে বসে গেছে। তার সেই অবুঝ লজ্জা দেখে ঘরে বসা সবাই হেসে উঠলো হাসি যেন এক ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারদিক।
তিয়াশা তখন দুষ্টু হাসি নিয়ে মজা করতেই পারলো না, মুখ টিপে বললো,
__” ও মা আমার নতুন ভাবি দেখি লজ্জায় রামধনু হয়ে যাচ্ছে ।”
অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো, যেন পৃথিবী থেকে নিজেকে আড়াল করতে চায়, অথচ তার লজ্জায় ভরা রূপ দেখে হাসি থামানোর ক্ষমতা কারো নেই।মেহজাবীন বেগম হেসে ওঠার পর স্নেহভরা সুরে বললেন,
__ ” আম্মু ওকে আর লজ্জা দিস না , এমনিতেই মেয়ে টা লজ্জায় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে । ওকে বলতে দে এখন কি পরবে বিয়ে তে ?”
অনন্যা আস্তে মাথা নিচু করে, গলায় কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দিলো,
__” লাল শাড়ি বড় আম্মু , মেজো আম্মু ।”
,তার সেই স্বীকারোক্তির মাঝে মিষ্টি এক স্বপ্নের আভাস, বুকভরা ভবিষ্যতের উত্তেজনা, আর চোখে ভাসতে থাকা এক অদ্ভুত আলো যেন সবাইকেই আবেগে ভিজিয়ে দিলো।
কিন্তু তিয়াশা সে তো মজা না করলে চলেই না। মুখ ফুলিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো
__” আচ্ছা বড় আম্মু, আম্মু , ছোট আম্মু তোমরা আমার বিয়ের সময় তো জিগ্গেস করনি আমি কি পরবো? বনু কে তো জিগ্গেস করলে।,”
কথা শেষ হতেই সবাই হেসে গড়িয়ে পড়লো। রুহেনা আর সুরাইয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতেই প্রায় কাঁপতে লাগলেন। তখন সুরাইয়া বেগম চোখে দুষ্টু ঝিলিক নিয়ে বললেন,
__” তোমার ঐ পাগল বর নিজের হাতে সব কিছু কিনেছিল তোর জন্য , আমাদের কিচ্ছু কিনতে দেয়নি
তোর জন্য ।”
এই উত্তর শুনে তিয়াশা যেন ভেতর থেকে ভিজে গেলো। মাথা চুলকাতে চুলকাতে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো, অথচ গোপনে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত টান খেলে গেলো যেন নিজের ভালোবাসা নিয়ে আবারো নতুন করে ভিজলো মন।
ঠিক সেই মুহূর্তেই করিডোর কাঁপিয়ে এলো এক পুরুষকণ্ঠ,
__” বউ….. বউ ।”
পুরো ড্রয়িং রুম স্তব্ধ হয়ে গেলো এক সেকেন্ডের জন্য, তারপর হাসি ঠাট্টার নতুন ঢেউ বইলো। মেহজাবীন বেগম বিরক্তি নিয়ে বললেন
__” দেখো মেয়ে টা দশ মিনিট ও হলো না নিচে এসেছে এর মধ্যেই ডাকাডাকি শুরু ।”
তিয়াশা লজ্জায় গলে যাচ্ছে,তিয়াশা জায়ন এর ডাকে সারা দেওয়ার আগেই অথচ উত্তর দেওয়ার আগেই মেহজাবীন বেগম গলা উঁচিয়ে বললেন,
__” কি হয়েছে , কি লাগবে বল? মেয়ে টা এইমাত্র নিচে আসলো।”
কিন্তু করিডোর থেকে আবারো ভেসে এলো জায়নের জেদি কণ্ঠ,
__” বউ লাগবে , বউ পাঠাও মা …..এইমাত্র কোথায় ? ১৫ মিনিট ৩৩ সেকেন্ড হয়ে গেছে নীচে গেছে এবার উপরে পাঠাও।”
তিয়াশা আবারো পরে গেল লজ্জায় , এই লোকটার জ্বালায় কোথাও গিয়ে বসতেও পারবে না , জায়ন এর কাণ্ড দেখে অনন্যা, রূহেন বেগম, সুরাইয়া বেগম মুচকি মুচকি হেসেই যাচ্ছে। এদিকে মেহজাবীন বেগম জানে তার পাগল ছেলে এখন বউ না পাঠালে পাগলামি করবে তাই হাল ছেড়ে দিয়ে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে তিয়াশা কে বলেই উঠল,
__” যা,আম্মু যা নইলে আবার কি পাগলামি করবে ঠিক নেই ।”
আবারো ভেসে এলো ,
___” বউ …..”
__” বউ ….”
তিয়াশা বিরক্ত গলায় ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলো। তার প্রতিটি পায়ে ভর করেই যেন মিশে ছিল লজ্জা, বিরক্তি, অথচ বুকের ভেতর লুকানো হাসিও।
রুমে ঢুকেই সে গম্ভীর স্বরে বললো,
__” চিৎকার কেনো করেছিল ??
জায়ন বিছানায় হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসেছিল, তার দৃষ্টি যেন কোথাও হারিয়ে গেছে, মুখের ভেতর অদ্ভুত এক চাপা টান। তিয়াশা ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ তাকে কাছে টেনে নিলো, বুকের ভেতর চেপে ধরে গলায় মুখ গুঁজে ভারী কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,
__” আমায় কখনো ছেড়ে যাবি না তো রোদ ? ভালোবাসার মানুষ এর মধ্যে একজনের কিছু হলে
আরেকজন তো পাগল হয়ে যাবে আর আমি তো মরেই যাবো । ”
সেই কণ্ঠে অদ্ভুত এক ভার, এক শ্বাসরুদ্ধ অসহায়তা, যা শুনে তিয়াশার বুক কেঁপে উঠলো। সে যেন বুঝে উঠতে পারছে না হঠাৎ কী হলো এই মানুষটার, যে সবসময় এত শক্ত, এত দৃঢ়।
তিয়াশা দু’হাত দিয়ে জায়নের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো, কপালে কপাল ছুঁইয়ে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
__” কি হয়েছে তোমার? হঠাৎ এরকম কেন বলছো?
আর আমি কোথায় যাব তোমায় ছেড়ে?”
জায়নের চোখে তখন স্পষ্ট এক ঝড়, ভেতরে ভেতরে দুপুর থেকে এক যন্ত্রণার ভারী ছায়া পড়েছে । ঠোঁট কাঁপছিল, কণ্ঠ কেঁপে যাচ্ছিল
__” কিছু না জান শুধু আমায় কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে থাক , শুধু আগলে রাখ ,তোর বুকের মাঝে রাখ আমার এখন শুধু তোর স্পর্শ চাই অনুভব করতে চাই বিশ্বাস কর আমার অন্য কোন কিছু চাই না শুধু এখন তোকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চাই ।তিন বছর আগে তোকে প্রথম যখন দেখেছিলাম তখন ভেবেছিলাম এটা শুধু অবসেশন কিন্তু কবে যে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছি, নিজেই জানি না জান, নিজেই জানি না।”
তিয়াশা তখন সম্পূর্ণ নিঃশব্দ। শুধু বুক ভরে জড়িয়ে রাখলো জায়নকে, যেন নিজের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে তাকে ভাঙন থেকে আগলে রাখতে চায়। সে দেখছে, এই মানুষটার চোখ ভিজে উঠছে অকারণেই, অথচ কেন তা কিছুই বুঝতে পারছে না। তার বুকের ভেতর হাহাকার জমে উঠছে, ভয় আর মমতায় ভরে যাচ্ছে মন। তিয়াশার মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে যদি সে না থাকে, তবে জায়ন ভেঙে পড়বে পুরোপুরি। তাই সে শুধু নিঃশব্দে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, যেন তার বুকের উষ্ণতাই হোক জায়নের একমাত্র আশ্রয়, আর নিজের নীরব ভালোবাসায় সে ঢেকে রাখলো জায়নের সমস্ত ভয় আর কষ্ট।
রাতটা ঘন, ঘরের কোণে টিভির হালকা আলো কাশফুলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে প্রায় নয়টা
জায়ন এর কোলে বসে তিয়াশা আর মুভির নীরব আনন্দে ভুলে আছে সময়। দুজনের মাঝে এক শান্তি, আর তখনই বাইরে থেকে কণ্ঠটা নড়বড়ে করে দরজায় নক দেয় ইউভি।
__” ভাইয়া একটু বাইরে আসবে ? ”
জায়ন বিছানায় বসেই বলে উঠল ,
__” তুই ভেতরে আয়, দরজা খোলাই আছে।”
দরজার বাইরে ইউভির কণ্ঠটা একটু টনটনে,অসহায়ের মতো, কিন্তু আড়েই একটা কৌতুক লুকিয়ে আছে। সে নিচু সুরে বললো,
__” না ভাইয়া রুমে যাব না, তুমি বাইরে আসো ।”
তিয়াশা দুশ্চিন্তায় গলায় একটু নরম করে বলল, যেন টিভির দিকে চোখের শান্তি বজায় রেখে,
__” জাও না ভাইয়ার হয়তো কোন দরকার ।”
জায়নের চোখে সামান্য বিরক্তি, কিন্তু ওই বিরক্তির পাশে এক মজার ধার সে তিয়াশাকে কোল থেকে সরিয়ে দরজার দিকে এগোলো,বাইরে যেতেই কোমড়ে হাত রেখে ভ্রু কুচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
__” কি হয়েছে বল ? ”
ইউভি লাজুক এক চাহনিতে মাথা চুলকে হাসিমুখ নিয়ে বলল সাধারণ কথায় বড় একটা বাধ্যতামূলক গোপন পরিকল্পনার ইঙ্গিত,
__ ” ছাদে আসো একটু, দরকার আছে ।”
ইউভির কথা শুনে জায়ন কিছু বলে উঠতেই যাবে তার আগেই ইউভি দ্রুত বলল একপ্রকার ছাদ-ডাকে আগ্রহ জাগিয়ে,
__” ভাইয়া ছাদে চলো তারপর প্রশ্ন করো।”
এই বলে ইউভি এক ঝটকায় ছাদের দিকে ছুটে গেল, জায়ন কিছুটা হতভম্ব হয়ে এক গভীর নিশ্বাস ছেড়ে তিয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল,
__” বউ একটু ছাদে যাচ্ছি এক্ষুনি চলে আসবো ।”
তিয়াশা টিভির দিকে তাকিয়ে নির্ভেজাল কণ্ঠে জবাব দিল, যেন আশ্বাসটা মৃদু ও নিরাপদ,
__” ওকে যাও ।”
তারপর জায়ন ধীর-পায়ে উঠে ছাদের পথে চললো। ছাদে ওঠার ফোঁকে সে দেখলো তিনটি মুখ দাঁড়িয়ে আছে, আকাশ, রায়ান আর ইউভি; আর আকাশের হাতে লাউডস্পিকারে খসে খসে আছে সাগর, নাজিম, আহান, পলাশ, জেমস। সবাই যেন নীরব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
এর মধ্যেই আকাশ বলে উঠলো,
__” নেও নেও সাগর ভাই ,বড় ভাই চলে এসেছে ।”
জায়ন যেন বুঝতেই পারছে না কী কাণ্ড চলছে; অস্বস্তিতে দাঁত কাঁটছে, কিন্তু মনেই মজাটুকু আছে। আকাশ ফোনটা জায়নের হাতে ঠেলে দিলে সাগর একটু গলা খাকরী দিয়ে বলল,
__” ভাই আমার ছোট ছোট ভাইরা, আর অবশ্যই আমরা মিলে তোমার কাছে একটা দাবী রাখতে চাই।”
জায়ন নাক ফুলিয়ে, রাগ আর তিক্ততা মিশিয়ে কণ্ঠ উঠালো তার ওই সরাসরি, টসকাটা স্বভাবটি স্পষ্ট,
__” বা* এই সময় কি নাটক শুরু করেছিস, যা বলবি
ঠিক করে বল । ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে আই ডিডনট ফা*কিং লাইক ইট।”
আকাশ আর ইউভি একটু কেঁপে উঠলো, রায়ান শুধু ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসছে,ফোনে থাকা চারজন চুপ, তারপর হঠাৎ পলাশের গলা ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো,
__” এইসব ফা*কিং ফু*কিং পরে করিস । আমরা একটু
ওই ছোট দুই ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে একটু ব্যাচেলর
করতে চাই । ”
এই কথা শুনে জায়নের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল মনে হতে লাগলো ছেলে পুলের বাপ হয়ে এখন ব্যাচেলর পার্টি ?অবাক চেহারায় বলল,
__” ভাই তোদের ছেলে মেয়ে হয়ে গেছে এখন ও তোদের ব্যাচেলর সাজার শখ হয়েছে ? কোন দিক থেকে ব্যাচেলর ভাই তোরা ।”
রায়ান তখন পাশ থেকে বলে উঠলো,
__” বড় ভাই এইটা এই দুই জনের প্ল্যান , আকাশ ভাই আর ইউভি ভাই এর।”
এই কথা শুনেই ইউভি আর আকাশ রায়ানের দিকে এমনভাবে তাকাল মনে হয় আগুনে চুবনি দেওয়াবে। রায়ান এর কথায় জায়ন কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
__” তাহলে যা তোরা ?”
আকাশ কিছুটা আমতা আমতা করে এদিক ওদিক করে বলল,
__” বড় ভাই বউ গুলো জানলে জ্যান্ত কবর দিবে।
তুমি একটু ম্যানেজ করো না তুমি পারবে ।”
ফোনের বাকি চার জনও একসুরে একই রকম অনুরোধ জানালো জায়ন প্রথমে হাত নেড়ে দুর্বল অস্বীকার করলো ভয়ের যোগে মিশে আছে মজার হুমকি—
__” আমি এসব পারবো না , তোদের বউ জ্যান্ত কবর দেবে আর আমার বউ ঘূর্ণি ঝড় উঠিয়ে তোদের সঙ্গে
আমাকেও পুঁতে দেব , আমি পারবো না কিন্তু তোরা যদি যাস আমায় ও একটু নিয়ে যাস আমার বউ কে বলে ।”
কিন্তু কথার ধার ধীরে ধীরে হাপে পোঁছলে জায়নের মুখে একটা দুষ্টু হাসি ফোটে—ফাঁকফোকরেই তার মিষ্টি নরম স্বভাব ভাসে; সে হাসিমিশে আবার বলল,
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৯
__” তোরা যাবি তাই বললাম নইলে আমি বাবা ওসব এর ধারে কাছেও যাই না । কিন্তু ভাই তোদের তো আমায় ছাড়া ভালো লাগবে না তাই আমার মন না চাইলেও যেতে হবে , তাই না ।”
জায়নের এই কাণ্ডকারখানায় সবার ঠোঁট খসে পড়লো চোখে বিস্ময়, সবাই ভেবে নিচ্ছে, এত নাটকও করতে পারে জায়ন।।
আকাশের মুখ থেকে তো বেরিয়েই গেলো,
__”অ্যা আ আ…..
