তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭১ (২)

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭১ (২)
নীল মণ

তিয়াশার নিস্তেজ শরীরটা এখনো জায়নের কোলের উপরেই পড়ে আছে, যেন সব শক্তি নিংড়ে গিয়েছে ভেতর থেকে। জায়ন তাকে এক মুহূর্তও নামায়নি। তিয়াশা চেয়েছিল অন্য সিটে বসতে, একটু দূরে সরে যেতে, একটু স্বস্তি খুঁজতে কিন্তু জায়নের এক ধমকেই সে স্তব্ধ, আর নড়েনি। তার ড্রেস টা পুরো ছেড়া ছিল, তাই জায়ন নিজের ব্লেজারটা পেঁচিয়ে পরিয়ে দিয়েছিল, সেই অবস্থাতেই পুরো রাস্তা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছে বাসার সামনে। জায়নের মুখটা এখনো গম্ভীর, চোয়ালের রেখা শক্ত হয়ে আছে, তার চোখে রাগের লেলিহান আগুন এখনো স্পষ্ট, অথচ একটাও শব্দ বেরোচ্ছে না ঠোঁট থেকে।

তিয়াশা ব্লেজারের ভেতর লুকিয়ে, মুখ ডুবিয়ে আছে জায়নের বুকের ভেতর, যেন এই বুকের ভেতরেই সে লুকিয়ে ফেলতে চায় নিজের কান্না, নিজের অপমান, নিজের ভয় কিন্তু তার ফর্সা মুখের দুই পাশ ফুলে আছে, গালে স্পষ্ট চড়ের দাগ, ঠোঁট ফুলে আছে ,জায়ন এর ঠোঁটের ঝড়ের কারণে ঠোঁট কেটেও গেছে । আর এই লালচে চিহ্নগুলো যেন সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জায়নের পাগলাটে রাগের।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সদর দরজা পেরিয়েই জায়ন হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকতে লাগল। ড্রয়িং রুমে তখন হাসি ঠাট্টা করছিল সকলে, আড্ডার শব্দে মুখর চারদিক, কিন্তু ওদের দুজনকে একসঙ্গে, এই অবস্থায় দেখে হঠাৎ যেন সব মুখ স্তব্ধ হয়ে গেল, জায়ন এর চুল এলোমেলো ,মুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে রাগের ঝিলিক মনে হচ্ছে কোন ঝড় বয়ে গেছে , তিয়াশাও গুটিয়ে আছে জায়ন এর বুকে ।হাসির ঝলক মিলিয়ে গেল, চোখ মুখ হয়ে গেল বিস্ফারিত। তারা তো আলাদা গিয়েছিল, তবে একসঙ্গে ফিরল কীভাবে?
রুহেনা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এলেন, কণ্ঠে দুশ্চিন্তার কম্পন,

__” বাবা, কি হয়েছে? তোর চেহারা এরকম লাগছে কেন? তোরা গেলি আলাদা, আসলি একসঙ্গে কী করে? আর ছোট আম্মুই বা কোথায়?”
জায়ন একবারও সেদিকে তাকাল না, শুধু সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে গম্ভীর সুরে ছুড়ে দিল তীরের মতো কথা,
__” মেজো মা, মেয়েদের যদি না সামলাতে পারো, আগে বলে দিও। তোমাদের ভরসায় রেখে যাব না।”
এই এক লাইনের উত্তর যেন আঘাতের মতো এসে পড়ল সবার বুকে। তিয়াশার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, নিঃশ্বাস আটকে এল তার। প্রণয় সাহেব, তাহসান সাহেব, রুহেনা বেগম, মেহজাবীন বেগম, সুরাইয়া বেগম সবার চোখ মুখ তখন হতবাক, হতভম্ব। মনে হচ্ছিল, এক মুহূর্তেই যেন বাড়ির দেয়ালের ভেতর ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে গেল।
মেহজাবীন বেগম ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলেন,

__” বাবা, কি হয়েছে বলবি তো?”
কিন্তু জায়নের দৃষ্টি এতটাই ভয়ঙ্কর, এতটাই রাগে জ্বলন্ত ছিল যে সেই এক দৃষ্টিতেই মেহজাবীন বেগমের বুক কেঁপে উঠল, ঠোঁট শুকিয়ে এল।
গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে জায়ন উপরে চলে গেল। রুমে ঢুকে লাইট জ্বালাল, বিছানায় বসিয়ে দিল তিয়াশাকে, ধীরে ধীরে ব্লেজারটা সরাতেই স্পষ্ট ভেসে উঠল তিয়াশার গলা আর বুকজুড়ে লালচে দাগ, যেগুলো ছিল জায়নের দেওয়া রাগের ছাপ, তিয়াশার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
তিয়াশা বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইলে জায়নের চোখের আগুন আরও তীব্র হয়ে উঠল, কণ্ঠে গর্জন,

__” কোথায় যাচ্ছিস?”
তিয়াশা ভয়ে মাথা নিচু করে, কাঁপা গলায় আস্তে বলল,
__” ফ্রেশ হতে। এখন কি সেটার জন্যেও পারমিশন লাগবে ?”
কথা শেষ হতেই জায়ন এক ঝটকায় কোলে তুলে নিল তাকে, ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল, গম্ভীর স্বরে বলল,
__” আমি করিয়ে দিচ্ছি।”
তিয়াশা স্তব্ধ, জানে তার কোন কথাই এই রুমে শোনা হবে না। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে জায়ন নিজের একটি টিশার্ট পরিয়ে দিল তিয়াশাকে, তিয়াশার চুল গুলো আঁচড়ে দিয়ে , বিছানায় বসিয়ে দিল ।
তারপর জায়ন বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, চোঁখে মুখে এখনো রাগের আগুন জ্বলছিল, তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন মাটিকে কাঁপিয়ে তুলছিল, ঠোঁট শক্তভাবে চেপে ধরা, চোয়ালের রেখা শক্ত, কপালের শিরা ফুলে উঠছে। তিয়াশার সন্দেহ হলো ফ্রেশ না হয়েই আবার বাইরে যাচ্ছ, ভেতরে ভেতরে কিছু একটা আন্দাজ করে ভয়ে কেঁপে উঠলো, বুক ধকধক করছে, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, কাপা কাপা কন্ঠে পেছন থেকেই বলে উঠলো,

__” কোথায় যাচ্ছো?”
জায়ন এর কানে সেই কথা আসতেই সে মুহূর্তেই থেমে গেল, ধীরে ধীরে তিয়াশার দিকে ঘুরে দাঁড়াল, রাগান্বিত চেহারায় গম্ভীর কণ্ঠে গর্জে উঠল, তার চোখে আগুনের লেলিহান শিখা,
__” কৈফিয়ত চাইতে।”
তিয়াশার চোঁখ বড় বড় হয়ে গেল, ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো, শরীরটা হিম হয়ে গেল। তবুও এই মুহূর্তে অজান্তেই প্রশ্ন করে বসল, ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে,
__” কিসের কৈফিয়ত? আর কোথায়?”
জায়ন কোমরে দুই হাত রেখে দাঁড়াল, মাথা নিচু করে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, সেই দীর্ঘশ্বাস যেন আগুনের ধোঁয়া হয়ে বেরোলো তার ভেতর থেকে। তারপর আবারো তিয়াশার দিকে এক তীব্র দৃস্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো, কণ্ঠস্বর কাঁপছিল যা ছিল রাগে ভরা,

__” জানিস না কিসের কৈফিয়ত নিতে যাচ্ছি? তোদের কৈফিয়ত, বিশেষ করে তোর। বাসা থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে আমার বউ অথচ আমি জানি না? যাদের ভরসায় বউ কে বাসায় রেখে যাচ্ছি তাদের নাকের ডগা দিয়ে বউ বেরিয়ে যাচ্ছে আমি কৈফিয়ত চাবো না ?”
এই কথাগুলো যেন বিষের মতো বিঁধে গেল তিয়াশার বুকে। সে নিঃশব্দে চোখ মুছল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল। তার ভয় আর অসহায়তার ভেতরে মিশে গেল লজ্জা আর এক অদ্ভুত অপরাধবোধ।
তারপর কি মনে করে ধীরে ধীরে ভারি পদক্ষেপে তিয়াশার দিকে এগোতে লাগল। তার প্রতিটি পদক্ষেপের শব্দে তিয়াশার বুক আরও দ্রুত কাঁপতে লাগল, মনে হচ্ছিল এই লোকটা এখনই তাকে টেনে তুলবে, না হয় শ্বাস বন্ধ করে ফেলবে। তিয়াশা বিছানায় বসে একটু পেছাতে লাগলো, হাত দিয়ে চাদর আঁকড়ে ধরল, জায়ন তিয়াশার কাছে যেতেই রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠলো,

__” ওই ড্রেস কোথায় পেয়েছিস?”
তিয়াশা ভয়ে নিজের হাঁটু গুটিয়ে নিল নিজের বুকের কাছে , টিশার্টের কাপড় আঁকড়ে ধরে উরু ঢাকতে লাগল, বুক কাঁপছে, হাত ঘামছে, ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে তিয়াশা ভাবছে সত্যি টা যদি জানলে তাহলে হয়তো আজ তাকে মেরেই ফেলবে।
জায়ন সামনে দাঁড়িয়ে, চোখ লাল হয়ে আছে, কণ্ঠে বজ্রপাতের মতো ধ্বনি,
__” কি হলো, শোনা যাচ্ছে না? কিছু জিজ্ঞেস করছি তো?”
মুহূর্তেই তিয়াশার কানে আবারো জায়ন এর গর্জন বাজলো, তার শরীর কেঁপে উঠলো, গলার স্বর কেঁপে গেল, তারাতারি করে বলে উঠল,

__” আজকে দুপুরে , দুপুরে শপিং করতে গিয়ে কিনেছি।”
জায়নের নাক রাগে ফুলে উঠছে, দাঁতের ফাঁক থেকে গর্জনের মতো শব্দ বেরোচ্ছে, চোখে রাগের ঝিলিক, শরীরের প্রতিটি রেখা শক্ত হয়ে আছে। আর তিয়াশা গুটিয়ে গেছে বিছানার এক কোণে, কাঁপছে ভয়ে।
জায়ন আবারো প্রশ্ন করে বসলো, কণ্ঠস্বর আরও ভারি, আরও রাগান্বিত,
__” মা, চাচীর সামনে তোরা এগুলো কি করে কিনলি? হুমম, বল?”
তিয়াশা হাঁটু গেড়ে বসে আস্তে আস্তে আরো পেছনে যেতে শুরু করলো, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, হাত কাঁপছে, চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। জায়ন এর এই দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল, চোখে আরও ক্ষোভ জমলো, গলার স্বর আরও কঠিন হলো,

__” কি হলো, পেছনে সরছিস কেন? প্রশ্নের জবাব দে, এগুলো কি করে কিনলি? তুই এসব ড্রেস ওদের সামনে কিনলি? আমার তো কৈফিয়ত নিতে হবে।”
গলাটা আটকে আসছে। কি করবে সে এই মুহুর্তে? মাঝে মাঝে এই লোকটার ভালোবাসা তাকে পাগল করে দেয়, মনে হয় এই পৃথিবীর সব থেকে ভাগ্যবতী সে। কিন্তু মাঝে মাঝে তার বরের এই ভয়ঙ্কর রূপ সে নিতে পারে না, সহ্য করতে পারে না। জায়নের চোঁখের দৃষ্টি এখনো রক্তাভ, এখনো তার মাথা ঠিক নেই।
তবুও তিয়াশা কাঁপা গলায় বলে উঠলো, ভেতর থেকে সাহস জোগাড় করে, একটু ভিত স্বরে,
__” ওনারা জানে না?”
জায়ন মুহূর্তেই অবাক হয়ে গেল, কপাল কুঁচকে গেল একসঙ্গে শপিং করেছে, তাহলে জানে না মানে? নিজের মনের সেই প্রশ্নকে আর ধরে রাখতে পারল না, ঠোঁট চেপে তীব্র সুরে বলে উঠলো,

__” জানে না মানে?”
জায়নের রাগ তখনো আকাশছোঁয়া, কিন্তু তার বুকের ভেতরে এক তীব্র ভালোবাসাও জ্বলছিল যা তাকে পাগলের মতো অধিকারপরায়ণ করে তুলছিল।
তিয়াশা ভয়ে কান্নাই করে দিলো , বিছানায় বসা থেকে একটু উঠে একদম বেডের কোনায় চলে গেল , দুহাত বুকের কাছে চেপে ধরে ভয়ে কুঁকড়ে বসে আছে , চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে , বুক কেঁপে উঠছে , কাঁপা গলায় অনুনয় ভরা স্বরে বলল ,
__ ” সেটা শুনলে তুমি আবারও মারবে …..
প্লীজ প্লীজ আর হবে না , তুমি এই ভয়ঙ্কর চেহারা সরাও , আমার খুব ভয় লাগছে ।”
জায়ন এর কানে যেন কিছুই ঢুকল না , তার চোখ লাল , শ্বাস ভারী , সে হঠাৎ করেই বিছানায় উঠে গেলো ।তিয়াশার সারা শরীর ঠাণ্ডা হিমশীতল হয়ে উঠল ,ঠোঁট কাপছে । বুকের ভেতরটা ছটফট করছে । অথচ জায়ন একটুও দয়া না করে তিয়াশার পা ধরে এক টানে নিজের দিকে টেনে নিলো আর দাঁতে দাঁত চেপে আবারো জিজ্ঞেস করলো ,
__” তারা জানেনা মানে কি ?”
তিয়াশার চোখের পানি ঝরে ঝরে নামছে , সে জানে যতক্ষণ উত্তর না দেবে ততক্ষণ রেহাই নেই , তাই বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে কাঁপা স্বরে বলল ,

__” আমি আর অনু গেছিলাম , বাসা থেকে কেউ যায়নি ।”
এই কথা শোনার সাথে সাথেই জায়ন এর রাগ আগুনের মতো উগ্র হয়ে উঠল ।সে তিয়াশার মুখ শক্ত করে চেপে ধরে বজ্রগলায় চিৎকার করে উঠলো , যেই চিৎকারে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল , দেয়ালের ভেতর প্রতিধ্বনি বাজলো ,
__” তারমানে তুই একা গিয়েছিলি ? আমাকে মিথ্যে কেন বলছিলি ? শুধুমাত্র ওই চিপ প্ল্যানিং এর জন্য ?”
তিয়াশা তখন হাউ হাউ করে কান্না করছে ।বুক ফেটে আসছে , কাঁদতে কাঁদতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ।জায়ন সেটা দেখার পর এক ঝটকায় মুখ ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বেরোতে যাবে , ঠিক তখনই তিয়াশা পেছন থেকে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল ,

__” প্লীজ ছোট একটা বিষয় নিয়ে আর সিন ক্রিয়েট করো না , তোমার যা বলার আমাকে বলো….. কেউ জানত না আমরা কোথায় গেছি , বাসায় বলে গেছি আমরা রেস্টুরেন্ট যাচ্ছি , প্লীজ ….আমার আর ভালো লাগছে না ।”
কিন্তু জায়ন এর রাগ তখনো আগুনের মতো জ্বলছে , সে আবারো ফিরে এসে বেডে এমন জোরে একটা লাথি মারল যে পুরো ঘর কেঁপে উঠল , ড্রেসিং টেবিলের কাঁচ দুলে উঠল , বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা জিনিসপত্র কেঁপে শব্দ করে উঠল , তারপর সে আবারো তিয়াশার মুখ শক্ত করে চেপে ধরে রাগে গর্জে বলে উঠলো,

__” আমি সিন ক্রিয়েট করছি ? এটা ছোট বিষয় ? হারা** বাচ্চা এটা ছোট বিষয় ? দেখিস নি সব মাদা*** গুলো কিভাবে তোদের দিকে তাকিয়ে হায়নার মতো গিলে খাচ্ছিল ? শা* আমার বউ এর উপর তাঁকিয়ে ছিল , আমার বোনদের উপর তাঁকিয়ে ছিল , আর আমি সিন ক্রিয়েট করছি ? যদি কিছু হয়ে যেত , যদি রাস্তা ঘাটে একটুও কিছু হতো , তখন কি করতি?তুই জানিস না আজকাল মানুষ কেমন ভয়ঙ্কর … মনে হচ্ছিল তোকে…. বা* আমার বউ এর হাজার মাইল আশেপাশে ও কোন পুরুষ আমি সহ্য করি না , আর সেখানে ওই অতগুলো পুরুষ তোর দিকে চোখ দিয়েই ছিঁড়ে খাচ্ছিল , তাহলে বল আমি ঠিক থাকবো কিভাবে ? আমাকে দেখেছিস কখনো তুই ব্যতীত অন্য মেয়ের দিকে ভুল করেও চোখ তুলে তাকাতে ? কারণ আমি শুধু তোর , শুধু তোর জন্য , আমি নিচে যাচ্ছি আর একটা কথা বললে বা* আজকে তোকে মেরেই ফেলবো।”

তিয়াশা ভেজা চোখে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে , ঠোঁট কাঁপছে , কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।নিঃশব্দ , বুক ধড়ফড় করছে , চোখ দিয়ে শুধু পানি গড়িয়ে নামছে , যেন গলা আটকে গেছে , শব্দ বেরুচ্ছে না ।
জায়ন আর কিছু বলল না , দমফাটা নিঃশ্বাস নিতে নিতে তিয়াশাকে ছেড়ে দিলো , তারপর টেবিলে এমন এক লাথি মারল যে গ্লাসগুলো ছিটকে পড়ে গেলো , দরজা এমন জোরে ধাক্কা মেরে বন্ধ করল যে শব্দে আবারো তিয়াশা কেঁপে উঠল , বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল , আর জায়ন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে গর্জে উঠল ,

__” মা…..
মেজো মা….
ছোট মা …..”
তার সেই বজ্রকণ্ঠ চিৎকারে সারা বাড়ি ফাটলো , ড্রয়িং রুমে বসা সবাই চমকে তাকালো , কারো মুখে কোনো কথা নেই , একটু আগে উপরে যে তুমুল চিৎকার হচ্ছিল তার প্রতিটা শব্দই নিচে বসা সবার কানে পৌঁছেছিল , প্রণয় সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছিলেন উপরে গিয়ে দেখবেন বলে , কিন্তু রুহেনা বেগম হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিয়ে ছিলেন । চোখে ভয় মিশ্রিত দুশ্চিন্তা ।আর চারপাশে থাকা সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে , কে কী করবে বুঝতে পারছে না , শুধু নিস্তব্ধতা আর আতঙ্কে ঘর ভরে উঠলো ।
কিন্তু প্রণয় সাহেব এবার আর থামলেন না উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

__” এরকম চিৎকার করছিস কেনো ? আর একটু আগে আমার মেয়ের উপরেই বা এত জোড়ে চিৎকার করছিলি কেন? আমার মেয়ের উপর কখনো আমি গলা চড়িয়ে কথা বলিনি জায়ন … ”
প্রণয় সাহেব এর বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠছিল, নিজের মেয়ের কান্নার শব্দে নিজের একটুও ভালো লাগছিল না অথচ বাইরে থেকে তিনি গলা শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলেন, যেনো পরিবারের সবাই বুঝতে না পারে ভেতরে কি ঝড় বইছে।
প্রণয় সাহেব এর কথা শেষ হতে না হতেই জায়ন এমন এক কথা ছুঁড়ে দিল যা শুনে সবার মুখ হা হয়ে গেল ।ড্রয়িং রুমে একদম পিনপতন নীরবতা নেমে এল ,

__” ও আগে এখন আমার বউ ,তারপর বাকি সম্পর্ক ।আর আমি বুঝে নেবো কি করবো না করবো । কেউ এ ব্যাপারে কথা বললে আমি ছেড়ে কথা বলবো না ।”
এর মধ্যেই প্রান্তিক সাহেব নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মুখে কড়া দৃষ্টি , গলায় অগ্নিমাখা স্বর । এসেই বলে উঠলেন ,

__” এত চেচামেচি কিসের ?”
হঠাৎ সদর দরজা পার করে রায়ান ইউভি আর অনন্যা ঢুকল , এদের দেখেই সবাই থমকে দাঁড়িয়ে গেল , ইউভি আর রায়ান এর মুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে প্রচণ্ড রাগ জমে আছে , চোখে আগুন , ঠোঁট কামড়ানো , আর অনন্যা মাথা নিচু করে আছে , তার ওড়নাটা কাঁধ থেকে নেমে এসে ড্রেসের উপর আঁকড়ে ধরা , যেন ভেতরের লজ্জা আর ভয়ের বোঝা ঢাকতে চাইছে ।
ওদের দিকে তাকাতেই জায়ন বাদে সবাই চমকে উঠলেন । সুরাইয়া বেগম যেন নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে গেলেন অনুর দিকে ।চোখে মুখে রাগ । শ্বাস কেঁপে যাচ্ছে , গলা জড়ানো স্বরে বলে উঠলেন ,

__” এই এ কি অবস্থা তোর ?”
অনু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঠোঁট কাঁপছে , চোখের কোণ ভিজে আছে কারন পুরো রাস্তা আজকে ইউভি আর রায়ান এর বকাবকি শুনতে শুনতে এসেছে। ওদিকে আকাশ গেছে আরোহী কে ছাড়তে, আজকে বিকাল টা এত সুন্দর ছিল কিন্তু রাত টা হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর ।
অনু কিছু বলতে পারছে না , তখনই তাহসান সাহেব ও কিছু বলার জন্য এগোতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই ড্রয়িং রুমে বেজে উঠলো জায়ন এর বজ্রকণ্ঠ ,

__” অনু রুমে যা রাইট নাউ।”
সবাই একদম চুপ নিঃশব্দ । শুধু সবার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে , আর অনু আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না , মাথা নিচু করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল । যেন পালিয়ে বাঁচলো জায়নের চোখ থেকে ।
জায়ন এবার ধীরে ধীরে মেহজাবীন বেগম এর দিকে ফিরল তার চোখে আগুন । ঠোঁট চেপে ধরা , মুখে গম্ভীরতা । একেকটা শব্দ যেন ছুরি হয়ে বেরোচ্ছে ,
__” তোমরা বাড়ির মেয়েদের খবর না রাখতে পারলে বলে দাও , নিয়ে চলে যাব ।”
জায়ন এর কথা শুনে মেহজাবীন বেগম অবাক হয়ে মুখে হাত চাপা দিলেন । চোখ ভিজে উঠলো , গলা কেঁপে উঠলো ,

__” কি বলছিস কি এইসব ? আমরা কোথায় খবর রাখলাম না ?”
কণ্ঠে দুঃখ, চোখে অবিশ্বাস তিনি যেন বুঝতেই পারছেন না ছেলের এই হঠাৎ অগ্নিগর্জন কোথা থেকে এলো।
এর মধ্যেই পাশ থেকে তাহসান সাহেব ভ্রু কুঁচকে, অস্থির ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
__” আ হা হয়েছে কি সেটা বলবি তো তোরা? ”
তাহসান সাহেবের গলায় যেন কর্তৃত্ব আর কৌতূহল মিশে আছে এই অস্থির পরিবেশে তিনি চান স্পষ্ট উত্তর।
এই বলেই তাহসান সাহেব রায়ান আর ইউভির দিকে ফিরে কড়া চোখে বলে উঠলো,
__” এই তোরা বলতো কি হয়েছে ?”
রূহেনা বেগম এর বুকের ভেতরেও তখন ঝড় বইছে চোখ বড় বড় করে ছুটে এলেন ইউভি দের দিকে , স্নেহভরা কণ্ঠে, কিন্তু ভয়ের চাপা সুরে বলে উঠলেন,

__” চুপ করে না থেকে বল বাবা কি হয়েছে?”
একজন মা হিসেবে তিনি বুঝছেন কিছু একটা বড় ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু তাঁর হৃদয় চাইছে আশ্বাস—যেন ব্যাপারটা এতটা ভয়ঙ্কর না হয়।
তখনই জায়ন বজ্রপাতের মতো চিৎকার করে বলে উঠলো,
__” তোমরা জানো না আমি আমার বউ কে রুম থেকেই বেরোতে দেই না সেইখানে সন্ধ্যা রাতে দুটো মেয়ে কে বাড়ির বাইরে যেতে দিয়েছো ?”
তাঁর গলা যেন বিদ্যুতের মতো ঘরে আছড়ে পড়লো, চারপাশে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে গেল সবার বুকের ভেতর ভয় আর অনুতাপ।
পাশ দিয়ে মেহজাবীন বেগম হতবম্ব, চোখে পানি চিকচিক করছে, হতাশা ভরা গলায় বলে উঠলো,

__” ওরা তো বলে গেলো বাইরে খেতে যাবে , তোর কথা জিজ্ঞাস করায় বলল তুই জানিস।”
তিনি যেন ভেতর থেকে দমে গেছেন ছেলের রাগের আগুনে নিজেকে দোষী ভাবছেন, অথচ সত্যিই তিনি ভেবেছিলেন সবকিছু জায়নের অজান্তে হচ্ছে না।
ঘরের বাতাস জায়ন এর ক্রোধে ভীষণ ভয়ঙ্কর, কেউ নড়ছে না, শ্বাস নেয়ার শব্দও যেন শোনা যাচ্ছে না। এই ছেলে এত রেগে রয়েছে যে কেউ কিছু বলতে গেলেই মুখে যা আসবে তাই শুনিয়ে দেবে সবাই একেবারে স্থির।
অমনি জায়ন এক বাকা হাসি দিয়ে, ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপ মাখিয়ে, আবার হাসিটা দমিয়ে, আগুন ঝরা চোখে গর্জে বলে উঠলো,

__” মা প্লীজ , এক্সকিউজ দেখিও না। তোমরা জানো না আমি ওকে একা ছাড়িনা …… আমাকে একবার কল দিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারতে ? কি পারতে না ? জানো না রাস্তা ঘাটে আজকাল কি হচ্ছে ?”
গলার প্রতিটি শব্দে শোনা যাচ্ছে তাঁর বউকে ও বোনদের নিরাপত্তায় রাখার আদেশ , বউ এর প্রতি ভালোবাসার আড়ালে লুকানো পাগলামি, আর পরিবারের প্রতি অবিশ্বাস।
মেহজাবীন বেগম মাথা নিচু করে আছে, চোখে পানি জমে উঠছে, একফোঁটা শব্দ বের হচ্ছে না তাঁর মুখ থেকে।
প্রান্তিক সাহেব চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু তাঁর কপালের ভাঁজ আর গম্ভীর দৃষ্টি গিন্নীদের দিকে রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে । কারণ ভিতরে ভিতরে সে নিজেও স্বীকার করছে জায়নের কথায় অনেক যুক্তি আছে।
এসবের মাঝেই রূহেনা বেগম ঠোঁট কামড়ে, এক মায়ের মত আক্ষেপ নিয়ে বলে উঠলেন,

__” বাবা ওরা তো বড় হয়েছে ? সব সময় কি তাদের আটকে রাখা যায় ? ওদের ও তো ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকে তাই না ।”
তাঁর গলায় একরাশ কষ্ট মেয়েদের স্বাধীনতা আর ছেলের কঠোর নিয়মের মধ্যে দ্বন্দ্বে তিনি ছিঁড়ে যাচ্ছেন।
রূহেনা বেগম এর কথায় জায়ন মুখ খোলার আগেই ইউভি একেবারে গম্ভীর স্বরে, চোখে ক্ষোভের ঝিলিক নিয়ে বলে উঠল,
__” ওদের সব ইচ্ছা অনিচ্ছা মানা হবে তবে সীমাবদ্ধতার মধ্যে। কিন্তু আজকে যা হয়েছে তা সীমাবদ্ধতার বাইরে এটা যেন দ্বিতীয় বার না হয়।”

তার গলায় ভরপুর দৃঢ়তা, যেন সে পরিবারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে এবং চোখে মুখে স্পষ্ট রাগ যে সে এমন অবহেলা মেনে নেবে না।
এই বলে ইউভি গম্ভীর পায়ে ওখান থেকে স্থান ত্যাগ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো, তাঁর পায়ের শব্দে যেন পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলো।
এদিকে রায়ান ঠোঁট কামড়ে, বুকের ভেতর দুঃখ আর ক্ষোভ জমিয়ে, তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
__” ছেলে কে যেমন শাসন করো , একটু মেয়ে কেও শাসন করা শিখতে তাহলে মেয়ের এতগুলো ডানা তৈরি হতো না ।”

তার গলায় কষ্ট, রাগ, আর একটা বিদ্রোহী তীক্ষ্ণতা যেন বাবাকে আঘাত করেও সত্যিটা শুনিয়ে দিতে চাইল।
এই শুনে তাহসান সাহেব ছেলের দিকে কটমট করে তাকালেন, চোখ রাগে লাল, কিন্তু রায়ান একটুও ভয় না পেয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ফিরেও দেখলো না ,মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, যেন এই লড়াই সে হার মানবে না।
প্রণয় সাহেব তখন আর চুপ থাকতে পারলেন না, জায়নের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে বলে উঠলো,
__” জানিনা ওরা কি করেছে কিন্তু আমি বরদাস্ত করবো না আমার মেয়ে দের উপর চিৎকার চেঁচামেচি।”
কণ্ঠে জ্বলন্ত রাগ আর বাবার স্নেহ তিনি স্পষ্ট করে দিলেন যে তার মেয়েদের উপর অন্যায় আচরণ তিনি সহ্য করবেন না।
প্রণয় সাহেব এর কথায় জায়ন এক গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে, বুকের ভেতর জমে থাকা জ্বালা ফুঁড়ে দিয়ে বলে উঠলো,

__” বললাম না আমার বউ আমি বুঝে নেবো । কেউ কোন কথা বলতে আসলে আমাদের মাঝে , আমি সম্পর্ক দেখব না, যা খুশি শুনিয়ে দেবো ।”
তার গলায় চূড়ান্ত ঘোষণা, যেন সবাইকে সতর্ক করে দিল সে আর কোনো বিরোধ বরদাস্ত করবে না।
একটু থেমে, আবারো জ্বলন্ত দৃষ্টিতে সবার উদ্যেশ্যে বলে উঠলো,
__” আজকের পর থেকে হাজারবার যাচাই করে তারপর যেন বাসার বাইরে পাঠানো হয় ।।”
শব্দগুলো যেন ছুরি হয়ে ঘরে ছড়িয়ে পড়লো সবাই নিস্তব্ধ, সবাই বুঝলো এ শুধু নিয়ম নয়, এক দমবন্ধ করা হুমকিও।

এই বলে জায়ন একরাশ রাগ বুকের ভেতরে গুমরে রেখে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।তার ভারী পদক্ষেপে গোটা বাড়ি যেন কেঁপে উঠলো, পিছনে রয়ে গেল আতঙ্ক, ক্ষোভ, কান্না আর অনিশ্চয়তার দীর্ঘশ্বাস।
এদিকে অনু আর নিজের ঘরে যায় নি, সে সোজা চলে গেছিল তিয়াশার রুমে, মনটা যেন ছটফট করছিল আপুকে না দেখে, ভেতরে অশান্তি কি করছে আপু, কেমন আছে আপু। রুমে ঢুকতেই তার বুক হিম হয়ে গেল বিছানায় বসা তিয়াশা কান্না করছে, হাটুতে মুখ ডুবিয়ে যেন নিজের সমস্ত কষ্ট লুকিয়ে ফেলতে চাইছে, কিন্তু চোখের পানি ফাঁস করে দিচ্ছে সবকিছু। অনু কোমল সুরে, ভয় মেশানো কণ্ঠে ডাক দিল,

__” আপু …..”
তিয়াশা অনুর কন্ঠস্বর শুনে সেদিকে তাকাতেই কেঁপে উঠলো অনু। তার আপুর এ কি মুখের অবস্থা করেছে তার বড় ভাই, মুখ এখনো চার আঙুলের ছাপ, ঠোঁট ফোলা, এতটা ভেজা চোখ অনু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তিয়াশা অনু কে দেখে তড়িঘড়ি করে চোখ মুখ মুছতে লাগল, যেন দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না, যেন ছোট বোনকে আর কষ্ট না দেয়। অনু ধীর পায়ে, কষ্টের ভার নিয়ে তিয়াশার কাছে গিয়ে বসলো। তিয়াশা চোখ মুছতে মুছতে, কাঁপা কন্ঠে, গলায় দমবন্ধ করা কান্না চেপে রেখে বলল,

__” এখানে কেন আসলি বনু, যা গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে।”
অনু কাতর চোখে তার আপুর দিকে তাকিয়ে রইল, বুকের ভেতর ব্যথা জমে যাচ্ছিল, সে আর চেপে রাখতে পারলো না, ভাঙা গলায় বলে উঠল,
__” আপু এ কি অবস্থা করেছে ভাইয়া ?”
তিয়াশা চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারল না, নিজের ভেতরের দুর্বলতা লুকাতে চাইলেও ভালোবাসার কাছে হেরে গেল, চোখের কোণ থেকে একের পর এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো। তবুও সে ছোট বোনকে দোষ দিতে দিল না, অনুর হাত ধরে কষ্ট মেশানো গলায় বলে উঠল,
__” সরি সোনা, আমার জন্য তোকেও অনেক বকা শুনতে হয়েছে। তোর ভাইয়া এরকম পাগলামি করবে আমি বুঝলে কিছুতেই তোদের নিয়ে ওখানে যেতাম না।”

অনু এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে, বুকের ভেতরের সব দুঃখ ছড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
__” আপু তুমি প্লীজ নিজেকে দোষারোপ করোনা। আমরা সবাই এক এক প্ল্যান রেখেছি তুমি ওনাদের শায়েস্তা করার প্ল্যান করেছো, আমি ওখানে যাওয়ার প্ল্যান করেছি, পরি আপু ড্রেসের প্ল্যান করেছে, আরোহী আপু কি করে যাব সেই প্ল্যান করেছে। বৃষ্টি আপু বলেছিল ওদের ইগনোর করতে। আমার তো মনে হচ্ছে আমাদের জন্য তুমি এত কষ্ট পেলে, আমাদের বোঝা উচিত ছিল ভাইয়া জিনিষটা ঠিক ভাবে নেবে না। ভাইয়ার ভালোবাসা দেখতে দেখতে রাগটা ভুলেই গেছিলাম । আপু আজকে তোমার ভাইয়া ও অনেক রেগে গেছে। জানো, আকাশ ভাইয়া তো রেগে বেরিয়েই যাচ্ছিল আরোহী আপু কে রেখে। তারপর সাগর ভাইয়ারা আকাশ ভাইয়া কে বুঝিয়ে আরোহী আপুকে বাসায় ছেড়ে দিতে বলেছে।”

তিয়াশার চোখ ভেজা, গাল ভিজে গেছে, বুকটা কেঁপে উঠছে। সে এক গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে চুপচাপ শুনছিল ছোট বোনের কথা। অনু তখনো চোখে পানি নিয়ে, আপুর কষ্ট দেখে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। সে তিয়াশার গালে হাত দিয়ে আবার বলে উঠলো,
__” আমার তোমাকে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে আপু, খুব ব্যথা করছে বলো ?”
তিয়াশা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে, তবুও সাহসের একটা মুখোশ পরে, কষ্টের ভেতর থেকেও একটু হাসি মুখ করে অনুর হাত শক্ত করে ধরে বলে উঠল,

__” চিন্তা করিস না, যে ব্যথা দিয়েছে সেই ভালোবাসা দিয়ে ঠিক করে দেবে। জানিসই তো, তোর ভাইয়ার মাথায় রাগ চড়ে বসলে পাগল হয়ে যায়, রাগ কমে গেলে নিজেই কষ্ট পাবে। তুই বরং আমার ভাইয়ার রাগ কমা যা।”
অনু মাথা নিচু করে ফেলল, বুকটা ভারী হয়ে এলো, একটু নরম সুরে, ভয় মেশানো গলায় বলল,
__” তোমার ভাইয়া বলেছে কথা বলবে না।”
তিয়াশা নিজের এত ব্যথা, এত ভাঙা মন নিয়ে তবুও হাসল—মুখে কষ্টের রেখা, কিন্তু চোখে স্নেহের আলো। সে শান্ত গলায় বলল,

__” সব বলবে, আমার ভাইয়া থাকতে পারবে না।”
এর মধ্যেই দরজা ঠাস করে খোলা গেল, ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা ভেঙে জায়ন রুমে প্রবেশ করল। তার ভারী পদক্ষেপে অনু আর তিয়াশা দুজনেই কেঁপে উঠলো, ঘরের বাতাস থমকে গেল। তিয়াশার আবার হাত কাপতে শুরু করেছে, বুকের ভেতরে ভয় জমে উঠেছে জানে না এখন আবার কোন রূপ ধারণ করবে তার বর, রাগে ভরা নাকি ভালোবাসায় ডোবা।
জায়ন ধীরে ধীরে একটু এগিয়ে এসে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকিয়ে, গম্ভীর গলায় বলে উঠল,

__” নিজের রুমে যা, এখানে কি? আর নেক্সট টাইম বেশি ওরা দেখলে পা ভেঙে বাসায় রেখে দেবো।”
অনু মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালো, তার বুকের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসছে। বড় ভাইয়ের চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার, তবুও নিজের আপুকে বাঁচাতে শেষ সাহসটুকু জোগাড় করে কাপা কন্ঠে বলে উঠলো,
__” ভা ভাইয়া, ওখানে যাওয়ার প্ল্যান আমার ছিল, আপুর কোন দোষ নেই। প্লীজ আপু কে আর কিছু বলো না।”
এই বলে অনন্যা তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো, বুকের ভেতরে ভয় আর আক্ষেপ মিশে একাকার।
জায়ন ভ্রু কুঁচকে অণুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল, মুখে চাপা ক্ষোভ, চোখে অগ্নি। তারপর হঠাৎ করেই ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সোজা ওয়াশ রুমে চলে গেলো, পিছনে রয়ে গেলো আতঙ্কিত তিয়াশা।

__” আচ্ছা বাবা সরি বলছি তো , আমি বুঝি নাই এতটা খারাপ অবস্থা হবে ।”
আকাশের মুখ টা দুই হাত দিয়ে ধরে আরোহী নিজের মুখ পাউট করে আকাশের রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে, চোখে-মুখে এক অদ্ভুত ভয় আর মায়ার মিশ্রণ। আরোহী দের এপার্টমেন্টের সামনে আকাশের গাড়ির ডিম লাইটে মুহূর্তটা যেন অদ্ভুত রোম্যান্টিক অথচ ভারী হয়ে উঠেছে। এই প্রথম সে আকাশকে এতটা রাগে, এতটা অভিমানী চেহারায় দেখতে পেল, যার প্রতিটা ছাপ যেন তার বুকের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধছে।
আকাশ নীরব, ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই, অথচ চোখে রাগের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তার বুকের ভেতর জমে থাকা দমবন্ধ করা রাগকে যেন শব্দ দিয়ে আর প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আবারো আরোহী একটু ঘ্যান ঘ্যাণ করতে করতে নরম স্বরে ফিসফিস করে উঠলো,

___” এই যে রাঙ্গা মুলো আর রাগ করে না সোনা । আমি কিন্তু কেঁদে দেবো । তোমাদের ও তো দোষ ছিল বলো ?”
আকাশ এবার হালকা বিরক্তির ছাপ মুখে এনে ভারী গলায় বলে উঠলো,
__” সোনা তুমি আমায় শাস্তি দিতে মেনে নিতাম মুখ বুঝে, কিন্তু এসব কেন করতে গেলে? ওই ছেলে গুলো কি ভাবে দেখছিল, তুমি বুঝছো? আমার মনে হচ্ছিল সব কটার চোখ উপড়ে ফেলি। ভাইয়া কি পরিমান রেগে গেছে দেখেছো? বনু কি পরিমান মার খেলো। যদি আমি তখন গিয়ে আটকাতে চাইতাম তাহলে ভাইয়া পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলতো। ”
এই বলে আকাশ মুখ ঘুরিয়ে নিল, চোখে এখনো অভিমান জমে আছে, ঠোঁটে নীরব রাগ, যেন প্রতিটি কথা আরোহীর হৃদয় ভেদ করছে।
আরোহী এবার আর সহ্য করতে পারল না, আবারো আকাশের মুখ দু’হাত দিয়ে টেনে আনলো, তার ঠোঁটে এক চাপা ম্লান হাসি, চোখে জল চিকচিক করছে, গলায় হালকা কাঁপা কাঁপা সুর,

___” আমার ও কষ্ট হচ্ছে, আমার বেবীর জন্য ,, কিন্তু ভাইয়া নিজেই আবার ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেবে তোমাদের। আর তেমন ভালোবাসা যেমন আমি এখন তোমাকে দেবো।”
এই বলেই কোনো কিছু না ভেবে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিল আকাশের ঠোঁটের উপর। মুহূর্তেই আকাশের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো, অবাক বিস্ময়ে থেমে গেলো তার বুকের ভেতরের সমস্ত রাগ। জলপরীর হঠাৎ এই সাহসী পদক্ষেপে আকাশের শরীর জ্বলে উঠলো আগুনে, অথচ সেই আগুনের সঙ্গে মিশে গেল এক অদ্ভুত কাঁপুনি, হাত পা যেন কেঁপে উঠতে লাগল।

আরোহীর চুম্বন যত গভীর হচ্ছিল, ততই আকাশের বুকের ভেতরের রাগ, অভিমান, অভিযোগ সব গলে পানি হতে লাগলো। পৃথিবীর সব রাগ যেন গলে গিয়ে এই এক চুম্বনে থিতু হলো।
আরোহী আকাশের দিকে ধীরে ধীরে আরও এগিয়ে আসছিল, তাদের ঠোঁটের খেলা থামছিল না এক মুহূর্তের জন্যও। আকাশ কাপা হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আরোহীর মেদহীন কোমর।বুকের ভেতর, যেন ভয় পাচ্ছে যদি এক সেকেন্ডের জন্যও ছেড়ে দেয় তবে আজ ও টাস্কি খেয়ে যাবে এত উত্তেজনায় ।
আরোহীর শরীরেও যেন একরাশ বিদ্যুৎ খেলে গেলো, বুক কেঁপে উঠলো ভালোবাসায়, আকাঙ্ক্ষায়।
আকাশ এবার তার সমস্ত বাঁধন ছেড়ে দিয়ে আরোহীর ঠোঁট কামড়ে ধরলো, গলায় রুদ্ধ হাস্কি স্বর বেরিয়ে এলো, শরীর কেঁপে উঠতে উঠতে নিজের কাপা হাতে আরোহীর কোমর জড়িয়ে ধরে সিটে শুইয়ে দিলো, আরোহীর পিঠ গিয়ে ঠেকলো গাড়ির দরজায়।

আকাশ থামলো না এক বিন্দুও চোখে উৎপন্ন হলো কাম*নার নেশা কিন্তু বুক কাপছে, আজ সে যেন তার সমস্ত অভিমান, সমস্ত রাগ গলিয়ে দিচ্ছে এই এক মুহূর্তে। আরোহীর দুই হাত ধরা আছে আকাশের গলায়, সে তার ভালোবাসায় নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিতে চাইছে ।
আকাশ লোভে নিচ্ছে আরোহীর নিচের ঠোঁট, ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে ভারী নিঃশ্বাসে হাস্কি স্বরে বললো,
__” সোনা, এই ড্রেস তোমার জন্য যতবার চাই কিনে দেবো, কিন্তু শর্ত একটাই এটা শুধু আমার সামনে পড়বে। বিকজ ইউ আর লুকিং টু হট, সোনা।”

এই বলে আবারো ঝাঁপিয়ে পড়লো আরোহীর ঠোঁটের উপর। মুহূর্তটা যেন থামিয়ে দিল সময়কে।
একটু পর কাপা হাত নিয়ে যখন আকাশ এগিয়ে গেলো আরোহীর বুকের দিকে, তখন হঠাৎ তার ভেতর এক অদ্ভুত উন্মাদনা জমে উঠলো , শরীর কেঁপে উঠলো আরও তীব্রভাবে , নিঃশ্বাস বন্ধ হতে লাগল।
আকাশ টাস্কি খেয়ে হঠাৎ আরোহীর উপর পড়ে গেলো, সেই চাপা মুহূর্তে আরোহী চোখ পাকিয়ে হালকা রাগ অভিমানে এক গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
__” এরকম চলতে থাকলে আমার আর বাচ্চা-কাচ্চার মুখ দিয়ে আম্মু ডাক শুনতে হবে না। ওহ আল্লাহ।”

জায়ন ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে চুল মুছে শুধু একটা ব্যাগি ট্রাউজার পরে নিল, একবার তিয়াশার দিকে তাকিয়ে দেখলো, বিছানায় আধ শুয়ে আছে, অন্য দিকে ফিরে চোঁখ ভেজা, বুক কাঁপছে, নিঃশ্বাস ঠেকছে। খালি গায়ে কাভার্ডের মেডিসিন কেবিনেট থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা বের করে তিয়াশার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল, যেন একেকটা পদক্ষেপে তার ধৈর্য আর রাগ মিশে যাচ্ছে। তিয়াশা মুখ ঘুরিয়ে আছে, জায়ন দাবির স্বর ছেরে বলল,
__” এদিকে ঘোর।”
তিয়াশা তবুও ঘুরলো না, বারবার চোখে পানি ঝরে, বুকের ভিতর দহন, রাগ আর ভয় মিশে আছে। এবার জায়ন বেডের উপর বসে, ধীরে ধীরে তিয়াশাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,

__” জেদ করবি না এই মুহূর্তে, আমার রাগ এখনো কমেনি, কি করে বসবো জানিনা।”
তিয়াশা ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে জায়নের দিকে, যেন চোখের পানি আর তার ভয় মিশে একাকার হয়ে গেছে। জায়ন মলম বের করে লাগাতে গেলে তিয়াশা হাউ হাউ করে কান্না করতে করতে বলে উঠল,
__” দরকার নেই মলম লাগানোর, পশুর মত মারধর করে এখন মলম কি জন্য লাগাতে হবে। মারো, আরো মারো, যত পারো মারো।”

এই মুহূর্তে ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত ভারী নীরবতা নেমে এলো। তিয়াশার চোখে জল, গলায় কাঁপন, অথচ কণ্ঠে ছোটখাটো বিদ্রূপ, যা জায়নের রাগ আর অনুতাপের মধ্যে এক মিশ্র আনন্দ তৈরি করে। সে চায় না রাগ আরও বাড়ুক, কিন্তু অভ্যাসে তার রাগকে ছাড়া যায় না এটাই তার প্রতিফলন।
জায়ন একটি গভীর নিশ্বাস নিয়ে,গম্ভীর স্বরে বলল,
__” রোদ… জেদ করিস না। মাথা ফেটে যাচ্ছে, আমার চুপচাপ মলম লাগাতে দে।”
তিয়াশা জায়নের বুকে দুই হাত দিয়ে মারতে মারতে, চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলে উঠলো,

__” শুধু পারো ধমকি দিতে, আর নিজের ওই হাতের বাঘের থাবা বসাতে। প্রমিজ করেছিলে, আর কিছু বলবে না, রাগ করবে না। কিন্তু তুমি তো শুধরাবে না। থাকব না আমি তোমার সঙ্গে, তুমি একটা পশু, তোমাকে আমি ডিভো… ”
বলতে পারল না পুরো বাক্য । জায়ন এতক্ষণ তার বাচ্চা বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল শাওয়ার থেকে আসার পর রাগ একটু কমেছে মনে হলেও, তিয়াশার কথায় চোখ আবার রক্তাভ হয়ে গেল, তিয়াশার কথা শেষ করার আগেই জায়ন তিয়াশাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, তার দুই হাত চেপে ধরে, ব্যথা ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়ে আবারো এক রাগের চুম্বন ছড়িয়ে দিয়ে তিয়াশা ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো ,

” আহ ” , এদিকে জায়ন তখনই ঠোঁট আলগা করে ভারী কণ্ঠে বলে উঠলো,
__” নেক্সট টাইম ওই ওয়ার্ডটা উচ্চারণ করার আগে নিজের হাতে আমাকে মৃত্যুর পথ দেখিয়ে দিবি। তুই নিজে না দেখালে আমি খুঁজে নেব। কারণ তোকে ছাড়া আমি এক বিন্দুও নিঃশ্বাস নিতে পারব না। জানি, রেগে গেলে মাথা ঠিক থাকে না। কিন্তু সেই রাগের কারণও তুই থাকিস, যেমন বেঁচে থাকার কারণ তুই, আমার ভালোবাসার কারণ তুই, আমার হাসির কারণও তুই থাকিস। আমার সবটাই তোকে ঘিরে, তাহলে আমার রাগটা ও সহ্য করে নে না জান, তুই ছাড়া অন্য কেউ এগুলো সামলাতে পারবে না।”

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭১

জায়ন এর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে তিয়াশা । জায়ন এর প্রতিটি শব্দে যেন বুক কেঁপে উঠলো , তাকিয়ে আছে তার চোখের দিকে তার সেই পুরুষের দিকে যার রাগ আর ভালোবাসা একসাথে তাকে বন্দি করে রেখেছে, যেন এক খাঁচার মধ্যে। সেই খাঁচা থেকে বেরোলে সে আর নিঃশ্বাস নিতেই পারবে না, কারণ শত ব্যথা দেওয়ার পরও সে এই খাঁচাতেই খুঁজে পায় সব সুখ, সব নিরাপত্তা, সব ভালোবাসা।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here