তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭২ (২)
নীল মণ
চৌধুরী বাড়ির বিশাল লন একেবারে রূপকথার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। চারপাশে ফেয়ারি লাইটে ঝলমল করছে, ছাদের ওপরে ঝুলছে ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি আর গোলাপি-সাদা ফুল দিয়ে আড়ম্বর সাজ। মেহেন্দির জন্য আলাদা করেই ডিজে সেট আপ করা হয়েছে, গানের বেজে উঠছে একের পর এক হিট বলিউড ও আরবী ফিউশন গান, আর নাচে মেতে উঠেছে সবাই। অনু আর আরোহী দু’জন বসেছে স্টেজের মাঝে, সোনালি-সবুজ আউটফিটে দুজনকেই স্বপ্নের মতো লাগছে। তাদের হাতে আর্টিস্ট মেহেন্দির নকশা আঁকছে, পাশ থেকে কাজিনরা মোবাইল ক্যামেরায় ভিডিও করছে, কেউ লাইভ দিচ্ছে। একপাশে খাবারের কাউন্টারে রাখা আছে মকটেল বার, আর ফুড কোর্টে কাবাব, বিরিয়ানি, পাস্তা থেকে শুরু করে সব আধুনিক ফিউশন ফুড।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছোটরা গ্রুপ ডান্সের জন্য প্র্যাকটিস করেছিল, সেটাও শুরু হলো, সবাই হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে। বড়রা হাসছে, কেউ কেউ নিজের ফোনে রিল বানাচ্ছে। পুরো পরিবেশে পুরোনো দিনের কোনো ঢং নেই, বরং চারপাশে ঝলমলে আনন্দ, আধুনিকতা আর হাই ফাই ভাইব।
এদিকে তিয়াশা পড়েছে মহা জ্বালায়। দুপুর থেকে জায়ন একেবারে তার ছায়ার মতো পেছন পেছন ঘুরছে, এক মুহূর্তের জন্যও পিছু ছাড়ছে না। যেন তিয়াশার নিঃশ্বাস ফেলারও অবকাশ নেই। তিয়াশার পরনে সবুজ রঙের ভারী কাজ করা লেহেঙ্গা, হাতে ঝনঝন করছে জায়ন এর আনা সবুজ কাচের চুড়ির সেট, গলায় সেই সঙ্গে মানানসই গয়না, আর চুলগুলো খোলা অবস্থায় পিঠ বেয়ে নেমে এসেছে। বাইরে থেকে দেখলে বিরক্ত মুখে তিয়াশা তাকে উপেক্ষা করছে বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে যেন একটু অভিমান মেশানো মিষ্টি লজ্জা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ড্রয়িং রুম থেকে মেহেন্দির প্লেট হাতে বেরিয়ে স্টেজের দিকে যাচ্ছিল সে, আর সেই একই ভঙ্গিতে জায়ন পিছন থেকে হেঁটে চলেছে। তখনই হঠাৎ কানে এলো প্রান্তিক সাহেবের কণ্ঠস্বর,
__” মেয়ে টা কে এবার একটু একা ছার, ওকেও একটু আনন্দ করতে দে সবার সঙ্গে।”
বাবার কথা শুনে তিয়াশা আচমকা থেমে গেল, লজ্জায় শরীরটাকে গুটিয়ে নিল, মনে হলো গোটা দুনিয়া তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু জায়নের গায়ে এসব কথার বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়লো না। সে যেন নিজের জগৎ নিয়েই ব্যস্ত। তিয়াশা আবারো সামনের দিকে হাঁটতে চাইলে হঠাৎই জায়ন তার হাত ধরে ফেলল। বিরক্ত ভঙ্গিতে বাবার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
__” বাবা আমার বউ আমি বুঝে নেব। তুমি তোমার বউ নিয়ে ভাবো, আমার বউ নিয়ে ভাবার দরকার নেই। আমার এত সুন্দরী বউ আমি এত লোক জনের মধ্যে একা ছেড়ে দিলে চিন্তায় শেষ হয়ে যাব।”
বাবার সামনে ছেলের এমন নির্লজ্জ জবাব শুনেই প্রান্তিক সাহেব রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন। চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গিয়ে গর্জে উঠলেন,
__” অপদার্থ! বাবার সামনে কি কথা বলতে হয় সেটাই জ্ঞ্যান নেই।”
কিন্তু জায়ন আর একটাও কথা বলল না যেন কি বলল তাতে তার কিছু যায় আসে না , স্বাভাবিক মুখ করেই তিয়াশার হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে গেল স্টেজের দিকে। তিয়াশা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পাশে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল,
__” তুমি কি শুরু করেছ বলো তো, এইটা মেয়েদের প্রোগ্রাম। এখান থেকে যাও।”
জায়ন যেন কিছু শুনতেই চাইলো না একটু ঝুঁকে তিয়াশার কানের কাছে ঠান্ডা ফিসফিসে গলায় বলল,
__” তুইও চল আমার সঙ্গে, আমি চলে যাচ্ছি। আমারো এই বাইরে এক সেকেন্ড ও ভালো লাগছে না , চল জান রুমে যাই। ডাক্তার পারমিশন দিয়েছে তো , এখন কোন সমস্যা হবে না ,চল না বউ।”
তিয়াশা এবার সত্যিই চটে গেল, চারপাশে এত লোকজন, তবুও তার বরের মাথায় যেন একেবারেই বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। রাগে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে কটমট করে বলল
__” অসভ্য লোক এত লোকজনের মধ্যে এখন এইসব মাথায় আনছো , যাও এখান থেকে বলে দিচ্ছি।”
কিন্তু জায়ন যেন এসব কিছুই বুঝতে চাইছে না, চোখ মুখে জেদের ছাপ নিয়ে অসহায়ভাবে গলা নামিয়ে বলতে লাগল
__ ” তাহলে আমাদের ওই বাসায় চল, চল না একটু খানি বউ, বেশি সময় নেব না দুই ঘণ্টা দিস তাতেই হবে। এক মাসের বেশি হয়ে গেল একটু বোঝার চেষ্টা কর তার উপর তুই এরকম মার্ডারিয়াস লুক নিয়ে ঘুরছিস কি করে ঠিক থাকি বল, চল না ।”
চারপাশে তখন অনেকের চোখ তাদের দিকে। দূর থেকে বোঝাই যাচ্ছে দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়ার মধ্যে তারা জড়িয়ে আছে। কেউ হেসে তাকাচ্ছে, কেউ আবার অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। তিয়াশা সেই দৃষ্টি অনুভব করেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। ঠোঁট কামড়ে, দাঁত কিড়মিড় করে ধীরে গলায় ফিসফিস
করে বলল,
__” যাবে এখান থেকে তুমি। বেয়াদপ পানার কিন্তু একটা লিমিট থাকে।”
কিন্তু জায়ন একেবারেই নাছোড়বান্ধা হয়ে পড়েছে বউ না নিয়ে যাবেই না তাই এবার করুণ সুরে, একেবারে অনুনয়ের ভঙ্গিতে হাত চেপে ধরে বলল
__” বেয়াদপ পানা কোথায় করতে দিচ্ছিস? সেই দুপুর থেকে বলছি , শুনছিস না । চল না বউ মাএ দুই ঘন্টাই তো চায়ছি।”
তিয়াশা তার বড় বড় চোখ গুলো একটু পাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবতে লাগল এখান থেকে যাওয়াই শ্রেয় নইলে এই লোকের গান বন্ধ হবে না সে আর কোন উত্তর দিল না। কেবল হাতটা জোর করে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা স্টেজে গিয়ে বসল। আর সেই মুহূর্তেই জায়নের চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে গেল রাগে , ভারী নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে রাগ উগরে দিল
__” একটু গেলে কি হত পাষাণ বউ? এখন গেলে অল্পতে ছেড়ে দিতাম , রাতে কোথায় যাবে সোনা?
রাতে একবার পাই তারপর তোমার কি অবস্থা করি দেখবে।”
এরমধ্যেই পেছন থেকে ভেসে এলো মেহজাবীন বেগম এর কন্ঠস্বর, কণ্ঠে বিরক্তি আর হালকা রাগ মিশে আছে, যেন এতক্ষণ ধরে ছেলের কান্ডকারখানায় তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে,
__” এখানে ঘুচ ঘুচ কেন করছিস, তোর ফুপী তোকে ফোন করে হয়রান হয়ে যাচ্ছে, তাই আমায় ফোন করে বলল তোর ফুপীর বাসায় যেতে বলেছে।”
জায়ন প্রথমে মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু থমকালো, ভেতরে ভেতরে কয়েক সেকেন্ড কি যেন ভাবলো ভাবলো, যেন কিছু হিসেব কষছে, তারপর একা একাই একটু মুচকি হেসে নিল তারপর গলা খাকরি দিয়ে বেশ গম্ভীর মুখে উত্তর দিল,
__” ঠিক আছে মা যাচ্ছি, তোমার মেজ আম্মুকে ও তাহলে তারাতারি রুমে পাঠিয়ে দিও আমরা ফ্রেশ হয়ে একটু পরেই বেরোচ্ছি।”
কিন্তু মেহজাবীন বেগম এর কপাল কুঁচকে গেল, তার চোখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল, ঠোঁট শক্ত করে তিনি জবাব দিলেন,
__” তুই একা যা, মেজো আম্মু আবার কি করতে যাবে, ওই বাসায় অত ছেলেদের মধ্যে ও একা মেয়ে গিয়ে কি করবে?”
এই কথা শুনেই জায়নের মাথার ভাঁজ আরও গাঢ় হয়ে উঠল, মুখ শক্ত হয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে বিরক্তি জমে গিয়ে মনে মনে সে গালি দিল, ভাবতে লাগল
__”আমি নিজে কি বউ নিয়ে যেতাম নাকি ওই পালের মধ্যে? না তো আমি যেতাম, বউকে যে কি করতে ডাকছি সে একমাত্র আমিই জানি।”
কিন্তু মা কে সরাসরি তো এসব বলতে পারবে না, তাই দাঁত চেপে ভেতরে ভেতরে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল
__”বিয়ে হলো দুই মাস, বউ কাছে পেলাম দুই দিন বা*লের জিন্দেগী! ধুরর…।”
জায়নের বুকের ভেতরে তখন এক অদ্ভুত ঝড় বইছে, বিরক্তি আর হাহাকার মিশে একাকার, কিন্তু বাইরে থেকে শান্ত থাকার চেষ্টা করেই আবার মুখ তুলল, মাকে জেদী গলায় বলল,
__” আমি ওই বাসায় গেলে, আমার বউ পাহারা দেবে কে?”
মায়ের কানে ছেলের এই কথাটা ঢুকতেই যেন বজ্রাঘাত হলো, চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, মনে হলো এই ছেলে তাকে একদিন হার্ট অ্যাটাক করিয়েই ছাড়বে। মেহজাবীন বেগম এই ছেলে নিয়ে পরেচে এক জ্বালায় , তীব্র রাগে ফেটে পড়লেন,
__” কেনো, আমার বৌমার গায়ে কি হীরা-জহরাত বসানো যে পাহারা দিতে হবে?”
এদিকে জায়ন যেন কোন ঘোরের মধ্যে ডুবে গেল। স্টেজে অনুদের পাশে বসে থাকা নিজের বউয়ের দিকে তাকিয়ে তার ঠোঁটে ধীরে ধীরে একটা নেশামাখা হাসি ফুটে উঠল, চোখে যেন এক ধরনের নরম আলো ঝলমল করছে, তারপর গলা নামিয়ে আবেগ ভরা স্বরে বলতে লাগল,
__” তোমার বৌমার গায়ে হীরা লাগানো থাকবে কেনো? আমার বউ তো নিজেই হীরা। আ হা, কি সুন্দর লাগছে আমার বউকে, কেউ যদি নজর দেয় তাই আমার বউকে আমি পাহারা দেব।”
ছেলের আজব উত্তরে তার কপাল আরও কুঁচকে গেল,জায়নের এই কথায় মেহজাবীন বেগম এর ভ্রু আরও কুঁচকে গেল, মনে মনে ভাবলেন এই ছেলে পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে নাকি? নাকি পুরোপুরি মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? বুকের ভেতরে চিন্তার আগুণ ধপধপ করে জ্বলছে, তাই ঝাঁঝি মেরে ধমক দিয়ে উঠলেন,
__” এই তোর এই নষ্ট মাথা নিয়ে এখান থেকে বিদায় হ, আমার বৌমাকে আমি নিজেই দেখে রাখতে পারব, যা এখান থেকে, এখন তোর ফুফির তোকে দিয়ে কাজ আছে। রাতে ওখানেই থাকতে হবে, তোর বাসায় আসতে হবে না, যা এবার।”
কথাটা শোনামাত্রই জায়ন যেন আকাশ থেকে পড়ল, মুখ হাঁ হয়ে গেল, চোখ বড় বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে, অবিশ্বাস ভরা কণ্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,
__” রাতে আসতে হবে না মানে? কেন, আমি কি ওখানে রাতে সিকিউরিটি গার্ডের ডিউটি করবো? নাকি মিষ্টি থেকে মাছি ওড়াবো? আমি কোথাও থাকতে পারবো না। এখন যাচ্ছি, রাতে চলে আসব আমি।”
ছেলের কথা শুনে মেহজাবীন বেগম ও থামলেন না, চোখ কটমট করে, ঠোঁট শক্ত করে, আরও দৃঢ় স্বরে বললেন,
__” তুমি সিকিউরিটির ডিউটিই করবা। তোমারই তো দুই ভাইয়ের বিয়ে তাই না? তাই বলা যায় না তারাও বউকে দেখার তাড়নায় বিয়ের আগের দিন ব্যালকনি চড়ে হাত-পা না ভেঙে বসে। তাই ওদের পাহারা দেওয়াই তোমার কাজ আজকে। রাতে বাসায় আসলে সব কটার ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেব। চিন্তা নাই, আমার তিন মেয়ের পাহারাদারও আমিই থাকব। এখন বিদায় হ।”
এইবার জায়নের মুখমণ্ডল একেবারে লাল হয়ে গেল, রাগে শরীর কাঁপতে লাগল, হাতের মুঠি শক্ত হয়ে গেল দাঁত চেপে বিরক্তিতে গর্জে উঠল,
__” ভালো ডিউটি পেয়েছো, আমার নানু নিশ্চই মীরজাফরের বংশধর ছিল , তা না হলে ওনার মেয়েও নিজের ছেলের সঙ্গে মীরজাফরগিরি করতেও একবার ভাবে না।”
এই বলে সে দুহাতে মাথার চুল টানতে টানতে একেবারে বিরক্ত ভঙ্গিতে চলে গেল গেটের বাইরে, রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সোজা বেরিয়ে গেল, নিজের রুমে আর ফিরে গেল না। আর এদিকে মেহজাবীন বেগম ছেলের এইসব আজব কথাবার্তা শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, মুখ হাঁ হয়ে রইল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল
__”এই ছেলে সত্যি সত্যি একদিন না একদিন আমায় হার্ট অ্যাটাক করাবে।”
__” সোনা দেখাও দেখাও আমার নাম কোথায় লেখা ? সোনা মনে হচ্ছে এক্ষনি গিয়ে তোমার হাত দুটোয় চুমু খেয়ে আসি ।”
আকাশের কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস, যেন পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ওর আর কোনো চিন্তাই নেই। ভিডিও কলে আরোহীর হাসিমাখা মুখ দেখেই তার চোখে ঝিলিক উঠছে, মনে হচ্ছে দুজনেই যেন আলাদা এক জগতে ডুবে গেছে। আকাশের ঠোঁটের কোণে খেলা করা হাসি তার গভীর ভালোলাগার কথাই বলছিল।
ওদিকে স্ক্রিনে থাকা আরোহীর গাল লাল টুকটুকে হয়ে উঠল, লজ্জায় চোখ নামিয়ে আনা মেয়েটি আস্তে করে বলল,
__”নিজের নাম নিজেই খুঁজে নিও সামনে এসে।”
এই একটুখানি কথায় আকাশের হৃদয় যেন আনন্দে লাফ দিয়ে উঠল। মুহূর্তেই বিছানায় শোয়া থেকে ঝটপট উঠে বসল, চোখে-মুখে একরাশ উচ্ছ্বাস খেলা করছে। সে উৎফুল্ল হয়ে হেসে উঠল, যেন কোনো অমূল্য ধন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে,
__” তাহলে রাতে আসি সোনা ?”
কথাটা শুনেই ভিডিও কলে আরোহীর চোখ হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। ঠোঁটে জমে থাকা লাজুক হাসি মুহূর্তেই চমকে ওঠার ভঙ্গি নিল। যেন তার বুকের ভেতর এক অজানা কাঁপুনি নেমে এল।
এদিকে একই সময়ে ইউভিও যেন ভেসে যাচ্ছে অন্য এক স্রোতে, অনন্যার সঙ্গের মিষ্টি কথোপকথনে। তার কণ্ঠে ছিল এক ধরনের আবেগমাখা কোমলতা,
__” পাখি তোকে দেখার পর আমার চোখ সরাতেই ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে তাকিয়েই থাকি।”
অনন্যা যেন কিছু বলতে যাবে, চোখ নামিয়ে ঠোঁট নড়তে শুরু করেছে ,ঠিক তখনই হঠাৎ ঘরের পরিবেশ কেঁপে উঠল। জোরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল জায়ান,দরজার শব্দে পুরো ঘর মুহূর্তেই থমথমে হয়ে গেল। আকাশ আর ইউভি একসাথে চমকে পেছন ফিরে তাকাল। জায়ানের চোখ তখন লাল হয়ে আছে রাগে, চোয়াল শক্ত, নিঃশ্বাস ভারী। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছিল।
এক মুহূর্তের মধ্যেই সে তাদের দুজনের পেছনে গিয়ে জোরে লাথি মারল। ব্যথায় ইউভি আর আকাশ দুজনেই হাত দিয়ে পেছনে চাপড়ে উঠল, মুখ থেকে বেরোল ব্যথাভরা স্বর আউচ!
এরপর দাঁত কামড়ে, চোখ জ্বলে উঠা ক্রোধ নিয়ে গর্জে উঠল জায়ান,
__” বা*ল তোমাদের পেছনে আমাকে নাইট গার্ড বানিয়ে, নিজেরা রোমান্স মাড়িয়ে বেড়াচ্ছো, আমার রোমান্সে অন্ধকার করে !”
হঠাৎ করেই চারপাশ স্তব্ধ হয়ে গেল। আকাশ আর ইউভি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, যেন শরীর জমে গেছে। ওদিকে ফোনের স্ক্রিনে এখনো ভিডিও কল চলছে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আরোহী, অনন্যা আর পাশে বসা তিয়াশার মুখ।
জায়ানের সেই গর্জন শোনার পরেই তিয়াশার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো একচিলতে খিলখিল হাসি। তার চোখে ছিল দুষ্টুমির ঝিলিক, ঠোঁটে অচেতন আনন্দের খেলা। এই হাসিটাই যেন জায়ানের কানে আগুন ঢেলে দিল। মুহূর্তের মধ্যেই আকাশের ফোনটা হাতে নিয়ে সে তিয়াশার দিকে তাকাল। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে, গলার স্বর নামিয়ে হুমকির মতো বলল,
__” হেসে নেও হেসে নেও সোনা, তোমার ব্যবস্থা তো আমি পরে করব… যাও, এক সপ্তাহর প্যাকিং করো আমাদের দুজনের জন্য।”
তিয়াশা থতমত খেয়ে গেল। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। অজানা আতঙ্ক আর কৌতূহলে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
__” কিসের প্যাকিং ?”
জায়ানের ঠোঁটে বাঁকা এক হাসি ফুটে উঠল, তার চোখে মিশল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। ঠাণ্ডা অথচ দাপুটে স্বরে বলল,
__” জামা কাপড় প্যাকিং সোনা, তোমায় নিয়ে পালাবো বিডি ছেড়ে জান, নইলে আমার যৌবন কালে যৌবনেই ফুলস্টপ লেগে যাবে। আর আমি কিন্তু খুব সিরিয়াস। যাও, প্যাকিং করতে শুরু করো। এদের বিয়ে চুকে গেলেই আমরা উড়ে যাব।”
এই অপ্রত্যাশিত কথার মধ্যে লজ্জায় গলা খাকারি দিল ইউভি। আকাশ মুচকি হেসে ফেলল। ইউভির কাশি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তিয়াশার মুখ লাল হয়ে গেল। সে আর দেরি না করে দ্রুত ভিডিও কল কেটে দিল, মুখ ফিরিয়ে নিল লাজে আর বিব্রততায়।
তিয়াশার হঠাৎ কল কেটে দেওয়া দেখে জায়ানের মুখে অবাক ভাব। ভ্রু উঁচু হয়ে গেল, পরক্ষণেই বুঝে ফেলল কারণ আর এক ঝটকায় ইউভির পেছনে আবারও লাথি বসিয়ে দিল। বিরক্তি মাখা গলায় ফিসফিস করে বলল,,
__” তোমার ওই বা*লের কাশি এখনি দিতে হলো !”
ব্যথায় আবারো “আউচ”করে উঠল ইউভি, তবে ব্যথার ভেতরেও হাসি আটকে রাখতে পারল না। ঠোঁট বাঁকিয়ে মজা করে বলল,
__” তুমি আমার সামনে আমার বোনের সঙ্গে রোমান্স করবা, আর আমি বসে বসে তাই দেখবো বেহায়ার মতো ?”
জায়ান বাকা হাসি দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকাল ইউভির দিকে। তার চোখে ছিল শয়তানি ঝিলিক শান্ত অথচ হুমকির সুরে বলল,
__” তাহলে দেব নাকি চোখ দুটো অন্ধ করে, যাতে দেখতে না হয় ?”
কথাটা শুনেই ইউভির শরীরে হালকা কাঁপুনি বয়ে গেল। চোখে-মুখে থতমত খাওয়ার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। এই দৃশ্য দেখে আকাশ হো হো করে হেসে উঠল, জায়ানও ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। ঘর ভরে গেল এক অদ্ভুত দুষ্টুমির আমেজে।
হাসি-মজার মাঝেই আকাশ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
__” ভাইয়া কোথায় যাচ্ছ তোমরা ?”
জায়ান সোফায় বসে ধীর গতিতে শরীর ছড়িয়ে দিল, যেন দুনিয়ার সব রাগ ঝেড়ে ফেলে শান্তির আসনে বসেছে। মুখে একগাল তৃপ্তির ছাপ রেখে বলল,
__” হানিমুন যাব বউ নিয়ে।”
এই কথা শুনতেই আকাশ মুখে অবুঝ অসহায় ভাব এনে বলল,
__” ভাইয়া, বিয়ে করছি আমরা, হানিমুন যাবে তুমি ?”
ইউভি আর আকাশ একসাথে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল, একসাথে বলতে লাগল,
__” বাহ ভাই কি সুন্দর তাই না, এতদিন যেতে পারনি, এখন আমাদের সামনে তোমার হানিমুন যেতে হবে ?”
জায়ান ততক্ষণে চোখ বন্ধ করে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। গলায় ছিল ক্লান্ত অথচ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি,
__” আরো চারটে টিকিট বানানো আছে, দুই সপ্তাহ আগেই বানিয়ে রেখেছি। আগামীকাল রাতে মালদিভ যেতে চাইলে, প্যাকিং শুরু করতে পারো। সঙ্গে আমাদের বোনদেরও বলতে পারো প্যাকিং করার জন্য।”
এই কথা শুনে মুহূর্তেই ইউভি আর আকাশের চোখে ঝিলিক ফুটে উঠল। দুজনেই যেন স্বপ্নের জগতে পৌঁছে গেল। আনন্দে তাদের ঠোঁটে লেগে গেল প্রশস্ত হাসি, চোখেমুখে উচ্ছ্বাসের আলো। চারপাশ আবার ভরে উঠল হাসি আর মজার অদ্ভুত আবেশে।
ঢাকা গুলশানের চৌধুরী বাড়িতে আজকের সকাল যেন অন্য রকম। ভোরের আলো ফোটার আগেই বাড়ির ভেতর কাজের লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। রান্নাঘরে হাঁড়ি চাপানো হয়েছে, মশলার গন্ধে পুরো নিচতলা ভরে উঠেছে। চারদিকেই ব্যস্ততার ছাপ—কেউ প্লেট গুনছে, কেউ শাড়ি আয়রন করছে, আবার কেউ অতিথিদের রুম গোছাতে ব্যস্ত।
বারান্দার পাশে সাজসজ্জার লোকেরা গোলাপ, গাঁদা আর রজনীগন্ধার মালা একটার পর একটা গেঁথে যাচ্ছে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে ফুলের গন্ধ। ড্রইংরুমে মেয়েরা গোল হয়ে বসে আছে হাতে গাঢ় মেহেদির রঙ মেখে, সকালের চা খেতে খেতেই ফিসফিস করে গল্প করছে, আবার হেসে উঠছে। কারো শাড়ির আঁচল বারবার কাঁধ থেকে সরে যাচ্ছে, কেউ আবার কাঁচের চুড়ির ঝনঝনানি বাজিয়ে মজা করছে। পরিবেশটাতে যেন খুনসুটি আর উচ্ছ্বাস মিশে গেছে।
__” ভাই বিয়ে আমাদের কিন্তু মেহেন্দির রং তোর সবথেকে বেশি কেন?”
আরোহী হঠাৎ খুনসুটি ভরা চোখে তিয়াশার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। কথার ভঙ্গিটাতেই লুকিয়ে ছিল মজা, আবার ছিল একরাশ কৌতূহল।
তিয়াশা সেই প্রশ্ন শুনে নিজের হাতের মেহেদি ভরা তালুর দিকে তাকালো যেখানে আঁকা ছিল আবরার জায়নের নাম। চোখের দৃষ্টিতে ভেসে উঠলো এক অদ্ভুত আবেগ, ঠোঁটের কোণে ফুটলো ম্লান অথচ গভীর এক হাসি। ধীরে ধীরে সে উত্তর দিলো,
__” কারণ আমার মানুষটার ভালোবাসা অনেক গাঢ়, তাই আমার মেহেন্দির রংও গাঢ়।”
এই কথার পর মুহূর্তেই চারপাশটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল, যেন সকালের কোলাহলের মাঝেই একটু আবেগ নেমে এলো। তিয়াশার চোখে সেই নিঃশব্দ ভালোবাসার ঝিলিক সবাই হঠাৎ স্পষ্ট করে দেখতে পেল।
অনু তখন নিজের হাতের মেহেদির নকশায় ডুবে থেকে চোখ তুলে হাসি মিশ্রিত আবেগে বলে উঠলো,
__” ঠিক বলেছো আপু, ভাইয়ার ভালোবাসা তোমার হাতের মেহেন্দির রঙেই মিশে গেছে। তোমার এই গাঢ় রংটা আসলে সেই ভালোবাসারই প্রতিচ্ছবি।”
বৃষ্টি পাশ থেকে উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে যোগ দিলো, চোখে মুখে লাজুক খুশি নিয়ে বলল,
__” তোদের হাতগুলোও দেখ, তোদের মেহেন্দির রংও অনেক গাঢ়। কারণ আমার সব ভাইয়ের ভালোবাসা রঙ দিতে জানে, তাই এই রং এত গভীর হয়েছে।”
বৃষ্টির কণ্ঠে ভেসে এলো মিষ্টি গর্ব, যেন নিজের ভাইদের ভালোবাসা নিয়ে সে একটু বড়াই করলো। কথাটাতে সবাই হেসে উঠলো, আবার হেসে উঠতেই কেউ নিজের তালুর দিকে তাকালো, কেউ আবার লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো।
এই মুহূর্তে হাসি, খুনসুটি, লাজুকতা আর মিষ্টি আবেগ মিলেমিশে এমন এক আবহ তৈরি করলো যে সকালের গুলশান চৌধুরী বাড়ি হয়ে উঠলো আনন্দের এক আলোকিত আসর। সবাই হঠাৎ যেন ডুবে গেল নিজেদের হাতের মেহেদির রঙের গভীরতায় সেই রঙে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা, স্বপ্ন আর জীবনের নতুন শুরুর আভাসে।
অনন্যা আর আরোহীর বিয়ের দিনটা যেন সকাল থেকেই অন্যরকম হয়ে উঠেছিল। দুপুর গড়িয়ে আসতেই বাড়ির ভেতর একের পর এক ব্যস্ততা যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। একদিকে আরোহী আর অনু পার্লার থেকে সেজে সরাসরি কমিউনিটি সেন্টারে যাবে বলে সবার মনোযোগ সেদিকেই ছিল, অন্যদিকে বাড়িতে ডাকা হয়েছিল এক পার্লারের মেয়েকে যাতে বাকি মেয়েদের পার্টি মেকআপ সুন্দরভাবে করে দেওয়া যায়। রঙিন সাজগোজের ভিড়ে কারো ঠোঁটে হাসি, কারো চোখে লাজুক ঝিলিক, আবার কারো মনে মিষ্টি উত্তেজনা সব মিলিয়ে যেন পুরো বাড়ির বাতাসটাই উৎসবের আবেশে ভরে উঠেছিল।
তবে সবার শেষে যে মেয়েটি সাজল, সে হলো তিয়াশা। কালো রঙের শিকুইঞ্জ সারি তার গায়ের গড়নকে যেন অন্যরকম জ্যোতিতে ভরিয়ে তুলেছিল। ম্যাচিং করে পরা বড় পিঠের কালো ব্লাউজ, তার সঙ্গে লাল-মেরুন লিপস্টিক, ছড়ানো সিল্কি চুল, কানের পাশে গুঁজে রাখা টকটকে লাল গোলাপ, গলায় ডায়মন্ডের সরু চোকার আর কানে ঝুলন্ত ডায়মন্ড ইয়াররিংস—সব মিলিয়ে তাকে দেখলে চোখ ফেরানোই দায়। হাতে কালো কাচের চুড়ির ঝনঝনানি যেন সাজটিকে আরও বেমিসাল করে তুলেছিল। পার্লারের মেয়েটি এক ঝলক তাকিয়েই অবাক হয়ে বলে উঠল,
__”আপু, আজ আপনার হাজবেন্ড নির্ঘাত টাস্কি খাইয়া পড়বে।”
তিয়াশা এই কথায় হেসে উঠে জবাব দিল
__” উনি এমনিতেই মাথা ঘোরে আমায় দেখলে ।”
এই কথা শুনতেই ঘরের ভেতর একটা টুকটুক করে খিলখিল হাসির রোল বয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন পার্লারের মেয়েরা কাজ সেরে চলে গেল, তখন তিয়াশা বৃষ্টি আর মারিয়া তিনজন একসঙ্গে নিচে নামল। তিনজনকেই দেখে ড্রইংরুমে বসা সবাই একসঙ্গে প্রশংসায় ফেটে পড়ল,
__”মাশাল্লাহ! তোদের তিনজনকেই আজ অপ্সরা লাগছে।”
এই প্রশংসায় তিনজনের মুখেই লাজুক হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল, তারা খুশিতে চোখ নামিয়ে নিলেও মনে মনে আনন্দটা চেপে রাখতে পারল না। হাসি, আনন্দ আর লাজুক দৃষ্টি মিশে যেন এক অন্যরকম আবহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এর ভেতরেই হঠাৎ ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা,
তিয়াশা যখন কোমর দুলিয়ে ড্রইংরুম পেরিয়ে সবার সামনে দিয়ে হাঁটছিল, তখনই সদর দরজা হঠাৎ ঝড়ের গতিতে কেউ এসে এক মুহূর্তের মধ্যে পরিচিত এক দৃঢ় হাত তাকে কাঁধে তুলে নিল। সবাই হতভম্ব হয়ে গেল, আর তিয়াশার মাথার পাশে গুঁজে রাখা গোলাপগুলো ধীরে ধীরে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল।
পরিবারের লোকজনসহ অতিথিরা সবাই হা করে তাকিয়ে রইল। পরিস্থিতি সামলানোর বদলে মারিয়া আর বৃষ্টি তো মুচকি হেসেই যাচ্ছে, যেন এ দৃশ্য তাদের কাছে নতুন নয়, বরং চেনা এক মজার কাণ্ড। কিন্তু প্রণয় সাহেব আর প্রান্তিক সাহেবের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। প্রান্তিক সাহেব ফিসফিস করে ভাইয়ের কানে বললেন,
__”তোর জামাইরে জন্য আমার আর মান-সম্মান থাকল না।”
প্রণয় সাহেবও মাথা নিচু করে একটা হালকা হেসে উত্তর দিলেন,
__”আর তোমার ছেলের জন্য আমার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে, বড় ভাই।”
দুজনেই একসঙ্গে মাথায় হাত দিয়ে বিব্রতভাবে মুখ নিচু করে বসে রইলেন, যেন এই দৃশ্য তাদের কিছুতেই মানা গেল না।
অন্যদিকে তিয়াশা জয়ন এর কাঁধে কাঁপতে কাঁপতে অস্থির হয়ে নড়াচড়া করতে লাগল, তার বুকের ভেতরটা ভয়ে আর বিব্রতিতে কেঁপে উঠছিল, ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে বিরক্তি আর অস্বস্তির মিশ্রণে ফিসফিস করে উঠল,
__”আরে কি করছ তুমি, সবাই তাকিয়ে আছে, নামাও বলছি।”
তার চোখেমুখে ছিল একসাথে লজ্জা, বরের ভালোবাসা আর একটুখানি দুষ্টুমি।
কিন্তু জয়ন যেন ওসব কিছুই শুনল না, কোনো উত্তর না দিয়ে হঠাৎ তাকে শক্ত করে বুকে আগলে ধরে সোজা নিজেদের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর দু’হাতের মধ্যে তাকে বন্দী করে বড় বড় চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে, কাঁপা স্বরে বলল,
__”তুই কি পাগল হয়েছিস জান! এরকম ভাবে সবার সামনে যাবি? আমি হার্ট অ্যাটাকে মরে যাব।”
তিয়াশা এবার বুঝতে পারল, আসল সমস্যা সাজগোজের নয় বরং এই মানুষটা তাকে এত অসহায়ভাবে ভালোবাসে যে তাকে নিয়ে কারও চোখে সামান্য অন্যরকম দৃষ্টি পড়াটাও সে সহ্য করতে পারে না। তাই নিজের ভেতরের সব বিরক্তি গলিয়ে দিয়ে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিল, জয়ন এর গলায় হাত জড়িয়ে আলতো করে মাথা তার কাঁধে ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে স্বর নরম করে বলল,
__”আজকে অন্তত সাজতে দাও, আমার ভাইদের বিয়ে তো।”
কিন্তু তিয়াশার সাজে যে অপরূপ সৌন্দর্য ফুটে উঠেছিল, তাতে জয়ন যেন আরও পাগল হয়ে উঠল। তার দৃষ্টি তিয়াশার উপর এমনভাবে আটকে গেল যেন চারপাশে আর কিছুই নেই। অস্থির নিশ্বাসে চোখ ভরে তাকিয়ে মুগ্ধ স্বরে হেসে বলল,
__”না, এই রিস্ক আমি একদমই নিতে পারব না। খুব শখ না নিজের হওয়ার গ্লাস কোমর সবাইকে দেখানোর? ঠিক আছে, ভাইয়ার বিয়ে দেখা বাদ দে, আমাকে এখন তোর হওয়ার গ্লাস কোমর দুলিয়ে দেখা।”
তার কণ্ঠে ছিল ঈর্ষা, অধিকারবোধ আর গভীর মোহের এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
তিয়াশা বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকালো, ঠোঁটে জমল বিরক্তির ছায়া, মনে হলো কিছু একটা রাগ করে বলে ফেলবে, কিন্তু তার আগেই জয়ন হঠাৎ তার কাপড়ের ফাঁকে উন্মুক্ত বাঁকানো কোমর দুহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে টেনে কাছে নিল। চোখেমুখ লাল হয়ে উঠল, আর হস্কি স্বরে, গলায় মুখ গুঁজে ঠোঁট দিয়ে ভেজাতে ভেজাতে কেঁপে ওঠা ঠোঁটে বলল,
__”সব প্যাকিং তো জান?”
তার কণ্ঠে ছিল কৌতুকের আড়ালে জ্বলন্ত কামনা।
তিয়াশা তার ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল, বুকের ভেতর কেমন যেন কেঁপে গেল, চোখ বুজে সারা শরীর নিস্তব্ধ করে শুধু মৃদু স্বরে ফিসফিস করে উত্তর দিল
__”হুমম… বর।,”
জয়ন তখন আরও অস্থির হয়ে তার উদরে আঙুল ঘুরিয়ে খেলতে লাগল, সেই ছোঁয়ায় তিয়াশার শরীর আরও থরথর করে কেঁপে উঠল। জায়ন এর লালচে চোখে একধরনের নেশা ভর করল, আর সেই নেশামাখা সুরে, কাঁপা নিশ্বাসে গলা নামিয়ে বলল,
__”কিন্তু আমার এখনই চাই।”
তার কণ্ঠে তখন আকুলতা, অধিকার আর অবদমনহীন কামনার ঝড়।
ঠিক তখনই বাইরে থেকে এক জোর নক ভেসে এল। জয়ন বিরক্তিতে চোখ শক্ত করে বন্ধ করে এক লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাধা এসে তার সুখ কেড়ে নিচ্ছে। দাঁত চেপে বিরক্তি আর রাগে গলা চড়িয়ে বলে উঠল,
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭২
__”হুদাই কপাল আমার! বউরে নিয়ে একটু রোমান্স করতে গেলেই সবার কুচো কিরমিতে কামড়াতে লাগে। ধুর র বা*!”
তার কণ্ঠে তখন ছিল অস্থির ঝাল, বিরক্তি আর ভাঙা মজার সুর, যেন নিজের অসহায় ভালোবাসাকেই অভিশাপ দিচ্ছে।
