তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ১৪

তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ১৪
নওরিন মুনতাহা হিয়া

_ রাত প্রায় সাড়ে দশটা। বিয়ে বাড়ির সকল কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আদ্রিয়ান তার রুমে বসে ছিল, তার ঘুম আসছে না। ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে। গরম গরম এক কাপ কফি ছাড়া, মাথা ব্যাথা আর ক্লান্তি কিছুই দূর হবে না।
আদ্রিয়ান তার রুম থেকে বের হয়, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। বাড়ির ড্রয়িং রুম জুড়ে এখন পিনপিন নীরবতা, সকল আত্মীয় স্বজন ভীষণ ক্লান্ত। যার জন্য প্রতৈকে রুমে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, শুধু কয়েকজন কাজের লোক ছাড়া অন্য কারো উপস্থিতি নাই। আদ্রিয়ান রান্না ঘরে যায়, উপস্থিত একজন কাজের মহিলাকে বলে __

“- আমার মাথা ভীষণ ব্যাথা করছে, এক কাপ কফি বানিয়ে দাও __.
“- ওকে স্যার। স্যার আপনি কি কফি এখানে খাবেন?
“- না আমার রুমে পাঠিয়ে দিও __.
“- ওকে স্যার __.

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদ্রিয়ান আর কথা বাড়ায় না, বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যায়। তবে আদ্রিয়ান তার রুমে না গিয়ে, ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ায়। রুমে যেতে ইচ্ছা করছে না তার, আর ঘুম ও আসছে না এখন। অন্যদিকে আবিহার রুমের, দরজার বাহিরে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে মেঘ। তার শরীর বড় চাদর দিয়ে মোড়ানো, চোখ – মুখ ছাড়া শরীরের অন্য অংশ দেখা যাচ্ছে না। মেঘের পোশাক আর তার উঁকি মারা দেখে, যেকোন মানুষ তাকে চোর মনে করবে।

আদ্রিয়ান যখন ছাদের সিঁড়ি দিয়ে, উপরে উঠতে যাবে তখন হঠাৎ তার চোখ যায় মেঘের উপর। দূর হতে, মেঘের মুখ দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া মেঘ পিছনের থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার পড়নের সাদা চাদর। রাতের বেলা অন্ধকারে, এমন চাদর গায়ে দিয়ে আবিহার রুমের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি কে দিচ্ছে? আদ্রিয়ানের সন্দেহ হয়। কোথাও চোর নয় তো? চুরি করার জন্য রুমের, বাহিরে এমন করে দাঁড়িয়ে আছে?

কিন্তু আমেরিকা এতো বড়ো বিলাসবহুল রিসোর্টে, চুরি করার সাহস কে দেখাবে? তবুও আদ্রিয়ান মনের সন্দেহ, দূর করার জন্য ধীর পায়ে হেঁটে যায় সেই দিকে। আজ আবিহা আর কারানের বাসর পর, বিয়ের পর আজ প্রথম তারা এক রুমে থাকবে। কারান এখন ও রুমে আসে নি, সে বন্ধুদের সাথে নিচে কথা বলছে।
আবিহার রুমের ভিতরে বসে আছে, সকল কাজনিরা। সকালে করা দুষ্ট পরিকল্পনা, অনুসারে তারা কাজ করছে। আর মেঘ দরজার বাহিরে পাহাড়া দিচ্ছে, কখন কারান আসবে।

আদ্রিয়ান ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে, মেঘের পিছনে দাঁড়ায়। মেঘ আদ্রিয়ানের উপস্থিতি টের পায় না, সে যখন পিছনে ঘুরে কারান এসেছে কি না দেখতে যাবে৷ তখন হঠাৎ করে ধাক্কা খায়, আদ্রিয়ানের বলিষ্ঠ বুকের সাথে। মেঘ মাথায় কিছুটা ব্যাথা পায়, সে মাথায় ব্যাথা পাওয়া স্থানে হাত দিয়ে। মেঘ তার মাথা একটু উপরে তুলে, সামনে থাকা মানুষটার মুখের দিকে তাকায়।

মেঘের থেকে অল্প দুরত্বে, গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান। মেঘ আদ্রিয়ানকে দেখার, সাথে সাথেই তার থেকে দূরে সরে যায়। কিন্তু আদ্রিয়ান মেঘকে, দূরে যাওয়ার আগেই। মেঘের হাত শক্ত করে ধরে ফেলে, আদ্রিয়ান বলে __

“- মেঘ তুমি এতো রাতে এখানে কি করছ? তাও আবার এমন চাদর মুড়ি দিয়ে। আর চোরের মত, এমন ঘরের ভিতর উঁকি দিচ্ছো কেনো?

আদ্রিয়ানের কথার কি উত্তর দিবে এখন মেঘ? যদি মেঘ তার সয়তানি পরিকল্পনার কথা, আদ্রিয়ানকে বলে। তবে নিশ্চয়ই কাজিনদের মতো, তাকে ও রিসোর্টের বাহিরে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে। সাথে উঠবস ও করাবে। না, না, মেঘ এই শীতের রাতে, কান ধরে দাঁড়িয়ে উঠবস করতে পারবে না। আর রিসোর্টে এখন শত শত মানুষ রয়েছে, যদি কেউ মেঘকে উঠবস করতে দেখে নেয়। তবে তার মান সম্মান, সব শেষ হয়ে যাবে।
মেঘকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, আদ্রিয়ান ধমকের সুরে বলে উঠে __

“- কি হলো মেঘ কথা বলছ না কেনো? তুমি এতো রাতে এখানে কি করছ?
আদ্রিয়ানের থমক শুনে, মেঘ থতমত খেয়ে যায়। সে দ্রুত তার মনের মধ্যে, মিথ্যা অযুহাত সাজায়। এরপর সামান্য ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠে __
“- আদ্রিয়ান স্যার আমি, আসলে আবিহার সাথে দেখা করতে এসেছি ___.

“- আবিহা তো রুমে আছে, রুমের ভিতরে না গিয়ে। বাহিরে এমন চোরের মতো উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছ কেনো?
“- চোরের মত উঁকি দিব কেনো? আসলে আজকে তো আবিহা আর কারান ভাইয়ের বাসর রাত। তাই একটু দেখার চেষ্টা করছিলাম __.
“- পড়াশোনা বাদ দিয়ে, অন্যর বাসর দেখার চেষ্টা করছিলে তুমি মেঘ? পরশু দিন থেকে তোমার মেডিক্যালের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, এখন যদি পড়াশোনা না করো। তবে সিলেবাস কি করে শেষ করবে? ডক্টর হওয়া কি এতো সহজ? এইসব সয়তানি বাদ দিয়ে, রুমে গিয়ে পড়াশোনা করো৷ যাও রুমে __.

হঠাৎ রুমের মধ্যে, আদ্রিয়ানের উপস্থিতি দেখে। কাজিনরা সকলে ভয় পেয়ে যায়, আদ্রিয়ানকে প্রতৈকে ভয় পায়। কাজিনরা ভয়ে থতমত খেয়ে বলে __
“- আদ্রিয়ান ভাইয়া তুমি? মেঘ তুই আদ্রিয়ান ভাইকে কেনো নিয়ে এসেছিস?
“- আরে আর কোনো উপায় ছিল না আমার , এখন সকলে তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়৷ কারান ভাই আসছে __.
মেঘের কথা শুনে সকল কাজিনরা, দ্রত লুকিয়ে পড়ে। মেঘ আদ্রিয়ানের হাত ধরে, তাকে দেয়ালের সাথে ঝুলন্ত পর্দার আড়ালে নিয়ে যায়। আদ্রিয়ান মেঘের হাতের বন্ধন থেকে, তার হাত ছাড়িয়ে নেয়। এরপর রাগী কণ্ঠে বলে উঠে __

“- মেঘ কি করছ তুমি এইসব? আর পর্দার আড়ালে লুকিয়ে কি করবে তুমি?
আদ্রিয়ানের রাগী কণ্ঠ শুনে, মেঘ বলে __
“- আদ্রিয়ান স্যার বকা পরে দিয়েন। এখন একটু চুপ করে থাকেন, না হলে আমার সকল পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যাবে __.
“- পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যাবে মানে? কিসের পরিকল্পনা?
মেঘ আদ্রিয়ানকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই দরজা খুলার শব্দ হয়। মেঘ বুঝতে পারে, নিশ্চয়ই কারান এসে পড়েছে৷ আদ্রিয়ান যদি এখন কোনো কথা বলে, তবে সব শেষ। মেঘ তাই দ্রুত, আদ্রিয়ানের মুখ চেপে ধরে। মেঘের এমন কাণ্ডে আদ্রিয়ান অবাক হয়ে যায়৷
পুষ্প সজ্জিত বিছানায় বসে আছে আবিহা, মাথায় তার ঘোমটা দেওয়া। ঘোমটার আড়ালে ঢাকা পড়েছে, লাজুক রাঙা রূপবতী নতুন বউ। তার মনকে শত ভয়, আর সংকোচ ঘিরে রেখেছে। ভয়ে তার সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেছে, হাত পায়ে মৃদু কাঁপন ধরেছে। জীবনে প্রথমবার কোনো, পুরুষের সাথে সে এক রুমে থাকবে। যদিও এই পুরুষ তার জন্য বৈধ, তার স্বামী। তবুও অষ্টাদশী কিশোরীর ন্যায়, তার মন জুড়ে অজানা ভয় কাজ করছে __.

কারান রুমে এসে দেখে, বিছানা জুড়ে বসে আছে আবিহা৷ কারান তার উপস্থিতি বুঝতে, শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজায় শব্দ শুনে, আবিহার শরীর মৃদু কেঁপে উঠে। তার সমস্ত শরীর জুড়ে, শিহরণ বয়ে যায়। কারান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, বিছানার কাছে। এরপর বিছানায় এসে, আবিহার কাছে বসে যায়। কারান নিজে ও কিছুটা, নার্ভাস ফিল করছে। কারান আবিহার কাছে গিয়ে, ধীরে ধীরে ওর ঘোমটা সরিয়ে দেয়। এরপর ওর থুতনির ওর আলতো করে ধরে, তার মুখ উঁচু করে করে বলে উঠে ___

“- মাশাআল্লাহ __.
আবিহা আর কারানের রোমান্টিক দৃশ্য, খাটের নিচ থেকে পর্দার আড়ালে, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে যাচ্ছে সকল কাজিনরা। তারা কুটকুটি হাসছে। অন্যদিকে মেঘ পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে, তার সাথে রয়েছে আদ্রিয়ান। মেঘের আঙ্গুল, আদ্রিয়ানের ঠোঁটে অবস্থান করছে। বাহিরে জানালা দিয়ে, মৃদু বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আদ্রিয়ানের ঠোঁটে মেঘের আঙ্গুলের ছোঁয়া লাগছে, মেঘ আর আদ্রিয়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখে।

আদ্রিয়ান সামান্য ঢুক গিলে, এই মেয়েটা তার কাছে আসলে সে এলেমেলো হয়ে যায়। মেঘ আদ্রিয়ানের চোখের দিকে, বেশিসময় তাকিয়ে থাকতে পারে না। খুব দ্রুত তার চোখ সরিয়ে নেয়, তার আঙ্গুল ও ঠোঁট থেকে নিচে নামিয়ে নেয়। আদ্রিয়ান ও কিছুটা স্বাভাবিক হয়। মেঘ আদ্রিয়ানের দিক থেকে ঘুরে, সামনে আবিহা আর কারানের বাসর ঘরের দিকে তাকায়।
‎কারান আবিহার থুতনি তুলে, তখন মুখটা স্পষ্ট করে দেখতে যাবে। তখন মেঘ দূর থেকে, আবিহাকে ইশারা দেয়। আবিহা কান্না শুরু করে দেয়, হঠাৎ করে আবিহার কান্না শুনে। কারান অবাক হয়ে বলে __

“- কি হয়েছে আবিহা? তুমি কান্না করছ কেনো?
“- কারান আমি তোমার সাথে সংসার করতে পারব না। আমি আকাশকে ভালোবাসি, তার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই __.
আবিহার মুখে আকাশ নাম শুনে, কারান অবাক হয়ে বলে __
“- এই আকাশ কে? আর তুমি ওকে ভালোবাসে মানে?
“- আকাশ আমার প্রেমিক হয় কারান?
“- তবে আমি কে?
“- তুমি আমার স্বামী হও। কিন্তু আমি আকাশকে ভালোবাসি, ওকে ছাড়া বাঁচব না। আকাশ তুমি কোথায়?

আবিহার এমন কথা শুনে, কারানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এই বাসর রাত নিয়ে, সে কতো সপ্ন দেখেছিল। আর এখন তার বউ অন্য একজনকে ভালোবাসে, কারানের ইচ্ছা করছে কচু গাছের সাথে ফাঁস টাঙিয়ে মারা যেতে। অন্যদিকে কারানের এমন গো – বেচারা মুখ দেখে, মেঘ সহ সকল কাজিনরা হাসতে হাসতে শেষ।

আবিহার মুখে আকাশ নাম শুনে, আদ্রিয়ান প্রথমে অবাক হয়। আবিহা অন্য একজনকে ভালোবাসে? কথাটা বিশ্বাস হয় না তার। পরে যখন মেঘের সয়তানি হাসি দেখে, তখন বুঝতে পারে নিশ্চয়ই এইসব এদের কাজ। তবে আদ্রিয়ানের কাছে, বিষয়টা খারাপ লাগে না। কারান বিয়ে করার জন্য, খুব পাগলামি করছিল। ওর একটু শিক্ষা হওয়া উচিত। আদ্রিয়ান ও পর্দার ফাঁক দিয়ে, কারান আর আবিহার কাণ্ড দেখতে থাকে। সত্যি কারানকে দেখে, এখন ভীষণ ফানি লাগছে৷ বেচারা।
আবিহা আরো বলে, যে সে আকাশকে অনেক ভালোবাসে। তার সাথে সংসার করতে চাই, কারানকে অনুরোধ করে আকাশের কাছে তাকে দিয়ে আসকে। কারান বেচারা, আবিহার কথা শুনে প্রায় কান্না করে দেওয়ার মতো অবস্থা।
রিসোর্টের বাহিরে গাড়ি থেকে নামে জিয়া। সে আজ বিয়ের অনুষ্ঠানে আসে নি, তার মূল কারণ সে আদ্রিয়ানের উপর রাগ করছে। জিয়ার গালে যে, সাতটা থাপ্পড় পড়েছে৷ তা সে ভুলে যায় নি, জিয়া তার প্রতিশোধ নিবে। অবশ্যই নিবে। আদ্রিয়ান শুধু তার, জেদ হোক বা ভালোবাসা আদ্রিয়ানকে তার চাই।

তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ১৩

কিন্তু আদ্রিয়ানকে সে জোর করে, নিজের করতে পারবে না। তার জন্য আগে, আদ্রিয়ানের কাছে কালকের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে৷ এরপর ধীরে ধীরে আদ্রিয়ানের কাছে একটু একটু করে যেতে হবে, তাকে ভালোবাসার মায়ায় জড়াতে হবে। জিয়া আদ্রিয়ানাকে এমন ভাবে, তার ভালোবাসার মায়ায় জড়াবে। আদ্রিয়ান চাইলে ও সেখান থেকে বের হতে পারে না, অসম্ভব।

তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ১৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here