তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১১
অহনা আক্তার
সরমিলা বেগম আজকে চলে গেছেন। দু’দিন যেতেই শুনতে পারেন ওনার বড় ছেলে গুরুতর অসুস্থ। বড় ছেলের অসুস্থতার কথা শুনেই পা’গল হয়ে গেছেন সরমিলা বেগম। মেয়ের বাড়িতে কয়েকদিন থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসলেও থাকতে পারেননি। যাওয়ার আগে সকলকে বারবার বলে গেছেন তারা যেন ওনাদের বাড়িতে যায়। বিশেষ করে জহির কে ভালোমতো বলে গেছেন সে যেনো সবাইকে নিয়ে আগে ভাগেই তার শ্বশুরের মৃত্যু বার্ষিকিতে চলে আসে। জহির শাশুড়ীর মুখের ওপর না বলতে পারেন নি।
মাঝরাত করে বাসায় ফিরেছে ফারিশ। দু’দিন ধরে একটু বেশি দেড়ি করেই বাড়ি ফিরছে সে। বাবার ইন্ডাস্ট্রিরও হালকা পাতলা দেখাশুনা, খোঁজ খবর রাখতে হয় তাকে। যার জন্য দিনের বেশিভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকে ফারিশ। অবশ্য পুরো ইন্ডাস্ট্রির দেখভাল, হিসাব নিকাশের সব কাজ তার বাবা আর মেনাজারই করেন। তবু্ও বাবার প্যানপ্যানানি তে তাকেও একটু দেখতে হয়। ফারিশ ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল মুসকান তার জন্য খাবার নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। এখন প্রতিদিনই মুসকান এটা করে। ফারিশ না আসলে তার জন্য খাবার সাজিয়ে বসে থাকে। কিন্তু ফারিশ ইদানীং মুসকানকে খুব ইগনোর করছে। তার সাথে ঠিক মতো কথা বলছে না। মুসকান আগ বাড়িয়ে বলতে আসলেও এড়িয়ে চলছে। বরাবরের মতো আজও ফারিশ মুসকান কে ইগনোর করে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মুসকান পিছু ডাকে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— খাবেন না?
ফারিশ পাত্তা না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠতে নিলে মুসকান আবার বলে,
— আমি কিন্তু তিনঘণ্টা যাবৎ আপনার জন্য এখানে বসে আছি..
ফারিশ তবু্ও না দাঁড়িয়ে ওঠে চলে যেতে নিলে মুসকান মায়াভরা কণ্ঠে বলে,
— আমি কিন্তু এখনো খাইনি।
ফারিশ এবার থেমে গেল উল্টো ঘুরে ধুপধাপ পায়ে এসে চেয়ারে বসে পড়ল। মুসকান চোখের পানি মুছে উৎফুল্ল হয়ে দ্রুত খাবার বেড়ে দিতে লাগল। আর এই পুরো ঘটনাটাই তাজমহল আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে দেখে মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল,
‘ তাদের মধ্যে কি মানঅভিমান চলছে জানিনা আল্লাহ।তুমি এই দুটোকে সবসময় এভাবেই একসাথে রেখো।’
ফারিশ ঘাড়ে হাত দিয়ে সোফায় বসে আছে। দু’দিন ধরে সোফায় শুয়ে তার ঘাড় প্রচন্ড ব্যাথা হয়ে গেছে। অভ্যাস না থাকায় ঘুমও হয়নি। মুসকান ফারিশকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ধীর পায়ে হেটে তার কাছে আসে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে,
— ঘাড় কি খুব ব্যাথা করছে? আপনি বিছানায় এসে শুননা। আমি দেখেছি আপনি সোফায় একদিনও ঠিক ভাবে ঘুমাতে পারেননি।
ফারিশ কথা না বলে সটান হয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল। চোখের উপর উল্টো করে হাত রেখে চোখ বুঝে রইল।
মুসকান আবেগী স্বরে বলল,
— কেন এমন করছেন? বলছিত আমার ভুল হয়ে গেছে? আর কতোবার মাফ চাইবো আপনার কাছে?কেন এভাবে রেগে আছেন আমার উপর?
ফারিশ চোখ বুঝে থেকেই গম্ভীর স্বর প্রয়োগ করল,
— আমি তোমার উপর রেগে নেই মুসকান। তোমার ভালোর জন্যই তোমার সাথে এক বিছানায় থাকতে চাইছি না। যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো। রাত হয়েছে অনেক।
— রেগে না থাকলে আমাকে এভাবে ইগনোর কেন করছেন আপনি? বিছানায় আসুন। আমি আপনার ঘাড়ে মালিশ করে দিচ্ছি দেখবেন একটু ভালো লাগবে।
ফারিশ একই ভঙ্গিতে থেকেই বলল,
— প্রয়োজন নেই।
মুসকানের চোখ দু’টো এবার ভিজে উঠলো। ধরা গলায় বলল,
— আপনি আমি থাকি বলেইতো বিছানায় শুতে চাইছেন না তাইনা। আচ্ছা আমি কালকে চলে যাব। দাদুকে সকালেই ফোন দিব আমাকে নিয়ে যেতে। আপনার ঘর বিছানা সব আপনাকে দিয়ে যাব। তখন থাইকেন শান্তি মতোন।
ফারিশ রেগে উঠে বসল। মুসকানকে এক রাম ধমক দিয়ে বলল,
— এই মেয়ে বেশ পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছো না? আগেতো মুখ দিয়ে শব্দই বের হতো না। আর এখন খই ফুটেছে! তোমাকে একবারও বলেছি আমি, তুমি এই রুমে থাকলে আমার কোনো অসুবিধা হয়? বলো বলেছি ??
মুসকান দ্রত দুই দিকে মাথা নাড়ালো।
— তাহলে এত পাকনামি করো কেন? বড় হয়ে গেছো খুব। নাক টিপলে দুধ বের হবে আর এখনি আমাকে চলে যাওয়ার হুমকি দাও! ঠা’স করে দু গালে চারটা লাগিয়ে দিব বি’য়াদব মেয়ে কোথাকার !! চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো! যাওয়ার কথা যেন তোমার মুখে আর না শুনি আমি !!
মুসকান বার দুয়েক ঢুক গিলল। ভয়ে তার কলিজা কাঁপছে। এমন ধমক সে বাপের জন্মেও খায় নি। ভয়ে ডানবাম না দেখেই বিছানার দিকে ছুটে গিয়েছে। ফারিশ সোফায় শুয়ে থেকেও মুসকানের ফুপানোর আওয়াজ শুনতে পারছে। সে দম করে ওঠে খাটে গিয়ে শুলো। মুসকানকেও টেনে বুকের উপর ফেলে তাকে টাইট করে জড়িয়ে ধরলো। মুসকানের বুক ধুকপুক করছে। হঠাৎ কি হলো তার এখনো বোধগম্য হচ্ছে না। যখন বুঝতে পারলো তখন মুচকি হেসে ফারিশের কোমর জড়িয়ে ধরে চোখ বুঝে নিল।
মুসকানের এভাবে নিজে থেকে জড়িয়ে ধরায় ফারিশের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।এই মেয়ে শান্তি দিবে না তাকে। ঠিক মতো রাগও করতে দিবে না। রাগ আসেও না এই মেয়েটার উপর। কি এক জ্বালা…
মধ্য দুপুরে হঠাৎই ফারিশদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন এরশাদ তালুকদার। এসেই আগে চড়া গলায় মুসকান কে ডাকতে লাগলেন। ওনার সাথে এসেছে রাতুল। সেতো এসে থেকে হা করে কেবল ফারিশদের বাড়িটিই দেখতে লাগলো। প্রথমবার বাড়িতে শশুরের উপস্থিতি দেখে তাজমহলের অবস্থা পা’গলপ্রায়। সে দিকশূন্য হয়ে পরেছে। কোনটা রেখে কোনটা করবে দিশা খোঁজে পাচ্ছে না। এই শশুরকে বসতে বলছে, এই খুশিতে স্বামীকে ফোন করছে, এই আবার নাস্তা পানির ব্যবস্থা করতে রান্নাঘরে ছুটছে। মুসকান বারান্দায় বসে ফাইজার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিল। দু’দিন বাদেই ফাইজার টেস্ট পরীক্ষা। যার জন্য এখন থেকেই তেল তুল দিয়ে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফাইজা সাইন্সের স্টুডেন্ট বলে তার মাথাটা খাটাতেও হয় বেশি। সারাক্ষণ পড়ায় ডুবে থাকে মেয়েটা। ডক্টর হওয়ার চেষ্টা কিনা। লেখাপড়ায়ও খুব ভালো ফাইজা। মুসকানের থেকেও ভালো। মুসকান কমার্স নিয়ে পড়ছে। সেও পড়ালেখায় অনেকটা এগিয়ে। কিন্তু তার মনে হয় ফাইজা তার থেকেও ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।
দাদুর গলা শুনে ছুটে রুম থেকে বের হলো মুসকান। নিচে এরশাদ তালুকদারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে এক প্রকার দৌড়ে এসে উনাকে কে জাপটে ধরল। তার দু’চোখ জুড়ে পানি চিকচিক করছে। এরশাদ তালুকদার নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
— কেমন আছে আমার গিন্নি?
মুসকান এবার ফুপিয়ে কেঁদে দিল। নাক ফুলিয়ে বলল,
— গিন্নিকে মনে আছে বুঝি তোমার?
এরশাদ তালুকদার গাল ভরে হাসেন। রসিক স্বরে বলেন,
— আমার গিন্নিত দেখছি মহা অভিমান করেছে। ব্যপার না আমি আজ সমস্ত অভিমান ভেঙে গিন্নিকে নিয়ে যেতে এসেছি।
মুসকানের চোখ খুশিতে চকচক করে ওঠে। ফাইজা এসে পাশে দাঁড়িয়ে তার দাদুকে সালাম দেয়। ফাইজার সাথে এরশাদ তালুকদারের কখনো তেমন কথা হয়নি বলে সে একটু সংকোচ বোধ করছে। মুসকানের মতো ফ্রী হতে পারছে না। এরশাদ তালুকদার হেসে ফাইজার সালামের উত্তর নিয়ে তাকেও অন্যপাশ থেকে মুসকানের মতো নিজের বুকে জড়িয়ে নেন। তাজমহল বলেন,
— আব্বাজান আপনি বসুন না। কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছেন।
এরশাদ তালুকদার বসে। তাজমহলের উদ্দেশ্যে বলে,
— জহির কে আসতে বলো। আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। বিকেলের মধ্যেই রওনা দিব।
— কেনো, কেনো আব্বাজান?’ বিকালের মধ্যে রওনা দিবেন কেন? প্রথমবার ছেলের বাড়িতে এলেন দু-একদিন না থেকেই চলে যাবেন! আমি আপনার ছেলেকে ফোন করেছি উনি এলেন বলে।
বলতে বলতে জহির এসে পরেছে। সে অনেকটা বাড়ির কাছেই ছিলো। স্ত্রীর মুখ থেকে আব্বাজান এসেছে শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন।
মুসকান রাতুলের সাথে কথা বলছিল। রাতুল বলছে,
— তোকে খুব মিস করেছি আপু। তুই ছাড়া বাড়িটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। মুসকান চোখের কোণের পানি টুকু মুছে মৃদু হাসে,
— আমিও তোদের খুব মিস করেছি।
তাদের কথার মাঝে ফাইজাও জয়েন হয়।
জহির এসে সোফায় উনার আব্বাজানকে বসে থাকতে দেখে দ্রুত গিয়ে সালাম দেন। খুশিতে অনর্গল বলতে থাকেন,
— কেমন আছেন আব্বাজান? শরীর ভালোতো? বাড়ির সবাই কেমন আছে? আপনি না বলে এই টাইমে এই বাড়িতে কি করে আব্বাজান !! আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না!
— বলছি বলছি বসো আগে। একটু জিরিয়ে নাও।
জহির সোফায় বসে। তাজমহল নাস্তা বানাতে রান্নাঘরে যাচ্ছিল। উনাকেও ডেকে সামনের সোফাটায় বসতে বলেন এরশাদ তালুকদার।
তাজমহলও বসেন। এরশাদ তালুকদার জিজ্ঞেস করেন,
— ফারিশ কোথায়?
তাজমহল উত্তর দিল,
— ওহতো একটু বিল্ডিং এর কাজের জন্য ঢাকার বাইরে গেছে। ফিরতে রাত হবে। বেশি দরকার কি আব্বাজান?আমি ফোন দিয়ে আসতে বলব?
— না নাহ। কাজে থাকলে আসতে বলার দরকার নেই। আমি তোমাদের কাছেই বলছি। ‘রাহিলা দীর্ঘদিন যাবৎ মুসকানকে দেখতে চাইছে। মেয়ের জন্য কান্নাকাটি করছে। আমাকে কবে থেকেই বলছিল মুসকানকে নিয়ে যেতে । এদিকে মুসকানের স্কুল থেকেও নোটিশ পাঠিয়েছে। সামনেই তাদের টেস্ট পরীক্ষা। পরীক্ষা না দিলে ফাইনাল দিতে পারবে না। এইজন্যই আসা। জামিলকেই পাঠাতাম। কিন্তু মনে হলো আমি আসলে আমার গিন্নি বেশি খুশি হবে।
মুসকানের ঠোঁটে প্রত্যাশার হাসি ফুটে। দাদু তাকে এক্সাম দেওয়াবে।
তাজমহল আর জহির সচকিত ফেরে। তারাতো মুসকানের লেখাপড়ার ভিষয় টা ভুলেই গিয়েছিল। মেয়েটা এই কয়দিনেতো কিছুই পড়েনি। পরীক্ষায় কি লিখবে! জহির নমনীয় ভাবে উত্তর দিল,
— আপনার নাতনি আপনি যখন ইচ্ছা তখন নিয়ে যেতে পারেন আব্বাজান। শুধু মুসকান নয় আমরাও ভিষন খুশি হয়েছি আপনি আশায়। প্রথমবার আমার বাড়িতে এসেছেন আপনি। খালি মুখে কিভাবে যেতে দেই বলেন। দুপুরে অবশ্যই খাওয়া দাওয়া করে যাবেন।
তাজমহল আব্বাজানের খাবর ব্যবস্থা করো জলদি।
এরশাদ তালুকদার ব্যস্ত গলায় বললেন,
— আরে না না। ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই। অন্যদিন এসে খাওয়া দাওয়া হবে ক্ষন। দূরের পথ আমাদের জলদি রওনা হতে হবে!
— না আব্বাজান তা বললে হয়না! আমি কোনো না শুনবো না! কি হলো তুমি যাচ্ছ না কেন? (তাজমহলকে উদ্দেশ্য করে)
–‘এইতো এক্ষুনি যাচ্ছি ‘ তাজমহল হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে ছুটলেন।
এরশাদ তালুকদার আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না।মুসকানের দিকে তাকিয়ে তাকে দ্রুত তৈরি হতে বললেন। মুসকান মাথা নাড়িয়ে ব্যাগ গুছাতে চলে গেল। সাথে ফাইজাও গেল। যেহেতু এক্সাম সেহেতু তাকে অনেক দিনই থাকতে হবে বুঝা যাচ্ছে। ব্যাগ গুছাতে নিয়ে বারবার মুসকানের মনটা কেমন করে ওঠছে। রাতেই যেভাবে রিয়াকশন দিয়েছে। এখন না বলে চলে গেলে না জানি কি করে। সে তো আগে থেকে জানতোও না যে তার দাদু আসবে। তাহলে নাহয় বলা যেত। ধ্যাত কি দরকার ছিলো রাতে ওই কথাটা বলার। উনি শুনে না জানি তাকেই আবার ভুল বুঝতে শুরু করেন…
তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১০
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিকেলের দিকেই এরশাদ তালুকদার নাতি, নাতনিদের নিয়ে বেড়িয়ে পরেন। ফারিশ কে বলে যাওয়ার জন্য ফোন করেছিলেন। কিন্তু তার ফোন বন্ধ পেয়ে আর বলা হয়নি। জহির ব্যস্ত না হতে বলে দিয়েছেন। ফারিশকে তিনিই জানিয়ে দিবেন।মুসকান একদিকে খুব খুশি কতোদিন বাদে সে তার গ্রামে যাচ্ছে। বন্ধু-বান্ধবি পরিবার সাবাইকে দেখতে পাবে। অন্যদিকে ফারিশের কথা ভেবেও মনের ভিতর অন্যরকম এক সুপ্ত অনুভূতির দেখা মিলছে..