তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২
অহনা আক্তার

— হোয়াট !!! মাথা ঠিক আছে তোমাদের ?? কি বলছো এসব ??? মুসকান আর আমাকে নিয়ে কি করে ভাবতে পারো তোমরা ?? ‘মুসকানের এজ দেখেছো?’ ফাইজার সমান ওহ! প্রায় এক যুগের গেপ আমাদের মধ্যে !! একজন আটাশ বছর বয়সী ছেলের সাথে ষোলো বছর বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ের বিয়ে কি করে ঠিক করতে পারো তোমরা?’ ফারিশ চিল্লায়ে কথাগুলো বলছে তার বাবাকে।
জহির তালুকদার বলেন,
— আমি এতোকিছু বুঝি না। আমার আব্বাজান বলেছে মুসকানকে আমর পুত্র বধূ করতে আমি তাই করবো। আমি আমার আব্বাজানের কথা অমান্য করতে পারবো না। জীবনের প্রথমবার আব্বাজান আমার কাছে কিছু আবদার করেছেন। আমি ওনাকে ফেরাতে পারিনি। তোমার বিয়ে মুসকানের সাথেই হবে। এটাই ফাইনাল।

— কি রকম চিপ মেন্টালিটি ইয়ার তোমাদের। মুসকান একটা বাচ্চা মেয়ে। ওর এখন পড়ালেখা করার বয়স। সংসার করার নয়।
— মুসকানের পড়ালেখা নিয়ে তোমাকে এতো ভাবতে হবে না। আমরা ওকে মুর্খ রাখবো না। গ্রামের মেয়েদের কম বয়সেই বিয়ে হয়। তারা সংসারও করে। মুসকানও পারবে। এটা নিয়ে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাইছিনা।
ফারিশ বিরক্ত হয়ে এবার তার মাকে বলল,
— তুমি কিছু বলছো না কেন বাবাকে? কি করে মেনে নিচ্ছ এটা? দাদু আমাকেই কেন মুসকানের জন্য সিলেক্ট করল। আর ওকে কেনই বা এখন বিয়ে দিতে চাইছে?
জহির তাজমহলের উদ্দেশ্যে বলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— তাজমহল তোমার ছেলেকে বলে দাও, বিয়ে করলে ওকে মুসকান কেই করতে হবে। এতোগুলো বছর পর আব্বাজান আমাকে আপন করে নিয়েছেন। আমার কাছে কিছু চেয়েছেন। আমি আমার আব্বাজানকে কিছুতেই ছোট করতে পারবো না।
তাজমহল বিপাকে পরে গেলেন। কার পক্ষে কথা বলবেন তিনি। ছেলে না ছেলের বাপ।
ফারিশ ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
— আমি মুসকানকে বিয়ে করতে পারব না।
জহির তালুকদার দ্বিগুণ ক্ষেপে বলেন,
— আমার কথার কোনো লড়চড় হবে না। কালই তোমার আর মুসকানের আকদ হবে। ভালোয় ভালোয় রাজি হয়ে যাও নাহলে আমি তোমায় ত্যজ্জ পুত্র করব।
— আপনার যা ইচ্ছা আপনি করতে পারেন। আমি এখন আপনার ওপর ডিপেন্ডেবল নই!
— ” ফারিশ ”

জহির তালুকদার ক্রুদ্ধ কণ্ঠে চিল্লিয়ে ছেলের দিকে তেড়ে যান। তাজমহল সামনে দাঁড়িয়ে বাঁধা দেন। পরক্ষনেই দরজায় তীব্র আওয়াজ শুনা যায়। জামিল ডাকছে। জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে। জহির বড় শ্বাস ফেলে দরজা খোলে দিল। জামিল দ্রুত বলল,
— আব্বাজান আপনাদের সবাই কে এক্ষুনি উনার ঘরে যেতে বলেছেন ভাইজান।
জহিরের গম্ভীর স্বর,
— তুই যা আসছি আমরা।
জামিল চলে গেলো। জহির যেতে নিয়েও পিছু ফিরে তাজমহলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— আব্বাজান নিশ্চয়ই বিয়ে বিষয়ক কথা বলতে ডাকছে। তোমার ছেলেকে বলে দিও সে যদি আব্বাজানের সামনে মুসকানকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে তাহলে ‘সে তার মাকে বিধবা দেখবে।’

মুখে হাত চেপে চিৎকার করে উঠেন তাজমহল। ফারিশ জিদ্দে ঘু*সি মারে সামনে থাকা দেয়ালে। জহির ছেলের রাগ তোয়াক্কা না করে গটগট পায়ে এরশাদ তালুকদারের ঘরের দিকে চলে যান। মাঝখান থেকে জ্বালায় ফাঁসলেন তাজমহল। বাপ যেমন ছেলেও তেমন। একটার থেকে একটা কম না। ছেলে যেন বাপের থেকেও এক কাঠি ওপরে। স্বামী আর ছেলের এই জেদ ঠেলতে ঠেলতেই তিনি নিজের জীবনের অর্ধেক আয়ু কমিয়ে ফেলেছেন।

জাহিদের মৃত্যুর আজ চারদিন। গতকাল রাতে এরশাদ তালুকদার কে হসপিটাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে। গুরুতর অসুস্থ তিনি। নাতনি মুসকান কে নিয়ে ওনার যত চিন্তা। মেয়েটার বাবা মা’রা গেছে। ওনার শরীরটাও আজকাল ঠিক থাকে না। কবে যেন আল্লাহর ডাক পরে বলা যায় না। তাই তিনি চাইছিলেন মুসকানের একটা কুল করে যেতে। মুসকানের জায়গায় অন্যকেউ থাকলে কখনোই এই পদক্ষেপ নিতেন না এরশাদ তালুকদার। মুসকান ওনার অনেক পছন্দের নাতনি। ওনার প্রিয় পুত্রের কলিজা ছিল মুসকান। তাই পুত্রের চিহ্ন কে রক্ষা করা ওনার দায়িত্ব। গ্রামের অনেক মানুষের বদনজর আছে মুসকানের উপর। যেজন্য এরশাদ তালুকদার চাচ্ছেন কম বয়সেই মুসকানের বিয়েটা দিয়ে দিতে। উনি না থাকলে কেউই মুসকান বা রাহিলার দেখবাল ভালো করে করবে না। রাহিলারও একটা ভালো ব্যবস্থা করবেন এরশাদ তালুকদার। উনি ভেবে রেখেছেন জাহিদের ভাগের বেশ অর্ধেক সম্পত্তি উনি রাহিলার নামে করে দিবেন। আর বাকিটুকু মুসকানের। তাহলেই তাদের কেউ অবহেলা করতে পারবেনা।

জহিরের ছেলে ফারিশ কে এই তিন/চার দিনেই বেশ মনে ধরেছে এরশাদ তালুকদারের। ছেলেটির স্বভাব চরিত্রে উনি নিজেকে খোঁজে পেয়েছেন। এমনকি নিজের থেকে একটু বেশি কিছুই দেখেছেন উনি ফারিশের মাঝে। ফারিশের পারসোনালিটি, দায়িত্ববোধ,মুখের আদল,গঠন সবকিছুই মুগ্ধ করেছে এরশাদ তালুকদার কে। তাছাড়াও উনি উনার নাতনি তানিয়ার থেকে ফারিশের পুরো ব্রেকরাউন্ডের খোঁজ নিয়েছেন। তেমন কিছুই পাননি। ছেলে জামিল, মেয়ে জিন্নাততো ফারিশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যেখানে মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে তার চরিত্রের সার্টিফিকেট দিয়ে দিতে পারেন এরশাদ তালুকদার সেখানে ফারিশতো উনার নাতিই। যার জন্য দ্বিতীয়বার আর চিন্তা না করে মুসকানের জন্য ফারিশকেই সিলেক্টে করেন এরশাদ তালুকদার। বড় ছেলে জহিরের কাছে প্রস্তাব রাখার সাথে সাথে জহির দিকবিদিক না দেখে মূহুর্তের মধ্যেই হ্যা বলে দেন। কিন্তু এখনতো দেখছে জল অন্যদিকে গড়াচ্ছে। ফারিশ নাকি তার বাবার সাথে মুসকান কে বিয়ে করবে না বলে তর্কাতর্কি করছে। খবর শুনে এরশাদ তালুকদার ততক্ষণাত সকলকে উনার রুমে ডাকেন।

মুসকান যেন এক ধাক্কার পর এক ধাক্কা খেয়েই চলেছে! বাবার মৃত্যুর তিনদিন গিয়েছে কিনা দাদু তাঁর বিয়ে ঠিক করে ফেলল! তার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করল না! সে বিয়ে করবে কিনা তার এ বিয়েতে মত আছে কিনা কিছুই জিজ্ঞেস করল না! আব্বা ছাড়া কেউই ভালোবাসেনা মুসকান কে কেউ না। দাদু শুধু এতোদিন ভালোবাসা দেখিয়েছে। যদি না দেখাতো তাহলে এতো তাড়াতাড়ি কিছুতেই তাঁর বিয়ে ঠিক করতে পারত না। এসব ভেবে মুসকান ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। রাহিলা মুসকানের ঘরে ঢুকে দেখে মেয়ে তার কান্না করে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। রাহিলা দ্রুত গিয়ে মুসকানকে জড়িয়ে ধরে। মুসকান তার মাকে পেয়ে এবার জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। ভাঙা গলায় বলতে লাগলো,

— আমি বিয়ে করবো না আম্মা আমি কিছুতেই এখন বিয়ে করবো না।
রাহিলা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে বোঝানোর চেষ্টা করেন,
— তা বললে কি করে হয় মা! তোর দাদু নিজে তোর বিয়ে ঠিক করছেন। তুইতো জানিস কেউ তোর দাদুর মুখের উপর কথা বলতে পারে না। উনি এককথার মানুষ। বিয়েতে রাজি হয়ে যা মা। তোর দাদুতো তোর খারাপ চায় না বল?
মুসকান রেগে ঝাড়া মেরে তার মায়ের হাত সরিয়ে ফেলল। উচ্চ স্বরে বলল,
— তোমরা সবাই এক। আব্বা ছাড়া কেউ আমাকে ভালোবাসেনা কেউনা! সবাই আমাকে বিদায় করার জন্য উঠে পরে লেগেছো। আমি এখন পড়ালেখা করতে চাই বিয়ে না কেন বুঝতে চাইছো না তোমরা?
রাহিলা বোঝানোর স্বরে বলল,

— আমরাতো তোকে বিদায় করতে চাইছিনা মা। ফারিশ তো তোর কাজিন। খুব ভালো ছেলে। ওর সাথে বিয়ে হলে তুই আমাদের মাঝেই থাকবি। যখন চাইবি তখন আসতে পারবি। দেখলিতো এই কটাদিন আমাদের কীভাবে খেয়াল রেখেছে ছেলেটা। তোর দাদুকে হসপিটালে নেওয়া থেকে শুরু করে তোকে ডক্টর দেখানো তোর চাচ্চুদের সামলানো সব করেছে। ফারিশ তোকেও ভালো রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। তাছাড়া তোর বড়চাচ্চু তোর দাদুকে কথা দিয়েছে উনারা তোকে পড়াবে। তুই যতদূর পড়তে চাস পড়াবে। ফারিশকে বিয়ে করলে তুই সুখি থাকবি মা। প্লিজ রাজি হয়ে যা। আমি তোর দাদুকে না বলতে পারবো না।
মুসকান করুন সুরে বলল,
— “তোমরা কেন বুঝতে পারছোনা আম্মা ‘আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। আমি সংসারের কিছুই বুঝিনা। আঠারো বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া আইনত অপরাধ তোমরা জানোনা?”
রাহিলা এবার শক্ত কণ্ঠে বলেন,

— গ্রামের মেয়েদের কম বয়সেই বিয়ে হয় মুসকান। তোর তানিয়া আপুরও কম বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। আস্তে আস্তেই সব বুঝে যাবি। তোর দাদু তোর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই এই ডিসিশন নিয়েছেন। আল্লাহ না করুক তোর দাদুর যদি কিছু হয়ে যায় আমি কোনোদিনও এই হিংস্র সমাজে তোর জন্য সুপাত্র খোঁজে বের করতে পারবো না । চুপচাপ বিয়েতে রাজি হয়ে যা।
— আম্মা***
মুসকান তার মাকে কিছু বলার আগেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। জিন্নাত ডাকছে,,
— ছোট ভাবি আব্বাজান এক্ষুনি সকলকে উনার ঘরে যেতে বলেছেন। জলদি আসেন। মুসকানকেও সাথে নিয়ে আসেন।
রাহিলা খাট থেকে নেমে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেন,

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১

— তোর দাদু ডেকে পাঠিয়েছেন। মনে হয় বিয়ের কথা বলবেন। তোর আব্বা কখনো তোর দাদুর কথা অমান্য করেননি, উনার মুখের ওপর কথা বলেননি। আশা করি তুইও তোর আব্বার মান রাখবি।
মেয়েকে এতটুকু বলে চলে গেলেন রাহিলা। মুসকান রাগে বিছানার বালিশ ছোড়ে ফেলেছে। চাদর এলোমেলো করে ফেলেছে। চিৎকার করে কাঁদছে….

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩