তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২১
অহনা আক্তার
এভাবে কেটে গেলো বেশ অনেকগুলো দিন। নানিজানের বাড়িতে কাটানো দিনগুলোও তাদের খুব ভালো কেটেছে। ফাইজা আর মুসকান এখন পুরো দমে পড়ায় মনযোগ দিয়েছে। যতদিন যাচ্ছে ততই ঘনিয়ে আসছে তাদের এক্সামের সময়। মুসকান এখন পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারেও মনযোগ দিচ্ছে। তাজমহলের থেকে বেশ কয়েক পদের রান্না শিখেছে সে। মাঝে মাঝে একাই সেগুলো ট্রাই করে। রান্না করতে গিয়ে কখনো হাতে তেলের ছিঁটা পড়েছে তো কখনো গরম পানি। আবার কখনো তরকারি কা’টতে গিয়ে নিজের হাত কে*টে ফেলেছে। তবু্ও হাসি মুখে করে যায়। বাবার আহ্লাদী মেয়েটাকে একসময় শ্বশুর বাড়িতে এসে সবই করতে হয়।
খাটে বসে একটা মোটা পেইজে বিল্ডিং এর নকশা করছে ফারিশ। মুসকান তার হাতের কফির মগটা ফারিশকে দিয়ে সে নিজেও এক পাশে বই নিয়ে বসে পরে। আজকে একটু আগে আগেই বাসায় এসেছে ফারিশ। আর এসেই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে কাজ নিয়ে পরেছে। ইদানীং কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে সে। মুসকান কেও তেমন একটা সময় দেয়না। যার জন্য মুসকানের মনে অভিমান জমা হচ্ছে। এই যে দশ মিনিটের মতো হয়ে যাবে সে এখানে বসেছে। কিন্তু ফারিশের কোনো হেলদোল নেই। সে নিজের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে। মুসকান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বইটা বন্ধ করে মাথার পাশে রেখেই কাত হয়ে শুয়ে পরে। পড়তে ইচ্ছে করছে না তার।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাঁকা চোখে একবার তাকায় ফারিশ মুসকানের দিকে। কোনো কথা না বলে চুপচাপ নিজের কাজটা শেষ করে। মুসকান এখনো উল্টো দিকে ঘুরে আছে। ঘুমায়নি কিন্তু ভুলেও ফারিশের দিকে ফিরছে না। কাজ শেষ হয়ে গেলে ফারিশ মুসকানের বইসহ নিজের কাগজপত্র গুলো সাইড টেবিলে গুছিয়ে রাখে। ঘরের লাইট নিভিয়ে জানালার পাশ থেকে পর্দা সরিয়ে দেয়। আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের আলো ডিরেক্ট মুসকানের শরীরে এসে পরছে। মুসকান একটা কালো রঙের থ্রি পিস পরেছে। পাতলা ওড়না তার বুকের উপর ছড়িয়ে। জানালা দিয়ে আসা মৃদু বাতাসে সেই ওড়না হালকা ভাবে উড়ছে ।
চুলগুলো বারবার মুখে এসে বারি খাচ্ছে। কালো পরলে মুসকানের গায়ের রঙ এমনিতেই উজ্জ্বল দেখায়। সেখানে চাঁদের আলোতে তার মুখটা আজ যেন একটা ফুটন্ত গোলাপ ফুল। বেশ কিছুক্ষণ ফারিশ মুসকানের মুখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মুসকান এবার চোখ বুঝা অবস্থায়ই সোজা হয়ে শুলো। এক চোখ পিটপিট করে কিছুটা মেলতেই ফারিশের কাছে ধরা পরে গেল। লজ্জায় হতভম্ব হয়ে সাথে সাথে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেও লজ্জা নিবারন করতে পারল না। ফারিশ যে এভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে এটা সে ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। মুসকানের কান্ডে শব্দ করে হাসলো ফারিশ। পরপর বিছানায় পা ওঠিয়ে তার পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। মুখ থেকে ওড়না সরিয়ে কপালের মধ্যস্থানে ঠোঁট ছুঁয়াল। মুসকান এখনো চোখ খুলছে না। ফারিশ হাসে। মুসকানের মুখের উপর ঝুকে গালে বুড়ো আঙুল ঘষে বলে,
—‘চোখ খুলো’
চোখের পাতা কাঁপিয়ে তাকায় মুসকান। ফারিশের চোখে নেশা। কানের কাছে মুখ নিয়ে লো ভয়েসে বলে,
— এতো অভিমান কিসের?
মুসকান মুখ ফিরিয়ে নিতে চায়। কিন্তু ফারিশ দেয় না। চিবুক ধরে আটকিয়ে দেয়। গলা থেকে টান মে’রে ওড়না টা সরিয়ে সেখানে গাঢ় ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ায়। পরপর ছুঁয়াতেই থাকে। মুসকান কাঁপে। সারা অঙ্গ ঝিমিয়ে উঠে। কম্পিত হাত আপনাআপনি ফারিশের চুলে চলে যায়। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে। ফারিশ ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকায়। গভীর স্বরে বলে,
— চলো স্বর্গ থেকে ঘুরে আসি। অভিমান ভেঙে গুড়িয়ে দিব…
শুক্রবার। ফারিশ নেই কিন্তু জহির তালুকদার আজকে বাড়িতে। জুম্মা পড়ে এসে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। আর এদিকে মুসকান আর ফাইজা শাড়ি পরে সেজেগুজে তৈরি হচ্ছে। তারা আজকে ঘুরতে যাবে। কোথায় যাবে সেটা এখনো প্ল্যান করেনি কিন্তু জহির বলেছে দু’জন কেই বিকেলের আগে রেডি হয়ে থাকতে। দুই মেয়ে নিয়ে আজ শহর ঘুরবেন তিনি। ফাইজা আর মুসকান তো ভেজায় খুশি। দুজনে মিলেই শাড়ি পড়ার প্লানিং করেছে। এখন দুজনে মিলে সেম টু সেম শাড়ি জুয়েলারি মেকওভার করে তৈরি হয়ে নিয়েছে। ঝটপট বাগানে গিয়ে ছবিও তুলে নিচ্ছে কয়েকটা। তাদের ছবি তোলার মাঝেই সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত জহির তালুকদার এসে ফাইজা আর মুসকান কে ডাকতে লাগলেন,
— কোথায় আমার মায়েরা? তৈরি হয়েছে?
দু’জনেই প্রফুল্ল হেসে হ্যা বলে। মেয়েদের দেখে গাল ভরে হাসেন জহির। দু’জনের মাথায়ই হাত রেখে বলেন,
— মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর লাগছে আমার মায়েদের।
ফাইজা, মুসকানও হাসে। তাজমহল পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। তার মুখেও উজ্জ্বল হাসি। তিনি আদুরে গলায় বলেন,
— আমাকে একা রেখে যাচ্ছ সবাই জলদি ফিরে এসো কিন্তু!
ফাইজা মুখ বেঁকায়,
— ইসস আমরা বলেছি নাকি তোমাকে একা থাকতে তুমিই তো যাবে না বলেছো।
— একটা দেব ফাজিল মেয়ে,,, আমি কি এখনো যাব বলছি নাকি ! তোমরা তোমাদের বাবার সাথে যত ইচ্ছে ততো ঘুরে আসো। বাড়িটা ফাঁকা লাগবে তাই বলেছি জলদি আসতে। অবশ্য তোমাকে তো দু’দিন বাদে এমনিতেও শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিব। (টিটকারি সুরে)
ফাইজা নাক ফুলায়,
— দেখেছো বাবা? মা নাকি দু’দিন বাদেই আমাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিবে !! আমি কিন্তু কোথাও যাব না বলে রাখলাম! তোমাদের জ্বালানোর জন্য পার্মানেন্ট এই বাসায় থেকে যাব !
মেয়ের কথায় উচ্চ স্বরে হাসেন জহির। আহ্লাদি সুরে বলেন,
— কার এতো সাহস আমার মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিবে! হাত-পা ভেঙে গুড়িয়ে দিব না।
মুসকান আর তাজমহল মুচকি হাসে।
ফাইজা খুশি হয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে।
যা দেখে মুসকানের নিজের আব্বার কথা মনে পড়ে যায়।
ঠান্ডা প্রকৃতি। বাতাসে শীতের আগমনী ভার্তা। বিকেলের দিকে রাস্তার আশপাশ গুলোতে বসেছে বিভিন্ন স্ট্রিট ফুডের মেলা। ফাইজা আর মুসকান আগেই গিয়ে গুনে গুনে চার প্লেট ফোসকা, চটপটি নিয়ে বসেছে। দুজনেই ঝাল দিয়ে যত পারছে তত খাচ্ছে। জহির বারণ করলেও শুনছে না। ঝালে দুজনের চোখ লাল হয়ে উঠতে দেখে জহির গিয়ে দ্রুত আইসক্রিম নিয়ে আসল। আইসক্রিম খেয়ে ঠান্ডা হয়ে তারা দ্রুত রাস্তার পাশে ফুলের খাঁচা নিয়ে বসা মহিলার দিকে ছুটে গেল। সেখান থেকে দুইটা ফুলের মুকুট নিয়ে সেকেন্ডের মধ্যে মাথায় পরে নিল। পরপর অন্য পাশের একজন মহিলার থেকে হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি নিল। আনন্দ যেন তাদের চোখে মুখে লেপ্টে ।
জহির নিজেই মুসকান আর ফাইজার হাতে রেশমি চুড়িগুলো পরিয়ে দিল। খুশিতে মুসকানের দু চোখ পানিতে ভর্তি। তার আব্বার কথা ভিষণ মনে পরছে আজকে। জহিরের নমনীয় আচরণে মুসকান ফুপিয়ে কেঁদে দিল। এই লোকটাও তার আব্বার থেকে কোনো অংশে কম ভালোবাসছে না তাকে! নিজের মেয়েকে যতটা স্নেহ ভালোবাসা দিচ্ছে তাকেও ততটাই দিচ্ছে। বরণ তাকে আরো বেশি দিচ্ছে। ফাইজার পাশাপাশি সেও যা চাইছে তাই কিনে দিচ্ছে। ফাইজার জন্য একটা জিনিস কিনলে তার জন্যও সেম একি জিনিস কিনছে। কোনো ভেদাভেদ করছে না।
তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২০
দুজনের দু হাত ধরে সবসময় নিজের দুই পাশে রাখছে। পুরোটা বিকেল তারা এভাবেই ঘুরাঘুরি খাওয়াদাওয়া করে কাটিয়ে সন্ধ্যের দিকে হাতিরঝিল গেল। রাতের হাতিরঝিলের প্রকৃতি দেখে মন জুড়িয়ে গেল মুসকানের। আলো ঝলমলে ব্রিজ,ঠান্ডা হাওয়া আর টলটলে পানির উপর দিয়ে চলা ওয়টারবাসে চরে কেটে গেলো তাদের পুরোটা সন্ধ্যা।
বাড়ি ফেরার পথে মাঝ রাস্তায় ঘটে যাওয়া এক অপ্রত্যাশিত দৈবাৎ ঘটনায় থমকে গেলো তিনজন….