তোমার মুগ্ধতায় শেষ পর্ব 

তোমার মুগ্ধতায় শেষ পর্ব 
অহনা আক্তার

মেয়েকে কোলে নিয়ে মুসকানের কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফারিশ। ঘুম থেকে উঠেই আয়রা তার মাম্মা কে দেখতে না পেয়ে কান্না শুরু করেছে। এমন ভাবে কান্না করছে যে তাজমহল হিমশিম খেয়ে ছেলেকে ফোন দিয়ে বাসায় এনেছে। ফারিশ আসার পরেও কিছুক্ষণ বাবার কোলে চুপচাপ থেকে মায়ের জন্য কান্না করছে আয়রা। অরুণ শান্ত থাকলেও বোনের কান্না দেখে এখন সেও কান্না জুড়ে দিয়েছে। দুই বাচ্চার কান্নায় মাথা ধরে গিয়েছে ফারিশের। এই সময়টায় সব সময়ই ঘুমায় তারা। কিন্তু আজ আয়রা দ্রুত উঠে গিয়েছে। ঘুম থেকে উঠলে মুসকান ছাড়া কেউই সামলাতে পারে না বাচ্চাদের। অরুণ কে কোনোমতে সামলানো গেলেও আয়রা কে একেবারেই সামলানো যায় না। মেয়েটা এতো বিরক্ত করে সবাইকে।

অরুণ কে কোলে নিয়ে তার দাদুভাই হাঁটতে বের হয়ে গেছে। দাদুর সাথে বাইরে বের হওয়ার পর কান্না থেমে গেছে অরুণের। কিন্তু তাজমহল আর ফারিশ মিলেও আয়রার কান্না বন্ধ করতে পারছে না। পাপার কোলে থেকেও কিছুক্ষণ পরপর ফুপিয়ে উঠছে আয়রা। বার বার ঠোঁট উঁচিয়ে মা’ম্মা বলার চেষ্টা করছে। আয়রার পিচ্চি কিউট মুখটা চোখের পানির উত্তাপে ভিজে ফুলে গেছে। ডাগর আঁখি জোড়া থেকে জলরাশি উপচে পরছে। মায়ের মতোই নাকের ডগা টা কেমন স্টবেরীর মতো লাল হয়ে আছে । মেয়ের ঠোঁট ভেঙে কান্না আর স’হ্য করতে না পেরে মুসকানের কলেজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ফারিশ। আয়রা কে কোলে নিয়ে ড্রাইভ করতে পারবে না বলে রিকশায় উঠে বসল।
মেয়েকে কোলে নিয়ে রিকশায় বসার পর কান্না থামিয়ে দিল আয়রা। চুপচাপ বাবার বুকে মাথা রেখে জার্নি উপভোগ করতে লাগলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এক্সাম দিয়ে বের হয়ে বাবা,মেয়েকে একসাথে দেখে হতবাক হয়ে গেল মুসকান। আয়রার পরনে নীল রঙা বেবী ফ্রক। ফর্সা শরীরে দারুণ মানিয়েছে হাতাকাটা ফ্রকটা। ওদের সামনে দিয়ে যে যাচ্ছে সে একবারের জন্য হলেও তাদের বাবা মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে। ফারিশের বুকে আয়রাকে মিশে থাকতে দেখে এতোটাই সুন্দর লাগছে যে মুসকানের বুকে ব্যথা করছে। বাচ্চাদের চিন্তায় আগে আগেই খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে মুসকান। ফাইজা এখনো এক্সাম হলে। বাইরে আসতেই এমন একটা সারপ্রাইজ পাবে বুঝতে পারেনি মুসকান। সাদা শার্ট পরিহিত সুদর্শন স্বামীকে নিজের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার ক্লান্ত শরীর নিমিষেই সতেজ হয়ে গেল। স্নিগ্ধ হেসে ফারিশের দিকে এগিয়ে যেতেই আয়রা লাফিয়ে তার মাম্মার কোলে চলে আসলো। ফারিশ মুসকানের হাতের ফাইলটা নিজের হাতে নিয়ে টিশু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল,

— ফাইজা কোথায়?
— ক্লাসে আছে। এসে পরবে এক্ষুনি। আপনি কখন এলেন?
— এইতো পাঁচ/দশ মিনিট হবে!
— আয়রা কে নিয়ে এলেন যে? ওহ কি কাঁদছিল?
— হু..
মুসকানকে বিচলিত দেখালো। মেয়েকে আরেকটু গভীর ভাবে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
— কখন উঠেছে ওহ? অরুণও কি কাঁদছিল?
— ওই একটু।
— কি বলেন !! চলেন জলদি বাসায় যেতে হবে। আমার ছেলে নিশ্চয়ই আমাকে খোঁজছে!
মুসকানের উদ্বেগ দেখে হেসে দিল ফারিশ। মুসকান ভ্রু কুঁচকে বলল,
— আপনি হাসছেন কেন?
আয়রা তখন তার মায়ের গলায় থাকা আইডি কার্ডটা মুখে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টায়। ফারিশ মেয়ের হাত থেকে সেটা ছুটিয়ে দিতে দিতে বলল,

— হাসছি কারণ যে মেয়েটাকে ছোট বলে বিয়েই করতে চাইছিলাম না সেই মেয়ে এখন আমার দু’বাচ্চা সামলাচ্ছে! কি অদ্ভুত তাই না? দাদু একসময় বলেছিলেন, ‘ আমি নাকি একদিন ঠিকই বুঝবো যে উনি কি দিয়েছেন আমায় ‘। একদিন কেন! আমি এখন প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহুর্ত উপলব্ধি করি যে উনি কি দিয়েছেন আমায়। তুমি না থাকলে আমার জীবনটা এতো কালারফুল কখনোই হতো না মুসকান। কৃতজ্ঞ আমি উপরওয়ালার প্রতি। আমাদের দাদুর প্রতি, বাবার প্রতি। বিকজ অফ দেম আই ফাউন্ড ইউউ।
— আপনার নিশ্চয়ই খুব গরম লাগছে তাই না? এইজন্য এমন আবোলতাবোল বকছেন! বাসায় চলেন আমি ঠান্ডা পানি দিয়ে ভালো করে লেবুর শরবত বানিয়ে দিবো। ওটা খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
ফারিশ শব্দ করে হাসল। মুসকানের গাল টেনে দিয়ে বলল,
— হোয়াই আর ইউ সো কিউট ইয়ার ?? কলেজে আছো বলে চু’মু থেকে বেঁচে গেলে।
মুসকানের গাল গরম হয়ে গেলো। সে না শোনার ভান ধরে আয়রা কে নিয়ে ভিতরে যেতে যেতে বলল,
— চলো আম্মু আমরা তোমার ফুপিমণি কে নিয়ে আসি।

বাড়িতে ঢুকতেই রিশাদকে ড্রয়িং রুমের সোফায় হ্যান্ডসাম পরিপাটি লুকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলো তারা তিন জন। শুধু বসেই নেই বর্তমানে সে অরুণ কে কোলে নিয়ে খেলা করছে । মামার কোলে উঠে অরুণও হেসে কুটিকুটি। বারবার রিশাদের হাত ঘড়িটা টেনে মুখে দিতে চাইছে আর রিশাদ সেটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে নিলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে।
এতোদিন পর রিশাদ কে এমন হাসোজ্জল রুপে চোখের সামনে দেখে বুকের পাঁজর নড়ে উঠল ফাইজার। সে শুকিয়ে শুকনো বাঁশে পরিণত হচ্ছে আর এই লোক দিন দিন কি গ্লো করছে!
আজ রিশাদ একা আসেনি। জিন্নাত আর এরশাদ তালুকদার কেও সাথে নিয়ে এসেছে। এরশাদ তালুকদার সোফার একপাশে বসে ছেলের সাথে কথা বলছেন। জিন্নাতও তাজমহলের সাথে আড্ডা জমিয়েছে। এতগুলো মাস বাদে ফুপিমণিকে এমন হাসি খুশি হয়ে বড়চাচির সাথে কথা বলতে দেখে মনটা ভরে উঠল মুসকানের। সে দ্রুত গিয়ে তার ফুপিমণি কে জড়িয়ে ধরে বলল, — কেমন আছো ফুপিমণি?
জিন্নাত হাসল। মুসকানের কোল থেকে আয়রা কে বুকে নিয়ে বলল,

— আলহামদুলিল্লাহ। তোরা কেমন আছিস?
— ভালো ছিলাম তোমাকে দেখে আরো ভালো হয়ে গেছি। ফাইজা রিশাদের দিকে আড়চোখে দু’একবার তাকিয়ে সেও জিন্নাতে সাথে হাসিমুখে কথা বলল।
ফারিশ এখানে বেশিক্ষণ থাকতে চাইলো না। ওইদিন যেহেতু তার ফুপিমণি তাকে ইগনোর করে চলে গেছে তাই ভেবে নিয়েছে আজও হয়তো তার সাথে কথা বলবে না। কেবল দাদুকে কে সালাম দিয়ে চলে যেতে নিল ফারিশ। তখনই এরশাদ তালুকদার পিছু ডাকলেন,

— দাঁড়াও।
ফারিশ দাঁড়িয়ে গেল। এরশাদ তালুকদার সোফা থেকে উঠে এসে নাতির মুখোমুখি দাঁড়ালেন,,
— তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা ছিলো। সময় হবে কি?
ফারিশ উষ্ণ শ্বাস ফেলল,
— বলেন কি বলবেন? সময় হবে না কেন?
— না আজকাল তোমার যা দাম। ভাবলাম আমার কথাগুলো শুনে যদি আরো দাম বাড়িয়ে দাও!
ফারিশ সটান হয়ে হাত ভাজ করে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
— এখন বুঝতে পারছি মুসকানের খোঁচা মে’রে কথা বলার স্বভাব আসলো কোথা থেকে ! গুঁড়া তো এখানে..
মুসকান আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি লোকাতে চাইল। মিনমিনিয়ে বলল, ‘এক নাম্বারের খ’চ্চর লোক।’
এরশাদ তালুকদার শুকনো কাশলেন। গম্ভীর স্বর প্রয়োগ করে বললেন,

— আসল কথায় আসি।
— হ্যা বলুন শুনছি। অবশ্য কিছুটা ধারণাও করতে পারছি (শেষের কথাটা রিশাদের দিকে তাকিয়ে বলল ফারিশ)
অরুণ মুসকান কে দেখে বারবার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে তার কোলে যাওয়ার জন্য। তা দেখে মুসকান রিশাদের কাছে এসে অরুণ কে কোলে নিল। পরিবেশ এখন গমগমে।
এরশাদ তালুকদার কথা তুললেন,
— আমি জানি তুমি ধারণা করতে পারছো। তবুও পরিষ্কার করে বলছি, আমি এখানে তোমাদের দাদু বা তোমার বাবার আব্বাজান হয়ে আসিনি। এসেছি রিশাদের নানাজান হয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আমার ছেলের সাথে আমি কথা বলেছি। সে ফাইজা আর রিশাদের সম্পর্ক টা মেনে নিয়েছে। ভেবো না এমনি এমনি মেনে নিয়েছে। তোমার বাপ আর আমার ছেলেতো! বহুত খাটুনি খাঁটতে হয়েছে। তোমার মা আর ফুপিমণি তো কেঁদে পায়ে পর্যন্ত পরতে যাচ্ছিল তোমার বাবার।
ফারিশ বিহ্বল চোখে তাকায় তার মা আর ফুপিমণির দিকে। এরশাদ তালুকদার পুনরায় নাতির মুখ ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরালেন,

— ওদের দিকে এরকম অবাক হয়ে তাকানোর কিছু নেই। দুনিয়ার সব মা-ই সন্তান কে সুখী দেখতে চায়। তোমার মায়ের চোখে তোমার বোনের ক’ষ্টটা ধরা পরেছে। যেটা তোমার চোখে পরেনি। তাইতো বোনকে এভাবে ভেঙে যেতে দেখেও তার সুখের জন্য এইটুকু করতে পারছো না। এই কয়েক মাসে কম খোঁজ তো নিলে না রিশাদের। পেয়েছো কিছু? বরণ তুমি যেরকম চাও সে তোমার বোনের জন্য সেরকম হওয়ার চেষ্টা করেছে।
— দাদু আমি…
— থামো। আগে আমাকে বলতে দাও। রিশাদের দোষ টা কোথায়? ওকে কেন মেনে নিচ্ছ না? আমি শুনেছি রিশাদ ফাইজার সাথে যোগাযোগ না করলেও তোমার সাথে করেছে। তোমাকে নানান ভাবে মানানোর চেষ্টা করেছে?
— হ্যা……

— তাহলে সমস্যা কোথায়? তোমার বাবা কে রাজি করাতে আমার, তোমার মায়ের, তোমার ফুপিমণির অর্ধেক জান বেরিয়ে গেছে। এখন তুমি কি চাইছো তোমাকে রাজি করাতে আমাদের বাকি জান টুকু বেরিয়ে যাক? মনে রাখবে আমি তোমার বাপেরও বাপ। তোমাকে যখন বিয়ের জন্য বাধ্য করতে পেরেছি ওদেরও বিয়ে দিতে পারবো!
নাতিকে একটানা এতো গুলো কথা বলে বড় করে দম ছাড়লেন এরশাদ তালুকদার। রীতিমত হাঁপাচ্ছেন তিনি। দাদুকে থামতে দেখে এবার মুখ খোলার সুযোগ পেল ফারিশ। এরশাদ তালুকদার কে উদ্দেশ্য করে শান্ত স্বরে বলল,
— আপনার বলা শেষ হ’য়েছে? এবার আমি কি কিছু বলতে পারি?
— হ্যা, হ্যা বলো তোমার কথা শোনার অপেক্ষাতেই তো আছি।
ফারিশ লম্বা একটা শ্বাস ছাঁড়ল,

— থ্যাঙ্ক গড অবশেষে সেই সুযোগটা দিলেন। আপনার এনার্জির প্রশংসা না করে পারছি না। এই বয়সেও এতো…
এরশাদ তালুকদার চোখ গরম করে তাকাতেই ফারিশ তার মাকে ডেকে বলল,
— একগ্লাস পানি দিও তো দাদুকে। খেয়ে গলাটা ভেজাক। ক্লান্ত হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।
— পানি লাগবে না। তুমি বলো ফাইজা আর রিশাদকে নিয়ে কি ভাবলে?
— বলছি আগে বসুন।
— পরে বসবো। আগে বলো?
গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়ে ফারিশ। ফাইজাকে ইশারায় নিজের কাছে ডাকে। ফাইজা কাছে আসতেই তার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,

— আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যা বলব নির্ভয়ে মন থেকে উত্তর দিবি।
ফাইজা মাথা দোলাল। ফারিশ তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
— রিশাদের সাথে সারাজীবন থাকতে পারবি?
চমকিত নয়নে ভাইয়ের দিকে তাকালো ফাইজা। ফারিশ মাথা নাড়িয়ে আবার জিজ্ঞেস করতেই নত মুখে বলল,
— তুমি কি চাও ভাইয়া?
অস্ফুট স্বরে হাসল ফারিশ। বুড়ো আঙুল দিয়ে কপাল স্লাইড করে বলল,
— এখনও আমার চাওয়া নিয়ে ভাবছিস?
ফাইজা নিচু কণ্ঠে বলল,
— তুমি না মেনে নিলে আমি কখনোই রিশাদকে বিয়ে করবো না।
ফারিশ শুকনো হাসল। স্বাভাবিক স্বরে বলল,

— আমি একসময় তোকে রিশাদের সাথে ভাবতে পারতাম না ঠিক। কিন্তু এখন আর ওইরকম টা ভাবি না। এখন আমিও মানি রিশাদ তোকে সত্যি সত্যি পছন্দ করে। তোর জন্য সব করতে পারে। আমি ভাবতে পারিনি রিশাদ নিজের পজিশনটা এতো শক্ত করে, নিজেকে একটা ভালো জায়গায় দাঁড় করিয়ে তোর হাত চাইতে আসবে। রাতের পর রাত তোকে ছাঁদে বসে নীরবে কাঁদতে দেখেছি। ভিতরে ভিতরে দুমড়ে মুচড়ে গেছিস তবু্ও আমি আর বাবা ক’ষ্ট পাবো বলে রিশাদের সাথে যোগাযোগ করিস নি। রিশাদ জানে তুই কখনো আমার আর বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে ওর সাথে সংসার পাতবি না। তাই ওহ ও এগােয় নি। যেমন হলে আমরা ওকে মেনে নিবো ওহ ঠিক ওইরকম পরিস্থিতি তৈরি করে এসেছে। দাদু ঠিকই শুনেছে। আমি এই কয়েকমাস রিশাদের ‘এ’ টু ‘জেট’ সব খোঁজ নিয়েছি। যার কাছে আমাদের এতো বছরের আগলে রাখা রত্মটি দিয়ে দিব তার ভালো করে খোঁজ নিতে হবে না? যদি আমাদের রত্নের কোনো অযত্ন হয় তো! কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে যতটুকু বুঝলাম,, আমাদের রত্ম যে জায়গায় যাবে সেই জায়গায় তার যত্ন আমাদের থেকেও দ্বিগুণ কেউ করবে। রিশাদ যখন ওর বাবার সাথে লড়াই করে ফুপিমণি আর রিতার গায়ে কোনো আঁচ লাগতে দেয়নি। আশা করি সে তোরও কোনো ক্ষতি হতে দিবে না। এতোকিছুর পরও আমি কি করে তোদের না মেনে থাকি বল?

ফাইজা ঢুকরে উঠে তার ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে অস্থির কণ্ঠে বলল,
— আই লাভ ইউ ভাইয়া। দুনিয়ার সব থেকে বেস্ট ভাইয়া তুমি।
বোনের চুলে হাত রেখে প্রসন্ন হাসল ফারিশ। রুমের প্রত্যেকের ঠোঁটেই উজ্জ্বল হাসি। রিশাদ যেন আনন্দে বাকহারা। খুশিতে তার দু চোখে পানি চিকচিক করছে। ফাইজা ফারিশকে ছাড়ার পরপর সেও ফারিশকে জাপটে ধরলো। আনন্দে বিমোহিত হয়ে প্রফুল্ল কণ্ঠে বলল,
— থ্যাংক ইউ ভাই। থ্যাংক ইউ সো মাচচ।

আয়রা, অরুন কে ঘুম পারিয়ে বাগানে আসলো মুসকান। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বিকেলের দিকে বাগানে এসে সবাই আসর জমিয়েছে । আসরটা মূলত ফাইজা আর রিশাদের বিয়ে নিয়ে।
বড় ছেলে আর মেয়ে জিন্নাতকে উদ্দেশ্য করে বলেন এরশাদ তালুকদার,
— আমি চাইছি আগামী শুক্রবার ফাইজা আর রিশাদের আকদ করিয়ে ফেলতে তোমরা কি বলো?
ফারিশ হতবাক হয়ে বলল,
— আগামী শুক্রবার মানে? আগামী শুক্রবার আসতে তো আর মাত্র তিনদিন? ফাইজার বিয়ে নিয়ে আমরা কতোকিছু ভেবে রেখেছি? আর আপনি সবকিছু এতো দ্রুত করে ফেলতে চাইছেন? ওরতো এখনো ইন্টারও কমপ্লিট হয়নি। ইন্টারটা কমপ্লিট করোক এরপর না-হয়…..
এরশাদ তালুকদার ধমক দিলেন,

— তুমি চুপ করো। বেশী বুঝো না। তোমার বোন ইন্টার দিতে আরো এক দের বছরের মতো লাগবে। ততোদিন কি ওহ একটা হা’রাম সম্পর্কে থাকবে? এমনিতেই তো পা’পের শেষ নেই। আকদ হয়ে গেলে পরে যা ইচ্ছে করো! বিয়ে আজ হলেও দিবে একবছর পরে হলেও দিবে। শুধু শুধু হা’রাম সম্পর্ক জড়িয়ে রেখে লাভ কি!
জিন্নাত সায় দিল,
–‘ আমার কোনো সমস্যা নেই আব্বাজান।’
জহিরও বলল,
— আপনি যেমনটা চান তেমন টাই হবে আব্বাজান।
ফারিশ আর কিছু বলল না। গোটা পরিবার যেহেতু রাজি সেখানে সে অমত করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

অবশেষে শুক্রবার দিন ফাইজা আর রিশাদের বিয়ে টা হয়েই গেল। ঠিক করা হলো যে, ফাইজার যতদিন এইচএসসি কমপ্লিট না হবে ততোদিন সে বাবার বাড়িতেই থাকবে। এইচএসসি এক্সামের পর তাকে ধুমধামে উঠিয়ে নেয়া হবে।
আকাশে আজ থালার মতো চাঁদ উঠেছে। চারপাশে বইছে ছন্নছাড়া মৃদু বাতাস। ফাইজার পরনে সিল্কের মেরুন রঙা শাড়ি। চুলে খোঁপা। তারই চারপাশে তাজা বেলী ফুল। খোঁপা থেকে নিয়ে পুরো পিঠ জুড়ে পাতলা ঝরঝেটে লম্বা দোপাট্টা। ছাঁদের দোলনায় বসে আরামে রিশাদের কাঁধে মাথা রেখে আকাশের গোল চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে ফাইজা। রিশাদের গায়েও সাদা রঙের সুতিরা পাঞ্জাবি। আপাতত সে এক হাতে ফাইজাকে পেছন থেকে পেঁচিয়ে রেখেছে।
অপর হাত দিয়ে ফাইজার মুখের উড়তে থাকা ছোট্ট চুল গুলো নির্বিঘ্নে সরিয়ে দিল। চাঁদের আলোয় একটা স্নিগ্ধ মায়াবী পরী মনে হচ্ছে ফাইজাকে । ফাইজার চুলের বেলীফুলের তীব্র ঘ্রাণ রিশাদের নাকে এসে বিঁধছে । ঘাড়টা আরেএকটু কাত করে ফাইজার খোঁপায় নাক ঘ’ষল রিশাদ। গভীর করে শ্বাস টেনে ভরাট স্বরে বলল,

— ঘুমিয়ে গেছো?
— উঁহু..
— তাহলে কথা বলছো না কেন?
আরেকটু শক্ত করে রিশাদকে পেচিয়ে ধরলো ফাইজা। মিহি রিনরিনে স্বরে বলল,
— এভাবেই ভালো লাগছে।
রিশাদ মৃদু হাসল,
— কতোদিনের স্বপ্ন ছিলো জানো? তোমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে খোলা আকাশের নিচে বসে চন্দ্র বিলাস করবো। ফাইনালি সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটা পেলাম।
— হুঁ..
— কি হুঁ হুঁ করছো? তোমাকে পাওয়ার জন্য এতো কষ্ট করলাম আমাকে তো একটা ধন্যবাদও দিলে না!
রিশাদের কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে ফেলল ফাইজা। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল,
— ক’ষ্ট কি তুমি একাই করেছো? আমি করিনি?
রিশাদের রশিক স্বর,

— ওহ তাই বুঝি? তুমিও ক’ষ্ট করেছো? আমিতো জানতামই না। তা কি কি ক’ষ্ট করেছো ?
রিশাদের বুকে কিল বসাল ফাইজা,
— ফাজলামো কেন করছো?
— কোথায় ফাজলামো করছি? আমিতো শুধু তোমার ক’ষ্ট গুলো সম্পর্কে জানতে চাইছি!
হঠাৎই ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠল ফাইজা। আচমকা ফাইজার কান্নায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রিশাদ। দ্রুত ফাইজার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
— হেই তুমি কাঁদছ কেন হঠাৎ? কাঁদে না প্লিজ?
ফাইজা নাক টেনে ফুপিয়ে বলল,

— আমার সত্যিই তোমার জন্য খুব ক’ষ্ট হয়েছে। তোমার সাথে এতোদিন কথা বলতে না পেরে মনে হয়েছিল ম’রে যাব। ভেবেই নিয়েছিলাম আমাদের হয়তো আর কখনো এক হওয়া হবে না*****উমমম**
হঠাৎই ফাইজার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিল রিশাদ। আচমকা চু*ম্বনে ফাইজার সমস্ত দেহ শিউরে উঠলো। লজ্জায়, অস্বস্তিতে ঠোঁট সরিয়ে নিতে চাইলে তার গলা সহ গাল আঁকড়ে ধরল রিশাদ। বেশ কিছুক্ষণ পর ছেঁড়ে দিয়ে বলল, — আর কখনো এসব বলবে না। আমরা এক হয়েছি। এখন থেকে সারাজীবনের জন্য এক হয়েই থাকবো। এই যে হাত ধরলাম (ফাইজার নরম হাতটা নিজের শক্তপোক্ত হাতের ভিতর আটকে ধরে) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই হাত ছাড়বো না।
ফাইজা শরীরের বেগে রিশাদ কে আষ্টেপৃষ্টে জাড়িয়ে ধরল। দীর্ঘ হেসে রিশাদও ফাইজাকে নিজের সাথে চেপে রাখল।

বাবার বুকের উপর লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে আয়রা। মেয়ের পিঠে একহাত ঠেকিয়ে অন্য হাতে ফোন টিপছে ফারিশ। মেয়েটা বাবার খুব আদুরে। বাবার কাছেই থাকতে পছন্দ করে বেশি। ডক্টর বলেছে আয়রা অরুণের থেকে তিন মিনিটের ছোট। ছোট বলেই হয়তো মেয়েটা এতো আহ্লাদী।
অরুণ কে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকলো মুসকান। ফারিশের কথায় আজ শাড়ি পড়েছে সে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে দেখতে। এতো রাত হয়ে গেছে ছেলেটা এখনও ঘুমায়নি। অরুণ এমনিতে চুপচাপ, কিন্তু ছটফট করে বেশি। সারাক্ষণ হাত-পা নাড়ায়। চেহারায়ও একটা চঞ্চল ভাব আছে। অরুণ কে কোল থেকে বিছানার মাঝে শুইয়ে চুলগুলো হাত খোঁপা করতে লাগল মুসকান। শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে একের পর এক ঘরের টুকিটাকি কাজ করতে লাগল। ফারিশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা জামা কাপড় গুলো একত্রিত করে ধুয়ার জন্য আলাদা করে রাখল। অরুণ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার মাম্মা কে দেখছে। হাত-পা নাড়িয়ে খেলছে। ছেলের এমন ছটফটানো দেখে ঘুমন্ত মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিল ফারিশ। ছেলের নরম তুলতুলে গালে চু’মু দিয়ে বলল,

— ঘুমাবে না পা’পা?
উত্তরে উল্টাপাল্টা স্বরে আওয়াজ তোলল অরুণ। দু’হাত নাড়িয়ে বাবাকে কি যেন বুঝাতে চাইলো। ছেলের কথা না বুঝলেও ঠোঁট এলিয়ে হাসল ফারিশ।
ঘরটা একটু গুছিয়ে ঠিকঠাক করে মেয়েকে সুন্দর মতো শুইয়ে দিল মুসকান। খাটের একপাশে শুয়ে ফারিশ কে ডেকে বলল,
— দেখি দিন ওকে আমার কাছে । সাথে নিয়ে না শুলে ঘুমাবে না।
অরুণ কে মুসকানের কাছে দিয়ে আধশোয়া হয়ে ফোন টিপতে লাগল ফারিশ। মুসকান সুইচ টিপে রুমের ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করে অরুণ কে ফিডিং করাতে লাগল। একসময় অরুণ ঘুমিয়ে গেলে তাকে ঠিক মতো শুইয়ে দিয়ে বিছানা থেকে উঠতে নিলেই ফারিশ এসে পুনরায় মুসকান কে খাটের সাথে চেপে ধরল। আচমকা ফারিশের এমন হা’মলায় ঘাবড়ে গেল মুসকান। আস্তে করে বলল,

— কি করছেন কি? বাচ্চারা উঠে যাবে সরেন!
ফারিশ সরলো না। বরণ মুসকানের উপর নিজের পুরো ভর ছেড়ে দিয়ে গলায় নাক ঘষে বলল,
— উঠবে না!
মুসকান ফারিশকে ঠেলে নিজের উপর থেকে সরানোর চেষ্টা করছে,
— আমি চেঞ্জ করবো সরেন।
আঙুলের ভাজে আঙুল ঢুকিয়ে বিছানার সাথে মুসকানকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরল ফারিশ। ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
— চে’ঞ্জ করানোর জন্যতো আমি আছি।
লজ্জায় মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল মুসকান,

— কি শুরু করলেন বলেন তো?
— রো/মাঞ্চ। মুসকানের গলার বাম পাশটায় ছোট ছোট চু’মু দিয়ে বলল ফারিশ।
মুসকানের নিশ্বাস ভারী হয়ে গেল। ফারিশের বুকের শার্ট মুঠোতে পুরে লহু স্বরে বলল,
— আমি ক্লান্ত এখন।
— প্রশান্তি দিতেই তো এসেছি!
— আপনি আসলেই একটা….
মুসকানের গালে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে স্লাইড করতে করতে মৃদু স্বরে বলল,

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩৯

— কী?
— কিছু না!
শব্দহীন হাসে ফারিশ। মুসকানের কানে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,,,
” অসম্ভব ভালোবাসি তোমায় বাবুদের আম্মা ”

সমাপ্ত