তোর প্রেমে উন্মাদ আমি পর্ব ১৬

তোর প্রেমে উন্মাদ আমি পর্ব ১৬
Raiha Zubair Ripti

পুরো রাত নির্ঘুমে কাটলো আরুর। ভোরের আজান কানে আসতেই রুমে ঢুকে ওজু করে নামাজ আদায় করে নেয়। তারপর বিছানায় শুতেই ঘুমেরা এসে হানা দেয়। এই ঘুম ভাঙে সকাল ১০ টার পরে। আড়মোড়া ভেঙে ঘড়িতে সময় দেখতেই চোখ কপালে উঠে যায় আরুর। সকালের রান্না তো করা হয় নি। তাহলে সবাই কি খেয়েছে? আর মামনি? সেও তো ডাকে নি।
আরু তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হয়। বসার ঘরে এসে দেখে বসার ঘর ফাঁকা। আর টেবিলে খাবার সাজানো। পরোটা, ডিম ভাজি,আর ডাল। আরু সন্ধ্যার রুমের দিকে গেলো। সন্ধ্যা বসে আছে। আরু এগিয়ে গেলো।

-” সরি মামনি, আসলে উঠতে পারি নি সকাল সকাল। তুমি রেঁধেছিলে সকালে?
সন্ধ্যা আরুর দিকে তাকালো।
-” না। ডাক্তার সাহেব হোটেল থেকে এনে দিয়ে গেছে।
-” ইশ কেনো যে সকালে ঘুমাতে গেলাম।
-” আহা এত অস্থির হচ্ছিস কেনো। কিছু হয় নি। রিলাক্স।
-” খাবার খেয়েছো?
-” না।
-” চলো খাবে।
আরু সন্ধ্যাকে ধরে খাবার টেবিলে নিয়ে আসলো। আরু খাবার প্লেটে বেড়ে চেয়ার টেনে বসে বলল-
-” মামনি শোনো।
-” হু বল।
-” তোমার ছেলে ফোন দিয়েছিল?
-” ভোরের দিকে দিয়েছিল ডাক্তার সাহেবের ফোনে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরুর মন চুপসে গেলো। সারা রাত সে অপেক্ষা করলো আরাধ্যর ফোনের। অথচ তাকে একবারও ফোন করলো না!
-” কথা হয়েছে তোমার সাথে? ঠিকমতো পৌঁছেছে?
-” আমার সাথে কথা হয় নি। আর ঠিক মত পৌঁছায়ছে। চিন্তা করিস না।
-” তোমার ছেলে তো আমায় ফোন দিলো না মামনি।
রাগ করে মন খারাপ করে বলল আরু। সন্ধ্যা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
-” দিবে নি ফোন। মন খারাপ করিস না।

আরু চুপচাপ খেয়ে প্লেট ধুয়ে। সন্ধ্যাকে তার রুমে দিয়ে নিজের রুমে আসলো। বিছানা থেকে ফোন নিয়ে আরাধ্যর নম্বরে কল লাগালো। ফোন বাজছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। মন আরো খারাপ হয়ে গেল। কয়েকবার দিলো ফোন। ফলাফল একই৷ আরু ফোন বিছানায় রেখে স্টাডি রুমে গেলো। হরেক রকমের বই এই রুমে। বিশেষ করে বেশি বই মেডিক্যাল টাইপের। আরাধ্য আর আষাঢ় পড়ে। আর কিছু বই আছে প্রবীণ লেখক দের। আরু সময় কাটানোর জন্য একটা বই নিয়ে সন্ধ্যার রুমে গেলো। বাহিরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। সন্ধ্যাকে নিয়ে সে বাগানে বসলো। বাগানের সবজির গাছ গুলোতে আজ ছোট ছোট সবজি দেখা যাচ্ছে, যেমন মরিচ গাছে মরিচ,বেগুন গাছে বেগুন,পেঁপে গাছে পেঁপে, লাউ গাছে লাউ। কয়েক দিন গেলেই বড় হয়ে যাবে। আরু বই টা পড়ে সন্ধ্যাকে শুনাতে লাগলো। সন্ধ্যা শুনলো। এদিকে আরশির স্কুলের ছুটির সময় হয়ে আসতেই ড্রাইভার কে বলল আরশিকে নিয়ে আসতে।
ড্রাইভার চলে গেলো আরশি কে আনতে। তবে আরশি কে একা আনে নি ড্রাইভার। সাথে এসেছে আয়ুশ। আরু আয়ুশ কে দেখে ভ্রু কুঁচকালো।

-” কিরে তুই এখানে?
আয়ুশ বোকা-সোকা মুখ করে বলল-
-” কেনো ইউ ডিড নট হ্যাপি আমাকে দেখে? বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তো দেখছি আমায় ভুলেই গেছ তুমি। আমি তো ভুলি নি তোমায়। সেজন্য চলে এসেছি।
-” নটাঙ্কি বাজ। আমাকে দেখতে এসেছিা নাকি আরশির জন্য এসেছিস আমি কি বুঝি না ভেবেছিস?
-” বুঝেছো ভালো কথা। এবার সেটিং করায় দাও তোমার ননদের সাথে।
-” জীবনেও না।
-” আমার এ জীবন তোমার ননদ ছাড়া যে বৃথা।
-” তাতে আমাদের কি? আমি তো আমার ননদ তোর কাছে দিব না। আমি ওর বিয়ে সুন্দর এক ছেলের সাথে দিব।
-” কেনো আমি কি সুন্দর না? কত মেয়ের ক্রাশ আমি জানো?
-” জেনে লাভ নেই আমার। আরশি তোমার না।
-” তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো আরশি কে আমার সাথে বিয়ে না দিলে দেখ।
-” ঝা’টা দিয়ে পি’টামু।
-” পিটাও। তাতেও রাজি।
-” পাবনার সিট একটা ব্যবস্থা করে রাখবো। যা ফ্রেশ হ। আমি খাবার দিচ্ছি।

আরু,আয়ুশ আর আরশি কে খাবার দিলো। দুজনে খাবার শেষ করে যে যার রুমে চলে গেল।
রাতের দিকে আরু আবার ফোন দিলো আরাধ্য কে। দু বার বেজেই কেটে গেল।তৃতীয় বার রিসিভ হলো। এতেই যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলো আরু। ওপাশ থেকে আরাধ্য বলে উঠল-
-” হ্যালো আরু?
মনে হলো কত বছর পর মানুষটার গলার স্বর শুনলো আরু।
-” কিরে শুনতে পারছিস?
-” হুম।
-” তো কথা বলছিস না কেনো?
আরু অভিমান জড়ানো কন্ঠে বলল-
-” ফোন দেন নি কেনো আমায়? বলিনি পৌঁছে ফোন দিতে?
-” নেট সমস্যা করছিল রে।
-” বাবাই কে তো ঠিকই ফোন করেছিলেন।

-” তোকে ফোন দিয়েছিলাম৷ ঢুকছিলো না। পরে বাবার ফোনে দিতেই ঢুকে গেল।
-” বুঝেছি তো।
-” কি বুঝেছিস?
-” চিন্তায় রাখতে ভালো লাগে আমায়?
-” ওমা কেনো? চিন্তা করছিলি নাকি আমায় নিয়ে?
আরু থতমত খেয়ে বলল-
-” করতেই পারি চিন্তা।
-” কেনো করবি চিন্তা?
-” সেটা চিন্তা কেই জিজ্ঞেস করুন। এখন বলুন কি করছেন?
-” কেবল ক্যাম্পে ফিরলাম। সারাদিন রোগী দেখে শরীর ক্লান্ত।
-” খেয়েছেন?
-” এসে খাইয়ে দিয়ে যা। হাত দিয়ে খাওয়ার মতন সময় ইচ্ছে করছে না নষ্ট করতে।
-” খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।
-” সব ভালো লাগা বাসায় রেখে আসছি। সেখানে খাবারে আর কি ভালো লাগা থাকবে।
-” মানে?
আরাধ্য মুচকি হেঁসে বলল-

-” মানে সিম্পল,,বাবা মা বোন কে বাসায় রেখে আসছি। সেটাই বললাম।
-” ওহ্। মন খারাপ হলো আরুর। লোকটার জন্য সে মরিয়া হয়ে যাচ্ছে আর লোকটা তাকে মিসই করছে না!
-” রাতে কেমন ঘুমালি? নিশ্চয়ই নাক ডেকে সকাল ১০ টা অব্দি।
আরু রাগ দেখিয়ে বলল-
-” হ্যাঁ নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাইছিলাম। শান্তিতে সারারাত।
-” আমি ঠিক জানতাম।
-” জেনে উপকৃত করলেন।
-” কি করছিস?
-” বসে আছি বেলকনিতে।
-” আজ তো জ্যোৎস্না নেই। সাথে প্রিয় মানুষ ও নেই। তাহলে বেলকনিতে বসে কি করছিস?
-” এমনি।

-” মন খারাপ নাকি?
-” থাকলেও তাতে আপনার কি?
-” চেষ্টা করতাম ভালো করার।
-” করুন তাহলে।
-” উমমম গান শুনবি?
-” শোনান।
-” হিন্দি গান ওক্কে? মিনিং বুঝিস তো?
-” আপনার কি আমাকে গাধা মনে হয় যে বুঝবো না।
-” গাধাই তো তুই।
-” গান শোনালে শোনান। তা না হলে আমি ফোন রাখলাম।
-” আচ্ছা শোগিটার টা আগে নিয়ে আসি।
-” গিটার! আপনার গিটার তো বাসায়।
-” আরে সৌরভ নিয়ে এসেছে আসার সময়। ফোনে থাক।
আরাধ্য গিটার চেয়ে আনলো সৌরভের থেকে৷ তারপর ক্যাম্পের বাহিরে চেয়ারে বসে গিটারে টুংটাং সুর তুলে গাইলো-

-” Taaron ko mohabbat ambar se
Phoolon ko mohabbat shabnam se
Jaise dil ko mohabbat dilbar se
Humein aise mohabbat hai tum se
Ab tum bhi kaho na kuch hum se
Sawan ko mohabbat badal se
Aankhon ko mohabbat kajal se
Peron ko mohabbat payal se
Humein aise mohabbat hai tum se
Humein aise mohabbat hai tum se..

-” শুনেছিস?
আরু ঠোঁট কামড়ে চুপ থেকে বলল-
-” হুম শুনেছি।
-” কিছু বুঝলি?
-” কিছুটা।
-” কি বুঝলি? বুঝা আমাকে।
-” এই তো ভালোবাসা বাসি।
-” কারেক্ট। কার সাথে কার বলতো?
-” দিলের সাথে দিলবার,পায়ের সাথে পায়েলের আর..
-” আর কি?
-” আপনার সাথে আমার?
আরাধ্য মুখ বাঁকিয়ে বলল-
-” এ্যাহ উনার সাথে আমার। রাত অনেক হলো যা ঘুমা।
আরু রাগী কন্ঠে বলল-

-” অসভ্য একটা পুরুষ আপনি।
-” আর তুই তো সভ্য নারী তাই না?
-” হ্যাঁ।
-” স্বপ্নে। রাখলাম। ভালো কথা খেয়েছিস?
-” হুমম।
-” আমি তো খাই নি। তুই খাইছিস কেনো?
-” আপনি কে যে আপনার আগে আমার খাওয়া যাবে না?
-” তোর একমাত্র জামাই আমি।
-” জাস্ট নামের।
-” কাজেরও চাচ্ছিস?
-” অবশ্যই।
-” ওক্কে। রাখছি।
-” আচ্ছা ফোন দিয়েন কিন্তু।
-” আমি কেনো দিব? তুই দিবি।
-” আমি দিলে তো পাই না আপনায়।
-” এই যে পেলি।
-” হঠাৎ মরিচীকার মতো পাই।
-” এতেই সন্তুষ্ট থাকতে শিখো মেয়ে। বেশি গুরুত্ব দিলে পরে পায়ে ঠেলবে।
-” মোটেও না।
-” তাহলে কি মাথায় করে রাখবি?

-” অবশ্যই।
-” লাল পানি টানি খেয়েছিস নাকি আজ আরু?
-” লাল পানি খেতে যাব কেনো?
-” না মানে এই যে আজ এভাবে কথা বলছিস।
-” কিভাবে কতা বলছি?
-” প্রেমিকার মতন।
-” আমি তো প্রেমিকাই। জাস্ট প্রেমিক নেই সেজন্য আপনায় বানাতে চাইছি। আপনি রাজি?
-” জীবনেও না।
-” তাহলে তেলের নদীতে ডুবে ম’রে যান।
-” বিধবা হওয়ার এত ইচ্ছে?
-” এমন জামাই থেকেই বা কি লাভ?
-” এত লাভ লোকসান খুঁজিস কেনো?
-” জীবনে খুঁজতে হয় লাভ লোকসান।
-” আচ্ছা পাগলী ঘুমা।
-” আপনিও খেয়ে ঘুমান।

আরু ফোন কেটে দিলো। ভালো লাগছে এখন। কিছুক্ষণ বেলকনিতে থেকে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে রান্নাবান্না করে খেয়েদেয়ে ভার্সিটি চলে আসে আরু। ক্লাস গুলো ঠিক মতন করে ক্লাস শেষে বের হতেই রনি ডেকে উঠলো। আরু পেছন তাকালো। রনি এগিয়ে এসে বলল-
-” ভুলেই গেছিস আরু বিয়ের পর। না ঠিকমতো ভার্সিটি আসিস আর না গ্রুপে মেসেজ দিস।
আরু স্মিত হেঁসে বলল-
-” সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকি রে।
-” বাব্বাহ বিয়ে করবি না করবি না বলে এখন সেই সংসার নিয়েই ব্যস্ত! ভীষণ চেঞ্জ এসেছে তোর মধ্যে।
-” তোর বিয়ে হোক। তখন তোর ভেতরও চেঞ্জ আসবে।
-” আচ্ছা চল আজ কোনো ক্যাফেতে বসা যাক। সাইফা,সাবু,মিনাল সবাই যাবে। সময় হবে?
-” আচ্ছা চল।
আরু রা সবাই মিলে ক্যাফে তে আসে। যে যার মতন গল্প করছে। আরু চুপচাপ শুনলো। কফি অর্ডার দেওয়ায় কফি চলে আসায় আরু কফি খেয়ে ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকতেই দেখলো আরাধ্য অনলাইনে। আরু মেসেজ দিলো-
-” কি ব্যপার অনলাইনে যে?

মেসেজ ডেলিভারি হলো কিন্তু সিন হলো না। মিনিট পাঁচেক পর দেখালো এক্টিভ ৭ মিনিটস এগো। আরু বুঝলো মহাশয় লাইনে নেই। আরো কিছুক্ষণ গল্প করে চলে আসলো বাসায়।
বাসায় আসতেই নতুন তিনটে মুখের দেখা পেলো আরু। বসার ঘরে বসে আছে একজন মহিলা ও একজন পুরুষ আর একটা ছেলে। আয়ুশের থেকে অনেকটা বড়ই হবে। মহিলাটার স্বামী আর ছেলে বোধহয় উনারা। আরুকে সন্ধ্যা দেখামাত্রই টেনে নিয়ে বলল-
-” শরিফা ও হচ্ছে আরু৷ কনার মেয়ে আর আমাদের আরাধ্যর বউ।
শরিফা আরুকে আপাদমস্তক পরখ করলো। মেয়েটা কথ বড় হয়ে গেছে। সেই ছোট থাকতে দেখে গেছে। বাহিরে দেশে থাকে সেজন্য বিয়েতে আসতে পারে নি। আরুকে দেখেই ব্যাগ থেকে একটা জুয়েলারির বক্স বের করে সেটা আরু হাতে তুলে দিয়ে থুতনিতে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বলল-
-” মাশা-আল্লাহ ভীষণ সুখী হও। রাত ভাইয়ার মেয়েটা কি মিষ্টি দেখতে হয়েছে।
আরাফাত তো সায় মিলিয়ে বলল-

-” আসলেই। সেই ছোট্ট থাকতে দেখে গেছি। চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেও চিনতে পারতাম না কেউ না বললে। তা আরাধ্য আষাঢ় কোথায়?
সন্ধ্যা জবাব দিলো-
-” ডাক্তার সাহেব আসতেছে। আর আরাধ্য তো এখানে নেই। চট্টগ্রাম গেছে।
-” ওহ্ ছেলেকেও ডক্টর বানিয়েছো বুঝি?
-” হ্যাঁ আপনার বন্ধু বানালো।
-” আমাদের কুনাল কে তো ডক্টরের লাইনে পড়াতেই পারলাম না। ব্যাটা আমার কমার্স নিয়ে পড়ছে। ব্যাংকার হবে।
-” কিসে পড়ে?
-” এবার টেনে পড়ে। বেশ ভালো স্টুডেন্ট কিন্তু কুনাল।

তোর প্রেমে উন্মাদ আমি পর্ব ১৫

-” মাশা-আল্লাহ, আমাদের কনার ছেলেটা একদম পড়াশোনা করতে চায় না। একবার দেখা হয়ে নিক জাস্ট আপনার সাথে দেখবেন আয়ুশ কি জিনিস। আপনার মাথা আউলে যাবে তার কথা শুনলে।
-” তাই নাকি? তাহলে তো দেখা করতেই হচ্ছে।
আরু কিছুক্ষণ বসে রুমে চলে আসলো। কুনাল ছেলেটা আয়ুশের থেকে বছর তিন-চারের বড় হবে। বেশ হ্যান্ডসাম এই বয়সেই। কেমন চুপচাপ এটিটিউড নিয়ে বসে ছিলো। কোনো কথা বললো না। আনইজি বোধ করছিল বোধহয়। প্রথম বার দেশে ফিরেছে। অচেনা সব সেজন্য বোধহয়।

তোর প্রেমে উন্মাদ আমি পর্ব ১৭