দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৬

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৬
আফরোজা আশা

ফাহাদের গাড়ি ঝড়ের বেগে চলছে। রাস্তায় অন্যান্য গাড়ি না থাকলেও কার আর বাইক চলছে মাঝে মধ্যে। সেগুলোকে একের পর এক ওভারটেক করছে ফাহাদ। এতো জোরে গাড়ি ছেড়েছে যে একটু এদিক-সেদিক হলে মারাত্মক দূর্ঘটনা ঘটবে।চোখ-মুখের অবস্থা ভয়ানক। গাড়ি একটানে এসে থামল দশ তলা বিলাসবহুল একটা বিল্ডিংয়ের সামনে। গাড়ি পার্ক না করেই গটগট পায়ে লিফটে চড়ে পাঁচ তলায় এসে থামে। পাঁচতলা পুরো ফ্লাটটা ওর আর ওর বড় ভাইয়ের। তবে এখানে ফাহাদ আসে না খুব একটা।

ওর বড় ভাই ফাহিমের নানা অবৈধ কাজ এখানে। সেসবে পরোয়া করে না ফাহাদ। জীবনে একবারই এসেছিল এই জায়গায় একজনের জন্য। আজ দ্বিতীয় বারের মতো পা রাখলো এখানে। গুন্ডা,মেয়েবাজ হলেও বড় ভাইয়ের মতো খারাপ মানসিকতা ওর নেই। কিন্তু আজ যেন মনে রাগ-ক্ষোভ কিছুতেই দমাতে পারছে না। পরণের শার্টের বোতাম একটা একটা করে খুলতে খুলতে গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই থমকে যায় ফাহাদ। চোখ খুলে হাতে আসতে চায় ওর। একি দেখছে ও। কোনো কিছু বলার আগেই আঘাত পড়ল কপালে। চেঁচিয়ে উঠল ফাহাদ। দুহাতে কপাল চেপে ধরল।
‘ আহহ! হোয়াট দ্যা হেল! ডাফার, মারছিস কেনো? ’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অপরপাশ থেকে ভয়াতুর গলার দৃঢ় আওয়াজ ভেসে এলো,
‘ আপনিও ওদের দলের। আমাকে মেরে ফেলতে চান আপনারা। এতো সাহস! জানেন আমি কে? ’
ফাহাদ কপাল থেকে হাত নামিয়ে চোখের সামনে ধরল। হাতে রক্ত। ভালোই লেগেছে ওর। মাথা ব্যাথা করছে, কানগুলো ঝনঝন শব্দ পাচ্ছে। হাত আবারো কপালে ঠেকিয়ে বলল,
‘ বেলা পাটোয়ারী। ডটার অফ রহমান পাটোয়ারী এন্ড আমেনা পাটোয়ারী। তিন বোনের ছোটজন আপনি। আপনার বাপ ফল ব্যবসায়ী। চাচা মিলের মালিক। আপনার ফুপি তালুকদার বাড়ির বউ। আমার জাতশত্রু দিগন্ত তালুকদারের রিলেটিভ আপনি। ’

কথাগুলোর মাঝে বেলা আবারো হাতে ধরে রাখা হকিস্টিকটা উঁচিয়ে ধরল ফাহাদকে পুনরায় আঘাত করার জন্য। তাতক্ষনাৎ সেটা ধরে ফেলল ফাহাদ। রাগান্বিত চাহনিতে চেয়ে ধমকে বলে উঠল,
‘ মুখ নেই! কথা না বলে মারছিস কেনো? এর বদলে আমি একটা মারলেই তো চোখে তারা দেখবি ডাফার। দে… ’
থেমে গেল ফাহাদের মুখের কথা। কানে ভাসল কিছুক্ষন আগে বলা বেলার কথাটা ‘ আপনিও ওদের দলের লোক। আপনারা আমাকে মেরে ফেলতে চান। ’
ধক করে উঠল ফাহাদের বুক। এক ঝটকা দিয়ে হকিস্টিকটা ফেলে দিল মেঝেতে। জোরে শব্দ করে পরে গেল সেটা। বেলার মুখোমুখি এসে অস্থির গলায় বলল,

‘ এখানে কি করে এলি? ত..তোকে ওরা ছুঁয়েছে? ’
তারপর আবার উন্মাদের মতো দুহাত দিয়ে বেলার গাল ধরে ভালোভাবে নজর বুলালো ওর সারা মুখ,গলা, ঘাড়। তেমন কোনো কিছু নেই। বেলার দুহাত উঠিয়ে মেলে ধরল চোখের সামনে। পুরো হাতটা দেখল কোনো দাগ নেই। শুধু হকিস্টিক ধরার কারণে হাতের তালু লাল হয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে ঢক গিলল ফাহাদ। কিছুক্ষন পর চোখ মেলে চাইল বেলার দিকে। ধরে রাখা হাতটা আস্তে করে ছেড়ে দিল।
বেলার সরল চোখে দেখছে ফাহাদকে। এতোক্ষন পর চিনতে পেরেছে। এই তো সেই লোক যে পার্কে ওকে মারতে চেয়েছিল। মনে পড়তেই চোখ বড় বড় হয়ে এলো বেলার। মূহুর্তের মাঝে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল,
‘ আ..আপনি সেদিন আমাকে মারতে পারেন নি বলে আজ আবারো কিডন্যাপ করে এনেছেন? আপনাকে তো আমি চিনি না তাহলে আমাকে মারতে চাইছেন কেনো? ’

ভ্রুঁদ্বয়ের মাঝে গাঢ় ভাজ পড়ে ফাহাদের। গমগমে গলায় বলে,
‘ মারলি তো তুই। আমি কি এখন পর্যন্ত একবারো তোর গায়ে হাত তুলেছি? ’
‘ না ’
‘ তাহলে? ’
‘ আপনি ভালো মানুষ না। মানুষকে মারেন। গুন্ডা, পঁচা লোক। ’
ঠোঁট বাঁকালো ফাহাদ। হালকা নমনীয় গলায় বলল,
‘ তুই ভালো বানিয়ে দে! ’
ফাহাদের কথা বুঝল না বেলা। না বুঝার চেষ্টা করল। ঠোঁট উল্টে ভাঙ্গা গলায় বলল,
‘ আমি আব্বুর কাছে যাবো। ’

নিরাশ হলো ফাহাদ। বলল কি আর জবাব পেল কি! বিরক্তি নিয়ে চোখ ঘুরিয়ে অপরদিকে তাকালো। দেখতে পেল ওর ভাই আর সাথে আরেকজন পড়ে আছে মেঝেতে। কিছু না বলে ওদের কাছে যাওয়ার জন্য বেলাকে পাশ কাটিয়ে দু’কদম বাড়াতেই পা জোড়া থেমে গেল।
মাথার পেছনে হাত দিয়ে তীব্র ব্যাথা নিয়ে আবারো পেছন ফিরে বেলার দিকে তাকালো। ফেলে দেওয়া স্টিকটা তুলে পুনরায় ফাহাদকে মেরেছে বেলা। দাঁতে দাঁত পিষল ফাহাদ। কিছু বলার চেষ্টা করলেও পারল না। আস্তে আস্তে পড়ে গেল মেঝেতে। চোখজোড়া বন্ধ করার আগে বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ কি যন্ত্রনা! কিছু না করেও মেয়েটা ফাহাদ দেওয়ানকে দু’বার পেটালো। করলে না জানি কি করবে! সব দোষ ওই শালা দিগন্তের। শালা শান্ত মেয়েটাকে নিজের মতো ডাকাত বানাচ্ছে। হারামজ…’ ফুরিয়ে গেল ফাহাদের দম। জ্ঞান হারিয়ে বাকি দুজনের মতো পড়ে রইল মেঝেতে। মাথা বেয়ে চুইয়ে পড়ল রক্ত।
ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপছে বেলা। ভীতু হলেও সেল্ফ প্রটেক্ট করতে জানে। অনেককিছুই শিখিয়েছে রহমান তাকে। সাথে স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজ থেকেও অনেক কিছু জেনেছে, শিখেছে ও। চোখে বেয়ে পড়া বিন্দুকণাগুলো দুহাতে মুছে নিয়ে ছুটে বের হলো ফ্লাট থেকে। ভাগ্য ভালো তাই দরজা খোলা পেয়েছে। ফাহাদ ফ্লাটে আসার পর দরজা আটকায় নি তাই খোলাই রয়ে গিয়েছে। কোনো দিকে না তাকিয়ে জান-প্রাণ ছুটিয়ে যেদিকে চোখ যায় সেদিকে ছুট লাগালো বেলা।

হাসপাতালে আসার পর থেকেই মাথা ঘুরছে মিতালীর। একদিকে মা অসুস্থ, অন্যদিকে বৃষ্টিকে নিয়ে ছোটাছুটি চলছে তার মাঝে বেলার খোঁজ পাচ্ছে না। এদিকে দুই মেয়ের কথা শুনেই জ্ঞান হারিয়েছে আমেনা। এখাকার সব ভার রাসেল পাটোয়ারীর উপর ছেড়ে হম্ভিতম্ভি করে বাড়ির দিকে ছুটছে
রহমান। ছোট মেয়ে বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবে! নিজেকে বড় অসহায় লাগছে তার। বাড়ি গিয়েই সব জায়গায় চেক করল। কোথাও নেই। কি করবে এখন? কোথায় যাবে? কোথায় গেলে মেয়েকে পাবে? রাত আটটার কাছাকাছি বাজে। বাড়িতে রেখে যাওয়া মেয়ে কোথায় চলে গেল! রহমানের মন কিছু মানতে চাইছে না। অবুঝের ন্যায় ভেতর থেকে বলছে এখনি মেয়েকে চাই মানে চাই। কিন্তু আফসোস বেলা নেই! হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়ল রহমান। কোথায় খুঁজবে? চেনা-জানা সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছে, পায় নি। পুলিশের কাছে গেলে কি হবে সেটা জানা আছে তার। ঘাড়ে কারো হাতের ছোঁয়া পেল। সেদিকে না তাকিয়েই ভাঙ্গা গলায় বলল,

‘ আমি আমার মেয়েদের সুরক্ষা দিতে পারি নি বড়আম্মা। একজনকে এতো বোঝানোর পরও, এতো সাপোর্ট দেওয়ার পরও আব্বুকে ভুল বুঝে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল, আরেকজন কোথায় আছে, কিভাবে আছে তাই জানি না। ’
দিহান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাণী বাবার পাশে বসে কান্নারত গলায় বলল,
‘ আল্লাহর পরে তুমি তোমার মেয়েদের বড় রক্ষক আব্বু। সময় নষ্ট করছো কেনো? বেলা নিয়ে আসো। ’
নেত্রজোড়া ছলছল করে উঠল রহমানের। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। হাহাকার করল মন। বেলাও হয়তো এভাবেই আব্বুকে ডাকছে, খুঁজছে। কিন্তু ওর আব্বু নেই ওর কাছে।

বিকেল থেকে রাত এতোটুকু সময়ের মাঝে বেলার ছোট মস্তিষ্ক বুঝল বাহিরের জগৎ এর মানুষ বিকৃত মস্তিষ্কের। পুরুষজাত নিয়ে ধারণা না থাকা বেলা আজ পুরুষের মধ্যে এতো ভেদাভেদ থাকে তা ভালোভাবে জানল। সারাজীবন আব্বু, ছোটাব্বুর ছায়ায় মানুষ হওয়া বেলা পাটোয়ারী আজ একের পর এক দেখছে ভিন্ন রূপধারী মানুষকে। অচেনা যে রাস্তা দিয়ে ছুটছিল সেটা বেশ ফাঁকা। হঠাৎ দুজন মানুষকে পেল। মন বলল এরা হয়তো ওকে আব্বুর কাছে পৌঁছে দিতে পারবে। এখানকার কিছুই তো চিনে না বেলা। আর রাতের অন্ধকারে ভয়ে হাত-পা জমে যাচ্ছে ওর। কিন্তু অভাগা বেলার ভাগ্য এবারো সাথ দিলো না। যে মানুষদের হাত থেকে পালিয়ে এলো সেরকম মানুষের খোপ্পড়েই আবার পড়ল।

বেলার পরনে যে সাদামাঠা সুতির থ্রিপিসটা ছিল সেটার একপাশ ছেঁড়া, মাথার খোঁপা এলোমেলো, হাত-পা কাঁপছে ভয়ংকরভাবে। ও জানে না এখন কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে! শহরের এই অংশে আগে কখনো আসেনি। অথচ এখন এখানে একা, নির্জন, দিকহারা।

দুটো মাতাল মানুষ ওর সামনে দাঁড়িয়ে। কি বাজে তাদের দৃষ্টি! বেলার পা দুটো আর চলতে চাইছে না। অনেকটা পথ দৌড়েছে। আর এখন ভয়ে তো আরো এক জায়গায় জমে গিয়েছে মনে হয়। বরফের ন্যায় শক্ত লাগছে পা গুলোকে। তবুও টেনে ছিঁচড়ে পেছনে ফেলে আসা রাস্তার দিকে আবারো ছুটতে চাইল। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না। রাস্তায়য় একটা উঁচু স্পিড ব্রেকারের সাথে পা বেঁধে মুখ থুবরে পড়ে গেল। ‘ আব্বুউউউ ’ বলে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল বেলা। হাত-পা ছিলে গিয়েছে। আরো অনেক জায়গায় ব্যাথা পেয়েছে। কংক্রিটের তৈরি পাকা রাস্তায় জোরে হোঁচট খেয়ে পড়েছে। নিমিষেই অবস্থা নাজেহাল হয়ে এসেছে ওর। কাঁদতে কাঁদতে বারং বার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে একি ডাক,

‘ আব্বু ’
এই সময়ের মাঝে মাতালদুটো চলে এসেছে বেলার কাছাকাছি। একজন লোভাতুর চাহনি ফেলে বেলাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়াতে গেলেই একটা শক্তপোক্ত হাত ধরে ফেলল ওই কালো হাতটাকে। উল্টো দিকে বাঁকিয়ে দিল এক মোচড়। মোট মোট শব্দ করে উঠল হাত, সেই সাথে লোকটা চিৎকার ভেসে উঠল।
হাতে থাকা বড় সাইজের ইটটা দিয়ে সমান তালে একের পর এক আঘাত হানতে শুরু করল দুই মাতালকে। হাত-চোখ-মুখ-নাক থেতলিয়ে দিল কয়েক মিনিটের মাঝে। এতেও ক্ষান্ত হলো না মন। দুর্বল জায়গা বরাবর পা দিয়ে আঘাত করল। লোক দুটোর আত্মচিৎকারে ভারী হয়ে গেল পরিবেশটা।
মারার পরে হাতের ইটটা দূরে ছুড়ে দিল। বেলার কাছে গিয়ে ওকে আলতো হাতে তুলে বুকের কাছে নিয়ে চেপে ধরল নিজের সাথে। আহ্লাদী বেলা ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে উঠল। কান্নারত আর্তনাদ করে অভিযোগী গলায় বলে উঠল,
‘ ওরা খুব পঁচা আব্বু। ’

আদরের মেয়ের ভাঙা গলা শুনে বুক ফেটে খানখান হয়ে গেল রহমানের। মেয়েকে আরো ভাবে আগলে ধরল। ভরসার এক হাত মাথায় রেখে আরেক হাত বেলার ছেঁচে গিয়ে রক্ত গড়ানো হাতটা ধরল। মুখের সামনে এনে সেখানে দুটো স্নেহের পরশ দিয়ে কেঁদে উঠল রহমান। ভঙ্গুর গলায় আওড়ালো,
‘ আমার আম্মা। আমার ছোট আম্মা। ’
বেলাও ঠোঁট ভেঙে আরো জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠল। আবারো আব্বুর কাছে অভিযোগ করল,
‘ ওরা বাজে কথা বলেছে আব্বু। ’
রহমান মেয়ের ছোট্ট শরীরটাতে কোলে নিয়ে বলল,
‘ আব্বু ওদের মেরেছে খুব। ’
বেলা বেদনাদায়ক স্বরে বলল,
‘ এরা না। এদের জন্য আমি পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি। আর ওই পঁচা লোকগুলো আমাকে অনেক বাজে কথা বলেছে। ’

কথাগুলো যেন তীরের ফলার মতো আঘাত হানল রহমানের বুকে। বেলাকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো রহমান। সব কথা পড়ে শুনবে। বেলার হাত-পায়ের অবস্থা ভালো না। জায়গায় জায়গায় জখম। পরণের থ্রিপিস টারও নাস্তা-নাবুদ হালত। বুক থেকে পেটের কাছে ভিজে উঠেছে। বুঝতে বাকি নেই রহমানের রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ার কারণে বুক-পেট ক্ষত হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে আশ্বস্ত গলায় কান্নারত মেয়েকে বলল,
‘ আব্বু এসেছে তো ছোটআম্মার কাছে। আর কাঁদতে নেই। আব্বু ঠিক করে দিবে সব। আর কেউ আপনার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাবে না। ’

বাবার আদুরে ছানা বেলা পাটোয়ারী তাতক্ষনাৎ বাবার বুকে মুখ গুজে চুপ হয়ে গেল। ক্লান্তিতে ভেঙে আসা শরীরটা ছেড়ে দিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল। আর কে পায় ওকে। আব্বু আছে তো দুনিয়া ঠিক।
দূর থেকে বাপ-মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে দিগন্ত। দুহাতে মুখ চেপে ধরে সীটে গা এলিয়ে দিল। মুখে দুটো ডলা মেরে নামিয়ে নিল হাত। চোখ বন্ধ রেখেই বলে উঠল,
‘ নাদানের ঘরে নাদান জন্মেছে, দেখেছিস। পুরুষ মানুষ হয়ে কাঁদছে। জানে না, পুরুষদের কাঁদতে নেই। এই বাপকে নিয়েই আবার গর্বে বুক ফুলিয়ে বেড়ায় ওই বেয়াদপটা। ’
রায়হান হতভম্বের ন্যায় দিগন্তের দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ তাহলে তোর চোখের কোণে পানি কেনো? ’
উত্তর এলো তখনি, ‘ ওর কাছে পৌঁছাতে দেরি করে ফেলেছি। ’

‘ এখনি যে বললি পুরুষের কাঁদতে নেই। ’
‘ আমি কাঁদি নি। ’
‘ তাহলে? এটাও বেলার বাপের দোষ। তার কারণেই তোর চোখের কোণ চিকচিক করছে? ’
একবাক্যে স্বীকারোক্তি দিগন্তের, ‘ হ্যাঁ ’
মুখ বেঁকে গেল রায়হানের। অবাক গলায় শুধালো,
‘ কিভাবে? ’
ঝট করে চোখ খুলল দিগন্ত। বাপ-মেয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টি ফেলে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

‘ একটা যুবতি মেয়েকে বাড়িতে একা রেখে যায় কিভাবে? এটা কোনো ধরণের বিবেকবান আদর্শ বাপের কাজ? এক নাদান পয়দা করছে। সেটা আবার আমার আমানত। ছোট বলে আমার আমানত তার কাছে এখনো। সেই আমানতের আবার খেয়ানত করে। এরকম একটা মানুষ আর তার পয়দা করা বেয়াদপ এক মেয়ের পাল্লায় আমি কিভাবে পড়লাম? না পাড়ছি সইতে, না পারছি কইতে। শুধু এদের আহারো বিষ দেখছি আর নিজের মনের সাথে, জীবনের সাথে যুদ্ধ করছি। ’
-‘ তুলে নিয়ে আয় ’

-‘ যেখানে আমাকে নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই সেখানে তুলে এনে কি করব? জোর করব! ওর বাপ এমনিই তুলে দিবে ওকে আমার হাতে। কাউকে জোর করবে না এই দিগন্ত তালুকদার। ওই বেয়াদপকে তো কখনোই না। নাইবা ওর কাছে যাবো। শুধু দুইটা মেয়ে নিয়ে দেখিয়ে দিবো ওর বাপকে আদর্শ বাপ কাকে বলে। ’
‘ এখনি না বলবি কাছে যাবি না। বাচ্চা কি তাহলে আসমান থেকে তোর কোলে পড়বে? ’
মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তিতে চোখমুখ কুঞ্চিত করে নিল দিগন্ত।
ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ তোকে এতো ডিটেলস কেনো বলব বে? দিগন্ত যাবে না কিন্তু বেলা! বেলাকে তো সেই দিগন্তের সীমানায় এসেই ডুবতে হবে। দিগন্তের কোল না ঘেঁষে যে বেলা অস্ত যেতে পারবে না। আমি যাবো না বলেছি। তাই বলে কি ও আসবে না নাকি!’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৫

রায়হান ভাবুক গলায় বলল, ‘ যদি না আসে!’
ঘাড় বাঁকিয়ে রাগান্বিত চোখে চাইল দিগন্ত। হিশিসিয়ে বলল, ‘শালা! ঠাডা পড়ুক তোর মুখে! ’
আরেক উল্টো রাস্তায় দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা গাড়ি। গাড়ির কাঁচ জানালা দিয়ে দুই বাপ-মেয়েকে গাঢ় দৃষ্টি ফেলে দেখছে ফাহাদ। ঘাড়ের কাছে কিছুটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আবার ছুট লাগিয়েছে বেলাকে খোঁজার জন্য। তীব্র মাথা যন্ত্রনা নিয়ে সীটের সাথে পুরো শরীরের ভর ছেড়ে দিল। এই একটা বাচ্চা মেয়ে ফাহাদ দেওয়ানের মাথা ফাটালো দুবার। এদিকে আবার বাপ অন্যেদের ফাটালো। ঠোঁট এলিয়ে আপন-মনে বিড়বিড় করে আওড়ালো,
‘ বাপ কা বেটি নাকি বেটি কা বাপ! যাই হোক, ফাহাদ দেওয়ানের মন কেড়েছে দুটোই। ’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৭