দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২
আফরোজা আশা

রাত বারোটার উপরে বাজে। এতো রাতে শাওয়ার নিচ্ছে দিগন্ত। শাওয়ার শেষে টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হলো। বের হতেই মিতালীকে পেল কফি হাতে। টাওয়ালটা সোফার উপর ছুড়ে দিয়ে কফির মগটা নিল। মিতালী উসখুস করছে কিছু বলার জন্য। দিগন্ত কফিতে সিপ দিতে দিতে ভরাট গলায় বলল,
“ কি বলতে চাও বলে ফেলো। ”
মিতালী দিগন্তের দিকে দু’পা এগিয়ে এসে বলল,

“ আর কতদিন এমন এলোমেলো জীবন-যাপন করবি, দিগু। বয়স ৩০ ছুঁলো বলে। এখনো জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছিস তুই। আজো তোর বাবা কি রাগারাগিটাই না করল! কেনো এরকম করছিস বল তো? শেষমেষ সবাই এসে আমাকেই বলবে, আমি তোকে মানুষ করতে ব্যর্থ হয়েছি। নিজের ছেলে না বলে তোকে হেয়ালি করেছি। আচ্ছা তুই বলতো বাপু, তোর আর দিহানের মাঝে আমি কখনো কোনো পার্থক্য করেছি? ”
নিয়ম মাফিক প্রতিদিন এই কথাগুলো বলবেই মিতালী। তাই দিগন্ত গায়ে লাগালো না কথাগুলো । এসব ওর বেশ জানা। তাও মিতালীকে শান্ত করতে ছোট করে উত্তর করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ না। ”
দিগন্তের উত্তর শুনে আবারো চড়াও হলো মিতালী। নাক টানতে টানতে বলল,
“ তাহলে কেনো অফিসে যাস না। দিহান কত সুন্দর অফিসে যাচ্ছে। নিজের সবকিছু ও গুছিয়ে নিয়েছে কিন্তু তুই! তুই কি করছিস? এমন ছন্নছাড়া জীবন বেঁছে নিলি কেনো? লোকে তোকে গুন্ডা নামে চিনে। তোর নামের সাথে গুন্ডা শব্দটা লাগলো কেনো বল? আজ পাশের বাড়ির ভাবি তোকে গুন্ডা বলল আমার সামনে। জানিস কত কষ্ট পেয়েছি আমি। ”

মিতালীর ফ্যাচ ফ্যাচ কান্নায় বিরক্ত হলো দিগন্ত। তবুও ঠান্ডা গলায় বলল, “ আহা! গুন্ডাকে গুন্ডা বলেছে এতে কষ্ট পাওয়ার কি হলো। ভালো লাগছে না আমার। যাও ঘুমিয়ে পড়ো।”
মিতালী রাগী গলায় আওড়ালো, “খবরদার দিগু! একদম এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবি না। তুই কি ভেবেছিস, তুই বেপরোয়া জীবন-যাপন করবি আর আমার ভাই তার মেয়েকে নাচতে নাচতে এমন ছেলের হাতে তার মেয়েকে দিয়ে দিবে। কখনোই না! তোকে এমনিও পছন্দ করে না বড়ভাই। তার উপর বেলা তার কলিজার এক টুকরো। আদরের মেয়েকে তোর মতো বেকার, গুন্ডা, ছন্নছাড়া ছেলের হাতে কিছুতেই দিবে না। ”
-“ ভালোভাবে না দিলে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। আফটার অল, গুন্ডা উপাধি নিয়ে ঘুরি। এসব আহামরি কিছু নয়, তাই না!” ভাবলেশহীন ভাবে বলল দিগন্ত।
দাঁতে দাঁত চাপলো মিতালী। অগ্নিঝরা কণ্ঠে বলল, “ নেহাৎ বড় হয়ে গিয়েছিস। নাহলে তোর এই নির্বোধ কথাটার জন্য পিঠের ছাল তুলতাম।”

তারপর হুট করে কিছু মনে পড়তেই তড়িঘড়ি করে দিগন্তকে বলল,“ হে রে দিগু! তখন কি যেন একটা বললি না বেলা কে নিয়ে। কি হয়েছে? ”
মিতালীর কথায় বেলার তখনকার ঘটনাটা মনে পড়ে গেল দিগন্তের। ঠাণ্ডা মেজাজটা হুট করে চটে গেল আবারো। মিতালীর দিকে তাকিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“ যৌবনের রং ধরেছে তোমার বেয়াদপ ভাতিজীর মনে। মনটা চাইছে কানের নিচে মেরে আসি! কত বড় সাহস ওর! আজ আমার সামনে রায়হানকে প্রপোজ করেছে। তাও বলে কিনা তার হালি হালি বাচ্চার মা হবে। আর এই অসভ্য মেয়েটাকে তুমি বাচ্চা বাচ্চা বলে মুখে ফেনা তোলো আমার সামনে। পেঁকে নষ্ট হয়ে গিয়েছে বেয়াদপটা। ”
দিগন্তের রাগ আর কথা শুনে হতভম্বের ন্যায় কিছুক্ষন চেয়ে থাকল মিতালী। তারপর হুট করে জোরে হেসে দিল।
-“ আশ্চর্য! হাসছো কেনো?”

মিতালী হাসতে হাসতেই বলল, “ সেকিরে দিগু! তোর খাঁচার পাখি অন্যের ঘরের দরজায় ঠকঠক করছে যে।
ঠিক হয়েছে, বোঝ এবার! কতবার বলছি একটু ভালোভাবে চলাফেরা কর, শুনিস আমার কথা! নে দেখ এখন, বেলার মন তোর কাছে না আটকে রায়হানের কাছে আটকেছে। বলেছিলাম না, ধমকা-ধমকি করে, রাগীভাবে কথা বলিস না ওর সাথে। মেয়েটা বড্ড সরল আর নাজুক বুঝলি। এসব একদমি নিতে পারে না। ”
-“এতো কিছু আমি বুঝি না। লাগাম টানো তোমার বেয়াদপ ভাতিজীকে। প্রথমবার বলে বেঁচে গিয়েছে। এরকম ভুল আবার করলে জানে মেরে ফেলব।”

-“ এই.. এই গুন্ডাগিরির জন্যই তো, বেলা দেখতে পারে না তোকে। আমি যে তোর বিষয়ে কথা বলব পারছি সেটা? একে তো বয়সের এতো পার্থক্য। মাত্র ১৬ তে পা দিয়েছে মেয়েটা আর তুই ৩০ এর দামড়া ছেলে। এটার জন্য প্রথমেই বড়ভাই মানা করে দিবে। তোর স্বভাব, অভ্যাস কিছুই পছন্দ নয় তার, তা আমি বেশ ভালো করে বুঝি।”
দিগন্ত মাত্রাতিরিক্ত চটে গিয়ে বলল, “কারো পছন্দ-অপছন্দের জন্য আমি আমার লাইফস্টাইল পাল্টাতে পারব না। আমি যেরকম সেরকমই ভালো। তোমার বেয়াদপ ভাতিজীকে আমি বলিনি, আমার সামনে এসে রূপের বাহার দেখিয়ে আমাকে ওর জালে ফাঁসাতে। ও নিজে যেচে এসেছে আমার জীবনে। এখন আগুনে তো পুড়তেই হবে। ওর বাপ মানবে, না মানবে ওসব বাল দিয়ে আমার কাজ নেই। আমার ভালোর জন্য ওকে চাই মানে চাই। এখন তুমি কি করবে তোমার ব্যাপার। ছোট বলে সময় দিয়েছিলাম কিন্তু ও কি করে বেড়াচ্ছে! প্রেমে করবে বেয়াদপটা, মেরে প্রেম করার সাধ মিটইয়ে দিবো একদম, অসভ্য মেয়ে মানুষ।”

মিতালী বুঝল দিগন্তের মাথা গরম হয়ে গিয়েছে। তাই আপাতত এই বিষয় আর কথা না বাড়ানোই ভালো। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
“ আচ্ছা ওসব আমি বুঝব। এখন চল খেয়ে নিবি। আমার ঘুম পেয়েছে খুব। তোকে খাইয়ে ঘুমাবো। চল, চল দেরি করিস না। ”
-“ ঘুমিয়ে পড়ো। আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। বারণ করেছি না, আমার জন্য এতো রাত অব্দি অপেক্ষা করবে না। কথা শোনো না কেনো? বিরক্ত লাগে এসব।”
-“ হ্যাঁ সেই! মনি অপেক্ষা করে সেজন্য বলতে পারলি এ কথাখানা। আমার জায়গায় তোর বউ থাকলে দেখব কি বলিস তখন ,” চোখ সরু করে বলল মিতালী।
না চাইতেও ঠোঁটজোড়া হালকা ছাড়িয়ে গেল দিগন্তের। পরক্ষনেই স্বাভাবিক হয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

“ বাড়িতে বউ আনবে আজ বাদে কাল। এখনো এতো হিংসে কেনো? হুমউ!”
মিতালী দিগন্তের হাত থেকে ফাঁকা মগটা নিয়ে বলল, “ এজন্য তো বাইরের মেয়ে আনব না। দুটো ছেলের জন্য ঘরের দুই মেয়ে আনব। তারপর আমরা তিনজন মিলে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবো তোদের দেখে নিস,” বলে উল্টো ঘুরে চলে গেল মিতালী।
দিগন্ত গলা বাড়িয়ে বলল, “ তোমার বেয়াদপ ভাতিজীকে সাবধান করবে। আমি কিন্তু একদম ভালো মানুষ না।”
মিতালীও গলা উচিয়ে গেটের বাইরে থেকে বলল, “ খেতে আয় আগে। খেয়েদেয়ে ভালো হবি না খারাপ হবি হোস। আমি ঘুমিয়ে পড়ব তাতে। চটজলদি নিচে নাম দিগু নাহলে আমি তোর বাপ-চাচাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে যুদ্ধ লাগিয়ে দিবো তোর সাথে। তখন করিস আমার বেয়াদপ ভাতিজীকে বিয়ে। ”

বিরক্তিতে চিরচিরিয়ে উঠল দিগন্ত। মুখ দিয়ে ‘চুউউউ!’ শব্দ বের করে নিচে দিকে গেল। মিতালী রান্নাঘরে তরকারি গরম করতে করতে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখল দিগন্ত চেয়ারে বসে মোবাইল ঘাটছে। স্মিথ হাসল। বেশ একটা অস্ত্র পেয়েছে, বেলার নাম দিয়ে জেদি দিগন্তকে সোজা লাইনে আনতে পারছে।

দিগন্ত যখন প্রথম বলেছিল ও বেলাকে পছন্দ করে, মিতালী সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল। একরোখা, রাগী, জেদি দিগন্ত তালুকদার শেষমেষ প্রেমে পড়েছে এ যেন অবিশ্বাস্য ছিল মিতালীর কাছে। বেলার ১৪ তম জন্মদিনে দিগন্ত মিতালীর কাছে প্রকাশ করেছিল ও বেলাকে চায়। সেই থেকে মিতালী যতটা খুশি ততটাই ভীত। পাটোয়ারী বাড়ির সবাইকে খুব ভালোভাবে চেনা ওর। রহমান পাটোয়ারী কিছুতেই বেলাকে দিগন্তের হাতে দিবে না। দিগন্ত আর বেলার বয়স পার্থক্য দেখলে যে কেউ নাকোচ করে দিবে। সাথে আবার দিগন্তের উচ্ছন্নে যাওয়া চলাফেরা। কি করবে, না করবে খুঁজে পায় না মিতালী। দিগন্তকে ও পেটে ধরেনি এই যা! কিন্তু সেই ছোট থেকে নিজ হাতে একটু একটু করে গড়েছে ওকে। দিহান দিগন্তের থেকে এক বছরের ছোট।

দুই ছেলেকে একহাতে সামলেছে মিতালী। কিন্তু দিগন্তের রাগ, জেদে আর একরোখা মনোভাবের সাথে পেরে ওঠেনি। ছেলেটা পুরোপুরি ওর মায়ের মতো হয়েছে । মিতালীর বড় জা সুফিয়া পাটোয়ারী মারা যায়, দিগন্তের যখন পাঁচ বছর বয়স। দু’জা জা কম বোন বেশি ছিল। একে অপরকে খুব সম্মান দিয়ে চলত। হঠাৎ সুফিয়া ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। রোগ ধরা পরার কিছুদিন পরেই ইহকালের মায়া ত্যাগ করে। তবে মারা যাওয়ার আগে দিগন্তকে মিতালীর হাতে দিয়ে যায়। সেই থেকে আজ অব্দি মিতালী নিজ দ্বায়িত্ব পালন করছেই। বাড়ির কেউ দিগন্তের সাথে টু শব্দটিও করতে পারে না। কারো কথা শোনেই না সে। টুকটাক একটু মিতালীর কথাই শোনে।

-“হয়েছে আর কত দিবে! খেয়ে এসেছি আমি।”
দিগন্তের কথায় হুশ ফিরল মিতালীর তরকারির বাটিটা টেবিলে রেখে ওর পাশে চেয়ার টেনে বসল। কিছুটা চিন্তিত গলায় বলল,
“ দিগু, ভাবছি কাল বড়ভাইয়ের সাথে কথা বলব। একটা সুযোগ আছে তোর আর বেলার বিয়ে ঠিক করার। ”
দিগন্ত খাম-খেয়ালিভাবে খেতে খেতে বলল, “ কি? ”
-“ বাণী আর দিহানের যৌতুক হিসেবে বেলাকে তোর জন্য চাইব।”

খাওয়া থেমে গেল দিগন্তের। মিতালীর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল, “ কিচ্ছু করতে হবে না তোমাকে। ও এখনো অনেক ছোট। স্বামী, সংসার সামলানোর মতো অভিজ্ঞতা এখনো হয়নি। আমি চাই না এখনি এসব কিছু জানা জানি হোক। তুমি শুধু তোমার বেয়াদপ ভাতিজীকে চোখে চোখে রেখো। ”
-“ আমার ভয় হয়! বড়ভাই যদি ভালো ছেলে পেয়ে বেলাকে অন্য কোথায় বিয়ে দিতে চায়, তখন কি করব?”
পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দিগন্ত ভাবাবেগহীনভাবে বলল,
“ আমি থাকতে ওসব কিছু হবে না। না আমি ওকে ওর ক্যারিয়ার গড়তে বাঁধা দিবো, না অন্য কাউকে সে সুযোগ দিবো। ও মুক্ত পাখির ন্যায় ওর স্বপ্নের দিকে আগাবে, তাতে সাথ দিবো আমি। কিন্তু মনের সব অনুভূতির শিকল আমার কাছে বাঁধা থাকবে। আমি ওর জীবনে, শিকল গাড়তে চাই না। ওর মনগহীনে অন্তরালে দিগন্ত তালুকদারের সম্পূর্ণ অস্তিত্ব দেখতে চাই।”

মিতালী অবাক হয়ে বলল, “ তোর এই প্রেমিক রূপ দেখে আমি এতো অবাক হই দিগু। কেউ কি আদোও জানে রগচটা দিগন্ত তালুকদার একটা বাচ্চা মেয়ের প্রেমে ডুব দিয়েছে! ”
-“ জানে। রায়হান আর তুমি শুরু থেকে শেষ অব্দি সব জানো। ”
মুচকি হাসল মিতালী। সবার কাছে দিগন্ত যাই হোক না কেনো মনির কাছে এখনো ছোট দিগুই রয়ে গেল। জীবনে যা ঘটবে সবকিছুর খবর মিতালীই আগে জানবে।
খাওয়া শেষ দিগন্তের। মিতালী ওর দিকে টিস্যুর বক্স এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“ তুই জানিস বেলার স্বপ্ন কি? আমাদের কাউকে তো কিচ্ছুটি বলেনি এখনো। ”
দিগন্ত হাত মুছতে মুছতে একপলক মিতালীর দিকে তাকিয়ে বলল,

“ ওর বিষয়ে এ টু জেড আমার ঠোঁটের আগালে। এমনকি ও যা জানে না তাও। ”
-“ বেশ পাগলাটে প্রেমিক দেখছি। ”
চোখজোড়া সরু হয়ে গেল দিগন্তের। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল,

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১

“ প্রেমিক কোনো কালেই হব না। না প্রেম করব। দিগন্ত তালুকদারের কাছে প্রেমের কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ, প্রেম-প্রেমিক শব্দযুগলের সীমাবদ্ধতা আছে কিন্তু তোমার বেয়াদপ ভাতিজীর জন্য আমার মন কুঠুরিতে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ”
আর দাঁড়ালো না দিগন্ত। কথা শেষ করেই, মিতালীকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে রুমের দিকে পা বাড়ালো।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩