দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২৮
আফরোজা আশা
‘ দিগন্ত বাজান! ’
বহু পরিচিত ডাক শুনে পাশ ফিরে চাইলো দিগন্ত। ঠোঁট জোড়া হালকা প্রসারিত করে চোখে থেকে সানগ্লাস টেনে খুলল। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘ কেমন আছো রায়কাকা? ’
সামনে দাঁড়ানো ষাটোর্ধ বৃদ্ধের দৃষ্টি টলমলে। কিছু আবেগী গলায় বলল,
‘ ভালা আছি। তোমারে দেইখা আরো ভালা হইয়া গেছি। সেই যে গেলা আর তো এ মুখো হওনি। এতোদিন পর এই গেট দিয়া তোমারে ঢুকতে দেইখা কি যে ভালা লাগতাছে বাজান। ’
পরক্ষনে রায়হানকে নজরে আসতে পান খাওয়া লাল ঠোঁটজোড়া বিশাল প্রসারিত হলো। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
’ রায়হান বাজান ও আইছো। আজ সুরুজ কোনদিকে উঠছিলো? দুইজনে একসাথে আইলা। কি যে খুশি লাগতাছে!’
রায়হান হালকা হেসে বলল,
‘ রায়কাকার দেখি এখনো আমাদের মনে রেখেছে। বয়স তো অনেক হলো কাকা! তুমি এখনো এই কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে ডিউটি করছোই! ’
‘ আগে তো একা থাকতাম। এহন আরো দুইজন রাখছে। আগের মতো বেশি খাটার লাগে না। আইজ পরীক্ষা দেইখা আমাতে এইহানে রাইখা বাকি দুইজন সামনে আছে। ’
দিগন্ত কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিল কিন্তু তার আগেই রায়কাকা জিজ্ঞেস করল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ তোমরা আইলা। মনারে আনলা না? হের কি বিয়া হইয়া গেছে গা। আহা! মাইয়াডা যেমন সুন্দর হের গানের গলাও তেমন সুন্দর আছিল। মেলা দিন থাইকা হের গান শুনি নাই। ’
দিগন্তের চোয়াল শক্ত হলো। রায়হান তড়িঘড়ি করে বলল,
‘ পরীক্ষা শেষ হলো বলে। পি.জে স্যারের সাথে দেখা করব। পরে আবার কথা হবে রায়কাকা। ভালো থেকো। ’
দিগন্ত আর টু শব্দও করল না। সামনের দিকে হাঁটা লাগালো। ওর সাথে রায়হানও এলো। দিগন্ত অনুভূতিহীনের ন্যায় হাঁটছে। চোখ শুধু রাস্তার দিকে। আশেপাশে কোথাও তাকাচ্ছে না। তাকালেই হয়তো পুরনো কোনো স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। সোজা এসে থামলো একটা রুমের সামনে। উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা প্রফেসর ড. জহিরুল দেওয়ান। মেলে রাখা দরজায় আঙুলের টোকা দিয়ে দুবার নক করল দিগন্ত।
শব্দ শুনে চশমা পরিহিত চোখজোড়া তুলে জহিরুল তাকালো গেয়ের দিকে। রায়হান আর দিগন্তকে দেখে চাওড়া হাসল। অতঃপর আমোদিত গলায় বলল,
‘ ওয়েলকাম এগেইন বয়ে’স। মনিটরে এতোক্ষন তোমাদের আগমন দেখছিলাম। কাম কাম!’
দিগন্ত কেমন যেন থমথমে মুখে মাথা নাড়িয়ে ভেতরে ঢুকল। রায়হানও ওর সাথে ঢুকল। ঘরে ঢুকে চারপাশটা একবার চোখ বুলালো রায়হান। ঠিক আগের মতোই সাজানো। বইয়ের র্যাক, বাঁ পাশে ছোট খাট টেবিলে কিছু গবেষণাপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা, দেয়ালে ঝুলছে ধূসর ফ্রেমে আঁটা পুরোনো একটা সার্টিফিকেট আর তার নিচে পজড-ফটো।ছাত্রদের সঙ্গে প্রফেসরের একগুচ্ছ হাসিমুখের মুহূর্ত।
রায়হান জহিরুলের সামনে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
‘ সব দেখছি আগের মতোই। কোনো চেঞ্জ নেই। ’
‘ সবার টেস্ট তো তোমাদের মতো পরিবর্তনশীল নয়। ’
সূক্ষ্ম খোঁচাটা দিগন্ত-রায়হান দুজনেই বেশ ভালোভাবে ধরতে পারল। দিগন্ত ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
‘ টেস্ট পরিবর্তন করি নি। নিজেকেই পরিবর্তন করেছি। ’
-‘ এটা আবার গর্ব করে বলছো? ভার্সিটি টপার হয়ে কি করলে তোমরা? তোমাদের সে পরিচয় কেউ জানেই না। অথচ গুন্ডা দেখিয়ে দিতে বললে বিনা সময়ব্যয়ে তোমাদের দেখিয়ে দেয়। ’
রায়হান বুকে দুহাত চেপে আয়েসী ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বসে বলল,
‘ তোমাদের বলতে? আপনার বংশের মাস্তানকেও বোঝাচ্ছেন নাকি স্যার? ’
জহিরুল হালকা হেসে বলল, ‘ ওকে তো তাও মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু তোমরা দুটো একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিলে। এক মেয়ের জন্য কতগুলো জীবন নষ্ট। ’
দিগন্ত জহিরুলের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলল,
‘ ঠিক এ কারণেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি স্যার। সেই যে এখানে পা রাখলাম সবাই বারবার কথার মাঝে ওই মহিলাকেই টেনে আনছেন। আমি বিরক্ত এসবে! অনেকদিন পর এসেছি। আপনার সাথে দেখা করব বলে ভেতরে পা মারিয়েছি। পুরনো কথা টেনে আর আঘাত করবেন না স্যার! ’
-‘ কুল মাই বয়! আমি মজা করেছি। ’
রায়হান মনিটরের দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে কিছু একটা দেখছে। হুট করে বলে উঠল,
‘ ফাহাদ দেওয়ান! ’
জহিরুল রায়হানের দৃষ্টি অনুসরণ করে মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ হুম। এক মাস হলো ভার্সিটির মিউজিক কো-অর্ডিনেট হিসেবে জয়েন করেছে। হঠাৎ মাস্তানি ছেড়ে ওর এতো ভালো হয়ে যাওয়া দেখে সন্দেহ হয়। আগের মতো টুকটাক গানও গাইছে দেখছি। ’
কথাটা দিগন্তের কানে পৌঁছতাতেই চোখ-মুখ বিকৃত করে ফেলল দিগন্ত। ব্যাঙ্গ করে হিসহিসিয়ে বলল,
‘ লেওড়ার গায়ক! শালা; হারামজাদা! মেয়েবাজ! ছ্যাকাখোর! ’
দিগন্তের মুখনিশ্রিত কথা শুনে ঘর কাঁপিয়ে স্ব-শব্দে হেসে উঠল রায়হান আর জহিরুল।
পরীক্ষা শেষ হয়েছে কিছুক্ষন আগে। মাইশাকে নিয়ে দিশা ওয়াশরুমে এসেছে। বেসিনে হাত ধুতে ধুতে চোখ আটকালো শেষ কিনারায় দুজন ছেলেমেয়ের দিকে। ঝট করে চোখজোড়া সরু হয়ে এলো দিশার। হাত ধোঁয়া ছেড়ে নিশব্দে ওই জায়গায় গিয়ে হাজির হলো। একটু দূরত্ব রেখে ঘাড় ইষৎ বাঁকিয়ে দৃষ্টি স্থাপন করল ছেলেমেয়ের দুটোর হাতের দিকে। একজন আরেকজনের হাত আকড়ে ধরে দেওয়ালের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ কিনারায় দেখে এদিকে মানুষজন নেই। কিছুক্ষন ওদের ভাবভঙ্গি অবলোকন করে জোর গলায় দিশা বলল,
‘ তোমরা পরীক্ষা দিতে এসে চিপায় কি করছো? আর এই যে ভাইয়া তুমি ঠোঁট এরকম গোল করেছে কেনো? ’
ছেলেটা মেয়েটার দিকে এগোতে নিয়েছিল কেবল দিশার কথা শুনে তড়িঘড়ি করে মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেল। মেয়েটা কিছুটা রাগী স্বরে বলল,
‘ আমরা কি করি করি। তোমার কি? ’
দিশা ভোলাভালা মুখ বানিয়ে বলল,
‘ আমার কিছুই না। ’
তারপর আবার দুষ্টু হেসে ছেলেটার দিকে ইশারা করে বলল,
‘ ওই যে ছেলেটা তোমার সাথে এতোক্ষন ছিল মালটা হেব্বি সুন্দর। আমার ভালো লাগছে। ’
‘ তোমার সাহস কি করে হলো? ও আমার বয়ফ্রেন্ড। ’
দিশা মেয়েটাকে একটা গা জ্বালানি হাসি দিয়ে ছেলেটার কাছে গেল। তারপর ছেলেটাকে বলল,
‘ উফ হ্যান্ডসাম! ’
ছেলেটা দিশার কথায় দাঁত মেলে হাসলো। হাত উঠিয়ে ভাব নিয়ে শার্টের দুই কলার নাড়তে শুরু করল।
দিশা হুট করে বলল, ‘ হাবলাচোদা! তোকে বলি নি। পেছনেরটাকে বলেছি। যা ফুট! ’
সামনের ছেলেটার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে দেখল। ওয়াশরুম থেকে একটা ছেলে প্যান্টের জিপ তুলতে তুলতে বের হচ্ছে। দিশা আর দাঁড়ালো না। ফুড় করে এক দৌড় লাগালো। সাথে মাইশাকে বলল বাহিরে যেতে।
মাইশা এতোক্ষন ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ভ্যাবলার মতো দিশার কাহিনী দেখছিল। এই মেয়েটা যেখানেই যাক। কোথায় কোন ছেলে পাচ্ছে হুট করে গিয়ে ফ্লার্ট মেরে পালাবে। দুপাশে না ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে মাইশা নিজেও ছুট লাগালো। ছেলে জাতির সাথে ও কখনোই পাঙ্গা নেয় নি। দিশার অনেক সাহস। হুটহাট একটা সুন্দর ছেলেকে নজরে পেলে কিসব আবোলতাবোল বকে পালিয়ে যায়। এই এখন কি ভুলভাল বলে চলে গেল। ছেলেগুলো যদি কিছু করত তখন। এগুলোর কোনো ভয় নেই মেয়েটার। মাইশা দ্রুত পায়ে ওই জায়গা ছেড়ে দিশার কাছে এলো।
এসে হাপাতে হাপাতে বলল,
‘ এসব ছাড়বে না তুমি? ভয় লাগে না। যদি কিছু হতো? ’
দিশা বিস্তর হাসি দিয়ে বলল,
‘ কিসের ভয়! আমার সাথে পারবে ওরা। আমি ক্যারাটে পারি। লাগতে এলে জায়গা মতো বসিয়ে দেবো। ’
-‘ ওরা কোথায় লাগে? তুমিই তো যেচে পড়ে ছেলেদের টিজ করে বেড়াও। ’
-‘ সরো! আমি নিষ্পাপ মেয়ে। টিজ ফিজ করতে পারি না। শুধু সুন্দর ছেলে দেখলে ক্রাশ খাই আর খাতির জমিয়ে আসি। ’
মাইশা ফিক করে হেসে দিল। হাসতে হাসতে বলল,
‘ আমি শুধু তোমার কপাল পুড়া জামাইয়ের কথা ভেবে কষ্ট পাই। বেচারার বউ উঠতে বসতে ক্রাশ খায়। ’
দিশা মুখ বাঁকিয়ে কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেল। কানে একটা সুন্দর গানের সুর ভেসে আসছে। ওরা দুজন অডিটোরিয়ামের পাশে দাঁড়িয়ে। দিশা আরেকটু এগিয়ে জানালা দিয়ে অডিটোরিয়ামের ভেতরে উঁকি দিল। অতঃপর চোখগুলো বিশাল আকৃতির করে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। মাইশাও ওর পাশে এসে ভেতরের দিকে দৃষ্টি রাখল। একটা ছেলে চোখ বন্ধ করে গিটারে সুর তুলছে। আশেপাশে বেশ কয়েকজন স্টুডেন্ট ছেলেটার গান শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে।
🎵🎶।। আমার আগুনের ছাই জমে জমে,কত পাহাড় হয়ে যায়।
আমার ফাগুনেরা দিন গোনে গোনে,আর উধাও হয়ে যায়।
যত পথের বাধা,সবইতো কালো সাদা,
কবে ঠিকানা পেয়ে হবে রঙ্গীন।
চেনা নামেরই ডাকে,আমি কি পাবো তাকে
কবে রে আসবে সে রোদেলা দিন
তোরই তো কাছে চাই পুরোনো কথা টাই,শুনতে আবার করে ও……এমনও যদি হয়, মনেরা নদী হয়,ভাসাবো অনেক দূরে।
ফেরাবো তোকে আর,চেনাবো তোকেই,পৃথিবী নতুন করে।
মেলাবো তোকে আজ,আমার রঙেতেই,বসাবো নতুন সুরে।
যত পথের বাঁধা,সবইতো কালো সাদা,
কবে ঠিকানা পেয়ে হবে রঙ্গীন।
চেনা নামেরই ডাকেআমি কি পাবো তাকে,
কবে রে আসবে সে রোদেলা দিন।
আমার আগুনের ছাই জমে জমে,কত পাহাড় হয়ে যায়।
আমার ফাগুনেরা দিন গোনে গোনে,আর উধাও হয়ে যায় ।।🎶🎵
মাইশা, দিশা দুজনেই মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় গান শুনছিল। গান শেষ হতেই ধ্যান ভাঙলো দিশার। অবাক গলায় বলল,
‘ আরেব্বাস! এই লাল্লু তো ভালোই গান গায়। কিন্তু এতো ছ্যাকাখরি গান কেনো? এতো সুন্দর পোলারে কেউ রিজেক্ট করছে নাকি! ’
মাইশা পাশ থেকে বলল, ‘ গানটা সুন্দর। ’
দিশা লাজুক হেসে বলল, ‘ ছোকড়া টাও সুন্দর। এর সাথে আমার একবার রাস্তায় দেখা হয়ছিলো। সময়ের অভাবে কথা বলতে পারি নি। আজকে পাইছি রে! ’
দিশার মতিগতি ভালো ঠেকলো না। তাই মাইশা ওর হাত টেনে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ ভাইয়া নিতে আসবে বলেছিল। ভুলে গেলে! দেখো সবাই বেড়িয়ে গিয়েছে। আমরাই ঘুরছি শুধু। ’
দিশা মুখ লটকিয়ে বলল, ‘ দুইটা মিনিট দাঁড়াও না। আমি শুধু যাবো আর ওই চললেট বয়, হটপট ছেলেটার সাথে খাতির জমিয়ে আসব। এতো সুন্দর পোলার সাথে কথা না বললে শান্তি পাবো না। ’
মাইশা নরম স্বরে বলল, ‘ ওই রুমে অনেক মানুষজন আছে। তুমি গিয়ে খাতির জমাতে চাইলেই পারবে? তোমার খাতির জমানো যে কি তা কি আমি জানি না। ভারী সাহস তোমার! আজ কিছু করিও না দিশা। দিগন্ত ভাইয়া জানলে বকবে আমাদের। ’
দিশা শুনল মাইশার কথা। যেতে যেতে আবারো পিছু ঘুরে সুদর্শন ছেলেটাকে দেখার চেষ্টা করল কিন্তু দেখা পেল না।
ফাহাদ গিটার রেখে ওর দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর উদ্দেশ্যে গম্ভীর গলায় বলল,
‘ এ ধরণের আবদার আর কেউ করবে না। সামনের উইকে তোমাদের কম্পিটিশন। ভালোভাবে চর্চা করো । এই উইকে আমি আর আসব না ভার্সিটি। ’
বলে আর এক মূহুর্ত থাকল না। অডিটোরিয়াম ছাড়লো।
ভর দুপুরের সূর্যটা খাড়া হয়ে আলো ছড়াচ্ছে। সেই সাথে ছড়াচ্ছে তীব্র রোদ আর গরম। ভার্সিটির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুই ব্যক্তি। দুজনেই একে অন্যর দিকে আগুন চোখের চাহনি দিয়ে ধ্বংস করছে। অথচ দুজনের চোখেই সানগ্লাস।
‘ কি করছিস এখানে? ’
দিগন্ত গমগমে গলায় বলল, ‘ তোকে বলতে হবে? ’
ফাহাদ বাঘের ন্যায় দুহাত দিয়ে থাবা মেরে দিগন্তের শার্টের কলার চেপে ধরল। রাগী গলায় ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
‘ এতোদিন তো আসিস নি। আমাকে আসতে দেখে আবারো চলে এলি নিজের রাজ্যত্ব গড়তে। স্কাউন্ড্রেল! ’
দিগন্তের দমিয়ে রাখা রাগ তড়তড়িয়ে বেড়ে গেল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ভারী একটা পাঞ্চ মারল ফাহাদের পেট বরাবর। পেটে হাত রেখে কিছুটা দূরে সরে গেল ফাহাদ। পরক্ষণেই পা উচিয়ে দিগন্তের বুকে এক প্রকান্ড লাথি বসাল।
ফাহাদের লাথিটা সোজা গিয়ে লাগল দিগন্তের বুকের মাঝ বরাবর। দিগন্ত ছিটকে গিয়ে ধুলোবালিময় জায়গায় পড়ল। সাদা শার্টটা ময়লায় মাখামাখি হলো। উঠে বসে শার্টটা হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে তাচ্ছিল্য করে বলল,
‘ মিনিমাম লজ্জাটুকুও নেই তোর। নিজেকে ক্লাউন প্রমাণ করার জন্য সব সময় চলে আসিস। হারামজাদা! ’
ফাহাদ সোজা হয়ে পকেটে দুহাত রেখে দাঁড়ালো। ওষ্ঠ কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে বলল,
‘ লজ্জার কথা বলছিস? শালা! তোর বংশের লজ্জা তো আবার বাঁধাই করা। কতবার থু ফেলি…’
ঝট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে ফাহাদের দিকে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে গেল দিগন্ত। বুকের মাঝে ধাক্কা দিয়ে এক হাত দিয়ে ওর ঘাড় চেপে ধরল আরেক হাতে ফাহাদের মুখে সরাসরি ঘুষি বসিয়ে দিল। ঠোঁট কেটে গেল ফাহাদের, র’ক্ত বেরিয়ে এলো।
ফাহাদের ক্ষোভ বাড়লো এতে। মাথা দিয়ে দিগন্তের নাকে সজোরে আঘাত করল। দিগন্ত শব্দ করল না। দাঁতে দাঁত পিষে ব্যাথাটা গলধকরণ করে নিল। নাকে বুড়ো আঙুল দিয়ে গড়গড়িয়ে বের হওয়া লাল র’ক্ত মুছে চোখের সামনে ধরল।
তখনি নিজের রুম থেকে দৌড়ে বের হলো জহিরুল। ফাহাদ আর দিগন্তের কাছাকাছি এসে রাশভারি গলায় হুংকার ছুড়ল,
‘ স্টপ ইট! আর কতদিন একে অন্যকে আঘাত করে বেড়াবে। নিজেদের দাপট দেখাতে গিয়ে অন্যের ক্ষতি করতেও ভাবো না তোমরা। আসতে না আসতেই আবার হাতাহাতি, রক্তারক্তি শুরু করে দিয়েছে। ডোন্ট ফরগেট, এটা ভার্সিটি। তোমাদের সো কলড টং ঘর নয়। ’
ফাহাদ কটমট চোখে দিগন্তের দিকে চেয়েছিল। জহিরুলের কথা শুনে চলে যেতে যেতে দিগন্তের পাশে একটু থেমে বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ তোর অহংকার আজ মিশিয়ে দিবো। জাস্ট ওয়েট; বাস্টার্ড! ’
দিগন্ত ওর দিকে না তাকিয়েই গমগমে স্বরে বলল,
‘ আ’ম ওয়েটিং। ব্লাডি বিচ! দেখি কত দৌড় তোর! ’
রায়হান ভ্রুঁ কুঁচকে দেখছে দিগন্তকে। নাক দিয়ে রক্ত ঝরে শুকিয়ে গিয়েছে ওর। কিছুক্ষন পর ত্যাড়া গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘ মাত্রই তো এলাম। এটুকুতেই তোদের দেখাও হলো আবার মারামারিও শেষ।’
মাইশা আর দিশাকে নিয়ে জীপে উঠেছিল ওরা। জীপ ছাড়ার আগ মুহূর্তে দিগন্ত খেয়াল করে ওর ফোন জহিরুলের টেবিলেই ফেলে এসেছে। সেটা নিতে গিয়েছিল। ফেরার পথে ফাহাদ আর ও গেটের সামনে একসাথেই আসে।
মাইশা, দিশা দিগন্তের অবস্থা দেখে অস্থির গলায় প্রশ্ন জুড়ে দিল। দিগন্ত ওদের একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিল না।
জীপের পেছনের দিকে বসতে বসতে রায়হানকে বলল,
‘ গাড়ি ড্রাইভ কর। ’
রায়হান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রাইভিং সীটে বসল। দিগন্ত মাইশার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ মাইশা! তুই পেছনে বস। দিশা সামনে বসবে। ’
দিগন্তের কথা শুনে অনাক হলো রায়হান। ঘাড় ঘুরিয়ে সরু চোখে তাকালো দিগন্তের দিকে। যে দিগন্ত দিশাকে রায়হানের আশপাশও আসতে দেয় সে দিগন্ত দিশাকে ওর পাশে বলতে বলছে। ব্যাপারটা বেশ ভাবালো রায়হানকে। পাশে যে দিশা আছে এটা হয়তো ও ভুলে বসেছে।
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২৭
চোখ ঘুরিয়ে জীপ স্টার্ট দিতে দিতে একবার মিররে তাকালো।
কালো বোরখায় আবৃত মাইশার চোখজোড়া ছাড়া কিছুই নজরে এলো না। মেয়েটার চেহারা দেখেনি এখনো রায়হান। কিন্তু চোখজোড়া যতবার দেখেছে ততোবার ওর নজর কেড়েছে। পুরোটা রাস্তা ড্রাইভ করল অথচ দৃষ্টি বার কয়েক ওই চোখজোড়াতেই যাচ্ছে। নিজের নজরের উপর অবাক হলো রায়হান। কয়টা বিশ্রি গালি ছুড়ল নিজের উদেশ্যে।