দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩৯
আফরোজা আশা
পাটোয়ারী বাড়ির সোফা দখল করে বসে আছে নতুন কিছু মুখ। তাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলছে রহমান আর রাসেল পাটোয়ারী। কিছু সময় বাদে ওদের সামনে এনে বসানো হলো শাড়ি পরিহিত এক রমণীকে। তাতক্ষনাৎ কথা থামিয়ে সবার নজর গিয়ে থামলো তার উপর। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেয়েটাকে দেখছে সকলে। তাদের মধ্যে শক্তপোক্ত দেহী,ভারী চোয়াল, কদমছাটা চুলের এক সুদর্শন পুরুষ সামনের রমণীকে দেখে স্তব্ধ হলো। আধ ঘোমটা টানা মেয়েটাকে দেখে অস্ফুট স্বরে বলল, মাশ-আল্লাহ।
এতো মানুষের সামনে বসে হাসফাস লাগছে বৃষ্টির। সবাই ওকে কিভাবে যেন দেখছে। দু-একজন ওর প্রশংসা করছে, সে আওয়াজ এসে কানে ঠেকলে লজ্জায় মুর্ছা যাচ্ছে ও। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে বৃষ্টির। বুক ধুকপুক করছে, নতুন মানুষগুলোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির তোপে ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে উঠেছে।
অনেকক্ষন কথাবার্তা চললো দুইপক্ষের। মিতালী আর বাণীও এসেছে। আজ দিন তারিখ সব ঠিক করে তবেই ফিরবে ছেলেপক্ষ। কথাবার্তার শেষ পর্যায়ে জহিরুল দেওয়ান রহমানকে বললো দুজনকে আলাদা কথা বলতে পাঠাতে।
রহমান বৃষ্টিকে বললো ছাদে যেতে। সাথে বেলাকে পাঠালো। বেলা বৃষ্টির পাশাপাশি হাঁটছে আর ওকে খুব মনযোগ দিয়ে দেখছে। এক পর্যায়ে প্রশ্ন করে বসলো,
‘ এই আপা,তোমাকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো? এভাবে লজ্জা পেতে হয়? আচ্ছা, দিগন্ত ভাই তাহলে এটারই কথা বলছিল সেদিন। ’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বেলার কথা বুঝলো না বৃষ্টি। মুখ সামান্য কাত ওকে দেখে আবারো সামনের দিকে ফিরিয়ে নিল। লোকটা ওদের পেছনে আসছে। পায়ের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে বৃষ্টি।
ছাদের একপাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টি। হাত-পা থেকে ঘাম ছুটছে ওর। পাশে বিশালদেহী এক পুরুষ টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুরুষটাকে দেখার সুযোগ পায়নি এখনো। জড়তার কারণে মাথা তুলে তাকাতে পারছে না।
বেলা ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে মনে যা আসছে তাই দিয়ে ধুচ্ছে দিগন্তকে। একপলক ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আবারো দিগন্তকে গালি দেওয়া শুরু করলো। ব্লক এখনো খুলেনি। একবার রাগ ঢাক ছেড়ে খুলেছিল কিন্তু এবার আর খুলবে না।
ফয়সাল বৃষ্টির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। অতঃপর হালকা গলা ঝেড়ে বললো,
‘ তোমার বিষয়ে আমি সব জানি। তাই আর প্রশ্ন করলাম না। আমি মেজর ফয়সাল দেওয়ান। বর্তমানে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট.. ’
ঝট করে চোখ তুলে তাকালো বৃষ্টি। সামনের মানুষটাকে ও চেনে। ফাহিমের চাচাতো ভাই। চোখ ছাপিয়ে পানি এলো ওর। রহমান সব জেনেশুনেও কিভাবে এ বিয়ের কথা আগাচ্ছে। শূন্য নেত্রে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে থাকলো বৃষ্টি। আস্তে আস্তে চোখ ছাপিয়ে ধর ধর করে পানি পড়তে লাগলো। বৃষ্টির চাহনী দেখে ফয়সাল কি বুঝলো কে জানে। হালকা হেসে বলে উঠলো,
‘ সবাই এক না। মাঝে মধ্যে বংশে এক-দুটো অজাত জন্মে যায়। যেগুলো সবার মুখে চুনকালি মাখাতে ওস্তাদ। ডোন্ট ক্রাই। ’
ফোন বেজে উঠলো ফয়সালের। কথা থামিয়ে ফোন কানে চাপালো,
‘ কোথায় আছিস? ’
ফাহাদ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বললো,
‘ কাছাকাছি। ’
তারপর কণ্ঠে দুষ্টুমির রেশ এনে বললো,
‘ শুধু নিজের ধান্দায় না থাকে আমারটাও দেখো। বাই দ্যা ওয়ে, মেয়েকে দেখে আবার কন্ট্রোল হারাইও না। ’
ফয়সাল বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকেই ছোট করে জবাব দিল,
‘ ঠিক আছি। আয় তাড়াতাড়ি। ’
‘ চলে এসেছি প্রায়। ’
রায়হানের যন্ত্রনায় টিকতে না পেরে ভার্সিটি গিয়েছিল দিগন্ত। সেখানে জহিরুলকে পায়নি। তার পিএ জানালো সে ছেলের বৌ দেখতে গিয়েছে। ঠিকানা শুনে রায়হান দিগন্ত দুজনেই অবাক হলো। দিগন্ত জহিরুলকে ফোন দিল। দিগন্তের ফোন পেয়ে জহিরুল আমোদ গলায় ওদের সেখানেই ডেকে বসলো। প্রথমে যেতে না চাইলেও রায়হানের খোঁচাখোঁচি আর বেলাকে দেখার লোভে পড়ে পাটোয়ারী বাড়ির যাওয়ার জন্য রাজী হলো দিগন্ত।
মিতালী ওকে বলেছিল আজ ওবাড়ি যাবে। কিন্তু কেনো যাবে তা শুনেনি দিগন্ত। ফয়সাল আর বৃষ্টির বিয়ের কথা চলছে সেটা ওর মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। জানত দিগন্ত কিন্তু ভুলে বসেছিল। ভেতরে ভেতরে রহমানের উপর কয়েদফা হাসলো।
পাটোয়ারী বাড়ির বড় দরজর সামনে পৌঁছেই রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো দিগন্তের। চোখজোড়া থেকে অসম্ভব ক্রোধ বের হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে, হাত শক্ত করে মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিল। ফলে রোগগুলো টান টান হয়ে ফুলে উঠলো। পুনরায় সামনের দিকে তাকালো ও। ব্যস পুরো অন্তর আত্মা জ্বলন্ত আগুনের মতো জ্বলে উঠলো। তারপর সেখান থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বাইক ছেড়ে চলে গেল। রায়হান হতভম্বের ন্যায় একবার সামনের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই আবার দিগন্তের পিছে পিছে ছুটলো।
সামনের রমণীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফাহাদ। কতগুলো দিন পর এতো কাছ থেকে দেখছে বেলাকে। আগের থেকে শরীর স্বাস্থ্য বেড়েছে বেলার। চামড়ার রঙ ছেড়েছে অনেক,ফর্সা হয়েছে বেলা। ফোলা গালদ্বয় আরেকটু ফুলেছে। মুখাবয়ব, শরীরের গঠন, পোষাক-আশাক বেলার মেয়েলী বয়স বৃদ্ধির পরিচয় দিচ্ছে।
গাঢ় দৃষ্টিতে বেলাকে দেখছেই ফাহাদ। পিটপিট করে চোখজোড়া খুলে সামনের ব্যক্তিকে দেখে ভয়ে জমে গেল বেলা। দিগন্ত আসবে শুনে বাড়ির বাইরে বের এসেছিল। মাথা নিচু করে দিগন্তকে গালি দিতে দিতে হাঁটছিল। হুট করে ধাক্কা লেগে ব্যালেন্স হারালো। পড়ে নি বেলা। কেউ ধরেছে ওকে। চোখ খুলে সামনে ফাহাদকে দেখলো। পার্কের ঘটনা জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো ওর মনে। এই লোকটা ওকে কিডন্যাপ করেছিল। ওর ক্ষতি করতে চেয়েছিল। সবকিছু স্মরণ হতে ফাহাদকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল বেলা। চোখমুখে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।
হাঁটুজোড়া কাঁপছে ভয়ে। ওকে আবার তুলে নিয়ে যেতে এসেছে। আবার ক্ষতি করতে চাইছে ওর। পেছন ফিরে বাড়ির দিকে ছুটলো ও। কিন্তু ভয়ের তাড়নায় পাজোড়া অবশ হয়ে এসেছে। দু-তিন কদম যেতেই পেছন থেকে হাতে টান পড়লো বেলার।
ভয়ার্ত চোখ ফিরিয়ে হাতের দিকে দেখলো বেলা। তারপর সামনে দিকে তাকাতেই দেখলো ফাহাদ ভ্রুঁ কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
‘ আমাকে ভয় পাচ্ছিস কেনো? আমি কি তোকে খেয়ে ফেলেছি? ’
ফাহাদের প্রশ্ন শুনে হাত মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো বেলা। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে কারো আশা করলো কিন্তু পেল না। প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে কুঁঞ্চিত ভ্রুঁ আরো খানিক কুঁচকে গেল ফাহাদের। নড়রে থাকা বেলার হাত আস্তে ঝটকা দিয়ে আবারো জোরে চেপে ধরলো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
‘ সেদিন আমি বাঁচালাম আর আমকেই মেরে পালালি। আজ আবার আমাকে ভয় পাচ্ছিস কেনো? ’
‘ আ..আপনি খারাপ লোক। গুন্ডা। আমার ক্ষতি করবেন। ’
কয়েক মূহুর্ত চুপ থাকলো ফাহাদ৷ তারপর বেলা হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,
‘ আমি তোর বোনের দেবর। গুন্ডা পান্ডা না ভেবে বেয়াই ভাব। সম্পর্ক অনেকদূর গড়াবে। ’
ছাড়া পেয়ে দৌড় লাগাতে চেয়েছিল বেলা। ফাহাদের কথা শুনে থেমে গেল। ঘাড় কাঁত করে হরবরিয়ে বললো,
‘ এতো সম্পর্কের প্রয়োজন নেই। আমি দেখেছি আপনি মানুষকে মারেন। পঁচা আপনি। ’
বেলার কাছাকাছি এলো ফাহাদ। হালকা একটু ঝুঁকে বেলার মুখোমুখি এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ সব ছেড়ে দিয়েছি। পঁচা থেকে ভালো হয়েছি অনেক। এখন থেকে আমার সাথে মানিয়ে চলা শুরু করো মেয়ে। আমি এসেছিই তোমার জন্য। ’
শুকনো ঢোক চেপে পিছিয়ে গেল বেলা। ফাহাদের কথা একটাও মন দিয়ে শোনেনি ও। দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। যার জন্য এসেছিল সেই লোকের দেখা নেই। এক গুন্ডার পাত্তা নেই আরেক গুন্ডা এসে মাতব্বরি করছে।
বাইক থামিয়ে সোজা রুমে এলো দিগন্ত। ওয়ারড্রব এলোমেলো করে সেখান থেকে একটা ফাইল বের করে আনলো। হাতে কলম তুলে নিতেই ওর পেছন পেছন রায়হান এসে হাজির হলো। দিগন্তের হাতে ফাইলটা দেখে চোখ বড় বড় করে চেঁচিয়ে উঠলো রায়হান,
‘ ওই বাটপার! খবরদার,সাইন করবি না। থাম, হারামজাদা, শালা। ’
বলে তেড়ে আসলো দিগন্তের দিকে। দিগন্ত কানে তুললো না ওর কথা। তার আগেই খসখস শব্দ তুলে সাইন করে দিল। রায়হান হায় হায় করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো বেডে। ভাবান্তর নেই দিগন্তের। ফাইলটা নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লো ও।
জুনায়েদ আর জয়নাল তালুকদার মিটিং রুমে। দিহানও আছে ওদের সাথে। মিটিং এর মাঝে সেখানে হাজির হলো দিগন্ত। ওকে দেখে অবাক হলো সবাই। সেদিকে পাত্তা নেই দিগন্তের। চোখমুখ গম্ভীর। রাগের কারণে নাক শক্ত হয়ে আছে। হাতের ফাইলটা জুনায়েদের সামনে ঝাটলা দিয়ে ফেলে গমগমে স্বরে বললো,
‘ ডিল ফাইনাল। এখন আমার শর্ত মানতে বাধ্য। ’
দিগন্তের কথা শুনে জয়নাল আকাশ থেকে পড়লো। দিহানের চোয়াল ঝুলে গেল। আর জুনায়েদ কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে দেখলো দিগন্তকে। তারপর ফাইলটা হাতে নিয়ে চেক করলো। সাইন দিয়েছে দিগন্ত। সেখান থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩৮ (২)
‘ কি চাই? ’
বেরিয়ে যেতে নিয়েছিল দিগন্ত। হাঁটা থামিয়ে ঘাড় কিঞ্চিৎ পেছনে করে গম্ভীর স্বরে জাবাব দিল,
‘ বেলা পাটোয়ারী। ’
পরপরই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।