দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪১

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪১
আফরোজা আশা

‘ বাজে জিনিস খেতে নেই আংকেল। ’
মাত্র সিগারেটটা ঠোঁট কাছে এনেছে ফাহাদ। উপরোক্ত কথাটা কানে ঠেকতেই হাতের গতি মন্থর হলো। ঘাড় নিচু করে শব্দযুগলের উৎসের দিকে তাকালো সে। নজরে এলো গোলগাল চেহারার একটা মিষ্টি পরীর দিকে। দুপাশে ছোট ছোট দুটো ঝুটি বাঁধা,পায়ের গোড়া সমান একটা নীল রঙের ফ্রক পড়া ছোট বাচ্চাটাকে দেখে চোখ জুরিয়ে এলো ফাহাদের। ওর দিকে একটু এগিয়ে আসতে নিলে দেখলো ফোলা ফোলা গাল আর মোটা ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে গেল বাচ্চাটার। নাকের পাশে গভীর দুটো ভাজ ফেলে বলে উঠলো,

‘ কি বাজে গন্ধ! ’
হাতের সিগারেটটার দিকে দেখলো ফাহাদ। নেশা চড়েছে, টানতে ইচ্ছা করছে কিন্তু কেনো যেন হাত ঝাড়া দিয়ে পেছনে ছুড়ে দিল। আনমনে বাচ্চা মেয়েটার দিকে একটু ঝুঁকলো ফাহাদ। ওর চুলে হাত বুলিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই বাচ্চাটা জোর গলায় আর্তনাদ করে উঠলো। হকচকালো ও। ওর হাত ঘড়িতে কয়টা চুল আটকা পড়েছে। চুলগুলো তড়িঘড়ি করে ছাড়িয়ে নিতেই দেখলো বাচ্চাটার ফর্সা মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। মুখের ভঙ্গিমা দেখে ঠাওড় করা যাচ্ছে রেগে গিয়েছে ভীষণ। চোখমুখ লাল করে ফোলা গালের মাঝে ডেবে থাকা ছোট ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ চুলে টান সহ্য হয় না আমার। তুমি জোরে করে টেনেছো আংকেল। আমার লেগেছে। ’
হাঁটু গেড়ে বসলো ফাহাদ। বাচ্চামো রাগী গলার অভিযোগটা শুনে ঠোঁটে হালকা হাসি খেলে গেল। একপাশের গাল আলতো টেনে প্রশ্ন করলো,
‘ তোমার নাম কি? ’
ব্যস ফাহাদের এই প্রশ্নে রাগের আগুনে ঘি পড়লো। নাকের পাটা ফুলিয়ে উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরলো বাচ্চাটা। ওর এহেন মুখভঙ্গিমা দেখে বিস্তর হাসলো ফাহাদ। নাকের মাঝে আস্তে করে টোকা দিয়ে বলে উঠলো,

‘ কি? নাম মনে নেই? ’
অগাধ বিরক্তি নিয়ে চিকন স্বর ভেসে এলো অপর পাশ থেকে,
‘ বাজে আংকেলদের নাম বলি না। ’
ভ্রুঁ কোঁচকালো ফাহাদ। একটা বাচ্চা মেয়ে ওকে সমানে বাজে বলে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করল,
‘ বাজে আংকেল কেনো? ’
‘ তুমি বাজে জিনিস খাও তাই বাজে আংকেল। ’
‘ ওগুলো বাজে জিনিস না। ’
‘ না, বাজে জিনিস। মাম্মা বলেছিল ওগুলো বাজে। ’
দু’ফুটের একটা বাচ্চার জোরালো কথায় দমে গেল ফাহাদ। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ, বাজে জিনিস। তোমার মা-বাবা কোথায়? একা একা এই রাস্তায় কি করছো? ’
রাত প্রায় নয়টা বাজতে চলছে। সন্ধ্যার দিকে বেলাকে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে, সেই যে আড্ডায় মেতেছিল দিগন্ত। এখন বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রায়হান মাইশার কাছে যাওয়ার জন্য কতক্ষন থেকে বকবক করছে সেগুলো শুনেও শুনছে না ও। বাইকের কাছে আসতেই রায়হান আবারো ওকে চেপে ধরেছে। একরাত বউকে বুকে নিয়ে ঘুমোতেই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে ওর। এখন আর বউ ছাড়া ঘুম আসবে না। এসব বলে দিগন্তের বাইকে উঠে বসতে নিলে ওর পেছনে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিল দিগন্ত। পুনরায় কাছে আসার আগেই বাইকের স্পিড তুলে জায়গা ছাড়ে ও। পেছনে হিসহিসিয়ে দিগন্তকে গালাগাল করতে থাকে রায়হান। রাস্তা দিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছিল দিগন্তের বাইক। হুট করে ব্রেক কোষলো দিগন্ত। বাইক কিছুটা পেছনে এনে থামালো। জোরে ডেকে উঠল,

‘ পতাসা বেবি! ’
ফাহাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সবে প্রস্তুতি নিয়েছিল প্রত্যাশা। পরিচিত কণ্ঠে নিজের নাম শুনে চট করে সেদিকে তাকালো। সহসা মুখভর্তি হাসি নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
‘ ভাইয়ায়া! ’
ফাহাদ ভ্রুঁ গুটিয়ে নিল। দিগন্ত বাইক থেকে নেমে ওদের কাছে এসে ছোঁ মেরে প্রত্যাশাকে ছিনিয়ে নিল ফাহাদের কাছ থেকে। ফাহাদ উঠে দাঁড়ালো। এক পলক দিগন্তকে দেখে প্রত্যাশার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। অতঃপর পকেটে দুহাত গুজে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ পতাসা? তোমার নাম পতাসা? আজব নাম! কখনো শুনিনি। ’
দিগন্ত রাশভারি গলায় ফাহাদকে বলল,
‘ এই এলাকায় তোর কি কাজ? ভেঙ্গে দেই পা! ’
ফাহাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

‘ মেইন রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়েছে। তাই এ রাস্তায় আমার পা পড়েছে। নয়ত ফাহাদ দেওয়ানের চুলও তোর বাড়ির রাস্তায় মারাতে আসতো না। ’
প্রত্যাশা দিগন্তের শার্টে কণা টেনে বলল,
‘ ভাইয়া,তোমরা ঝগড়া করছো? ’
ভাইয়া ডাক শুনে ফাহাদ গমগমে স্বরে প্রত্যাশাকে বলল,
‘ আমাকে তো আংকেল ডাকলে। ওই দামড়াকে আবার ভাইয়া ডাকছো। কল হীম আংকেল! ’
বলা শেষ হতে না হতেই দিগন্তের ভারী হাতের বিশাল এক ঘুষি পড়ল ফাহাদের মুখে। ঘাড় কাত হয়ে গেল ফাহাদের। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে গালে হাত রাখল ফাহাদ। পরক্ষণেই তড়িৎ গতিতে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে দিগন্তের দিকে এগিয়ে আসতে নিলে প্রত্যাশা ওদের মাঝে এসে অপর হাত বাড়িয়ে দিল ফাহাদের দিকে। থেমে গেল ফাহাদের কদম। প্রত্যাশার বাড়ানো হাতটা চেপে ধরে দিগন্তের চোখাচোখি তাকিয়ে বলল,

‘ বাচ্চাটা আছে নাহলে তোর নাকের নকশা পাল্টে দিতাম হারাম’জাদা। ’
প্রত্যাশার ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় ফাহাদকে বলল দিগন্ত,
‘ ওর হাত ছাড়। বাচ্চা মেয়ের উপর তোর খারাপ নজর দিবি না। চোখ উপড়ে ফেলব। ’
ফাহাদ চোয়াল শক্ত করে ফেলল। প্রত্যাশার হাত ভালোভাবে চেপে ধরে বলল,
‘ তুই কে বে? ও তো তোর কেউ না। আমি পেয়েছি রাস্তায়। মাঝখানে এসে দালালি করছিস তুই। শালা;হারাম’জাদা। ’
প্রত্যাশা গোল গোল চোখে একবার ফাহাদকে দেখছে তো একবার দিগন্তকে। এর মাঝেই দূর থেকে ওর নাম ধরে এক নারী কণ্ঠস্বরের ডাক ভেসে এলো। প্রত্যাশা পেছন ঘুরে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠল,

‘ মাম্মা, আমি এখানে। ’
দিগন্ত,ফাহাদ দুজনেই থামকালো। অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর চিনতে দুজনের কারোর ভুল হয়নি। মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময় ভাব ছড়িয়ে পড়ল দুজনের চোখে মুখে। ফাহাদের দৃষ্টি সোজা সামনের দিকে চলে গেল। দিগন্তও ঝট করে পেছনে ঘাড় ফেরালো।

চশমা নিয়ে বের হয়নি মনা। দূরের সবকিছু ঝাপসা দেখছে। দোকানে আইসক্রিম কেনার ফাঁকা হাত ছেড়ে বাইরে চলে এসেছে প্রত্যাশা। পাগল হয়ে মেয়েকে খুঁজছে মনা। নাম ধরে ডাকছে আর রাস্তায় মানুষজন পেলে তাদের জিজ্ঞেস করছে। দূর থেকে প্রত্যাশার গলা শুনে ছুটে এদিকে চলে আসলো ও। কিন্তু কাছাকাছি আসতেই পা জোড়া থেমে গেল। সামনেরনের দুই পুরুষকে দেখে চোখ ভিজে এলো ওর। শরীর এক জায়গায় আটকে গেল।
প্রত্যাশা মনাকে দেখে আবারো মাম্মা বলে চেঁচিয়ে উঠল। সে ডাক কর্ণকুহুরে পৌঁছাতেই দুপাশ থেকে দুজনে প্রত্যাশার ধরে রাখা হাত ছেড়ে দিল। ছাড়া পেয়ে প্রত্যাশা মনার কাছে দৌড়ে এলো।

দিগন্ত মনার দিকে ঘৃণার চোখে চেয়ে থাকল কিছুক্ষন। পরপরই চোখ সরিয়ে প্রত্যাশার দিকে তাকালো। শরীরের শিরা-উপশিরায় আগুন ঝলকে উঠল ওর। দাঁতের পেষণ এর ফলে মাথার রগগুলো ফুলে উঠল। রাগে-ক্ষোভে ভয়ংকর হয়ে উঠল ওর চোয়াল। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিয়ে পাশে গাছে সজোরে আঘাত করলো। চামড়া থে*তলে র*ক্ত বেরিয়ে এলো হাত থেকে। সে ব্যাথা উপলব্ধি হলো না দিগন্তের। ঘৃণায় অন্তয় বিষিয়ে উঠেছে ওর। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। পাশ ফিরে থুতু ফেলল। তারপর আর কোনোদিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করল না। বাইক নিয়ে চলে গেল। পেছন থেকে প্রত্যাশা ভাইয়া বলে কয়েকবার ডাকল দিগন্তকে। সে ডাক দিগন্তের নিকট অসহ্যকর ঠেকল।

ফাহাদ সেই তখন থেকে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে মনাকে দেখছে তো দেখছেই। অনেকদিন পর মেয়েটাকে দেখল। আগের থেকে শরীর স্বাস্থ্য বেড়েছে। সৌন্দর্য্যতা কমেনি একটুও বরং দ্বিগুণ বেড়েছে। পা ফেলে মনার সামনা-সামনি এলো ও। মনা কাঁদছে। চোখ গড়িয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। দিগন্তের ঘৃণা আর সামনের বহু কাঙ্ক্ষিত পুরুষটাকে দেখে ভেতরে দম আটকে এসেছে ওর। ফাহাদ প্রত্যাশার দিকে ইশারা করে বলল,
‘ ইন্টারেস্টিং! এ বয়সে এসেও সুন্দরী মেয়ে জন্ম দিয়েছে জুনায়েদ তালুকদার। সুখ দেয় খুব? ’
লজ্জায়-অপমানে চোখ বন্ধ করে নিল মনা। ফাহাদ দমলো না। কৌতুকের স্বরে বলল,

‘ যে তোমার পরিচয় গড়ে দিল তার বাপের কাছেই নিজেকে বিকিয়ে দিলে। অথচ চার বছর ছ্যাচড়ার মতো ঘুরলে আমার পেছনে। তোমাদের মতো মেয়েরা পারেও এসব! ফ্লার্টবাজ ফাহাদ দেওয়ানকেও ঘোল খাইয়ে বাপের বয়সী লোকের সাথে শুয়ে পড়লে। এই! তোমার একবারো লজ্জা লাগেনি? ট্রাস্ট মি! জাস্ট এই প্রশ্নটা করার জন্য হলেও আমি চেয়েছিলাম একদিন তুমি আমার সামনে এসো..’
ফাহাদের একেকটা কথা মনার কানে উত্তপ্ত লোহার ঢেলে দেওয়ার ন্যায় আঘাত হানছে। আর নিতে পারছে না ও। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,

‘ ফাহাদ, প্লিজ। প্লিজ, স্টপ। ’
উন্মাদের ন্যায় হাহা করে হেসে উঠল ফাহাদ। হাসতে হাসতেই চোখজোড়া লাল রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো ওর। প্রত্যাশাকে মনার কাছ থেকে সরিয়ে ওর চুলে মুঠি শক্ত করে চেপে ধরলো।ব্যাথায় চোখ খুলল মনা। ফাহাদ হিসহিসিয়ে বলল,
‘ তোকে আমি কোনোদিনও ভালোবাসি নি। একটা কু*ত্তাও চার বছর একজনের পেছনে ঘুরলে তার ওপর করুণা জন্মে। তোর ওপরেও করুণা হয়েছিল আমার। যেভাবে মুখিয়ে থাকতিস আমার জন্য, আসতে দিয়েছিলাম জীবনে। কি করলি তুই? হাসির খোরাক বানালি আমাকে! কি ছিল ওই জুনায়েদের মধ্যে? ওর থেকে বেশি সুখ দিতে পারতাম আমি। ওর সাথেই যদি শুবি তাহলে পুরা ভার্সিটিতে রটিয়েছিলি কেনো তোকে ফাহাদ দেওয়ান বিয়ে করবে? এতো অন্যায় করার পরও এখনো তোর প্রতি ভেতর থেকে করুণা আসে আমার। কেনো জানিস? লোভে পড়ে হীরে হাতাতে গিয়ে কয়লায় মুখ দিয়েছিস। ’

বলে ঝটকা মেরে সামনে থেকে সরিয়ে দিল মনাকে। সেখানে আর এক মিনিটও দাঁড়ালো না ফাহাদ। আর বেশিক্ষন থাকলে হয়তো জানে মেরে ফেলবে ওকে।
মনা নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। মুখে কোনো কথা নেই। ফাহাদের মুখ থেকে বের হওয়া তিক্ত কথাগুলো বুকে ধারালোভাবে ছু’রিকাঘাত করছে। পাশে প্রত্যাশা ভয়ে কাঁপছে। ফাহাদ চলে যেতেই মনাকে জাপটে জড়িয়ে ধরল ও।

গেট পেরিয়ে বড় বড় কদম ফেলে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে দিগন্ত। রান্নাঘর থেকে বিকট আওয়াজ পেয়ে হাঁটা থামাল। দিশার আওয়াজ পেয়ে পা ঘুরিয়ে চটজলদি রান্নাঘরে এলো। গ্যাসের চুলায় কিছু রান্না করছে দিশা। তেল ছিঁটকে ছিঁটকে চারদিকে পড়ছে। কানে হাত চেপে ভয়ে চেঁচাচ্ছে দিশা।
দিগন্ত এসে গ্যাস নিভিয়ে দিল। রাগান্বিত স্বরে ধমকে উঠল দিশাকে,
‘ চুলার কাছে কি করছিস? ’
দিশা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ঢোক চাপল। ভয়ে ভয়ে বলল,
‘ রান্না করছি। খিদে পেয়েছে। ’

রাগে মাথা খারাপ হয়ে আছে দিগন্তের। দিশার কথা শুনে আরো রাগ বাড়ল। হুংকার ছুড়ে বলল,
‘ থাপড়ে দাঁত নড়িয়ে দেবো। যেটা পারিস না সেটা করতে এসেছিস। মণি কোথায়? মণিকে বলতে পারিস নি। এমনি তো সারাদিন ঘাড়ের উপর বসে খাচ্ছিস। এখন নাটক করতে এসেছিস। ’
দিশার চোখ ছলছল হলো। একে তো পেট চোঁ চোঁ করছে তার উপর দিগন্তের চিল্লানি। রাগ করে কোনো কথা না বলে ধুমধাম পা ফেলে চলে গেল।

মিতালীকে খুঁজলো দিগন্ত কোথাও পেল না। দিহানকে জিজ্ঞেস করলে ওবাড়িতে ঘটা সবকিছু দিগন্তকে জানালো ও। সব শুনে মাথা নষ্ট হওয়ার উপক্রম দিগন্তের। প্রত্যাশার ব্যাপার নিয়ে জুনায়েদের উপর রাগ-ঘৃণা জমেই আছে আবার মিতালী আর বাণীকে পাটোয়ারী বাড়িতে রেখে এসেছে শুনে বাড়ি মাথায় তুলল দিগন্ত। জুনায়েদের সাথে বিরাট ঝগড়া হলো ওর। দিশা আর মাইশা রুম থেকে বের হয়নি। পুরো বাড়ি এলোমেলো করেছে দিগন্ত। রাগে কাঁপছে ওর পুরো শরীর। জয়নালের কাছে এসে জোর গলায় বলল,

‘ বেলা পাটোয়ারীকে চেয়েছি আমি। প্রয়োজন পড়লে ওকে তুলে আনবেন। এ বাড়ির বউদের কোন সাহসে ফেলে আসো। পর পর পাঁচটা গানের চুক্তি ছিল না পেপারে? লেখা শেষ হল সব গানের লাইন জুনায়েদ তালুকদারের লোভী মুখে ছুড়ে মারবো। ভালো চাও তো দুজনে পাটোয়ারী বাড়ি গিয়ে যেভাবে ওদের ফেলে এসেছো, সেভাবেই আবার ফিরিয়ে আনবে। জুনায়েদ তালুকদারের মতো নিম্ন মানসিকতা হয়েছে তোমার। ওই লোকের সাথে থেকে থেকে রুচির দুর্ভিক্ষ হয়েছে। বিয়ে করার হুমকি দিয়ে আসো! ছিহ! থুহ! ’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল দিগন্ত। দিহানের সামনে এসে কদম থামালো। কড়া একটা চড় দিল ওকে। রাগী স্বরে বলল,

‘ বাপ-চাচার কথা শুনে মা-বউ রেখে চলে এলি। ইউসলেস একটা! ’
বলে আর থামলো না দিগন্ত। জীপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ফাহাদের সাথে রহমান পাটোয়ারী বেলার বিয়ে ঠিক করেছে। কথাটা শোনার পর থেকেই পুরো দুনিয়ায় আগুন জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ওর। একের পর এক ঘটনায় মাথা আউলে গিয়েছে দিগন্তের। কোথাকার রাগ কোথায় গিয়ে ঠেকছে তার কূল-কিনারা নেই।
রাত প্রায় বারোটার উপরে। জুনায়েদরা ঝামেলা করে যাওয়ার পর থেকে পাটোয়ারী বাড়ির পরিবেশ গরম। রহমান চুপ মেরে বসে থাকলেও রাসেল, তালুকদারদের উপর নিজের ক্ষোভ ঝারছে। বাড়ির কেউ এখনো খায় নি,ঘুমায় নি।
বেলা যখন থেকে শুনেছে রহমান ওর বিয়ে ঠিক করেছে তখন থেকেই রুমে গিয়ে থ মেরে বসে আছে। বাড়িতে এতো চিল্লাচিল্লি ওর কানে ঢুকছে না। বিছানার উপর হাঁটু গেড়ে নির্জব হয়ে বসেই আছে ও। রিনা এসে কয়েকবার ডেকেছে ওকে কিন্তু সাড়া দেয়নি। বাণী কাঁদছিল বলে বৃষ্টি আর আমেনা ওকে নিয়ে ঘরে গেছে। রহমান রুমে এসে চিন্তায় পড়েছে। রাসেল ড্রয়িংরুমে বসে মিতালীর উপর চেঁচাচ্ছে। মিতালীও চুপ করে ভাইয়ের সব কথা শুনছে। ইতিমধ্যে রহমানের উপর একচোপট রাগ দেখিয়েছে ও। বারবার বলেছে বেলার বিয়ে ও দিগন্তের সাথে দিয়েই ছাড়বে। এ জন্য রহমান কিছু না বললেও, রাসেল ক্ষেপেছে ওর উপর।

জীপ নিয়ে সোজা পাটোয়ারী বাড়িতে আসলো দিগন্ত। সদর দরজা লাগানো। কলিং বেলে নিজের রাগ ঝারতে শুরু করলো ও। যতক্ষন না দরজা খুলল ততক্ষন পর্যন্ত বাজাতেই থাকল। এতোরাতে এভাবে অভদ্রের মতো বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুললো রহমান পাটোয়ারী। দিগন্তকে দেখে রেগে গেল। রহমানকে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না দিগন্ত। সোজা বাড়িতে ঢুকে পড়লো। গলা ছেড়ে বেলাকে ডাকা শুরু করলো।
‘ বেলা পাটোয়ারী, সামনে আয়। বেলা! ’

দিগন্তের চেঁচামেচিতে সবাই এক জায়গায় জোরো হলো। মিতালী দিগন্তকে থামানোর চেষ্টা করলো শুনল না দিগন্ত। এক নাগাড়ে ডেকেই চলেছে বেলাকে। রহমান আর রাসেল দিগন্তের এহেন অসভ্যতামি দেখে ক্ষুব্ধ হলো প্রচণ্ড। দিগন্তের আওয়াজ পেয়ে এতোক্ষনের ধ্যান ভাঙলো বেলা। ছুটে বের হলো রুম থেকে। উপর থেকে দিগন্তকে দেখে ভয়ে আত্মা শুকিয়ে এলো ওর। ভয়ংকর লাগছে দিগন্তকে। চোখমুখ কেমন বিকৃত হয়ে আছে। ভয়ে ভয়ে নিচে এসে দিগন্তের সামনে দাঁড়ালো বেলা।

সঙ্গে সঙ্গে প্রকাণ্ড এক থাপ্পড় পড়লো ওর গালে। ছিটকে পড়ে গেল বেলা। রহমান চেঁচিয়ে উঠলো দিগন্তের উপর। তাকে তোয়াক্কা করলো না দিগন্ত। বেলার কাছে এসে জোড়ালো হাতে ওর চোয়াল চেপে ধরলো। দিগন্তের শক্ত হাতের ভারী থাপ্পড়ে গাল জ্বলে গিয়েছে বেলার। আবার চেপে ধরায় ছটফটিয়ে উঠলো ও। দিগন্তের মায়া হলো না তাতে। দাঁতে দাঁত পিষে হিসহিসিয়ে বলল,

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪০ (২)

‘ বেয়াদবের বাচ্চা! নাটক করিস আমার সাথে। তোর বাপ অন্য একজনের সাথে তোর বিয়ে দিতে চাইলো তখন কি তোর মুখ ছিল না। আটকালি না কেনো? অসভ্য মেয়ে! আমার সামনে এসে চোপার জোর বাড়ে তোর, আর বাপের সামনে ভেজা বেড়াল সাজিস। বেয়াদবের ঘরের বেয়াদব! এই, বিয়ে করবি তুই? হ্যাঁ; বিয়ে করবি ওই ফাহাদকে? দে, জবাব দে। তোর বাপ ফাহাদের সাথে বিয়ে দিতে চাইলে তুই বিয়ে করবি? উত্তর দে বেয়াদব! নাহলে এখানেই খু’ন করবো তোকে। ’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪২