দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৭

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৭
আফরোজা আশা

#দিগন্তবেলা নেমে এসেছে ধরণীগাত্রে। সূর্যটা ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে গড়িয়ে পড়ছে। আর সেই সোনালি রোদে চারপাশ ঢেকে গিয়েছে এক অদ্ভুত রঙের আবেশে। না ঠিক লাল, না ঠিক কমলা। গ্রামের মেঠো পথ ধরে ফেরা গরুগুলোর গলায় বুনো ঘণ্টার শব্দ বাজছে নরম সুরে। ঝুনঝুন শব্দটা একটা স্নিগ্ধ আবহ তৈরি করছে চারপাশ জুরে। আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মেঘের স্নিগ্ধ রেখাচিত্র। সূর্যের শেষ আলো তাদেরকে রাঙিয়ে তুলেছে আঁচড় তোলা তুলির মতো।

ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে আর পরিবেশের স্নিগ্ধতা উপভোগ করছে দিগন্ত। কোনো কালেই এসময় তাকে বাড়িতে পাওয়া যায় না। কিন্তু আজ ভাগ্যবশত বাড়িতে রয়েছে। দিহান শত কাকুতিমিনতি করে দিগন্তকে আটকে রেখেছে। দিগন্তের পাশেই কফি হাতে ছাদের রেলিং ঘেষে বসে আছে দিহান।
দিহান আকাশের দিকে চেয়ে থেকে বিরস কণ্ঠে বলে,
‘ বিয়ে কবে করবে? তোমার আশায় থাকতে থাকতে আমি বিয়ে করে নিচ্ছি। আর কতদিন ভাই? ’
সিগারেটে একটা জোরে টান দেয় দিগন্ত। ফুসস করে ধোঁয়া ছেড়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ আমারটা এখনো ছোট। ’
-‘ কে সে? ’
-‘ তোর ভাবি। ’
-‘ নাম কি? ঠিকানা দেও!’
-‘ দিলে কি করবি? ’
এবার বেশ ভাব নিল দিহান, ‘ তুলে আনব তোমার জন্য। ’
এক ভ্রু সরু হলো দিগন্তে। ঠাট্টা মিশ্রিত গলায় বলল,
‘ জানতে পারলেই প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবি। ভাবটা কম দেখা। ’

নিভে গেল দিহান। কত বড় হয়েছে এখনো দিগন্ত ওকে কিভাবে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলার কথা বলতে পারে! আতে ঘা লাগল ওর। চেতল খানিকটা। জোর গলায় কিছু বলতে নিবে কিন্তু পারল না, থেমে গেল সহসা। চোখজোড়া বিস্ময়ে কিছুটা বড় হয়ে গেল। ঠোঁটজোড়াও স্থানচ্যুত হয়ে গিয়েছে। দিগন্তের শার্টের বোতাম খোলা রয়েছে। শেষের দিকে দুটো লাগা শুধু। বাতাসের ঝাপটা লেগে বাম পাশের শার্টের দিকটা সরে গিয়েছে অনেকটা। পেটানো শরীরে চাওড়া প্রশস্থ বুকটা অনেকাংশে উন্মুক্ত। বুকের বাঁ পাশে হৃদপিণ্ডের ঠিক উপরিভাগে চকচক করছে একটা ছোট্ট শব্দ। চামড়ায় খোদাই করে লিখেছে বোঝা যাচ্ছে।

ছোট শব্দ অথচ গোটা গোটা অক্ষরে লেখ “#বিন্দুচারিণী”।
অনেকক্ষন ধরে কোনো সাড়া না পেয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে দিহানের দিকে তাকালো দিগন্ত। এদিকে দিহানের সম্পূর্ণ দৃষ্টি লেখাটাতে নিবদ্ধ। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বুকের দিকে তাকালো দিগন্ত। মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ বের করে শার্ট টেনে ঠিক করতে করতে বলল,
‘ দুদিন পর বিয়ে। এভাবে মেয়েদের মতো যেখানে-সেখানে নজর দিয়ে বেড়াস কেনো? সমস্যা আছে? ’
চোখ সরু করে দিগন্তের কাছে এলো দিহান। অনুসন্ধানী গলায় বলল, ‘ কি ছিল ওটা, ভাই? সিরিয়াসলি! আমি শকড! বিন্দুচারিণী মানে? ’

কপালে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা চুলগুলো পেছনে ঠেলে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিল। অতপর ঠাণ্ডা গলায় আওড়ালো,
‘ বিন্দু থেকে শুরু হয়েছে আমার হৃদয়ে তার চারণ। কবে,কখন, কিভাবে অসীমে পৌঁছালো বুঝিনি। এখন সে আমার বিন্দুচারিণী। আমার মনগহীনের একমাত্র অধিকারীণি।’
একের পর এক শক গিলছে দিহান। গুরুগম্ভীর, বেপরোয়া দিগন্ত তালুকদার প্রেমে পড়েছে এটা জানত কিন্তু প্রেমে পড়ে যে দেওয়ানা হয়ে গিয়েছে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ওর। হতবাক গলায় মুখ থেকে বের হলো,
‘ এতোটা! এতোটা পরিবর্তন। গুন্ডা, মাস্তান দিগন্ত তালুকদার এখন আমার সামনে কব্যিক রূপে দাঁড়িয়ে। আই কান্ট বিলিভ! ’
এরমাঝেই ভেসে এলো মিতালীর গলার স্বর। বিক্ষিপ্ত মনে দুই সুপুত্রকে গালি ছুড়তে ছুড়তে ওদের দিকে তেড়ে আসছে।

‘ দুইটা দামড়া রয়েছে আমার ঘরে। একটা নাকমুখ ফাটিয়ে বেড়ায়, আরেকটা মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে বসে থাকে। তোদের যে বললাম শাড়িগুলো ওবাড়িতে দিয়ে আয় সেকথা কি কানে ঢুকে নি। দুটোই মটকা মেরে ছাদে এসে খোশগল্পে মেতেছিস। ’
দিগন্ত রাশভারি গলায় বলল, ‘ আমি যাবো না। ’
ছ্যাঁত করে উঠল মিতালি,‘ কেনো?’
-‘ তোমার ভাতীজিদের মাথায় গোবর আছে। বিরক্ত লাগে ওদের। ’
এমনি মেজাজ চটে আছে। তারউপর দিগন্তের এরকম মন্তব্য যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল। তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে রাগী গলায় হুংকার ছুড়ল মিতালী।
‘ খবরদার দিগু। ওরা আমার বংশের রক্ত। একদম অপমান করনি না। আমিও ওই বংশের মেয়ে, ভুলে যাস নাকি। আমার গায়ে লাগে এসব। ’

দিগন্ত হেয়ালিপূর্ণ গলায় বলল, ‘সত্য কথার ভাত নেই। ’
-‘ এতো বেশি সত্য বলিস না দিগু। মারা পড়বি। আজ একা দেখে বলতে পারলি। দোকা হোও, তখন আমিও দেখবো কত বুলি আওড়াতে পারো তুমি। ’
দিহান কানে হাত চেপে বলল, ‘ হয়েছে বাবা, চুপ করো। ’
মিতালীর দিকে তাকিয়ে দিগন্ত নরম গলায় বলল,
‘ দুজনকে পাঠাচ্ছি। দিয়ে আসবে ওরা।’
কিছু কড়া কথা বলতে গিয়ে দমিয়ে নিল নিজেকে মিতালী। কিছুক্ষন ছোট চোখে অবলোকন করল দিগন্তকে। তারপর দিহানের উদ্দেশ্যে বলল,

‘ বাণীর হলুদের শাড়ি নেইনি। ওটা তুই ওকে সাথে নিয়ে গিয়ে ওর পছন্দ মতো কিনে দিবি। তারপর ফের হতাশ গলায় বলল, বুঝলি দিহান বেলাটা শাড়ি পড়তে খুব ভালোবাসে। সবার জন্য কেনাকাটা শেষ কিন্তু ওর জন্যই নেওয়া হলো না। মেয়েটা রং নিয়ে এতো খুঁতখুঁতে স্বভাব। যদি আমার দেওয়া শাড়িটা পছন্দ না হয় তাই নিলাম না। আমার তো এখন সময়ও নেই হাতে যে ওকে নিয়ে বেড়বো। ভাবলাম তোরা ওবাড়ি গেলে, বাণীর সাথে ওকেও নিয়ে যাবি। সে যা হোক, নাস্তা পাঠাচ্ছি খেয়ে নিস দুজনে।’
বলে উল্টো পথ ধরল মিতালী। এদিকে দিগন্ত দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে মিতালীর কথা শুনছিল। শেষ হতেই মুখ দিয়ে চুউউউ শব্দ করে উঠল। মিতালী ততোক্ষনে কিছুটা দূরে এগিয়ে গিয়েছে। পেছন থেকে দিগন্তের ভারী কণ্ঠস্বরে পা থামালো।

‘ সন্ধ্যা নেমে আসছে। কি দিতে হবে তাড়াতাড়ি দেও। ওগুলো পৌঁছে দিয়ে আমি আমার কাজে চলে যাবো। ’
-‘ নাহ। তুই এখনি কাজে যা। তোর মতো চাকরিধারী ব্যস্ত মানুষদের এতো খাটতে হবে না। আর বললি না, দুটো ছেলেকে পাঠাবি। পাঠা জলদি, কি করতে হবে আমি বলে দিবো ওদের। তারপর দিহানের দিকে ফিরে, তোকেও যেতে হবে না দিহান। আমি খাবার পাঠাচ্ছি,এখানে বসে বসে গিল তুই। শুধু বিয়ের দিন শেরওয়ানি গায়ে চাপিয়ে শাহ বাহাদুর এর ভং ধরে গিয়ে কবুল বলবি। পারবি না? ’
দুভাই মিতালীর দিকে অসহায় নজরে চেয়ে আছে। এই এক মানুষ যার কথার কাছে এ বাড়ির কারো কথা টেকে না। দিহান মিনমিন গলায় বলল,

‘ আমি তো কিছু বলিনি আম্মু। আমাকে এভাবে বলছ কেনো? ’
সেকেন্ড সময়ও যেতে দিল না মিতালী। ছ্যাঁত করে উঠে জবাব দিল,‘ হ্যাঁ সেই। তোমার অবস্থা ধরি মাছ না ছুঁই পানি। না কিছু বলেছো, না কিছু করেছো। তুমি বাবুসাহেব হয়ে বসে থাকো তো বাপু। আর দিগু যা বাবু, তোর অনেক কাজ। যা কাজ কর আর কিছুক্ষন পর নাক-মুখ ফাটিয়ে আমার মুখ উজ্জ্বল করে আসিস কেমন। ’
বিরক্ত গলায় দিগন্ত বলল, ‘ তোমার বলা শেষ হলে যা যা পাঠাবে সেগুলো আমার জীপে তুলে দেও। দিহান, যা তৈরি হয়ে আয় তাড়াতাড়ি। ’
ঠোঁটে ঠোঁট চাপল মিতালী। একটু কাজের জন্য কতগুলো বাক্য ব্যয় করতে হয় ওর। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দেখে দিগন্তদের নিচে আসতে বলে আবারো ওদের ওপর একচোট ঝাড়ি দিতে দিতে চলে গেল।

পাটোয়ারী বাড়ির দরজার সামনে চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে দিগন্ত। সামনের দৃশ্য দেখে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গিয়েছে ওর। একটা লাঠি হাতে বেলাকে মারছে বৃষ্টি। আশেপাশে কেউ নেই। বেলার ফর্সা শরীরে নীলচে দাগ ফুটে উঠেছে। বৃষ্টি রাগীভাবে কিছু বলছে আর মারছে ওকে। শব্দহীনভাবে কাঁদছে বেলা। মুখে কোনো রা নেই ওর। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল দিগন্তের। বড় বড় পা ফেলে ওদের কাছে গিয়ে বৃষ্টিকে ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল বেলার কাছ থেকে। খড়খড়ে শক্ত হাতে পর পর তিনটা থাপ্পড় মারল বৃষ্টিকে। মাত্র কিছু সেকেন্ডের মাঝে কি থেকে কি হলো বুঝতে বেগ পেল বৃষ্টি। পরক্ষনেই দুগালে মরিচ লাগার মতো জ্বলুনি অনুভব করল। এক মিনিট ওভাবেই থাকল। হুট করে একটা জোড়ে চিৎকার ছুড়ে গালে হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। কেমন তড়পাতে শুরু করল। জ্বলে যাচ্ছে গালগুলো। বৃষ্টির চিৎকার শুনে ছাদ থেকে হুড়মুড় করে সবাই নিচে নেমে এলো। রহমান পাটোয়ারী মেয়ের কাছে দৌড়ে এসে বৃষ্টির ঘাড়ে ভরসার হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি হয়েছে? বৃষ্টি, এরকম করছিস কেনো? বল আমাকে? কি হয়েছে? ’
বেলা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর বৃষ্টিকে দেখছে। বাণী বেলার কাছে এসে ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে অস্থির গলায় বলল, ‘ বেলা! কি হয়েছে? তোকে তো অনেকক্ষন আগে নিচে পাঠিয়েছি। বৃষ্টি কাঁদছে কেনো এভাবে? তোর চোখমুখ এরকম লাল হয়ে আছে কেনো? কি হয়েছিল,বোন? ’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৬

হেঁচকি তুলে কাঁদছেই বেলা। মুখ থেকে কিছু বের হচ্ছে না। কোনো রকম কাঁপা কাঁপা হাত তুলে দিগন্তের দিকে দেখালো। বেলার ইশারা অনুযায়ী সেইদিকে তাকালো সবাই। দিগন্ত সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছে, ওর পাশে হতভম্বের ন্যায় থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে দিহান।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৮