দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৮

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৮
আফরোজা আশা

বেলার দাদী রূপজান পাটোয়ারীর বুকে মুখ গুজে ন্যাকা কান্না কাঁদছে বৃষ্টি। রূপজান নাতনির পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, ‘ কান্দোন থামা বুবু। মাথা ধরব। যার জন্য তোর চোখের পানি পড়ছে হের ভালা হইবো না। ’
বৃষ্টি নাক টেনে বলে, ‘ আমাকে মেরে কাজটা ভালো করল না । ওকে আমি কত ভালোবাসি আর ও এভাবে আমাকে অপমান করল। এর শোধ কিভাবে তুলতে হয় তা ভালো করে জানা আছে আমার। ’
রূপজান নাতনিকে লায় দিয়ে বলল, ‘ একবার ওই ভাবওয়ালা ছেড়াডারে কাবু কইরা বিয়ে কর। তারপর হের নাকে দড়ি দিয়া ঘুরায় নিয়ে বেড়াবি। ’

দাদীর আস্কারায় যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল বৃষ্টি। মনে মনে কিছু একটা ছক কোষে নিয়ে শয়তানি হাসি দিল।
লিভিং রুমের সোফায় রাসেল পাটোয়ারী আর রহমান পাটোয়ারীর সামনের নির্বাক হয়ে বসে আছে দিগন্ত। দিগন্তের পাশে দুরুদুরু বুকে বসে আছে দিহান। ওদের মাঝে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেলা। দিগন্ত বেলার দিকে ঘুরেও তাকাচ্ছে না। সটান হয়ে চুপচাপ বসে আছে, দৃষ্টি রহমান পাটোয়ারীর দিকে। একটু দূরে বেলার মা আমেনা, চাচি রিনা আর বাণী দাঁড়িয়ে আছে। চোখ-মুখ শুকনো সবার। রাসেল পটোয়ারী বেলার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বলল,
‘ কি হয়েছিল তখন? বৃষ্টি কেনো তোমায় মেরেছিল? ’
কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল, বেলা নিরুত্তর হয়ে আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। রহমান পাটোয়ারী ছোট মেয়ের কাছে এসে ওর মাথায় হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ কি হয়েছিল আব্বুকে বলো? তুমি কি ভুল কিছু করেছিলে যে কারণে বৃষ্টি মেরেছে ? আব্বুকে বলো বেলা। ’
ফুঁপিয়ে উঠল বেলা। কান্নারত অবস্থায় আটকা আটকা গলায় বলল,
‘ আমি কিছু করি নি আব্বু। আপার ফোনে কল এসেছিল। পাশে আপা ছিল না বলে আমি তুলেছিলাম। এ কারণে আপা কেনো যেন রেগে গেল। আমাকে অনেক বকল। ’
কথাটুকু বলে বেলা ঠোঁট উল্টে আবারো কেঁদে দিল। রহমান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,
‘ কাঁদে না বেলা। এটুকুর জন্য বৃষ্টি তোমার গায়ে হাত তুলেছে? ’

উপরে নিচে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো বেলা। তা দেখে চোয়াল শক্ত করে ফেলল রহমান। গলা ছাড়িয়ে জোরে বৃষ্টির নাম ধরে ডাকল। বাবার গলা শুনে দাদীর বুক থেকে মুখ তুলে হাসল বৃষ্টি। নিশ্চয়ই ওকে মারার জন্য দিগন্ত এখন ওর কাছে সরি বলবে। এজন্যই ডাকছে রহমান। সে আশায় ধুপধাপ পা ফেলে তখনি হাজির হলো লিভিং রুমে। সোজা গিয়ে দাঁড়ালো রহমানের কাছে। হালকা কান্নার রেশ ধরে ন্যাকামী গলায় বলে উঠল,
‘ আমায় ডাকলে আব্বু? ’
রহমান পাটোয়ারী কড়া দৃষ্টিতে বৃষ্টির দিকে তাকালো।

‘ তোমার মোবাইল কোথায়? ’
হঠাৎ মোবাইলের খোঁজ করায় হকচকালো বৃষ্টি। স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘ আমার রুমে। ’
‘ নিয়ে আসো। ’
চমকে উঠলো বৃষ্টি। আমতা আমতা করে বলল,
‘ ক..ক কেনো? ’
রহমান স্বাভাভিক গলায় বলল, ‘ নাহ। তুমি এখানেই থাকো। বাণী বৃষ্টির রুম থেকে ওর ফোনটা আনো। ’
বাণী অসহায় হয়ে দেখছিল সব। বাবার আদেশ পেয়ে বৃষ্টির রুমে গিয়ে ওর ফোন এনে রহমানের হাত দিল। রহমান ফোনটা হাতে নিয়ে অন করল। লক করা দেখে বৃষ্টির দিকে বাড়িতে দিয়ে কড়া গলায় বলল, ‘ লক খুলে দাও। ’
মুহূর্তে থমকে গেল বৃষ্টি। পায়ের নিচের জমিন কেঁপে উঠল ভয়ে। রহমান পাটোয়ারীর কণ্ঠস্বরে কোনো আদর নেই, কোনো প্রশ্রয় নেই। শাসনের ভারী গর্জন শুনে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল ওর।
রহমান আবারো বলল, ‘ সময় নষ্ট করবে না। খুলে দেও তাড়াতাড়ি। ’

শুকনো ঢোক চেপে কাঁপাকাঁপা হাতে ফোনটা নিল বৃষ্টি। প্রথমবার ভুল করল। সেটা দেখে চেঁচিয়ে উঠল রহমান। ওর হুংকারে কেঁপে উঠল বৃষ্টি। কোনো মতে লকটা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা ওর হাত থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিল রহমান। প্রথমেই কল লিস্টে ঢুকল। এক নাম্বার থেকেই অনেকবার কল এসেছে। সেইভ করা (হার্টবিট♥)। বিচক্ষন রহমান পাটোয়ারী যা বোঝার তা বুঝে নিল। মোবাইলটা একহাতে আছাড় মেরে মেঝেতে ফেলে দিল। চিৎকার করে উঠল বৃষ্টি। দাঁত কিড়মিড়িয়ে রাগী গলায় তেজ নিয়ে বলল, ‘ কেনো ফেলে দিলে ফোন? এটা আমি নিজের জমানো টাকায় কিনেছিলাম। তোমার..’

আর বলতে পারল না। সপাট একটা চড় পরল গালে। তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে গিয়ে পড়ল খানিক দূরে। রহমান পাটোয়ারীর শরীর কাঁপছে রাগে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথাযথ চেষ্টা করে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলে কাজটা ভালো করো নি তুমি।তাদের শাসন করার জন্য আমিই যথেষ্ট। এবারের মতো কিছু বলছি কিন্তু মনে রেখো আমার মেয়েদের ব্যাপারে অন্য কারো হস্তক্ষেপ আমার পছন্দ নয়। ’
দিগন্ত কিছু বলল না। চুপ করে তাকিয়েই থাকল রহমানের দিকে। রহমান আবার বলে উঠল,
‘ বাণীকে নিতে এসেছো নিয়ে যাও। এই মূহুর্তে আমার পারিবারিক ঝামেলাটুকু আমি তোমাদের সামনে মিটাতে ইচ্ছুক নই। আশা করি খারাপভাবে নিবে না আমার কথা। ’
দিহান সহসা বলল, ‘ না মামু বুঝেছি। এখন আমাদের এখানে থাকাটা উচিত নয়। কিন্তু আম্মু যে বলল আমাদের সাথে বেলাকে নিয়ে যেতে। ’
রহমান বেলার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে শুধালো,

‘ তুমি যেতে চাও আম্মু? ’
বেলা মানা করে দিল। মন ভালো নেই ওর। এখন কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। ঝট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো দিগন্ত। গমগমে গলায় বলল,
‘ আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি। ’
কথাটুকু বলে আর এক মূহুর্ত অপেক্ষা করল না। গটগট পায়ে বেরিয়ে গেল। ওর পিছু পিছু দিহানও সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এলো।

প্রকৃতির নির্মল বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে দিগন্ত। কালো লাল রঙের জীপ গাড়িটার সীটে মাথা হেলিয়ে রেখেছে। ওর পাশে চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বসে আছে দিহান। নাহলেও বিশ মিনিটের উপরে হয়ে গিয়েছে ওরা বাইরে অপেক্ষা করছে। কারো আসার নামগন্ধ নেই। দিহান হাসফাস করতে করতে বলল, ‘ আর কতক্ষন অপেক্ষা করব ভাই? সেই সন্ধ্যায় এসেছি এখন রাত আটটা বেজে গেল। আর দেরী করলে হয়েছে আজ ওদের শপিং করা! উফফ, বিয়ে করাও পাপ। এই ভেজাল, সেই ভেজাল এর শেষ নেই। ’
দিগন্ত চোখ বন্ধ রেখেই বলল, ‘ বিয়ে করা পাপ না। বল মামাতো বোনকে বিয়ে করতে এসে নিজের কপাল পুড়েছিস। ’
দিহান ম্লান গলায় বলল, ‘ আসলেই। অন্য বাড়িতে বিয়ে হলে জামাই হওয়ার একটা আলাদা ফায়দা নিতে পারতাম। শ্বশুড়ের সামনে ফুটানি দেখাতে পারতাম। কিন্তু মামুর সামনে কি ফুটানি দেখাবো! সে তো আমার সম্পর্কে আগা টু গড়া সব জানে। ’

এর পরিপ্রেক্ষিতে চুপ রইল দিগন্ত। আরো কিছু সময় যাওয়ার পর একটা ছোট মিনমিনে গলার স্বরে চোখ খুলে তাকালো ও। বেলা এসে দাঁড়িয়েছে ওর পাশে। এদিকে দরজা দিয়ে আস্তেধীরে বাণীকে আস্তে দেখে গাড়ি থেকে নেমে ওর দিকে এগিয়ে গেল দিহান। বেলাকে দেখেও গাড়ি থেকে নামল না দিগন্ত। শুধু চোখ দিয়ে ইশারা করল অপর পাশে গিয়ে বসতে। বেলা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে দিগন্তের অপর পাশে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষন চোখ ঘুরিয়ে বলে উঠল, ‘ এটা অনেক উঁচু দিগন্ত ভাই। আমি কিভাবে উঠব। ’

ঘাড় বাঁকিয়ে বেলার দিকে তাকালো দিগন্ত। চোখ-মুখ শক্ত করে রেখেছে। ত্যাড়া গলায় বলল,
‘ কেনো, গাড়িতে কিভাবে চড়তে হয় সেটা তোর আদর্শ বাপ শেখায় নি? ’
দিগন্তের কটাক্ষ করে বলা কথার বিপরীতে মাথা নাড়িয়ে না বলল বেলা। সরল মনে বলল,
‘ আমাদের বাড়িতে তো জীপ নেই দিগন্ত ভাই। আব্বু শেখাবে কিভাবে? ’
দাঁতে দাঁত চাপলো দিগন্ত। ধমকে বলে উঠল,

‘ চুপ কর বেয়াদব মেয়ে। ভালো কিছু তোর বাপ শেখাক আর না শেখাক, মুখে মুখে তর্ক করা ঠিকি শিখিয়েছে। ’
টুকুর টুকুর চোখে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বলল বেলা,
‘ তর্ক কোথায় করলাম? ’
বড় একটা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করল দিগন্ত। বেলার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ হাত ধরে উঠে আয়। ’
দিগন্তের দাবাং বড় হাতের মাঝে বেলা ছোটখাটো নরম হাতটা রাখল। বেলার দুহাত মিলিয়ে হয়তো দিগন্তের এক হাত। দিগন্তের পাশে উঠে বসল বেলা। গাড়ির স্টারিং এ হাত রেখে ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবুক গলায় দিগন্ত বলল,

‘ তুই বড় হবি না? হাত এখনো এতো ছোট আর নরম কেনো? ’
‘ মানে? ’
‘ কিছু না। ’
‘ তুই না আসতে চাইছিলি না। কেনো এলি? ’
‘ আব্বু বলল যেতে। ’
ঝট করে চোখ ঘুরালো দিগন্ত। বেলার দিকে বাঁকা চোখে চেয়ে বলল,
‘ শোন তোর বাপের দেমাগ কমাতে বলবি। আমি কারো পরোয়া করে চলি না। আমার জিনিসের উপরে অন্য কারো হস্তক্ষেপও আমি মানব না।’
বেলা সোজা গলায় বলল, ‘ আচ্ছা বলব। ’
বেলার কথায় ভ্রুঁ কোঁচকালো দিগন্ত। ভারী গলায় বলল,

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৭

‘ কি বলবি? ’
-আব্বুকে বলব দিগন্ত ভাই বলেছে, ‘ তোর বাপের দেমাগ কমাতে বলবি। আমি কারো পরোয়া করে চলি না। আমার জিনিসের উপরে অন্য কারো হস্তক্ষেপও আমি মানব না।’
চোখমুখ বিরক্তিতে ছেঁয়ে গেল দিগন্তের। এ কোনো ভেজাল! কোনটা কটাক্ষ, কোনটা কি তাই বোঝে না। কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই বাণী আর দিহান চলে এলো। বাণীকে নিয়ে পেছনের সীটে উঠে বসল দিহান। ওদের চলে আসায় নিজের মুখটা সংযত রাখল দিগন্ত। চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ অসভ্য, বেয়াদব একটা মেয়েকে বেঁছে নিয়েছি আমি। না বড় হবে আর না আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিবে। ’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৯