দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১০
অবন্তিকা তৃপ্তি
ফুলে ফুলে মোহময় একটা ঘর। ঘরটা অনিরূপের। সম্পূর্ণ ঘরটাই সাদা রঙে মোড়ানো যেন। ফার্নিচার থেকে শুরু করে বিছানার চাদর অব্দি সাদা রঙের। সাদা রুমটা আজ সাজানো হয়েছে লাল গোলাপে। দেখতে ভীষণ আই-ক্যাচিং লাগছে ঘরটা। আশাকে কিছুক্ষণ হল বসিয়ে দিয়ে গেছে অনিরূপের বিছানায়। যাবার আগে টেবিলের উপর, এক গ্লাস দুধ আর একটা প্লেট দুটো মিষ্টি রেখে গেছে ওরা। মেয়েরা হৈ-হল্লোর করে বেরিয়ে যাওয়ার পর আশা মাথার ঘোমটা খুলে ফেলে লম্বা করে নিঃশ্বাস ছাড়ে! ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত বারোটা বেজে দশ মিনিট। আশার এক বিন্দুও মুড নেই, সং সেজে অনিরূপের জন্যে বেডে বসে থাকার।তাই ও বিছানা থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজে নিজে চেষ্টা করে চুলের ক্লিপগুলো খুলতে।
অনিরূপ শেরওয়ানির হাতা গুটাতে গুটাতে ঘরের দিকে আসছিল। মাঝপথে তাকে ঘিরে ধরে অরূপসহ আরও কিছু ছেলেরা। অনিরূপ থামে, ভ্রু নাড়ায় সন্দেহ নিয়ে- ‘কী চাই আপনাদের?’
অরুপ হাসে। একে অপরের দিকে চায়, ইশারায় কথা চলে তাদের। সবাই অরূপকে আগে বলার জন্যে ধাক্কা দিচ্ছে বারবার। অনিরূপ ওদের একে অপরকে ধাক্কা দেওয়া দেখে আবারও ভ্রূ কুচকে অরূপের দিকে চায়। অরুপ ভাইয়ের এমন চাওনি দেখে বোকা বোকা হেসে বললো-‘টাকা চাই। আনুমানিক পঞ্চাশ?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অনিরূপ হাতের ঘড়ি দেখে,বেশ দেরি হয়ে গেছে। অনিরূপ ভ্রু নাড়িয়ে অরূপকে বললো-‘হাসপাতালের টাকা আমাদের জয়েন্ট একাউন্টে ডিপোজিট হয়, সেখান থেকে নিয়ে নে।’
‘না, তুমি তোমার কার্ড থেকে দিবে।’ -অরূপ মাথার চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে ভাব নিয়ে বললো।
অনিরূপ মোবাইল বের করে মাত্র বিশ হাজার টাকা সেন্ড করল অরূপের ফোনে। অরূপ টাকার এত কম পরিমাণ দেখে হইহই করে উঠল-
‘বিশ কেন? পঞ্চাশ দেওয়ার কথা ভাইয়া।’ -অরূপের হাহাকার গলা।
অনিরূপ ভ্রূ কুঁচকালো এবার। তার নীলাভ চোখদুটোতে যথসম্ভব রাগ ফুটিয়ে তুলতেই অরূপ হেসে হেসে বললো-‘না না। এতেই চলবে।আমরা যাই। এনজয় ভাইয়া।’
অরূপ দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেলো হৈ-হল্লোর করতে করতে। ওরা যেতেই অনিরূপ কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে থেকে হেসে ফেলল আচমকা। ডান হাতের তর্জনী কপালে ঠেসে খুব হাসল, তারপর হাসতে হাসতে বাসর ঘরে ঢুকলো নিজের।
বিছানায় বউ নেই! অনিরুপ হতবম্ব হয়ে এগুলো সামনে-‘আশা, আশা?’
কেউ জবাব দিচ্ছে না। অনিরূপ পুরো রুমে একবার চোখ বুলালো,, বারান্দাতেও গেল। কেউই নেই রুমে। অনিরূপ ভ্রূ কুঁচকে বাথরুমে কান পাতলো। পানির আওয়াজ আসছে, আশা তাহলে বাথরুমে। অবিরূপ হাফ ছাড়ল।যাক-পালায় নি!
আশা গোসল করছে! নিজের ভাগ্যের উপর নিজেরই রাগ লাগল অনিরূপের। কোথায় সে ভেবেছে, ঘরে ঢুকবে, বউয়ের ঘোমটা তুলে, লুতুপুতু একটা ভাব নিবে। সেগুরেবালি! অবশ্য এমন ভাবে বিয়েত
করে এর বেশি কিইবা আশা করা যায়? আশা যে তাকে জনসম্মুখে চড় মারেনি সেটাই তার সাত কপলার ভাগ্য বলা চলে। অনিরূপ ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বিছানায় বসল। হাত দিয়ে একটা গোলাপ ফুল তুলে নিয়ে বসে বসে মুখ ভার করে সেটার পাপড়ি ছিঁড়তে লাগল!
একসময় বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ এলো! আশা বেরিয়ে এলো চুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে, আধভেজা সুতি একটা শাড়ি গায়ে। অনিরূপ হেলায় পড়ে চোখ তুলে আশার দিকে, তারপরই সে চমকে যায়। অপলক চেয়ে থাকে আশার দিকে! আশা বাথরুম থেকে বেরিয়ে অনিরূপের দিকে চোখ পড়ে। অনিরূপ হা করে আশার দিকে চেয়ে আছে। আশা বিরক্ত হয়ে তাকায় অনিরূপের দিকে। তারপর ড্রেসিং টেবিলের ওদিকে যেতে যেতে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠে-‘চোখ দিয়ে গিলে খাওয়া বন্ধ করুন আমাকে।’
অনিরূপের হা হওয়া মুখ সাথেসাথে বন্ধ হয়ে যায়। গলা কেশে সে অন্যদিকে চোখ ফেরায়। সে মোটেও গিলে খাচ্ছিল না আশাকে। আশা ফেইসক্রিম মেখে চুপচাপ অনিরুপের সামনে এসে দাঁড়ায়-‘শুনুন।’
অনিরূপের মনে হল, সে একটা ফুল হার্ট বিট মিস করলো। বুকে হাত চেপে চোখ বুজে দুবার ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে অনিরূপ আশার দিকে চায়। আশার হাতে বালিশ! ও জিজ্ঞেস করলো-
‘আমি কোথায় ঘুমাব?’
অনিরূপ বিছানার দিকে চেয়ে বলে-‘বিছানায়, কেন?’
‘আমরা একসাথে? নো ওয়ে।’ -আশার হতবম্ব উত্তর।
‘তো কোথায় ঘুমাবে? ফ্লোরিং করে? আমার রুমে তো তথাকথিত হিরোর মতো সোফা নেই, ডিভানও নেই।’ -অনিরূপের মজার স্বর!
আশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফ্লোরিং করে আশা ঘুমাবে কিভাবে? আশার ঠান্ডার প্রচুর সমস্যা। আশা কিছুক্ষণ ভেবে বললো-
‘আমি বিছানায় ঘুমাব, আমাদের মাঝখানে কুশন দিয়ে রাখব, অ্যাজ অ্যা বর্ডার!’
অনিরুপ কিছুক্ষণ আশার দিকে হা করে চেয়ে পরপর খি-খি করে হেসে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো-‘এই তুমি কী এটা সিনেমা পাইসো?বর্ডার, কুশোন কী সব বলছো?’
আশা ভ্রু কুঁচকে অনিরূপের মজা উড়ানো দেখে। অনিরূপ হাসছেই, থামার নাম নেই। আশা এবার রেগে গটগট পায়ে ফ্লোরে বিছানা করতে শুরু করে। অনিরূপ সেটা দেখে দ্রুত আশার হাত চেপে ধরে। আশা রক্তলাল চোখে তাকায়, অনিরূপ তাই হাত ছেড়ে দিল। বললো- ‘বিছানায় ঘুমাও, বর্ডার লাগলে দিয়ো, আসো।’
আশা থামে, অনিরূপের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে তারপর বালিশ নিয়ে বিছানায় শুলো। অনিরূপও এসে অপরপাশে শুয়ে পড়ল। আশার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে এভাবে কোন পুরুষের পাশে শুতে। বারবার মনে হচ্ছে শাড়ি উঠে যাচ্ছে পায়ের উপরে। আশা বারবার হাত দিয়ে শাড়ি ঠিক করছে, গায়ের আঁচল ঠিক করছে। অনিরুপ ভীষণ আগ্রহ নিয়ে আশার অস্বস্তি দেখছে। অনিরূপ এভাবে তাকিয়ে থাকতে আশা আরো বেশি কুকড়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে আশা বিরক্ত হয়ে অনিরূপের দিকে চায়, ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে-‘আমি পুতুল নই কোনো। এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন শুধু?’
আশা কথা বলে আবার পায়ের দিকের শাড়ির আঁচল টেনে ধরে। অনিরূপ হালকা হেসে চোখে হেসে বললো-‘ইয়্যু আর টু মাচ অ্যাডোরেবল টু মি লাইক অ্যা ডল!’
আশা ভ্রূ কুচকায়, পরপর বিরক্তির নিশ্বাস ছেড়ে আবার শাড়ির আঁচল ঠিক করার চেষ্টা করে।
অনিরূপ আশাকে দেখে, দেখতেই থাকে শুধু! প্রথমে আশাকে বিরক্ত করার জন্যে চেয়ে থাকলেও, ধীরে ধীরে বিরক্তির নেশা কেটে যায়। জন্মায় কেমন যেন একটা ভিন্ন এক অনুভূতি! অনিরূপের নীলাভ চোখ বদলে যায়, ছোটছোট হয়ে আসে চোখগুলো! নেশালো চোখদুটো ঘুরতে থাকে আশার সর্বাঙ্গে!
হঠাৎ বাতাসের ঝাপটায় আর আশার অত্যধিক নড়াচড়ায় ওর কোমর থেকে শাড়ির আঁচল সরে যায়! অনিরূপ থমকে যায় সেদিকে চেয়ে! এতোক্ষণ বহু কষ্টে দমিয়ে রাখা অনুভুতি উষ্কে উঠে এবার। অনিরূপ মোহগ্রস্তের মতো হাত দিয়ে আশার মসৃণ কোমর স্পর্শ করে। আশা চমকে উঠে, সঙ্গেসঙ্গে অনিরুপের থেকে ছিটকে সরে আসে- ‘কী করছেন আপনি?’
অনিরূপ আশার চোখের দিকে চায়। ওই চোখে স্পষ্ট অচেনা কোনো অনুভূতি দেখতে পেল। ভয়ে আশা নীল হয়ে গেলো একদম, সঙ্গেসঙ্গে শোয়া থেকে উঠে বললো-‘আমি ফ্লোরিং করে ঘুমাব।’
আশা বিছানা থেকে উঠতে গেল, সঙ্গেসঙ্গে অনিরূপ পেছন থেকে আশার হাতের কব্জি চেপে ধরে! আশা ভয়ে আঁতকে উঠে হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়! এবার আর হাত ছাড়েনা অনিরূপ। আশা ভয়ে ভয়ে বলে-‘আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলে-‘
বাকিটা এ বলতে পারেনি আশা। অনিরুপ হ্যাঁচকা টানে আশাকে নিজের বুকের উপর ফেলে। আশার ভেজা চুলগুলো অনিরূপের চোখে-.মুখে ছড়িয়ে পড়ে। অনিরূপের নেশা যেন আরও তীব্র হয় এতে। অনিরূপ আশার চুল গুছিয়ে দিলো আলতো হাতে, কাতর গলায় অনুমতি চায়-‘প্লিজ!’
আশা কাঁদোকাঁদো গলায় বললো-‘না।’
অনিরূপ আর কিছু শোনার ধৈর্য্য রাখে না। আশাকে বিছানায় ফেলে নিজে ওর উপর আধোশোয়া হয়ে পড়ে। আশা এবার কেঁদেই ফেলল,
‘আপনি নিজেকে আমার সামনে আরও ছোট করছেন। প্লিজ থামুন।’
অনিরূপ এসব শুনতে রাজি নয়! সে আবারও অনুমতি চায় কাতর গলায়- ‘প্লিজ!’
আশা দুপাশে মাথা নাড়ে, কাঁদোকাদো গলায় বললো-‘না, না।’
অনিরূপ হাল ছেড়ে দিল। আর কোন পথ খোলা নেই ওর হাতে। নিজের অনুভূতি সামলানোর চেষ্টা করলে, সেটাও বেপরোয়া গতিতে ছুটছে! অনিরূপ পারলো না, সে হার মানল! নিজের বিবেকের কাছে, নিজের মনুষত্বের কাছে। সরিয়ে দিল আশার শাড়ির আঁচল! আশা কেঁপে কেঁপে উঠছে, আর কাঁদছে।
অনিরূপ আশার গলায় মুখ রাখল, ছুঁলো আশাকে। আশা ফুঁপিয়ে উঠে এবার। অনিরূপ শোনে ওই কান্না। গলায় মুখ রেখে সে থেমে থাকে কিছুক্ষণ! আশা ফুঁপানো কমে, ভাবে অনিরূপ থেমে যাবে। কিন্তু অনিরুপ থামে না! ফুঁপানোর শব্দ থেমে যেতেই ধীরে ধীরে আশার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে অনিরূপের ছোঁয়া! অনিরূপ ভীষণ যত্নে ছুঁলেও, আশার গায়ে যেন ওই ছোয়া বি/ষ হয়ে ঝরে পড়ে। আশা কাতরাতে থাকে।
কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে ভারী হলে, অনিরূপ আশার কানের কাছে অসহায় গলায় শোধাল-‘আমি তোমার কাছে অসহায় আশা! আমাকে আরও অসহায় বানিয়ে দিয়ো না।’
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৯
আশা শোনেনা সেসব! সে কাঁদছে, গলার স্বর ভেঙে গেছে কাঁদতে কাঁদতে! অনিরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আশার কানের কাছে ঠোঁট ছুয়ে পুনরায় আশাকে নিজের করতে মগ্ন হয়ে পড়ে! আশাকে নিজের কাছে বেঁধে রাখার অনেক উপায় ছিল, কিন্ত অনিরূপ না চাইতেও পছন্দ করল এই উপায়।