দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৩
অবন্তিকা তৃপ্তি
‘বার্থ কন্ট্রোল ট্যাবলেট? তুমি আনিয়েছো?’
অনিরূপের গলার স্বর গম্ভীর, ডিপ! যখন ও রেগে যায়, এমনটাই হয়ে জয় ওর গলার স্বর! আশা বোঝে, শোনে! অনিরূপের ওমন আগুন দৃষ্টিকে এক বিন্দু পাত্তা না দিয়ে প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকে। খাবারের প্লেটটা অনিরুপের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো- ‘খেয়ে নিন।’
অনিরূপ ভ্রূ কুঁচকে ফেলল, আশা অনিরূপকে চুপ দেখে চুপচাপ খাবারের প্লেট টেবিলের উপর রেখে চলে যেতে নিচ্ছিলো! কিন্ত পারলো না, সঙ্গেসঙ্গে অনিরূপ আশার হাত পেছন থেকে ধরে ফেলল। আশা ছলাক করে উঠে রাগান্বিত চোখে ফিরে তাকাল অনিরূপের দিকে। অনিরূপ আবারও বললো-
‘জবাব দিচ্ছো না কেন?কিছু জিজ্ঞেস করছি না আমি?’
আশা এবার সরাসরি অনিরূপের চোখে চোখ রেখে জবাব দিল স্পষ্ট গলায়-‘হ্যাঁ আমিই আনিয়েছি, এখান থেকে একটা ট্যাবলেট খেয়েছিও। তো?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আশার ‘তো?’ বলাটা অনিরূপ দেখে চোখ বুজে জোরেজোরে শ্বাস ফেলে আবারও তাকায় ওর দিকে! কিছুসময় আশাকে চেয়ে দেখে রাগান্বিত চোখে! তারপও হঠাৎ করে আশাকে অবাক করে দিয়ে মৃদু শব্দে হেসে উঠে! আশা ভ্রূ কুঁচকে চায়। অনিরূপ মেডিসিনগুলো বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আশাকে পেছন থেকে আগলে ধরে, কাঁধে থুতনি রাখে! আশা ছটফটিয়ে উঠে যেমন! কই মাছের ন্যায় নড়ে অনিরূপকে সরাতে চায়, তবে অনিরূপের পুরুষালি ভারি দেহখানা এক ইঞ্চিও সরাতে পারলো না।
অনিরূপ হালকা স্বরে শোধাল-‘ভালোই করেছ আনিয়ে। আমিও আসার সময় নিয়ে এসেছি! অপেক্ষা করতে পারতে আমার নিয়ে আসার! বড্ড অধৈর্য্য তুমি আশা!’
আশা চোখ বড়বড় করে অনিরূপের দিকে চায়! অনিরূপের বাচ্চা চাই না? অনিরূপ আবারো আশার কাঁধে ছোট করে চুমু খেয়ে বললো-
‘বাচ্চা আমার চাই। তবে বিবাহিত লাইফ ফুল এনজয় করার পর! আপাতত তো না!’
আশা অনিরূপের চুমুতে কাঁধ সংকুচিত করে ফেলে, পুনরায় ছটফটিয়ে উঠে! লোকটা এমন কেন? গিরগিটির মতো রং বদলায়। আশা বিরক্ত হয়ে আবারও অনিরূপকে সরাতে সরাতে বললো-‘তাহলে এতোক্ষণ নাটক কেন করছিলেন? ছাড়ুন।’
অনিরূপ ছাড়ে না, সুন্দর হেসে বলল-‘দেখছিলাম একটা জিনিস। দ্য গ্রেট অনিরূপের ওয়াইফের চোখে নিজের জন্যে ভয় দেখতে চেয়েছিলাম। বাট আফসোস, তুমি তো আমাকে একফোঁটাও ভয় পাওনা আশা। লজ্জা লাগছে আমার।’
বলে মন খারাপের ভান করল অনিরূপ। আশা বিরক্ত হয়ে অনিরূপের ম্যালোড্রামা দেখে, তারপর বললো-‘ম্যালোড্রাম শেষ হলে আমাকে ছাড়ুন, ভাত খান গিয়ে।’
অনিরূপ এবার আর বেশি অবাধ্য হলো না। চুপচাপ আশাকে ছেড়ে দিয়ে ভাতের প্লেট নিয়ে বসলো। আশা এই সময় ওর বাড়ি থেকে ননিয়ে আসা লাগেজ বের করে কাপড়গুলো বের করে করে আলমারিতে রাখছিল! অনিরূপ খেতে খেতে বললো-‘তোমার খাওয়া শেষ?’
আশা অনিরূপের দিকে চেয়ে বললো-‘না।’
অনিরূপ শোনে বললো-‘এখানে এসে বসো, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
আশা ডান ভ্রুটা উঁচু করে চায়, তারপর বিদ্রুপ করে হেসে বললো-‘এটুকু দয়া না দেখালেও চলবে। আমার হাত আছে, আমি নিচে গিয়ে খেয়ে নিব।’
অনিরূপ আর জোর করলো না। খেয়েদেয়ে হাত ধুয়ে আবারও ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসলো। এরমধ্যে আশার কাপড় গোছানো প্রায় শেষ! অনিরূপ ল্যাপটপে কাজ করার ফাকে ফাঁকে আশাকে দেখছিল আড়চোখে! আশার সেসব মন নেই অবশ্য! আজ আবার বাবার বাড়ি যাবে বলে, সেটারও কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে।
এরমধ্যে ওয়াহিদা এসে ওদের দরজায় টোকা দিলেন। আশা গিয়ে দরজা খুলে দিল। ওয়াহিদা মেঝেতে লাগেজ দেখে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন-‘লাগেজ গুছাচ্ছো? অনির জন্যে কী কী নিয়েছো দেখি।’
আশা এবার আর কথা বলে না। সে তো নিজের কাপড় নিয়েছে শুধু। অনিরূপের জন্যে কিছুই নেওয়া হয়নি। ওয়াহিদা আশাকে চুপ থাকতে দেখে বললেন—’লাগেজ খুলো?’
ওয়াহিদা বিরক্ত হচ্ছেন দেখে আশা লাগেজ খুলে দেখালো। লাগেজের অর্ধেক জায়গাই ফাঁকা পড়ে আছে! বাকি অর্ধেকে আশার কাপড়-চোপড়। সেখানে আশার জামাকাপড় থাকলেও অনিরূপের জন্যে কিছুই নেই। ওয়াহিদা বললেন-‘আশা, অনি যাবে তোমার সঙ্গে। তো ও কী সেখানে এক কাপড় পরেই থাকবে? ইউ হ্যাভ নো রেসপনসিবিলিটি, আশা।’
আশা চুপ করে থাকে। ওয়াহিদা এবার নিজেই দেখে দেখে অনিরূপের জন্যে প্রয়োজনীয় কাপড় লাগেজে ঢুকালেন। আশা এসময় ঘরের এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিল এসব! ওয়াহিদা জিজ্ঞেস করলেন-’টয়লেট্রিজ নিয়েছো?’
আশা বললো-‘আমাদের বাড়িতে আছে।’
‘তোমার জন্যে আছে, অনির লাগবে না? ও ওগুলো ব্যবহার করবে? যাও, ড্রয়ারে ওর ব্যাগ আছে একটা। ওটায় আছে, নিয়ে আসো।—-ওয়াহিদা কাপড় ঢুকাতে ঢুকাতে বললেন!
অনিরূপ এতোক্ষণ শুধু দেখে যাচ্ছিলো বউ-শাশুড়ির কাজ! আশাকে ওয়াহিদার সামনে ভেজা বেড়াল হয়ে থাকতে দেখে অনিরূপের পেট ফেটে হাসি আসছে! ওর সঙ্গে তো কেমন চটর-পটর কথা বলে। ওয়াহিদা সামনে এলেই নিশ্চুপ! বাহ, অনিরূপ বৌকে বাঘে আনার অ/স্ত্র পেয়ে গেছে! এখন এটাকে কাজে লাগাতে হবে। অনিরূপ এদের কান্ড দেখে ল্যাপটপে চোখ রেখেই হাসতে থাকে আড়ালে!
একবার আশার চোখ গেলো অনিরূপের হাসির দিকে, আশা রাগ রাগ নিয়ে তাকাল তখন! অনিরূপ সেটা দেখে ডান ভ্রুটা উঁচু করে আশাকে দেখে আলগোছে হাসিহাসি মুখটা ভার করে ল্যাপটপে চোখ রাখল! আশা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে আবারও ওয়াহিদার কাজ দেখতে লাগল!
দুপুরে খাবার পরেই আশা-অনিরূপ এবং সঙ্গে অরূপ চলল আশাদের বাড়ি ফেরাযাত্রায়! ওদের সঙ্গে ওয়াহিদা মিষ্টি, ফল, পিঠা প্যাক করে দিয়েছেন। অরূপ গাড়ি ড্রাইভ করছে। আশা-অনিরূপ পেছনে বসে আছে!
অনেক লম্বা পথ! মাত্র খাবার খেয়েই গাড়িতে উঠেছে বলে, আশার শরীর খারাপ লাগছিল ভীষণ! তাই ও জানালার গ্লাসের মধ্যে মাথা রেখে একটাপর্যায়ে শুয়ে পড়ল। অনিরূপ এতোক্ষণ ফোনে কী দেখছিল। আশার দিকে চোখ পড়লে দেখে, আশা জানালার মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে, যার দরুণ গাড়ি নড়তেই টোকা খাচ্ছে মাথায়! অনিরূপ ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে আলগোছে আশার মাথাটা নিজের কাঁধে রাখল। আশাও আরাম পেয়ে অনিরূপের কাঁধে মাথা রেখে গভীর ঘুমে চলে গেলো। অনিরূপ আশার ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে হালকা হাসল! কে বলবে এই মেয়েটা ঘুমে এতটা শান্ত-নিশ্চুপ! কে বলবে এই মেয়েটাই একেকটা কথার বানে অনিরূপের বুক ক্ষ/তবিক্ষ/ত করে ফেলে? কেউ না! এই যে ঘুমিয়ে আছে, একদম চুপচাপ! ভালোই তো লাগছে অনিরূপের কাছে!
আব্দুর রহমান মেয়ে জামাই আসবে বলে আজ অনেক আয়োজন করেছেন। তার নতুন ফসল হয়েছে, ভালোই বিক্রি হওয়ায় উনার মনটা আজ ভীষণ ফুরফুরে বলা যায়! তাই জামাইর আপ্যায়নে আজ কোনও কমতি রাখেননি। নিধিও ব্যস্ত! রান্নাঘরে বসে পিঠা বানাচ্ছিল! গাড়ির শব্দে আব্দুর রহমান উঠোনে ছুটলেন। নিধিও হাত ধুয়ে উঠোনের দিকে ছুটল!
আশা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। আব্দুর রহমানও ছলছল চোখে মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন-‘আসতে কোনো কস্ট হয়নি তো আম্মা?’
আশা সরে দাঁড়িয়ে কাঁদোকাঁদো মুখে মাথা নাড়লো! নিধি এগিয়ে এসে আশাকে আগলে ধরলো! আশার কপালে চুমু বসিয়ে বললো-‘চেহারা এত মলিন কেন? দুপুরে খাস নি?’
আশা অনিরূপের দিকে আড়চোখে চায়, অনিরূপ বরাবরের মতো ডান ভ্রুটা উঁচু করে আশাকে দেখছে! আশা নিধির দিকে চায়, হালকা করে মাথা দুলায়-‘খেয়েছি! টায়ার্ড লাগছে ভীষণ তাই বোধহয়।’
নিধি হালকা হাসে। এবার অনিরূপ-অরূপের দিকে চেয়ে ওদের বেশ খাতিরদারি করে ঘরে নিয়ে আসা হলো! নিধি সবাইকে মিষ্টি, শরবত সার্ভ করে দিচ্ছে! ওর ডান গালে পিঠা বানানোর ময়দা লেগে আছে! অরূপ সেটা লক্ষ্য করে! নিধি অরূপকে মিষ্টি দিতে এলে অরূপ ফিসফিস করে বললো-‘গালে ময়দা।’
নিধি অরূপের দিকে তাকায়, অরূপ ইশারা করে দেখায়! নিধি অপ্রস্তুত হয়ে গাল মুছে ফেলে! অরূপ হেসে বলে-‘এবার ঠিক আছে।’
নিধি হালকা হাসার চেষ্টা করে সবাইকে নাস্ত সার্ভ করে আবারও রান্নাঘরে ছুটে! আশাও নিধির পেছন পেছন ছুটে! দুদিন পর বোনকে কাছে পেল, কতকিছু বলার আছে! অনিরূপের বদনামও তো করতে হবে!
ওরা দু বোন বেরিয়ে যেতেই ঘর খালি হলো! অরূপ অনিরূপকে জিজ্ঞেস করলো—‘আচ্ছা ভাইয়া? ভাবির বোনের ডিভোর্স কেন হয়েছিল?’
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১২
অনিরূপ ভাবুক গলায় বললো-‘তেমন আইডিয়া নেই। শুনেছিলাম- ওর হাসবেন্ড প্রথমে ভালোই ছিল নাকি! পরবর্তীতে হুট করেই একদিন জুয়া খেলা শুরু করে, সেখান থেকে মদ খেয়ে নিধিকে মা/রধর করত! একবার তো বোধহয় হাসপাতালেও ভর্তি ছিল মা/র খেয়ে! সেদিনের পরেই মেইবি ডিভোর্স এর জন্যে অ্যাপ্লাই করে এরা।’
অরূপ শোনে! কেন জানেনা, ওর ভীষণ দুঃখ লাগল এটা শোনে! এত ভালো, ফুটফুটে একটা মেয়েকে অল্প বয়সে কত কিছু সহ্য করতে হলো! অরূপ হঠাৎ কী মনে করে দরজার দিকে চেয়ে দেখে, মেয়েটা আবার খাবার নিয়ে এই আসলো বলে! সবসময় তো দৌড়ের উপরেই তো থাকে! অরূপ যতবার দেখল, ততবার শুধু ছুটছেই।একবার এদিকে, নয়তো ওদিকে। হাসে অরূপ; ছুটন্ত কন্যা!