দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৬

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৬
অবন্তিকা তৃপ্তি

‘ফর গড শেক, ক্যান ইউ প্লিজ শাট অ্যাপ এন্ড গো আউট ফ্রম মাই রুম? ইউ আর ইরিটেটিং মি অ্যান্ড আমি আমার ঘরে কারো ইরেটেশন সহ্য করতে পারছি না।সো- জাস্ট গেট আউট।’
আশা অনিরূপের এমন অপমানে লজ্জায় কুকরে যায়। আশা মনেমনে হয়তো কোথাও চায়, অনিরূপ শুধরে যাক, আশা তাকে মেনে নিক সব ভুলে। কিন্তু আজকে অনিরূপের এমন ব্যবহারে আশা হতাশ, ভয়ঙ্কর অপমানিত হয়ে আর একটিবারও মুখ তুলে তাকালো না অনিরূপের দিকে। মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

আশা যেতেই অনিরূপ দুহাতে মাথার চুল খামছে ধরে চেয়ারে বসে পড়ে। অনিরূপ চায়নি আশাকে এভাবে অপমান করতে। কিন্ত থা/প্পরটা অনিরূপ একদমই ভুলতে পারছে না। ওই শব্দ, ওই ব্যথা, ওই অপমান- সবটুকু বিষ লাগছে অনিরূপের কাছে।
আশা কিছুক্ষণ অন্যরুমে গিয়ে বসে থাকে। কাঁদছে না, তবু শান্তও থাকতে পারছে না। অদ্ভুত লাগছে। অস্থিরতা কমাতে কল করল নিধিকে। নিধি কল রিসিভ করলে আশা একটা ঢোক গিলে থেমে থেমে বলল-
‘আপা, আমি বাড়ি আসতে চাই।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিধি থামে, আশার গলা ঠিকঠাক লাগছে না। দুদিন হলো না আশা বাড়ি থেকে গেলো, এখনই আবার আসতে চাইছে? নিধি চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করে,
‘তুই ঠিক আছিস আশা? কাঁদছিস নাকি?’
আশা ঠান্ডা হবার চেষ্টা করে, কান্না আটকে রেখে স্বাভাবিক গলায় বলে-
‘আমার একটু টাইম লাগছে সবকিছু সামলাতে। ভাবছি বাড়ি থেকে ঘুরে আসলে মনটা ফ্রেশ হবে, সংসারেও মন দিতে পারব-তাই বলছি।’
নিধি ভাবে- ঠিকই। আশাকে যেভাবে বিয়ে দেওয়া হয়েছে-এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক। তাই সেও মেনে নিলো। বললো-

‘আমি আব্বাকে দিয়ে তোর শাশুড়ির কাছে অনুমতি নিচ্ছি। অনিরূপকে বলেছিস তুই?’
‘উনি ব্যস্ত।আমি একাই আসব।’-আশার কাটছাঁট গলা।
‘একা? পাগল তুই? কিভাবে আসবি তুই একা? পাগলামি ছাড়, আমি তোর শাশুড়িকে কল দিচ্ছি। আব্বা এসে নিয়ে যাবে।’

নিধি আশাকে বুঝিয়ে কল রাখলো। আশা কল রেখে আবারও চুপচাপ বসে থাকল বিছানায়।
একটু পর, ওয়াহিদা ডেকে পাঠালেন আশাকে। আশা চোখ মুছে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে গেলো ওয়াহিদার কাছে। ওয়াহিদা আশাকে দেখে বললেন-
‘বাড়িতে যাবে নাকি তুমি? তোমার বাবা বললেন।’
আশা মাথা নেড়ে বললো-‘মন টানছে আমার, আব্বা তাই বলল ঘুরে আসতে।’
ওয়াহিদা মুখ কুঁচকে ফেললেন, বললেন-‘যাও তাহলে। আগে থেকেই তো সব ঠিক করা। অনিরূপ জানে?’
আশা বললো-‘আপনি অনুমতি দিলে জানাব।’

‘জানিয়ে আসো ওকে। তোমার আব্বা বললেন তিনি আসছেন নিতে, রাতের দিকে। রেডি হয়ে নাও এখন।’
আশা মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে গেলো। অনিরূপের বেড রুমের সামনে এসে থমকলো কিছুসময়ের জন্যে। ঢুকবে রুমে? সবার ভাষ্যমতে- রুমটা ওদের। কিন্তু যে রুমে আশাকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে ঘটা করে বলা হয়-সেটা আদৌ আশার কখনো ছিল? বোধহয় না। আশা নিজেকে সামলে ঢুকল রুমে। অনিরূপ রেডি হচ্ছে,এপ্রোন গায়ে দিচ্ছে। আশা অনিরূপের দিকে একবার চেয়েই চোখ সরিয়ে ফেলল।

দ্রুত পায়ে আলমারির দিকে এগিয়ে নিজের কাপড় বের করতে লাগল। অনিরূপ আড়চোখে দেখছে সব। আশা ব্যাগ গোছাচ্ছে, অনিরূপ বুঝতে পারছে আশা চলে যাচ্ছে, নিশ্চয়ই বাপের বাড়ি। আহ্, অনিরূপের বউও টিপিক্যাল বউদের মতো ঝগড়া হলে বাপের বাড়ি দৌড় দেয়। অনিরূপ আশাকে একটু দেখেই ঘড়ি হাতে পড়তে লাগল। আশা লাগেজ গোছানো প্রায় শেষ, অনিরূপ তখন ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। আশা তাই হঠাৎ-ই পেছন থেকে ডেকে উঠে- ‘শুনুন।’

অনিরূপ থামে, তবে আশার দিকে ফিরে না। আশা নিজেকে শক্ত রাখে, তারপর বলল-
‘আমি বাড়িতে যাচ্ছি আজ।’
অনিরূপ শুনে, গা ছাড়া ভাবে রিপ্লে করে-‘যাও।’
আশা তাকায় অনিরূপের সুগঠিত পুরুষালি পিঠের দিকে। তারপর বলে-‘
‘নিজেকে যেদিন শুধরে নেওয়ার মনোভাব আপনার মধ্যে জন্ম নিবে, আমি সেদিন ফিরব। কারো খায়েস বা পুতুল না হয়ে সত্যিকার স্ত্রী হয়েই ফিরব তখন।’

অনিরূপ থমকে যায়, তবুও ফিরে তাকায় না আশার দিকে। কী বলতে চাইল আশা? বুঝে আসে না ওর। আশা আর কথা বাড়ায় না। আবারও লাগেজ গোছাতে মন দেয়। অনিরূপ কিছুক্ষণ সেভাবে দাঁড়িয়ে থেকে, তারপর বেরিয়ে যায়।
আশা হাল ছাড়ে, অনিরূপ আদৌ শুধরাবে না কোনোদিন। মিথ্যা আশা নিয়ে বসে আছে ও। আশা ঢোক গিলে সবকিছু গিলে ফেলার চেষ্টা করছে বারবার।

তারপর আশা সেদিনই বেরিয়ে যায় শেখ বাড়ি থেকে।কদিনের জন্যে আশা নিজেও জানে না।মনেমনে আশা শক্ত-অনিরূপ সবকিছু শুধরে নিজে গিয়ে না ফেরালে আশা ফিরবে না। এতে যদি ডিভোর্স হয়, হোক!
অনিরূপ আজ বেশিক্ষণ রোগী দেখেনি। মনটা বড্ড উসখুস ওর। কয়েকটা দেখেই এসিসট্যান্টকে বলে দিয়েছে- আজকের সব কাজ অরূপকে দিয়ে দিতে। ও আপাতত রেস্টে থাকবে।
চিন্তায় অস্থির, এসি রুমেও ঘামছে অনিরূপ, তাই একপ্রকার বিরক্ত হয়েই এপ্রোন খুলে চেয়ারে রাখল। চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো অস্থিররূপে।
দরজায় নক দিল কেউ তখন।

‘কাম ইন।’ -অনিরূপের ভরাট স্বর।
অনিরূপের ফ্রেন্ড, ডক্টর তৃষা রহমান ভেতরে ঢুকলো। অনিরূপ তৃষাকে দেখে হেসে উঠে উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে।
‘হাই, অনেকদিন পর দেখা। বস।’
তৃষা চেয়ারে বসল। বললো-
‘বিবাহিত ক্রাশদের সামনে এলে মুশকিল হয়ে যায়, তাই এই না আসা। চা আনা দুকাপ। খাই, তোর নাকি আজকে খুব মন খারাপ। শুনতে এলাম তাই।’

অনিরূপ হাসে, দুকাপ চা আনায়। তৃষাই কথা তুলে-‘কী হয়েছে বল? আমি এটা কেন শুনছি- পুরনো দ্য গ্রেট অনিরূপ শেখ জয়কে নাকি আজকাল কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হুয়াই?’
অনিরূপ মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললো-‘পাওয়া যাচ্ছে না নাকি? জানতাম না তো।’
তৃষা এবার টেবিলে বাড়ি দিয়ে বললো-‘ঝেড়ে কাশ, খামখেয়ালি অনেক হয়েছে।’
অনিরূপ বললো-‘আছে কিছু। বলা যাবে না, ভেরি পার্সোনাল।’
তৃষা বললো-‘আমার কাছেও পার্সোনাল? কিন্তু আমি তো জানি দ্য গ্রেট অনিরূপ আমার কাছে একসময় খোলা বইয়ের মতো ছিলো।’

‘খবরদার এটা আমার বউকে বলবি না। নাহলে ও যা সেনসিটিভ, ভাববে রিলেশন-টিলেশন করে বসে ছিলাম তোর সঙ্গে।’
তৃষা এবার মুখটা ছোট করে ফেলে। ছোট করে শ্বাস ফেলে বললো-‘এটাই তো করানো গেলো না তোকে। আমার এতকিছুর পর বিয়ে তো সেই সেনসিটিভ বউকেই করলি। যাজ্ঞে- এখন বউ কী করছে? ভালো-টালো বাসে না নাকি?’

অনিরূপ থামে। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললো-‘জেদের বশে বিয়েটা করেছি, এখন আফসোস হচ্ছে। ও আমাকে শুধরাতে বলে, আজ বাপের বাড়ি পালিয়েছে।’
‘কিহ?তোকে তোর বউ এ কদিনেই এত ভালো করে চিনে ফেলল?ভেরি ইমপ্রেসিভ!’
অনিরূপ ভ্রূ বাঁকিয়ে চায় তৃষার দিকে। অনিরূপ ভ্রূ নাড়িয়ে বললো-
‘আমার মধ্যে কীসের কমতি? আমাকে শোধরাতে বলছে? আর তুই এটা সাপোর্ট করছিস? উফ!’
তৃষা থামে, বলে-‘সাপোর্ট করছি না, বাট তোর বউ তোর সবচেয়ে কাছে থাকে। তাই ও যেহেতু বলছে শুধরানোর জন্য, তো সিম্পল। বউ পেতে হলে শুধরে যা। হয়েই যায়।’

‘কী শুধরাব? আমার দোষটা কোথায় সেটাই বুঝতে পারছি না। একজন স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে যেভাবে বিহেইভ করে, আমিও ঠিক সেটাই করেছি।’
‘বন্ধু হয়ে কখনো দেখেছিস?’
‘বন্ধু?’ অনিরূপের উপহাসের স্বর!
‘হাসবি না। তোদের বিয়েটা কাইন্ড অফ অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। তুই এখুনি স্বামী স্ত্রীর মতো বিহেইভ না করে, আগে বন্ধু হবার ট্রাই কর। ওর সঙ্গে কথা বল, ভবিষ্যতে কিভাবে তোরা তোদের সম্পর্কটাকে দেখতে চাস সেটা নিয়ে সরাসরি আলাপ কর। তোর বৌ সবে তোদের বাড়ি এসেছে। তার এই বাড়িতে কোনো প্রবলেম হচ্ছে কিনা কখনও জিজ্ঞেস করেছিস?’

‘আমার কী দোষ রে বাবা। ওরে কিছু জিজ্ঞেস করলেই ক্ষেপে যায়। তাই জিজ্ঞেস করিনি।’
‘এটাই ভুল তোর। তুই ওর অভিমানকে পাত্তা দিস না, ওর রাগ দেখে তুইও হাল ছেড়ে বসে থাকিস। ইটস নট ফেয়ার অনি। একটা সম্পর্কে মেয়েরাই সবচেয়ে দুর্বল থাকে, ওদের একটুখানি আশ্রয় দরকার পরে। তুই এগিয়ে যা, সম্পর্কটার গুরুত্ব ওকে বোঝা, নিজেকে মেলে দে ওর সামনে। ব্যাস, মেয়ে তো ভাই তোর খপ্পরেই- হান্ড্রেড পারসেন্ট।’

অনিরূপ শোনে! হয়তো বুঝতে পারছে একু একটু করে, ওই ভুলটা কোথায়। আশার ক্ষেপে থাকার কারণ কী? তৃষা অনিরূপকে অন্যমনস্ক দেখে মুখটা কিছুটা এগিয়ে এনে বললো-
‘ভাবছিস? তোর ভুল আছে?’
অনিরূপ কিছুটা থেমে তারপর বললো-‘আই গেইস!’
‘ব্যাস, আজকে বাসায় যা, ভাব। আর তারপর বউকে ফিরিয়ে এন। গো অ্যাহেড। দ্য গ্রেট অনিরূপ এভাবে ভেঙে পড়লে তোর নাম ডুববে ব্যাডা’
অনিরূপ হেসে ফেলে। তৃষা তারপর ঘড়ি দেখে বললো-‘লেইট হয়ে যাচ্ছে, যাই। দ্রুত বাড়ি যা, এখানে বসে মাছি মেরে লাভ নেই।যা যা।’

তৃষা হেসে চলে গেলো। অনিরূপ হেসে মাথার চুলে হাত বুলালো। তারপর দ্রুত চেয়ার থেকে থেকে এপ্রোন হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলো হাসপাতাল থেকে।
সেদিন রাতটা অন্যরকম কাটলো অনিরূপের। সে ভাবছে- আশাকে এভাবে জোর করে তার মোটেও পাওয়া যাবে না। তার আশাকে দরকার- সেটা এভাবে নয়। অনিরূপ একভাবে পারেনি তো কী হয়েছে- অন্যভাবে তো নির্ঘাত পারবে আশাকে জয় করতে। সেটাই করবে অনিরুপ।

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৫

কারণ- অনিরুপ হাল ছাড়ার মানুষ নও। যেটা ওর চাই-সেটা ও হাসিল করেই ছাড়ে। এভার ওর নেভার!
অনিরুপ বক্র হাসে। মোবাইল ফোনে আশার ছবিটা দেখে ক্রূর হেসে বললো-‘আম কামিং বেইবি!’

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৭